যত দিন গিয়েছে ততই আমার মনে হয়েছে, শুধু কবিতা নয়, যেকোনো শিল্প বা সাহিত্য বা ছবি আসলে আমরা যে সাধারণ দুনিয়াদারির ধারণার ভেতর বসবাস করি, মুহূর্তেই তার পরিবর্তন ঘটায়। এবং এর থেকেও বড়ো ব্যাপার হলো একজন মানুষ কবিতা বা শিল্প বা সাহিত্য বা ছবির ভেতর দিয়ে যে পরিবর্তিত অবস্থায় পৌঁছায় তার থেকে পূর্বে আর ফেরত যেতে পারে না। এখন এই পরিবর্তন নেতি বা ইতিবাচক দুই-ই হতে পারে।
সমগ্র দুনিয়ার দিকে তাকালে দেখবেন, সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সৈনিকদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র যে ক্ষমতা বা ধ্বংস করার ক্ষমতা দেয় তার থেকে বেশি প্রাণশক্তি জনগণের ভেতর সঞ্চালন করতে সক্ষম মাত্র ক’টি শব্দ, ক’টি বাক্য বা একটি কবিতা। ফলে, ক্ষেত্র বিশেষে একটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর অস্ত্র থেকেও কবিতা বিধ্বংসী। দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কবিতাই প্রথম কথা বলে। দুঃশাসনের ভেতর থাকতে থাকতে যখন মানুষ স্বাধীনতা ও অধিকার ভুলে যায় তখন জনপদের এক কোণ থেকে উষ্কশুষ্ক চুলে প্রায়ান্ধ একজন লোক বলে ওঠে কবিতায় এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। আবার বসন্ত এলে ফুল যতই ফুটুক কবিকে কবিতায় বলে না দিলে বসন্ত মানুষের মনে জাগে না। ‘মধুর বসন্ত এসেছে’। আর যে দৃশ্য-বাস্তবতার ভেতর আমরা বসবাস করি তাকেও আরো বেশি প্রাসঙ্গিক, অর্থপূর্ণ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তোলে শিল্প। উটের গ্রীবা বা বেতফল তো হাজার হাজার বছর সভ্যতায় ও জঙ্গলে ছিল। জীবনানন্দ দাশের আগে আমরা তা দেখতেই পেলাম না। ফলে, তার কবিতা পড়ার মতো আরো অগণিত কবি আছে দুনিয়ায় যাদের কবিতা পড়ার পর আমাদের চারপাশটাও বদলে যায়। আবার এই কবিতা দিয়েই এই দুনিয়ায় অসংখ্য কবি দুঃশাসনটাকে সহনীয় করে তুলতে চায়।
আর্টকে খুব পরিশুদ্ধ, পবিত্র ব্যাপার হিসাবে দেখানো হলেও তার হাতও অন্যায়ে যুদ্ধরত সেনাদের মতো খুনে রঞ্জিত। ফলে, যেকোনো আর্টকে এতো সোজা চোখে দেখার কিছু নাই। আর্ট মানেই মহৎ কিছু না।
তারা মানুষকে আফিম আক্রান্ত করে দেবে এবং বলবে যে, যা চলছে খুবই ঠিক আছে। জনগণের উন্নয়নের জন্য কিছুটা ভায়োলেন্স, দমন-পীড়ন, কথাবলা বারণ ঠিক আছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে হিটলার যখন জামার্নিতে সংখ্যালঘু ইহুদীদের হত্যার নানা বৈধতা তৈরি করছে ডেটা ও পরিসংখ্যান দিয়ে, মিডিয়াকে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য সজানো হচ্ছে। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে মানুষ পোড়া ছাই ও দমবন্ধ গন্ধ উড়ছে, লিঙ্গে দেওয়া হচ্ছে ইলেকট্রিক শক, গুম ও বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে নাৎসি বাহিনীর পক্ষ থেকে, তখনও অগণিত কবি, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিক্ষক এর পক্ষে কবিতা লিখেছে। জ্ঞানের কারখানায় এগুলোর পক্ষেই জ্ঞান উৎপাদন করেছে। তাদের ছোটো ছোটো স্বার্থ রক্ষার জন্য জনগণকে শান্ত হতে বলেছে। নাজির পক্ষ মেনে নিতে বলেছে উন্নয়নের নামে। এটাও বাস্তব। ফলে, আর্টকে খুব পরিশুদ্ধ, পবিত্র ব্যাপার হিসাবে দেখানো হলেও তার হাতও অন্যায়ে যুদ্ধরত সেনাদের মতো খুনে রঞ্জিত। ফলে, যেকোনো আর্টকে এতো সোজা চোখে দেখার কিছু নাই। আর্ট মানেই মহৎ কিছু না। সেই কারণে আর্ট কালচারের ভেতর দিয়ে মানুষের যে পরিবর্তন তা মানুষকে দানবের পাশাপাশি অতিমানব করে তুলতে পারে। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো ঔষধের সাইড ইফেক্টে থেকে একটা সময় পরে সাধারণ অবস্থায় দেহ ফিরে আসতে পারে, কিন্তু আর্টের ভেতর দিয়ে মনের যে পরিবর্তন তা অমোচনীয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। অন্য দশায় উপনীত হতে পারে কিন্তু আগের অবস্থায় কোনোভাবেই আর নয়। আর্ট, চিন্তা ও দর্শনের ভেতর দিয়ে মানুষের পরিবর্তনের পর কেউ যদি তার চিন্তা ও দেখার পূর্বাবস্থায় ফিরতে চায় তবে তা প্রায় অসম্ভব একটা বিষয়। এটাই আসলে অতি জীবন্ত, প্রভাব সঞ্চারী কবিতা পড়ার রিস্ক ফ্যাক্টর।
