ছুঁয়াছুঁয়ি ভালোবেসে
সূর্যের আগুন ফোটে শরীরে সবার।
মানুষ পোড়ায়;
পুড়েও শান্তি পায় নিজের ভিতর।
মরার পরেও খোঁজে
আলোরূপ, মুখাগ্নি, সৎকার।
শ্মশান উজাড় করে
কড়িকাঠ ছাই হয়ে গেছে।
সম্পর্কের স্নেহস্রোতে অবোধ তরল
ভয়ে ভয়ে গড়িয়ে পড়ছে বহুদূর।
শ্রদ্ধার বিদর্ভ সুদূরতা— মৌন মনের মানুষ
সরে গেছে আরও; শুধু রাতের ইন্ধনে
বেঁচে আছে চন্দ্রাহত লাশের বাগান।
মাটিও দেবে না রন্ধ্র খুলে
………………. প্রবেশের অধিকার।
‘কবর! কবর!’ বলে
যতবার চাহিদা ঘনায়
আকাশ মুড়িয়ে রাখে
কালো শোক, মেঘে মেঘে বোঝা যায়।
কেউ কি ছুঁয়েছে হাত?
অচ্ছুত দেহের খড়িমাটি?
কাঠের খাটিয়া আজ মৃতের জগৎ
জেগে আছে কাফনের সাদা সাদা গ্রাম।
তবে কি মানুষ এক
পাতক পোকার অনুতাপ?
দেহজলে সংক্রমিত
অবাধ স্পর্শের কানামাছি?
দু’হাতে যা-কিছু ধরে
সে-ই ভুল; নিজের তিমির?
গোলাপ প্রাণের টানে সুগন্ধ বিলায়;
তাকে ছিঁড়ে আনে করাল মুঠোয়।
পাখির প্রসন্ন প্রভা ওড়ার সময়
রক্তময় করে তোলে ধনুক-শলায়।
যে তাকে নিসর্গ দেয়
সবুজ আশ্রয়ে রাখে মাতৃগর্ভময়
সে তার জরায়ুমুখে
বিদ্ধ করে বিষাক্ত কুড়াল।
ছিন্নভিন্ন পাতা ও কাণ্ডের পরিণামে
জ্বলন্ত আগরবাতি
ঘ্রাণের আড়তে নিভে যায়।
ক্ষতির আসক্তিভরা
পৃথিবীর বর্জ্য-পদতল
………………. মানুষের গুপ্ত পরাভবে
হিমালয় চেপে ধরে বুকের ওপর।
কে দেবে সুরভিদিন? দু’মুঠো নিঃশ্বাস?
রুহের বাতাসভরা লৌহ-সিলিন্ডারে?
প্রশ্নের বিবর্ণ গুহামুখে
আলো এসে পড়ে। জানালার গ্রিলের ওপর
পর্দার উদ্বেল খেলাধুলা; যেন পর্দা নয়
কাপড় জড়িয়ে ঢেউগুলো গুছিয়েছে কেউ।
স্মৃতিকুণ্ডে কত শত সমুদ্র-সংগ্রাম
আমরাও জমা রাখি; জড়ো হই
………………. মুগ্ধ কাকলিতে হৃদয়ে সবার।
প্রেম চিরদিন একা একা
মনের দু’কূলে ভেসে-ওঠা নবদ্বীপ।
গোপন সঙ্গমে রাখা
যতটা আড়াল, সবটুকু সমাগম।
ইতিহাস মুখ্যত সংঘাত;
নীরব বর্ণিত কোলাহলে
কাগজের কাঁকড়া-হরফ
আঁচড় কাটছে প্রতিদিন।
মানুষ ময়ূর হলে নখর লুকায়;
পুচ্ছের রঙিন বনে
পায়ে তার ঘাতকতা
কুণ্ডলিত সাপের অতীত।
তবু মৃত্যু-দোলায়িত মহাকালে
এক বিন্দু মানবজনম
………………. এতো কেনো ভালো লাগে?
