মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

মানস চৌধুরীর সাথে মনোরম পলকের আলাপ : দ্বিতীয় কিস্তি

0

Manos Chowdhury‘ঐকতানের গল্প আর বিরুদ্ধতার গল্প একসঙ্গেই থাকে, কেবল খুঁজবার ইনটেন্টে বদলায়’—মানস চৌধুরী


সাবঅল্টার্ন চিন্তার সীমানা, এলিটিজমের ব্যাকরণ, কবিতা ও কবিতা পাঠ, দুই বাংলার সত্তা— ইত্যাদি নানা বিষয়ে মনোরম পলক ২০২১ সালের মার্চ মাসের ৫ তারিখ কথা বলেছেন মানস চৌধুরীর সঙ্গে। আজ রইল পুরো আলাপের দ্বিতীয় কিস্তি।


প্রথম কিস্তির পর…


মনোরম পলক : ঠিক।

মানস চৌধুরী : আমার বিশ্ববিদ্যালয়কালীন এক বন্ধু ছিলেন, দুর্দান্ত কবিতা লিখতেন সুমন রহমান। লেখেন বলা উচিত যেহেতু উনি জীবিত। কবিতা লেখা কমে গেছে। সুমন রহমান তার ১৮, ১৯, ২০, ২১ বছরের বয়সে এমন সব কবিতা লিখতেন! যদিও বায়োলজিক্যাল বয়স ব্যাপার নয় আমি জানি। কিন্তু প্রচলিত অর্থেই বলছি, একদম স্টানিং। তারপর আমাদের কফিল আহমেদ ছিলেন। আমরা কফিল ভাই বলতাম। তারপর ক্যাম্পাসে দেখলাম যে সুনীল সাইফুল্লাহ নামে একজন আত্মহত্যা করেছিলেন; কবি, ইংরেজি সাহিত্যে পড়তেন। ওঁর কবিতার বই আত্মহত্যা করার কারণে আলাদা করে মনোযোগ দিয়ে পড়ি এবং তখন আসলে আচ্ছন্ন ছিলাম। এখন রাইসু, টিপু প্রমুখ সমেত অনেকের কবিতার প্রতি আমার আকর্ষণ আছে। ফলে পলক এটা ১-২-৩ জনের একটা তালিকা নয়।

 

মনোরম পলক : আমারও এদিক থেকে হালকা একটু মিল আছে। কিন্তু আমি যেটা করি সহজ করে বলার জন্য কেউ প্রিয় কোনো কিছু জানতে চাইলে প্রথম যেটা মাথায় আসে আর যেটা সেই মুহূর্তের জন্য হয়তো বাকিদের থেকে একটু বেশি সে নামটা বলে দেই।

মানস চৌধুরী : অনেক সময় আমরা শ্রোতা সামলাতে এরকম উত্তর দেই।

 

মনোরম পলক : শ্রোতা সামলাতে না, বরং আমার টেন্ডেন্সি আছে যে কথা একটু কম বলার চেষ্টা।

মানস চৌধুরী : যেমন এটাও সত্য যে ধরেন আমাকে যদি ১৮-২০ বছর বয়সে জিজ্ঞেস করতেন প্রিয় ঔপন্যাসিক কে, আমি হয়তো বিভূতি, গজেন্দ্র, ৩-৪ জনের নাম বলে দিতে পারতাম। ফলে আমার মনে হয় যে এগুলো এরকম। তখন হয়তো অনায়াসে ৩ জনের নাম বলতে ইচ্ছা করত। এখন আমি চাইবো না ৩ জনের নামে সীমিত রাখতে; ব্যাপারটা এরকম।

 

মনোরম পলক : তাহলে আপনাকে প্রশ্ন অন্যভাবে করতে হবে একটু। আপনার পছন্দের আবৃত্তিকার কারা?

মানস চৌধুরী : হা হা হা হা হা!

 

মনোরম পলক : হা হা হা হা হা!

মানস চৌধুরী : বাংলাদেশে আমার মুস্তাফা সাহেবের আবৃত্তি সবসময় ভালো লাগত। এখন সেটা হতে পারে যে কৈশোরের কান, শৈশবের কান। আপনি তো জানেন যে শৈশব-কৈশোরের মুগ্ধতাগুলোর খুব একটা চিরস্থায়ী ইম্প্যাক্ট থাকে। এবং ‘তুমি বাংলা ছাড়ো’ কবিতার যে পলিটিক্যাল কনোটেশন তার কারণেও হতে পারে। মুস্তাফা সাহেবের কণ্ঠস্বর-উচ্চারণ সবকিছু আর কি; মানে, আমাকে দীর্ঘকাল আচ্ছন্ন রেখেছে। কিন্তু গড়ে আমি যদি বলি সব্যসাচী ছাড়া কিংবা আরও বড়ো হয়ে কখনো কখনো শম্ভু মিত্র—যাঁরা আপনার পারফরম্যাটিভ কম। মানে এটা খুব ডিফিকাল্ট বলা; কারণ আবৃত্তিকারদের আহত করা আমার লক্ষ্য না, প্রাথমিক লক্ষ্য না। তার মানে পারফরম্যাটিভ বলতেই বা কি বুঝাচ্ছি! আমার কাছে মনে হয়, দীর্ঘকালীন-ই, আবৃত্তিচর্চাতে একটা কণ্ঠস্বরপ্রিয়তার চর্চা আছে; ধ্বনিপ্রিয়তার চর্চা আছে। এখন হয় কি, আপনি যখন কবিতা পড়েন তখন ধ্বনি কিংবা কণ্ঠস্বরের চাইতেও শব্দাবলীর যে বিস্তীর্ণ অর্থ— তা আরও বেশি হয়তো আপনাকে ভাবায়। এবং শম্ভু মিত্রের পাঠে সেটা আছে বা আমি পাই। আবার সব্যসাচীর ক্ষেত্রে পাঠের ব্যাপারই না, ওনার কণ্ঠস্বর এত জাদুকরী। এগুলো তো সনাতনী নামগুলো বলা হলো। কিছুকাল আমার জগন্নাথ বসুর আবৃত্তি ভালো লেগেছে। ঢাকায় অল্প কিছুদিন হলেও আমার কামরুল হাসান মঞ্জুর আবৃত্তি কানে লেগেছিল। আমার এক বন্ধু ছিলেন মোনালিসা। বন্ধু ছিলেন মানে উনি এখনো আছেন; উনি তখন অল্প বয়সে কবিতা পড়তেন। ফাহমিদা হক এরকম নাম। ফলে আবারও ওরকম যাঁদের পাঠে আপনার আমার কানে ধ্বনিপ্রিয়তার চাইতে পঠন পাই।

