জীবনকে যদি একটা নদী হিসেবে ধরি, তবে তার বয়ে চলা সর্বত্র তো এক নয়। পাথরের আঘাত লেগে কোথাও সে অশান্ত, চঞ্চল। আবার কোথাও শান্ত, স্থিতধী অচঞ্চল এক নদী। শৈশবের কর্ণফুলী কিংবা কর্ণফুলী থেকে সরু হয়ে অন্য অভিমুখে বাঁক নেওয়া ইছামতীকে দেখেছি। কখনো কোথাও খলবলানো কিশোরী, আবার কোথাও শান্ত-সমাহিত। আমি অদ্যাবধি জীবনকেই পাঠ করেছি। আর অভিজ্ঞতাই আমার লার্নিং। সে হিসেব করলে মানুষ আমার একমাত্র বই।
তবুও, বর্ণমালা পড়ে, বানান শিখে, শব্দবাক্য পড়ে আমিও শিখেছি কীভাবে গল্প বলেন লেখকেরা, বয়ান ভঙ্গিতে কতরকম সৌন্দর্য থাকে— সেসবও শেখা ও চর্চারই বিষয় বৈকি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে ছড়া মুখস্থ করাতেন তখনই আদিম তৃষ্ণা জেগেছিল আমার মানবমনে, কবিতার, ছন্দের আর সুরের। সে-ই কি শুরু নয়! দূর সম্পর্কের এক দাদি যখন হঠাৎ ছেলের কাছে আসতেন, মাস কয়েক থাকতেন, আমরা ছোটোরা তাঁকে ঘিরে বসতাম, আলো-আঁধারির ঐন্দ্রজালিক এক পরিবেশে।
আমার প্রথম বই আমার মা। সুরে সুরে যখন কোরান তেলাওয়াত করতেন, যখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমাকে ছড়া মুখস্থ করাতেন তখনই আদিম তৃষ্ণা জেগেছিল আমার মানবমনে, কবিতার, ছন্দের আর সুরের। সে-ই কি শুরু নয়! দূর সম্পর্কের এক দাদি যখন হঠাৎ ছেলের কাছে আসতেন, মাস কয়েক থাকতেন, আমরা ছোটোরা তাঁকে ঘিরে বসতাম, আলো-আঁধারির ঐন্দ্রজালিক এক পরিবেশে। উঠোনে চাঁদের আলো ভাসিয়ে নিয়ে যেত চরাচর। কোথাও দূর থেকে কোনো গাছের আড়ালে বসে ডেকে যেত রাতচরা পাখি। তাদের গা ছমছমে ডাক, পাল্লা দিয়ে দাদি বলে যেতেন জ্বিনপরী-ভূতের কেচ্ছা। কোনো রূপকথার দৈত্যদানব এসে আমাদের মাটির উঠোনে বিচরণ করে যেত! আমরা ভয়ে গুটিয়ে যেতে যেতে এইটুকুনি হয়ে যেতাম কিন্তু সমস্ত ইন্দ্রিয় বেয়ে ছুটে চলত গল্পের শেষাবধি শোনার তৃষ্ণা। আর বাকি জীবন সে তৃষ্ণা-ই তো আমাকে আরও অক্ষরের দিকে তাড়িত করেছে। দাদি কি আমার সে-ই অপ্রকাশিত বই নয়? যে গল্পগুলো পৃথিবীর আর কোনো বইয়ে লেখা নেই! আর দাদির গল্প বয়ানের সময় যে মুখভঙ্গি, কপালের ভাঁজ, হাতের নাড়াচাড়া এসবও তো আর কোথাও, কারো কাছে ছিল না।
আমরা তো একটা অজপাড়াগাঁ-এ জন্মেছিলাম প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সন্তান হয়ে। আলোহাওয়া, পাহাড়-নদীর আশীর্বাদ হয়ে। ফলে পড়েছি ধূলিকণা, ঘাস-পাতা ও পাখিদের স্বর। কত কী শিখেছি তাদের কাছে! সে-ই তো মৌলিক বই। যার কোনো অক্ষর নেই, বর্ণ নেই। কিন্তু গন্ধ আছে। পাতার গন্ধ, ধুলোর গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ…
বাড়িতে সদাই আসত। মুড়ি-সুপারি-মশালা জড়িয়ে যেসব ঠোঙা আসত, কুড়িয়ে পড়ে নিতাম। আজ মনে করে বলতে পারব না কী পড়েছি সেসব ঠোঙায়। কিন্তু কোথাও ঘটে যাওয়া কোনো অপমৃত্যুর খবর কিংবা চিত্রনায়ক-নায়িকার জীবনের রসালো ঘটনা এসবও তো ফেলনা নয়! আমরা তো পত্রিকা কিনে পড়তে পারিনি। নব্বই দশকের শিশু হয়েও। প্রকৃতিই আমার কাছে বড়ো একটা ঢাউস বই।
আমাদের প্রাইমারি স্কুলের লাইব্রেরির ভাঙা দরজা ঠেলে শীর্ণ শরীরখানি ঢুকিয়ে দিয়ে চুরি করেছিলাম ‘সহপাঠ’, যা ক্লাসে পড়ানো হতো না। চুরি করা সেসব বইয়ে ছিল শিশু উপযোগী অনেক গল্প-ছড়া-কবিতা। আমার গুপ্ত সম্পদ। বছরের শুরুতে নতুন পাঠ্যবইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে রুদ্ধশ্বাস মুখস্থ করতাম কবিতাগুলো।