বিস্তীর্ণ মুখের ভাবালুতা
বন্ধু ও স্বজন-সম্পর্কিত
হাসির দোলক
হৃদয়ের স্পন্দিত পর্বতে
লুকিয়ে রেখেছি।
ক্ষয়ের আবর্ত ছাড়া
কোথাও ওঠে না প্রাপ্য সুবর্ণ ফসল।
আমরাই অনূদিত ঘোর
মাটির চলিত বিশ্বে নতুন কৃষক।
ফলন বিভোর এক ঘরের ছায়ায়
মাঠের আশ্বাস বুকে তুলে নিই।
আমাদের ভুবনবেলায়
সোনালি দিনের চাষবাস
স্মৃতির লাঙলে ফিরে আসে বারবার।
ক্ষরণ-শষ্যের দিকে
বিভিন্ন আশার দাপাদাপি
মুদিত আত্মায় আজো নিভৃতে জমছে।
ভোরের হাওয়ায়
কুয়াশার গল্প তাই ফুরফুরে, যেন
সূর্যকে লিখতে চায় বিন্দু বিন্দু জল।
সূর্যের পা নেই; তবু তার
চলন-শক্তিতে নিরূপায় আস্থা রাখে
এখনো মানুষ।
চরাচরে রোদের ব্যাপক
চাহিদা এখন; তবু বাইরে কোথাও
বসন্ত দিনের শোরগোল
ফুলে ফুলে সমাদৃত নয়।
দূর থেকে দেখিঃ
মৌন মায়া— নারীর নিস্তার
বাঁশের ছায়ায় এসে থামে;
বাঁশঝাড়ে পাতার নিখিল
সবুজের শীতল ঝালরে ঝিরঝির।
সূর্যকে আমলে নিয়ে
ওইটুকু সামান্য সংযম
পৃথিবীর বিপুলা সোহাগ
বলে ভুল হয়; তবু দেখি।
পৃথিবীতে সুখ আনে চোখের বিভ্রম।
একটা নিথর কাক থ্যাতলানো সময়কে
দোহন করছে ডালে বসে।
রোদ তার দোহন-দর্শক।
এমন রোদ্দুরে কতদিন শুভ্র’র গোঁয়ার
প্রেমে স্নেহ-সূর্য হয়ে নিজেকে ভেবেছি
আলোর মার্বেল। শুধু পথের উপান্তে
গাছগাছালির তমো-সমুদ্র দেখবো বলে
পাখির ঝংকারে ঝরা-গান পাবো বলে
ধূসর ধুলোয়, ভ্যান রিক্সায় গড়িয়ে
পড়েছি দু’জন।
কোনোদিন রোকন শাহরিয়ার
পল্লবিত ডালে এসে বসতো কাছেই।
সে যেন নিমগ্ন পাতা। সবুজ সঞ্চারে ঝুলে থাকে।
ঝাঁকি দিলে ঝরে পড়ে গচ্ছিত বর্ণিল কথাপ্রাণ।
অথচ ওরাও দুই মেরু;
দুই মোহচুম্বকের মাঝখানে
একটা পৃথিবী আমি; নিজের ঘূর্ণনে
দেখি না ওদের ঘূর্ণিপাক।
…………সম্পর্ক এমনই হয়— সকলে পরিধি;
ফলে কেউ কেন্দ্রীভূত নয়।
একেকটা দিন যেন আমরা ছিলাম
দূর থেকে আগত দুর্মর গাছগগ্ধে
………………. ধেয়ে-আসা ঝড়ের বাতাস।
কোনো কোনো গাছ
কাণ্ডের গহিন গর্তে ধরে রাখে
মরা মানুষের দীর্ণ চোখের খোড়ল।
কারো কারো চোখ এই মতো মৃত্যুকূপ।
চোখের ভাষায় পৃথিবীর
আদিম নির্মম খুনোখুনি।
দৃশ্যের বেতাল বর্ণ থেকে পাশ-ফেরা
নিথর পুকুর দেখে ঝিমিয়ে পড়েছি একদিন।
মনে মনে ভাবি, বৃষ্টি সমতল হয়ে
পুকুর জন্মায়; তার জলকান্না নিঝুম তরল।
কোথাও উদ্দাম নাই।
উন্মত্ত নদীর দিকে তার নিঃস্ব বুক
প্রবাহের প্রেমবার্তা
………………. কোনোদিন পৌঁছাতে পারে না।
কারো কারো নিজস্ব জগৎ
নীল হাহাকারে মনোহর।
যদি ধূম্র জমাট কুয়াশা হয়
তবে অগ্নি হোক লেলিহান।
আমি বিধবাকে দেখলাম
যৌবনের ধুঁয়ার নিঃশেষ
………………….. জলে ঢেলে যেতে।
পেছনে তরুণী ছিলো; শরীরে উদ্বাহু ইশারায়
লকলকে দাহ; পুকুরের জলে আগুন নেভায়।
পৃথিবীর সবকিছু দৃশ্যখোপ;
সব দৃশ্য নিজে নিজে কারাগার।
অতন্দ্র পাহারা দেয় রঙের লেঠেল।
তবু ঢুকে পড়ি;
দৃষ্টি হলো অবারিত ঘোষের বান্ডেল।
বহু পথ মাড়িয়ে এসেও
চিন্তার বিকল্প রাস্তা পেয়ে যাবে ঠিক।
নাকি সব সৌর ব্যাধি? হাওয়াই মিঠাই?