ধ্বনিপ্রিয়তা বলতে আমি কী বলছি এটা বোঝাতেও পারি। আপনি যদি কবিতার শব্দগুলো বাদ দেন তাও দেখবেন ৯০ ভাগ কবিতাকে আপনি এভাবে, মানে ধ্বনিগত গ্রাফে, ফেলতে পারবেন। আপনি যদি গ্রাফিক্যালি রাখেন তাহলে দেখতে পারবেন এটা একটা মডেল। তার মধ্যে তাঁর নিজের কন্ঠস্বরের পিছনে একটা মায়াটান আছে, অনেক আবৃত্তিকারেরই। এইগুলো আমাকে আকৃষ্ট করে না। যাঁর উচ্চারণের শব্দগুলো খুবই টান টান থাকবে শব্দগুলো আপনি খেতে পারেন শ্রোতা হিসেবে। কখনো কখনো দারুণ লাগে যে তিনি হয়তো কোনো খ্যাতিমানই নন, দারুণ কবিতা পড়ে ফেললেন। এরকম হয় না! যেমন কথার কথা, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ফরহাদ মজহারের ‘ফরিদার জন্য ক্যামেরাগিরি’ কিংবা ‘শালিক পাখির দিকে তাকাইবার সাড়ে সাতটি পদ্ধতি’ এই কবিতাগুলো আমার থেকে ভালো কেউ পড়েই নাই। আশা করি বুঝবেন যে রঙ্গরস বাদ দিলে কেন বলছি কথাগুলো। মানে ওই কবিতাগুলোর যে ভাব যে জীবনদর্শন ওটার সাথে আমি কানেক্ট করি বলে; এটা ঠিক পারফরমেন্সের প্রসঙ্গ না। আপনি শ্রোতা হিসেবে মনে না করতে পারেন, কিন্তু আমার পড়বার সময় মনে হয় যে আমার থেকে ভালো কারো পড়বারই কথা না।

 

মনোরম পলক : দুই বাংলা আপনার কাছে কী করে এক? আর কোন দিক থেকে স্বতন্ত্র?

মানস চৌধুরী : সরল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও বলা দরকার যে, এক এবং ভিন্ন— এ দুটোই জগতের সকল কিছু নিয়ে বলা যায়। যেমন আপনি যখন আমরা মেহেরপুরবাসী বলেন-কথার কথা আপনি হয়তো বলেন না— আমরা মেহেরপুরবাসী; তখন যে অটুটতা-অখণ্ডতা আশা করেন প্রবক্তারা সেটা নেই কোথাও। মনে আছে যাঁরা কুষ্টিয়াতে জেলা সমিতি করতেন, এগুলোই বলতেন। আমি যেহেতু জেলা সমিতি পছন্দ করতাম না, ফলে যেতামও না। তখন তো বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা। মেহেরপুর জেলা সমিতি তো নিশ্চয়ই অনেকদিন পরে তৈরি হয়েছে।

 