দুনিয়ায় অনেক প্রেমের অনুভূতি বা পদ্ধতি আছে যা এখনো অনাবিষ্কৃত, অব্যবহৃত। যেগুলোকে কবিতায় বলে দিতে হয়। অনেক দ্রোহ বাকি আছে কবিতায় লেখার। চলতি নৈতিকতার যে ধারাপাত তাকে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো দেহের ঘর থেকে বিদায় করে দেওয়া দরকার যেন নতুন নতুন নৈতিকতার বৈধতা তৈরি হয়।
প্রত্যেকটা মানুষের নিজের মতো একটা ভাবনা থাকে। প্রতিটা মানুষের উপলব্ধি আলাদা। তাদের অভিজ্ঞতা ও গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন। এই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের দুনিয়া দেখা ও উপলব্ধি করার প্রক্রিয়ার সাথে আরো কিছু সংযুক্ত করতে চেয়েছি ‘মানুষ একাকী এক মিথ’ দিয়ে। আমাদের বহু চিন্তাকে উল্টে দেখার বাকি আছে। দুনিয়ায় অনেক প্রেমের অনুভূতি বা পদ্ধতি আছে যা এখনো অনাবিষ্কৃত, অব্যবহৃত। যেগুলোকে কবিতায় বলে দিতে হয়। অনেক দ্রোহ বাকি আছে কবিতায় লেখার। চলতি নৈতিকতার যে ধারাপাত তাকে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো দেহের ঘর থেকে বিদায় করে দেওয়া দরকার যেন নতুন নতুন নৈতিকতার বৈধতা তৈরি হয়। মানুষ নামক যে মিথ এখানে চালু আছে সেই মানুষের নতুন নৈতিকতার জার্নিটি আমি লিখতে চেয়েছি। এই জার্নি সমাজে সচল। মানুষ নামক এক মিথ থেকে অন্য মিথে সে প্রতিস্থাপিত বিচ্ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভাবে। সেই নতুন মানুষের একটা আইডিয়া হলো ‘মানুষ একাকী এক মিথ’। আমি কবিতা দিয়ে কারো জীবন পরিবর্তন করতে আসিনি। প্রতিটা প্রাণ আলাদা সত্তা। প্রতিটা মানুষ যেন নিজের বদলের অনুভূতিটা খুব প্রবলভাবে ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারে তার কাব্যিক সহায়তা বলা যেতে পারে এই কবিতা গ্রন্থটিকে। ‘মানুষ একাকী এক মিথ’ মূলত নিজেকে দেখার শব্দ-বাক্যে গড়া কাব্যিক আয়না। আমাদের ভেতর যে নবজীবন তাকে দেখা যাবে এখানে।
কবিতায় আমি দুনিয়া পাল্টাতে চাই না, মানুষের ভেতরটা উল্টে দিতে চাই। যেন নতুন চিন্তা জন্ম নিতে পারে।
‘মানুষ একাকী এক মিথ’ এ পাঁচটি দীর্ঘ কবিতা আছে। এই বইয়ের কবিতাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে লেখা হয়েছে। ‘মানুষ একাকী এক মিথ’ ২০০৪ এর শেষের দিকে লেখা শুরু। লাস্ট এডিট হয়েছে ২০২০ সালে। দীর্ঘ পনেরো বছর আমি একে বহন করেছি। অনেকগুলো ভার্সনের ভেতর দিয়ে গত বছর মনে হয়েছে, এটা আর ঠিক করার কিছু নাই। এমন কবিতাও আছে যা খুব তাৎক্ষণিকভাবে লেখা। কাব্য, দর্শন, রাজনীতি ও প্রেম সংক্রান্ত বোধ বুদ্ধিজাত একটা সরল জার্নি বলা যাবে।
আসল কথা হলো, এই বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটা পড়ার পর তা যত রাতই হোক বা যত ভোরই হোক বা যত দুপুরই হোক বা যত গভীর বিকেলই হোক, প্রিয় পাঠক, আয়ানার সামনে দাঁড়ান। নিজের দিকে তাকান। পরিবর্তনটা লক্ষ্য করতে পারবেন। কবিতায় আমি দুনিয়া পাল্টাতে চাই না, মানুষের ভেতরটা উল্টে দিতে চাই। যেন নতুন চিন্তা জন্ম নিতে পারে। যেমন ফসলের মাঠে লাঙলের ফলা ভেজা মাটি ভেদ করে যায় নতুন ঋতুর ফসলের ঘ্রাণের জন্ম দিতে।
বিজ্ঞাপন
প্রিয় লেখক, ২০২১ গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আপনার বইটি নিয়ে লিখুন ‘আমার বই’ বিভাগে। লেখা পাঠান আমাদের ইমেইলে। সঙ্গে আপনার এবং বইয়ের পরিচিতিমূলক তথ্য এবং ছবি। লেখা পাঠানোর মেইল : editor.sreebd@gmail.com
কবি ও গদ্যকার। প্রকাশিত কবিতার বই: জলপ্রিজমের গান [২০১০], কাছিমের গ্রাম [২০১৬], ঊনমানুষের ভাষা [২০১৮], প্রকাশিত গদ্যের বই: কবিতাকলা ভবন: শিল্প ও সাহিত্যবিষয়ক ব্যাবহারিক চিন্তা [২০২০]। যোগাযোগ: mridulmahbub@gmail.com