সবাই চোখের মধ্যে খাঁচা নিয়ে ঘুরি?
এরাচ গাছের ডালগুলো
আকাশটা ক্ষত করে
মেঘ ফুঁড়ে যাবে না কোথাও;
মাছরাঙা, চিল ও বাদুড়গোত্র
বাজপাখি, দুরন্ত ঈগল আর পক্ষীকুল
মেঘের প্রলেপ মেখে উড়ার ডানায়
কখনো জানে না
স্থিতি-বেদনায় অনন্তের মর্ম মেলে;
গাছ তার সমূহ পোষক।
বাতাসের দেহে ক্ষয় নাই;
জলের শরীর
কখনো বিক্ষত হয় বর্শার ফলায়?
এইসব দৃশ্যের বৈরিতাই
পরিধির বিন্দু বিন্দু গ্রামে
নিসর্গের অনন্ত ডাকাত!
আমাদের বিদেহী মনেও হানা দেয়;
শরীর সেঁধিয়ে যায় রোদের প্রপাত
যখন বেরিয়ে পড়ি। ভ্যান চলে।
চাকার পৃথিবী
………….গোল হয়ে ঘোরে।
দূরে, শিশুতোষ হাতে
টায়ার গড়িয়ে নেয় এক বাচ্চা ছেলে।
দিগন্ত প্রসার ওর ক্ষমতার দিকে
চেয়ে চেয়ে ভাবিঃ
আমরাও নিরত ঘুরছি পরাহত,
………………. শাসনে শাসনে চিরকাল।
গতিময় জীবনের সবকিছু
ছেড়ে ছেড়ে যায়।
আমূল নিজস্ব হয়ে কিছুই থাকে না—
দৃশ্য, পাখি, জলাশয়, বিনম্র নিমের ডালে
ঝিরি ঝিরি ফুল; তবু মাছির খাবারে
আবর্জনা সুরে সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়।
মহিষের আবলুস পিঠ
কতগুলো ব্যাঙ নিয়ে জলের উদরে
মুদ্রিত প্রচ্ছদ; কেউ
…………………. ছাপ দিয়ে রেখেছে, এমন।
তাকে ঘিরে মনঘুঘুদের উড়াউড়ি
প্রণোদিত জীবনের ডাক দিয়ে যায়;
আমরা গহিনে ফিরি।
সবার জীবনে
………………. উন্মূল একটা চোখ আছে
হৃদয়ের দিকে তাক-করা। তাকে মানি।
দেখি, ঘুঘু নয়, কিছু সাদা বক
দুর্দান্ত উড়ছে;
আবার বসছে এসে সীমিত সময়।
যেন লীলাঃ মহিষ চতুর কৃষ্ণ, পিঠে নিয়ে
বসেছে রাঁধার শুভ্র চরিত্রহীনতা।
প্রেমে প্রেমে মানুষ-জন্মের
কত ভুল ধুলোয় লুটিয়ে দিই;
কত ভুলে ফিরে পাই নিজেকে আবার।
মন
….পরিযায়ী পাখি।
ক্ষতমুখ ঢেকে রাখে নিজের ডানায়।
উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে
নীল নভো অত্যাচারে
আকাশকে ফেলে রেখে আমরা পালাই।
পায়ের কলিঙ্গ-ধুলো-দেশ
হঠৎ খামছে ধরে; দেখি
নতুন একটা বাড়ি; খুব ফুটফুটে।
সামনে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে;
মায়ায় উদাস তার মুখ; যেন দেবী।
মন তার মহাশূন্য মাছের খালুই;
ইচ্ছে করে মাছ হয়ে ভিতরে লাফাই।
সময়ের সব ধুলো ঝেড়ে
যখন ফিরবো,
………………. কেউ একজন বলে,
ও মেয়ে নয় তো, ও হিজড়ে।
বহু সাধনার শেষে অনেক ভুলের
সামনে দাঁড়িয়ে ভালো লাগে আমাদের।
জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ খ্রি. শৈশব থেকে বসবাস ময়মনসিং-এর মুক্তাগাছায়। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘লখিন্দরের গান’ (২০০৬), ‘অশ্রুপার্বণ’ (২০১১), ‘কাক তার ভোরের কোকিল’ (২০১৭), ‘রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই’ (২০১৮)। ‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ ‘Song of Lokhindar’ Translated by Ahmed S. Kaderi ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় এ্যান্টিভাইরাস প্রকাশনি থেকে। পেশা: সহকারি অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ মুক্তাগাছা, ময়মননিংহ। স্বীকৃতি: কবিতাসংক্রান্তি সম্মাননা ২০০৭ লোক লেখক সম্মাননা ২০২০ এক সময় সম্পাদনা করতেন লিটলম্যাগ ‘মেইনরোড’।