মাসরুর আরেফিনের নতুন উপন্যাস ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ সম্পর্কে যখন জানতে পেলাম যে এর পটভূমি রাশিয়ার রাজধানী মস্কো, তখন আমার বেশ আগ্রহ বোধ হলো। কারণ আমার যৌবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি বছর কেটেছে ওই শহরে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ চার বছর এবং ওই ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার পর গড়ে ওঠা পূঁজিতান্ত্রিক নতুন রাশিয়ার প্রথম দুই বছর আমি মস্কোর গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯৩ সালে দেশে ফিরে আসার পরে মনে হয়েছে, আমি যেন আমার হৃদয়ের অর্ধেকটাই ফেলে এসেছি ওই শহরে। তার পর থেকে একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে চলেছি, আজও সেই চেষ্টা শেষ হয়নি। ফলে, মস্কো আজও আমার মন ও মস্তিষ্কের অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়ে গেছে।
কিন্তু মাসরুর আরেফিনের উপন্যাসটির মস্কো আমার ফেলে আসা গর্বাচভ–ইয়েলৎসিনের মস্কো নয়, এটা ভ্লাদিমির পুতিনের আজকের মস্কো। এই মস্কো আমার কাছে অনেকটাই অচেনা; ১৯৯৩ সালের পর আমি ওই দেশে আর একবারও যাইনি। অবশ্য বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে যে পূঁজিতান্ত্রিক রাশিয়ার নতুনভাবে গড়ে ওঠার শুরু, তাঁর পর থেকে ভ্লাদিমির পুতিন যে রাশিয়া শাসন করে চলেছেন, এবং আজীবন করে যাবেন বলে পণ করেছেন, সেই দেশটি সম্পর্কে যৎসামান্য খোঁজখবর না রেখে আমি পারি না। দুই দশকের বেশি সময় ধরে অলিগার্ক-উপদ্রুত ওই দেশ, পূঁজির প্রাথমিক পুঞ্জিভবন পর্বের যাবতীয় নীতিহীনতা, নিষ্ঠুরতা, বিভীষিকার মধ্যে ঘুরপাক চলেছে যে রাশিয়া, চির-আকাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে কোনোভাবেই শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, সেই দেশটির মানুষদের প্রতি আমার ঔৎসুক্যের শেষ নেই। কখনো মনে হয়, আমি তাদের বেশ ভালোভাবে চিনি, আবার পরের মুহূর্তেই মনে হয়, সেটা অসম্ভব: জাগাদোচনায়া রুস্কায়া দুশা, এনিগম্যাটিক রাশান সোল এক চির-অধরা বস্তু।
মাসরুর আরেফিন রাজনীতি-সচেতন লেখক। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ তাঁর রাজনৈতিক ডিসকোর্স। এই উপন্যাসে তাঁর ডিসকোর্সের বিষয় ঘটনাক্রমে আজকের রাশিয়া, এটা ইনসিডেন্টাল; অন্য যেকোনো দেশই তা হতে পারত। উপন্যাসের প্লটের খাতিরে তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে রাশিয়া নামের দেশটিকে। কারণ, উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের বড়ো ভাই ২৬ বছর আগে গেছে সেই দেশে, তারপর থেকে পরিবারের সঙ্গে তার আর কোনো যোগাযোগ নেই। মায়ের অন্তর উদগ্রীব হয়ে আছে, অন্তত একবার ছেলের কণ্ঠস্বর শুনবেন। উপন্যাসের বীজ এই; এখানেই গাছটার জন্ম; তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে রাশিয়া পর্যন্ত।
অবশ্য এই আখ্যানের খুব বড়ো জায়গা জুড়ে রয়েছে এক হতভাগা রুশ কবির মর্মান্তিক কাহিনি, সেটা প্রটাগনিস্টের বড়োভাইয়ের কাহিনি থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু ওসিপ মান্দেলশতাম নামের সেই কবির কাহিনিটি লেখকের প্রয়োজন হয়েছে, কেননা তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য তো রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বভাব সম্পর্কে নিজের দর্শন ব্যক্ত করা। সোভিয়েত ‘কমিউনিস্ট’ রাষ্ট্রযন্ত্রটি নিজের অস্তিত্ব রক্ষার পথ নিষ্কণ্টক করতে স্তালিনের সময় স্রেফ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ কী সাংঘাতিক নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিয়েছিল, সেই কাহিনি না বলে লেখকের আত্মার মুক্তি ছিল না। আবার, খুব পরিচিত এক পরিহাস হলো এই যে, উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট নিজেও একজন কমিউনিস্ট ভাবধারারই মানুষ।