মনোরম পলক : জি

মানস চৌধুরী : আমার মনে আছে আমি একাধিক লোককে থামাতাম শাহ আজিজুর রহমানের কথা বলে। কুষ্টিয়ায় কেমনে এ বিষয় হয়! আমাদের কুষ্টিয়াতে লালন। আমাদের কুষ্টিয়াতে রবীন্দ্রনাথ। আমি সাথে সাথে বলেছি যে শাহ আজিজুর রহমানও ছিলেন। তো, থাকে না, ওই যে পাকিস্তান পন্থী-টন্থী? তখনকার বুদ্ধিতে ওই নামটাই কুলাতো। আমি বলতে চাচ্ছি যে, অটুটতার পক্ষে বা অখণ্ডতার পক্ষে যাঁরা বলেন, তাঁদের স্বপক্ষেও মেলা মেলা উদাহরণ পাওয়া যাবে। যাঁরা পক্ষে বলেন না, স্থান নিয়ে বা ভাষা নিয়ে, তাঁদের পক্ষেও অনেক। কমপ্লিকেটেড উদাহরণ দেই। ১৯৭১ সালে লাহোরে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ এবং লাহোর কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে যে ধরনের জমায়েত করলেন, ছোটো হোক, ওরা তো পাকিস্তানি যেমন, আবার অপাকিস্তানিও ততটাই। ৭১-এই আপনার স্বাধীনতার দাবিতে সমর্থন জানাচ্ছেন, এটা পাকিস্তানি তথাকথিত জাতীয়তাবাদে অটুট অর্থ তৈরি করে না। ফলে যেটা হয়েছে যে, বিষয়গুলো, আমার মনে হয় একটা চিরকালীন প্রসঙ্গ যেখানে আমরা আপন এবং পরের প্রসঙ্গগুলোর যে একটা রাজনীতিক-সাংস্কৃতিকতা আছে সেগুলোকে ভোঁতা ভাবে দেখলে এক জিনিস দেখব; আবার সূক্ষ্মভাবে দেখলে আরেক জিনিস দেখব। আমরা সারাক্ষণ একটা ঐকতানের গল্প খুঁজতে পারি, আবার একটা বিরুদ্ধতার গল্পও খুঁজতে পারি। এবং সম্ভবত এটা যুগপৎই থাকে, কেবল খুঁজবার ইন্টেন্টের ভিন্নতা হলো বিষয়।

 

মনোরম পলক : ইন্টারেস্টিং!

মানস চৌধুরী : দেখেন, পূর্ব জার্মানি-পশ্চিম জার্মানি— একবার দুই জার্মানি হওয়ার পরে যদি ওঁরা ৩০ বছর আলাদা থেকে থাকেন জিওগ্রাফিক্যালি এবং পলিটিক্যালি, পলিটিক্যাল জিওগ্রাফিক বলা উচিত রাজনৈতিক-ভৌগোলিকভাবে, তাহলে কিন্তু ওঁরা অখণ্ড জার্মানি হিসেবেও আছেন পরের ৩০ বছর। বরং এখন ওই দিকটায় কমে গেছে সংখ্যা। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হলো জার্মানিতে পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানির মানুষজন অনায়াসে সম্পৃক্ত হন নাই। ফলে কালকে যদি দক্ষিণ কোরিয়া-উত্তর কোরিয়া জাতিসংঘকে লুকিয়ে, বনফুলের রসগোল্লা খাইয়ে, নিজেদের লোকদের কোলাকুলি করিয়ে দেয়, আপনি আমি আমাদের বুদ্ধি দিয়ে বুঝি এই ২০, ৩০, ৪০ বছরে বা হয়তো আর কখনোই এই ভেদরেখা মুছবে না। ফলে আবারও বলছি পলিটিক্যাল-জিওগ্রাফিক্যালি, ভৌগোলিক-রাজনৈতিকভাবে যে বিভাজনগুলো ঘটে তার দীর্ঘ আছর পড়ে।

 

মনোরম পলক : ঠিক

মানস চৌধুরী : মিজোরামের প্রচুর মানুষ আছেন যাঁরা মিজোরামের মানুষ, আবার বাংলাদেশের বান্দরবানের ওদিকটাতে কিছু লোক আছেন যাঁরা যদি রাজনৈতিক মানচিত্র না হতো তাহলে তাঁরা অখণ্ড মিজোই থাকতেন। একটা মানচিত্র আঁকার কারণে আপনার মেঘালয়ে থাকা মান্দিরা আর বাংলাদেশের হালুয়াঘাটে থাকা মান্দিরা এত ঐতিহাসিকভাবে আলাদা হয়ে গেছেন যে, এমন হতে পারে ২০৭২ সালের দুনিয়াতে আর চেনাই গেল না যে ওঁরা আসলে একই পাহাড়ের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা একটি সম্প্রদায় ছিলেন। কারণ আধুনিক রাষ্ট্রের যে নিজস্ব একটা সামর্থ্য আছে এটা কোথায় যাবে! মাত্র ২-৩ শতাংশ ভোটে সিলেট আসামে না গিয়ে থেকেছে গণভোটে। গুরুতর তো কোনো পার্থক্য ছিল না। প্রচুর লোক তো ভোট দিয়েছিলেন আসামে রাখবার জন্য, মানে বৃহত্তর আসাম রাজ্যের অংশ হওয়ার জন্য। বলতে চাচ্ছি এরকম একটা আছর কম নয়। ফলে আজকে ১৯০৫, ১৯৪৭ ডিঙিয়ে দুটো ভূখণ্ড দুটো রাজনৈতিক অস্তিত্বের হতে পারে যেটা একটা টপডাউন ইফেক্ট; অবশ্যই শাসকদের বানানো। কিন্তু তার তো একটা আছর পড়েছে। সে আছরটা দেখা যায় একটা ক্রিকেট খেলাতে পরস্পরের বিদ্বেষ সৃষ্টি করে এবং প্রচুর পরিমাণ গালাগালি উৎপন্ন করে। বিভেদ কোনো সমস্যা না। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অর্থে বলছি। কিন্তু যে পরিমাণ গালাগালি, বিদ্বেষ সেটার কথা বলছি। তার মানে এই যে দুই ভূখণ্ড হলো রাজনৈতিক ভূখণ্ড। সে রাজনৈতিক ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সীমা আছে, সেই ভৌগোলিক সীমানা নতুন প্রজাদের ভিতরে নিজ নিজ ভিন্ন সত্তা তৈরি করছে। ফলে আমি পলক, আমি বা আপনি যেভাবে দেখি না কেন, আমরা যদি গুরু বা নেতার মতো দুই হাত তুলে বলি আমরা একটি ভাষায় একটি হৃদয় তাহলে ঠিক আছে, একটা অনুষ্ঠানে চলতে পারে। কিন্তু আপনি আমি অন্য সময়ে বুঝতে পারি, আসলে একটি ভাষা আর একটি হৃদয় বলবার মতো নাই। রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের সত্তাগুলোতে তৈরি হয় ভারতীয়ত্বের বোধ, বাংলাদেশীর বোধ, আমরা-তারার বোধ— সোজা বাংলায় বললে জাতীয়তাবাদের যে ইনস্ক্রিপশনগুলো আছে, খোদাইকৃত রূপগুলো আছে, সেই বিচারেও কিন্তু আমরা গুরুতর ভিন্ন হয়ে আছি। আমি হচ্ছি সেই দলে যারা দেখবে দুটো প্রবাহ; আপনি একই সঙ্গে দেখতে পাবেন। ঐকতানের খোঁজে আমরা চাইলেই তাকিয়ে বললাম, একটি অনুষ্ঠানে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘আমরা দুটি ভগ্নি, আমাদের ভিতরে একই সুর।’ আমি খাটো করছি না, যাঁরা বলেন তাঁদের টিজও করছি না। ওটা বলবার জন্য যথেষ্ট উপকরণ আছে তাঁদের হাতে। কিন্তু এই যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক-জাতীয়তাবাদের কারণে আমাদের স্ব-স্ব রাজনৈতিক পরিচয় নির্মিত হয়েছে এবং সেটা যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাময়ই নয় কেবল, যথেষ্ট ঘৃণাপূর্ণও বটে— সেটা কিন্তু কোথাও মুছে দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে আমি মনে করি এগুলো দেখবার ভঙ্গির ওপর নির্ভর করবে কোনটা দেখতে পাচ্ছি।