তারপর ৯৪-৯৫ সালের দিকে, আমাদের প্রাইমারি স্কুলের লাইব্রেরির ভাঙা দরজা ঠেলে শীর্ণ শরীরখানি ঢুকিয়ে দিয়ে চুরি করেছিলাম ‘সহপাঠ’, যা ক্লাসে পড়ানো হতো না। চুরি করা সেসব বইয়ে ছিল শিশু উপযোগী অনেক গল্প-ছড়া-কবিতা। আমার গুপ্ত সম্পদ। বছরের শুরুতে নতুন পাঠ্যবইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে রুদ্ধশ্বাস মুখস্থ করতাম কবিতাগুলো। ‘নুরু-পুষি আয়শা শফি…’, কিংবা ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও…’ উঁচু ক্লাসের কবিতাগুলোও বাদ যেত না। গল্পগুলোও পড়তাম ধীর তালে। ফলে ‘আমার বাংলাবই’ ছিল আমার প্রিয় সবসময়।
মা বকতেন ছোটোবেলায়, মানুষের কথা গিলতাম বলে। ‘কথা গিলন্যা মাইয়াপোয়া’ এই ছিল বদমান। আসলে আমার কাছে কথা মানে তো শুধু কথাই নয়। কথকের ঠোঁট নড়া, চোখের ভঙ্গি, ভ্রু-কুঁচকান সবটাই দেখার এবং শেখার। পাঠক হিসেবে আমি সর্বভুক। ফলে হঠাৎ গৃহকোণে পেয়ে যাওয়া পর্নোপত্রিকাও আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। মানব শরীরের কত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কত রহস্য সেসময় বুঝিনি। কিন্তু বড়ো হয়ে সে অভিজ্ঞতাও আমাকে সমৃদ্ধ করেছে।
তবে লেখক হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বই আমাকে প্রভাবিত না করলেও আমার ব্যক্তিচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’।
কৈশোরে পাঠ্যবইয়েই যতটুকু পেয়েছি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎ বা অন্যান্যদের। তারপর এসএসসি পরীক্ষার পর হঠাৎ এক বন্ধুর সূত্রে পেয়েছি সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’। সে-ই তো সুদূরের হাতছানি! তারপর একে একে সমরেশ, শীর্ষেন্দু, সুনীল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির থেকে হালের লেখকেরা নানাভাবে আমাকে ভাবিয়েছেন। কবিতার পাঠক হিসেবেও আমি সর্বভুক। চর্যাপদ, বৈষ্ণব পদাবলী, জীবনানন্দ থেকে হালের কবি মুয়িন পারভেজ সবারই তাই কোনো না ভালো কবিতা পড়ে নিজেরও একটা ভালো কবিতা লেখার তৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। আমরা তো সে-ই আদিকবিদের পরম্পরা ধরে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি। একটা সুন্দরতম কবিতা লেখার চেষ্টা করছি। কী করেছি, কতটুকু তার হিসেবে না যাই। প্রতিদিনই নতুন করে শুরু করি, সে কবিতাকে ধরতে পারি কই! বরং এটাই বলি আমি প্রভাবিত হতে চাইনি বিশেষ কারো দ্বারা। চেয়েছি সবার নির্যাস নিয়ে নিজের চিন্তার মৌলিকত্ব কাজে লাগাতে।
তবে লেখক হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বই আমাকে প্রভাবিত না করলেও আমার ব্যক্তিচিন্তাকে প্রভাবিত করেছে সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’। এই বইটি কৈশোরে আমার ব্যক্তিগত জীবনের বাঁকবদলে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ৮ জুলাই ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। পেশায় তিনি একজন উন্নয়নকর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থ : লিলিথের ডানা [কবিতা, চৈতন্য, ২০১৬], কয়েক লাইন হেঁটে [কবিতা, জেব্রাক্রসিং, ২০১৮], ময়ূরফুলের সন্ধ্যা [কবিতা, বাতিঘর, ২০১৯], সুবেহ তারা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, ২০১৯], বিস্ময়চিহ্নের মতো [উপন্যাস, বাতিঘর, ২০২০], অনন্তকলহ [কবিতা, বাতিঘর, ২০২২]।