সোলঝেনিৎসিন, শালামোভ প্রমুখ লেখকদের বদৌলতে স্তালিন আমলের রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার কাহিনিগুলো সম্পর্কে আমার এত বেশি জানার সুযোগ হয়েছে যে, এ নিয়ে বিশেষ কোনো কৌতূহল আর অবশিষ্ট নেই। তবে আমার কৌতূহল ছিল, মাসরুরের এই উপন্যাস মান্দেলশতামের বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করে তা দেখার। কারণ, মহাফেজখানার তালা খোলার পর দলিল-দস্তাবেজগুলো ইতিহাসের অন্ধকার থেকে যে চিত্র তুলে আনে, একজন ঔপন্যাসিকের আঁকা ছবিতে তার চেয়ে আরও বেশি কিছু থাকবে, এই আমার প্রত্যাশা। সোভিয়েত পতনের পর রাষ্ট্রীয় আর্কাইভগুলো উন্মুক্ত হলে স্তালিনীয় নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে যে অজস্র তথ্য ও বয়ান আমরা জানতে পেরেছি, ঔপন্যাসিকের হাতে সেগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হলো, তা দেখার কৌতূহল আমার ছিল। দেখলাম, এখানে আমার বাড়তি প্রাপ্তিযোগ তেমন হলো না। মান্দেলশতাম ও তাঁর বন্ধু-সহযোদ্ধা কবি-সাহিত্যিকদের উপর স্তালিনীয় নিষ্ঠুরতার কাহিনিগুলো যদি আমার জানা না থাকত, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা বলা যেত।
রাষ্ট্র মানে কী, এই যন্ত্র কীভাবে চলে এবং পুরো সমাজ ও তার সমস্ত মানুষকে কীভাবে চালায়, কীভাবে মানুষে–মানুষে সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেয়, এসব সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কল্পনা আছে। আরও ধারণা পেতে, আরও নানা রকমের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত হতে আমার আপত্তি নেই, বরং আগ্রহই আছে। কিন্তু সে জন্য আমি উপন্যাস পড়ি না; পড়ি ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি নিয়ে লেখা ননফিকশন। আমি উপন্যাস পড়ি হিউম্যান ড্রামা উপভোগ করার প্রত্যাশায়। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ডিস্টোপিয়ান রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিংবা মানব–স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া পূঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যেখানেই হোক, হিউম্যান কন্ডিশান বা হিউম্যান প্রেডিক্যামেন্ট কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে, এটাই উপন্যাস ও ঔপন্যাসিককে নিয়ে আমার আগ্রহ-ঔৎসুক্যের প্রধান বিষয়।
‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে আমার একটা অতৃপ্তির জায়গা এটা। প্রধান চরিত্রের বড়ো ভাই শামসুল আরেফিন, বাল্যবন্ধু কামাল, আরেক বন্ধুর ছোটোভাই সাদাত ও তার স্ত্রী ভালেন্তিনা, এদের প্রত্যেকের পরিস্থিতি দুর্দান্ত একেকটা হিউম্যান ড্রামার আভাস দেয়; কিন্তু শুধু আভাসই দেয়, বিশদভাবে মেলে ধরে না। বিশেষ করে বন্ধু কামালের বিলিয়নিয়ার হয়ে ওঠা এবং তার বিপরীত দিকে বড়োভাই শামসুল আরেফিনের দারিদ্র্যপীড়িত পরিণতিতে পৌঁছার প্রক্রিয়া এক্সপ্লোর করা হলে পিরিস্ত্রোইকা ও তার পরের তিন দশকে রাশিয়ার রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যাপক রূপান্তর এবং ব্যক্তিমানুষের বদলে যাওয়ার অনেক ছবি পাওয়া যেত; তার ফলে লেখকের রাষ্ট্র, ক্ষমতা, রাজনীতি সম্পর্কিত ডিসকোর্সের উপন্যাস-সুলভ বৈশিষ্ট্য আরও উপভোগ্য হতে পারত বলে আমার বিশ্বাস।