 

মনোরম পলক : তাহলে দুটোই সত্যি

মানস চৌধুরী : দুটোই সত্য। আমাকে যদি এক বাক্যে বলতে বলেন, দুটোই সত্য। ৪৭-এ ভারত যাওয়া মানুষজন এখনও দেখা হলে— প্রথমে ৭১-এর শরণার্থীদের কথা বাদই দেন, ৭১-এ অপেক্ষাকৃত গরিবেরা স্থানান্তরিত হয়েছেন যা বিভিন্ন সময় আমি বলতে থাকি; ৪৭-এ অপেক্ষাকৃত গৃহস্থরা বা ফিউডালেরা গেছেন; যে অভিজ্ঞতা নিয়েই যান না কেন, বা কার সাথে কী অন্যায় হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ঢুকছি না, কারণ ওইগুলা এখনকার প্রসঙ্গ নয়— তিনি শুরুই করেন ‘ফরিদপুর থেকে এসেছ? আমার অমুক এর অমুক ফরিদপুরে ছিল’। আপনি স্মৃতিচিহ্নগুলো কোথায় রাখবেন? এমনকি প্রণব মুখার্জি পর্যন্ত এসে নড়াইলের জামাই এই অভিধাতে ইলিশ মাছ খেলেন, ভারতের রাষ্ট্রপতি। স্মৃতির উপাদানগুলোকে আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি কীভাবে! ফলে এটা একীভূত। আবার এই বিদ্বেষ যে, ধোনির মুণ্ডু তাসকিন হাতে নিয়ে একটা ছবি পোস্টার হয়ে গেল। আপনি এই বিদ্বেষকেই বা উড়িয়ে দিচ্ছেন কীভাবে? ফলে আমার একটা বাক্য তৈরিতে দুই বাংলার যে কমপ্লেক্স সম্পর্ক সেটা উড়ে যাচ্ছে না। ওই প্রণব মুখার্জি ইলিশ খাওয়াটাও অতীব যাপিত বাস্তবতা নড়াইলে গিয়ে; আর আমাদের সাইবার স্পেসে তাসকিনের হাতে একটি কল্পিত ধোনির মুণ্ডু নিয়ে যাচ্ছেন—ভিজুয়ালি খুবই নৃশংস দৃশ্য—এটাও আসলে বাস্তব। আমরা দুটো একেবারেই উল্টো চিত্রের বাস্তবতায় বসবাস করি বলে আমি দেখতে পাই, দুটি সত্য।

 

মনোরম পলক : আপনি আপনার টকটাতে বলেছিলেন যে, আবৃত্তিকাররা নিজ নিজ কণ্ঠস্বরের প্রতি বেশি হয়তো একটু মনোযোগী থাকেন। আপনার কি মনে হয় যে মূলভাবটা আবৃত্তিকারের প্রকাশ করা উচিত নাকি নিজের একটা ইন্টারপ্রিটেশন— স্টাইল বা সিগনেচার এর জায়গা আছে যেখানে?