মাসরুর আরেফিনের গদ্য বেশ ডিসকার্সিভ; এমন শাখাপ্রশাখাময় বয়ানকৌশল কাহিনিগদ্যের পাঠকের মনোযোগ মাঝে মাঝেই ছিন্ন করে; ফলে পাঠের মধ্য দিয়ে ঘটমান মানসিক পরিভ্রমণ বাধাগ্রস্ত হয়; মনে গভীর ছাপ ফেলার যোগ্য মুহূর্তগুলোও লেখকের প্রসঙ্গান্তরজনিত ডিসট্র্যাকশনের কারণে অচিরেই মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়।
উপন্যাসকে আমি একটা সম্পূর্ণ জগৎ হিসেবে দেখি: ঔপন্যাসিকের ব্যবহৃত শব্দ, নির্মিত বাক্য, বাক্যের পর বাক্য জুড়ে সাজানো অনুচ্ছেদ, থরে থরে সাজানো অনুচ্ছেদে গড়ে ওঠা অধ্যায়, অধ্যায়ের পর অধ্যায় যুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা এক নির্মাণ।
উপন্যাসকে আমি একটা সম্পূর্ণ জগৎ হিসেবে দেখি: ঔপন্যাসিকের ব্যবহৃত শব্দ, নির্মিত বাক্য, বাক্যের পর বাক্য জুড়ে সাজানো অনুচ্ছেদ, থরে থরে সাজানো অনুচ্ছেদে গড়ে ওঠা অধ্যায়, অধ্যায়ের পর অধ্যায় যুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠা এক নির্মাণ। কথাশিল্পীর নির্মিত সেই জগতের বাসিন্দারা রক্তমাংসের জীবন্ত মানুষ; তাদের জীবন যাপন, পারস্পরিক সম্পর্ক, কথা ও কাজ ওই জগতের অর্ন্তনিহিত নিয়ম, যুক্তি, শৃঙ্খলায় বাঁধা। তারা ঔপন্যাসিকের হাতের পুতুল নয়, তাঁর বক্তব্য বা দর্শন প্রকাশের মুখপাত্র নয়। ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের জগৎটির বাসিন্দাদের গল্প যিনি বলছেন, সেই মুখ্য চরিত্রটিকে প্রায়শই লেখকের রাজনৈতিক দর্শন ও বিশ্ববীক্ষা প্রকাশের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুখপাত্র বলে আমার মনে হয়েছে। বরং ভালেন্তিনা ও সাদাতকে মনে হয়েছে লেখকের নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেকটাই মুক্ত চরিত্র, যারা পুতিনের রাশিয়ার অবজেক্ট রিয়ালিটির করুণ, অসহায় শিকার। বড়োভাই শামসুল আরেফিনকেও বেশ স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্র বলে মনে হয়েছে। বাল্যবন্ধু কামালের চরিত্রকে সে তুলনায় আরোপিত লেগেছে, বিশেষত সেই মুহূর্তগুলিতে, যখন তার মুখ দিয়ে রাষ্ট্র, ক্ষমতা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে নানা বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে।
উপন্যাসের পটভূমি মস্কো— এটা জেনে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলাম। জানা ছিল না মাসরুর আরেফিনের এই উপন্যাসে মস্কো শহরের কী ছবি দেখতে পাব। কী প্রত্যাশা করা যেতে পারে সেই ধারণাও ছিল না। শুধু কৌতূহল ছিল। এখন মনে হচ্ছে বঞ্চিত হলাম: বার্চ গাছের একটুখানি বর্ণনা ছাড়া মস্কো শহরের চেহারা-সুরতের (যা আমি চলে আসার পরের ২৮ বছরে ভীষণভাবে বদলে গেছে বলে শুনতে পাই) তেমন কিছুই আর দেখতে পেলাম না। আফসোস রয়ে গেল।
একটা বিশেষ প্রাপ্তির কথা বলতেই হচ্ছে : তা হলো ওসিপ মান্দেলশতামের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ। কাহিনির প্রয়োজনেই সেগুলো যুক্ত করা হয়েছে, এটা বোঝা যায়। বিশেষত ‘স্তালিন এপিগ্রাম’ নামের কবিতাটি (রুশ নাম ‘ক্রেমলিওফস্কি গোরেৎস’ বা ক্রেমলিনের পাহাড়ি) ছাড়া এই উপন্যাসের মান্দেলশতাম উপখ্যানটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
তবু কবিতাগুলোকে বাড়তি প্রাপ্তি বলে গ্রহণ করেই আমি আনন্দিত হতে চাই এবং লেখককে ধন্যবাদ দিতে চাই।
জন্ম বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলায়। সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ এবং কলাম সংকলন— সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ এর অধিক।