মানস চৌধুরী : একটু ডিফিকাল্ট প্রশ্ন। কারণ এত বড়ো একটা কমিউনিটি তাঁদের নিজেদের আবৃত্তিকার বলেন ফলে, আমি সতর্ক থাকব তাঁদের কমিউনিটি হিসেবে কোনো আঘাত না করে বসি। কিন্তু সাধারণভাবে যদি বলেন কবিতা আবৃত্তি, বা বিতর্কও যেমন,—পারফর্মিং আর্ট ক্যাটেগরি হিসেবে যেভাবে ঢাকায় বা বাংলাদেশে এগুলো বিকশিত হয়েছে—আবৃত্তিকার শিল্পী বা বিতার্কিক এগুলো আমাকে ইমপ্রেস করে না ব্যক্তিগতভাবে, সেটা বলতে পারি। সেটা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি রবীন্দ্র সংগীতের যে চলগুলো আছে সেগুলোও আমাকে ইমপ্রেস করে না। কিন্তু ওয়ান্স এগেইন: ‘তুই কে যে তোকে ইমপ্রেস করতে হবে?’ আমি কেউ না! আমি বড়োজোর গ্রহীতা হিসেবে বলছি। “শিল্পরসিক গ্রহীতা”। সেখানে বলতে গেলে এটা হয়তো কণ্ঠস্বরের সরলীকরণ হতে পারে। অনেক আবৃত্তিকারের এই কণ্ঠস্বর-সজাগতা লক্ষ করেছি! হয়তো হতে পারে তাঁদের কণ্ঠস্বরে ওই শব্দগুলো বাণীটা যথেষ্ট অর্থ বহন করে না বলে কন্ঠস্বরটা প্রধান হয়ে উঠেছে। তো ধরেন, আমরা যখন বলি আমরা ভারী টোনের গলা পছন্দ করি—বচ্চনের গলা, একই ভাবে শচীন দেব বর্মণের গলা এবং সায়গালের গলা হজম করি— প্রচুর কবিতা পাঠক আছেন যাঁদের কণ্ঠকে ‘সুন্দর আর সার্ফেসের’ লাগে। এটাই বোধহয় বলা কাজের হবে এবং কখনো কখনো শুনলে মনে হয় না যে এই কবিতাটি আসলে তিনি ধারণ করেন। এটা হচ্ছে খুব সরল করে বললে। এটা বোধহয় পারফর্মিং আর্টেরই খোদ শর্ত। আপনার মনে পড়বে যে— আমি তর্কটাকে বরং এখানে নিয়ে যাই, এফডিসির ছায়াছবির অনেক রকম অভিযোগের মধ্যে অনেকগুলো সস্তা অভিযোগ আছে যেগুলো আমাকে কনভিন্স করে না। একটা অভিযোগ হাই পিচের; যেটা খুব সিরিয়াসলি দেখার বিষয় এবং এটার বিশ্লেষণ ঢাকায় আছে যে যাঁরা কিনা প্রথম জমানায় এসেছিলেন চলচ্চিত্র করতে, তাঁদের বড়ো অংশই কিন্তু স্থানীয় থিয়েটারের সাথে যুক্ত। এই স্থানীয় থিয়েটার হচ্ছে দেশজ থিয়েটার তথা যাত্রা বলতে পারেন। এখন যাত্রার যে অ্যাক্টিং-লাইন সেটা আলাদা। আর সাধারণভাবে একজন ভালো অ্যাক্টর মন্দ অ্যাক্টরের প্রসঙ্গ আলাদা, দক্ষ বা অদক্ষ।

 

মনোরম পলক : যাত্রার অ্যাক্টিং লাইনটাই হচ্ছে অনেক লাউড।

মানস চৌধুরী : এখন তাঁরা যখন সিনেমার পর্দায় আসছেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত পরিচালক কারেক্ট করে দেন সেটা অথবা পরিচালক নিজেও যদি যাত্রার অ্যাক্টিং স্টাইলের ভক্ত হন, তাহলে আপনি তখন এই প্রবণতাকে কীভাবে দেখবেন? একই ভাবে, আমার অভিযোগ করার সময় এটা খেয়াল রাখতে হবে যে কণ্ঠস্বর-প্রিয়তা যদি আবৃত্তি স্কুলসমূহের এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকে! কিংবা তাঁরা ‘চ’ এবং ‘ছ’, আর এবং ‘ও’ এবং ‘অ’-এর উচ্চারণে যদি মনোযোগ দেন! তাঁদের তো সেটা স্কুল বা ধারা। উইথ ডিউ রেসপেক্ট, সেটা আমাকে কবিতা পাঠের সময় অত বেশি আকৃষ্ট করে না। তার থেকে অনেক বেশি করে, ওই কবিতার বাণী যাঁর গলায়, আমার মনে হয়, দৃশ্যরূপ পাচ্ছে। এইভাবে বললে বোধহয় পলক ঠিক বলা হবে। যিনি কবিতাটি পড়তে গিয়ে কবিতার দৃশ্যকল্পের একটা প্রস্তাব করেন, তাঁর গলায় চলে আসে, তিনি আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কবিতা-পাঠক। কিন্তু যিনি কিনা সারা জীবন কাটিয়েছেন ও ‘এ’র সাথে ‘অ’-এর পার্থক্য করার জন্য, ‘চ’-এর সাথে ‘ছ’-এর পার্থক্য করার জন্য, ‘প’-এর সাথে ‘ফ’-এর পার্থক্য করার জন্য, তাঁর এই নিষ্ঠাকে তো আপনি উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কিন্তু পড়বার সময় হয়তো ওই হাতুড়ির মত একটা স্পর্শ থাকে, ওটাই প্রকট থাকে। সব্যসাচীর দারুণ উচ্চারণ একদম ব্যাকরণিক উচ্চারণ, ধ্বনিগুলো আরকি— কিন্তু পরিশেষে ওটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা হয়নি, কারণ ওঁর পাঠই আমাকে এতটা ইমপ্রেস করে। ফলে আমার কাছে, বলা যায় খুব ডেলিকেট অভিযোগ করছি; বরং বলা যায়, অনেক পাঠকারীর আবৃত্তি শুনে আমার কবিতার একটা দৃশ্যকল্প মাথায় কাজ করে এবং অনেকের ক্ষেত্রে শুনলে মনে হয় বেশ মোটা গলা তো, বেশ চর্চিত গলা তো, বেশ একটা গলা তো, বেশ একটা গলা তিনি শোনাবার চেষ্টা করছেন তো— এইগুলো যখন অনুভূত হয় তখন আর কবিতা শোনা হয় না। এরকম আর কি।

 

মনোরম পলক : জীবনানন্দ কে কি আপনার নিহিলিস্টিক কবি মনে হয় নাকি সিটি লাইফ বা নগর জীবনটাই অর্থহীন একটা ইমেজ অটোমেটিক্যালি দেয়?

মানস চৌধুরী : এক হচ্ছে যে আমার শুধু জীবনানন্দ দাশ না, আমার মনে হয় সকল লেখকেরই— এখন আমি বলছি লেখক বলতে আপনার তথাকথিত ক্রিয়েটিভ রাইটার যাঁরা প্রবন্ধকার নন, সব কবি, গল্পকার—সকল লেখকেরই আসলে ওই সময়ের অডিয়েন্সরা যে যেভাবে ধারণ করে তার ওপরে মূল্যমান তৈরি হয়। যেমন, ধরা যাক, এমন হতেই পারে যে আপনি হন বা আমি হই ধরা যাক ১৯৮০ সালে যখন মনোযোগ দিয়ে লালনের পদগুলো পড়েন, ঠিক সেভাবে ২০২০ সালে, বাংলাদেশে যখন ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো টু অমুক ব্যাংক তমুক ব্যাংক, সবাই লালন-ভক্ত, তখন আপনার একইভাবে পদগুলো পড়তে ইচ্ছা নাও করতে পারে। মানে আমি আশা করি বোঝাতে পেরেছি যে কীভাবে কন্টেক্সট পাঠকত্ব বা রিডারশিপ বদলে দেয়। আমার এটা মনে হয় যে জীবনানন্দ দাশের লাগাতার যে নাগরিক কনজাম্পশন মানে নগর অঞ্চলের লোকজন যেভাবে তাঁকে খাচ্ছেন, এইটাতে জীবনানন্দ দাশ খোদ লার্জার দ্যান লাইফ প্রসঙ্গ হয়ে গেছেন। ফলে আমি মনে করি, একটা হচ্ছে আমার প্রজ্ঞার বিকাশ, আমার বড়ো হয়ে ওঠা, তখন যে মুগ্ধতার ছিল সেটা প্রজ্ঞার কারণে কমেছে। আরও কমেছে আপনার এই লাগাতার কনজাম্পশনে। আমি বলব না তিনি ডিজার্ভ করেন না; সেটা প্রসঙ্গ নয়, উনি যেভাবে করে সারাক্ষণ উল্লিখিত হতে থাকেন। তো এখন এই বিশেষ আর্টিস্টিক এক্সিবিশন, এই একাকীত্বের ঘোষণায়— আমি কালকেও কী জানি একটা লেখা পড়লাম ‘দি মোস্ট ওর দি লোনলিয়েস্ট পোয়েট অফ বেঙ্গল’; আজকে আসলে কালকে না—এই যে লোনলিনেস, ধূসরতা, বিচ্ছিন্নতা, এই যে নগরে যখন বলতে-থাকা হয়, তখন আমার বিবেচনায় এটা খোদ জীবনানন্দের উৎপাদিত প্রসঙ্গের চাইতেও চর্চাকারীদের সারাক্ষণ ইন্টারপ্রিটেশনের একটা জগত হয়ে দাঁড়ায়। এবং এই ব্যাপারটা অনেক সিনিক্যাল, এমনকি বলা উচিত স্কেপ্টিক্যাল। যে শহরে মার্কসের এলিনিয়েশন মানে শ্রমিকের বিযুক্তি নিয়ে যথেষ্টভাবে বোধগম্য আলোচনা তৈরি হয়নি, সেখানে এই নগর অঞ্চলের কবি—আবারও বলি, এ প্রসঙ্গটি জীবনানন্দের চাইতেও জীবনানন্দের উৎপাদিত পণ্যের কনজাম্পশন—নিয়ে যে ধরনের একটা আলাপ মতো তৈরি হয়েছে সে আলাপে দীর্ঘকাল বসবাস করা আমার পণ্ডশ্রম মনে হয়। এটা সবচেয়ে সঠিক বলা হবে। নগর বিযুক্তি, ঠিক আছে ফাইন, কোনটা আপনার জন্য নতুন! ঠিক আছে এই বিচ্ছিন্নতা! এর থেকে অনেক বেশি বিচ্ছিন্নতা ঢাকাতে, ধরুন ঢাকাতে শ্রমিকদের একমাত্র জাগরুক শ্রমিক গার্মেন্টসে। মাঝেমধ্যে তাঁরা রাস্তায় দাঁড়ান। আর এতগুলো ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের কোনোরকম সামাজিক অবয়ব আপনার আমার পরিচিত নয়, তাঁদের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে কথা হচ্ছে না।

 

মনোরম পলক : একদম ঠিক কথা।

মানস চৌধুরী : একটা গ্রহণযোগ্য চেহারা পর্যন্ত আমরা চিনি না। লেগুনা চালক থেকে শুরু করে বিলুপ্তপ্রায় পাট শ্রমিক থেকে শুরু করে পলিথিন শ্রমিক বলেন, কেমিক্যাল শ্রমিক বলেন, চিমনির শ্রমিক বলেন, বুনবুনি বানান যাঁরা, মানে লজেন্স, আমার হঠাৎ করে মনে পড়ল! একমাত্র একটা ভিজিবল শ্রমিকদল আছেন, তাও তাঁরা সামনে কয়েকবার পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছেন বলে এবং দাঁড়িয়েছেন বলে। তার মানে আপনি যদি বিযুক্তির প্রসঙ্গ তোলেন তখন কি আপনার মনে হবে না ইটস মেকিং নো সেন্স? কী বিযুক্তি নিয়ে কথা বলব? চলচ্চিত্রের এক্সট্রা একজন কল্পনা করেন, চেহারা অফস্ক্রিন আপনার আমার কোনো ইমাজিনেশন কাজ করে না। মানে অফস্ক্রিন আমাদের কোনো ইমাজিনেশন কাজ করে না, অনস্ক্রিন ঠিক আছে। একই রকমের জামা কাপড় পড়ে তাঁরা কাজ করছেন। তো যেখানে আমাদের একেবারেই সেক্টরভুক্ত নন শ্রমিক ঢাকাতে কয়েক লক্ষ, সেখানে সেক্টরভুক্ত শ্রমিকেরই কোনো সামাজিক আদল আপনার আমার কল্পনাশক্তিতে কাজ করে না। আপনি-আমি সম্ভবত নির্বোধের মধ্যেও পড়ি না। এই পর্যায়ের অনুপস্থিতির মধ্যে যখন কিনা ভ্যাজর-ভ্যাজর একটা বিযুক্তি নিয়ে কথা হতে থাকবে তখন আপনার মনে হতে পারে কন্টেক্সটবিহীন একটা আলোচনা হচ্ছে। এটাই মিন করছি আর কি।

 

মনোরম পলক : দুঃখ ইকুয়ালস টু ভাব আর স্টাইল ইকুয়ালস টু বিলাসিতা, কি মনে হয় আপনার?

মানস চৌধুরী : হা হা হা হা

 

মনোরম পলক : হা হা হা হা

মানস চৌধুরী : আমার কাছে মনে হবে যে মজার কোরিলেশন। একদিক থেকে মজার এবং আমি উড়িয়ে দেব না। কারণ হচ্ছে যে আমি প্রায়শই ক্লাসে বা অন্যান্য একাধিক বক্তৃতাতে বলেই থাকি, এগুলো খুব ক্যাজুয়ালি বক্তৃতা যেখানে মাস্টারি করি, যে আমাদের এখানে ধরুন একজন দুঃখী নন, দুঃখ প্রকাশ করেন না তিনি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক নন। এটা বহু দিনের একটা চল আছে। এবং ইন্টারেস্টিং হলো বিশেষ করে ‘এটা আর্টিস্টিক নয়’ কিংবা ‘আর্টিস্টমাত্রই দুঃখ আছে’—এ ধরনের সস্তা থিওরি আপনি শুনে থাকবেন। আশির দশকে তো ছিলই ‘শিল্পীর একটি নিজস্ব দুঃখ থাকে’; এরকম একটা বাক্য আমার ধারণা আপনি শুনছেন। আপনার এবং আমার বয়সের পার্থক্য যদি বিবেচনা করি তাহলে তিন দশক ধরে ক্যাম্পাসে একটি জাগরুক তত্ত্ব বা বলা যায় সস্তাতত্ত্ব। আমার কাছে মনে হয় যে, সে অর্থে বলতে গেলে, আমাদের এ অঞ্চলে, দুই বাংলাতেই, কলকাতা এবং ঢাকাতে, দুই জায়গাতেই কমবেশি শিল্পরসের একটা মানে দাঁড়িয়েছে যে, এর গ্রহীতা দুঃখী হবেন, বিষাদগ্রস্ত হবেন। বিষাদ শিল্পের একটি অত্যন্ত ভারী মুড হিসেবে দেখা হয়েছে। সে দিক থেকে আপনার এই হালকা স্বরে বলা মনে হতে পারে যেটাকে, সেটাকে আমি নিলাম ভাব—ওই অর্থে মুড। আমাদের অঞ্চলে বা মধ্যবিত্ত সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাকারদের কাছে দুঃখ বা বিষাদ একটা অত্যন্ত ভালো ভায়াবল, ডেলিকেট, গ্রহণযোগ্য, বিপণনযোগ্য মুড।

 

মনোরম পলক : দুঃখের পাটাতন তো শুধু ক্লাসের ব্যাপার না। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আপনার কী মনে হয়? এলিটদের দুঃখটা কী রকম?

মানস চৌধুরী : নিশ্চয়ই এলিটদের ভিতরে একরকম হবে না। কিন্তু একটা বিষয় হলো যে ধরুন সব সময় আমার মনে হয় যে, এই যে করোনার সময় লোকজন ভাবেন ‘সময় কাটাব কী করে’, এই জিজ্ঞাসাটা নানান ফর্মে অজস্রবার আপনার কানে এসেছে, আমার কানে এসেছে। ‘কীভাবে সময় কাটাব?’ দেখুন কত অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ, যেখানে সাথে সাথেই বিভিন্ন বাড়ির দারোয়ান-ড্রাইভার শুধুমাত্র মধ্যবিত্তদের ওপর নির্ভরশীল শ্রমিকরা আছেন—দারোয়ান, বুয়া, ড্রাইভার—একদমই ঢাকার বাংলাগুলো বলছি; এঁদের শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে চাকরি গেছে। অথবা সিরিয়াস বেতন কার্টেল হয়েছে, তাই তো? ‘৪০০০ টাকা নে, তোর চাকরি থাকল, এখন জ্বালাস না।’ এরকম মডেলগুলোর সাথে তো আপনি পরিচিত। এখন বাস্তবতা হলো এখানে সময় কাটানোর প্রসঙ্গটাকে উচ্চারণ করা হচ্ছে যেভাবে সেটা শ্রেণীনির্দিষ্ট। সময় কাটানোর প্রথম প্রসঙ্গ হচ্ছে কার? যাঁর কিনা ধরেন ১৪০০০ থেকে কার্টেল হয়ে ধুম করে ৪০০০-এ নেমে আসছে অথবা চাকরিটাই নেই, তাঁর তো আসলে সময় কাটানোর প্রসঙ্গ না। তিনি তো সাথে সাথে পটলের ঝাঁকি মাথায় নিতে হয়েছে যদি তার থেকে ২০ টাকা আসে।

তো আমি বলতে চাচ্ছি যে, এখন উচ্চবিত্ত বা এলিট বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্লাস যেগুলো তাঁদের— ধরেন, কথার কথা, দুঃখ শব্দটি ব্যবহার না করি—তাহলে অসন্তোষগুলো কী নিয়ে ছিল? অসন্তোষ ছিল বাংলাদেশে লেখাপড়া হয় না; যদি হিস্টরিক্যালি দেখি। তাঁরা কী করলেন! বাংলাদেশের লেখাপড়া হয় এমন জায়গা বানালেন, তাঁরাই তো! নিশ্চয়ই নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপনি আমি তৈরি করিনি। এবং তাঁরা দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ক্রেডিট ট্রান্সফারের বিজ্ঞাপন দিতেন। যেহেতু দুঃখ শব্দটার নিজস্ব একটা অবসোলিটপনা আছে, এটাকে বাদ দিয়ে যদি আমি আপনাকে প্রস্তাব করছি বিনয়ের সাথে, যদি শব্দটাকে ‘বিষাদ’ বলি, ‘অসন্তোষ’ বলি। অসন্তোষ হবে কাদের? যাঁদের অসন্তোষগুলো দৃষ্ট! তাঁদের দেশি ব্যাংকে পোষায় না, তাঁরা বিলাতি ব্যাংকে স্থাপন করলেন। বিলাতি ব্যাংক আবার না; প্রাইভেট লোকাল বিলাতি ব্যাংক স্থাপন করলেন। আমি বলাতেই বোধহয় পরিষ্কার হয়ে গেল কী মিন করছি। এবং তাঁরা স্কুল পছন্দ না করে-করে ষাটের দশক থেকেই নিজেদের পছন্দের স্কুলগুলো স্থাপন করলেন। তারপরে এমন কি তাঁদের ঢাকা শহরে থাকাটাও পোষায় না। ফলে ঢাকা শহরে যাতে বড়োজোর ছ’মাস থাকা লাগে বা দুই মাস-তিন মাস সেরকম একটা ব্যবস্থা হলো। ফলে তাদের এখন ডুয়েল সিটিজেনশিপ পর্যন্ত গৃহীত এবং যদিও ঠিক আইনীভাবে জানি না কিন্তু আমরা আইনী বে-আইনীর ঊর্ধ্বে নিশ্চয়ই অনেকে জেনে গেছি যে পার্লামেন্টে পর্যন্ত আছে ডুয়েল সিটিজেনশিপওয়ালা।

ফলে আমার মনে হয়, তাঁদের অসন্তোষ কী কী ছিল সেটা বুঝতে আমাদের অধিক গবেষণার প্রয়োজন পড়বে না। কারণ আমরা স্থাপনা থেকেই বুঝতে পারি। তা শিক্ষাব্যবস্থা হোক, স্বাস্থ্যব্যবস্থা হোক, তা দেশান্তরী হওয়ার ব্যবস্থা হোক, তার লগ্নি করার ব্যবস্থা হোক, তা অন্যান্য ব্যাংকে টাকা রাখা হোক এবং সন্তানাদি রপ্তানি করার ব্যাপারে হোক অথবা রপ্তানি না করে এখন বলব— ১০ বছর আগে হলে হয়তো রপ্তানি বলতাম কিন্তু এখন বলব ড্রিফট— গতায়াতের ব্যবস্থা সুলভ করা হোক। এখানে-ওখানে, ওখানে-এখানে। ৪০ বছর হলে এখানে আপনি বরং মসজিদ বা ইস্কুলটা বা গানের-সেতারের স্কুলটা আপনি এখানে দিতে আসেন তখন আপনার বাচ্চা ওখানে পড়ছেন, তাই তো? আপনি এখানে-ওখানে বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯; ঢাকা । জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত; "Where Is Kajol?" এর প্রতিষ্ঠাতা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।