চরিত্র
আসাদ
খোকন
নার্গিস
: হাহা এতো সোজা! আমাকে আটকানো! মরে যেতে রাজী আছি, কিন্তু ফুরিয়ে যাবো না তো আমি! কী দিয়ে আমাকে আটকাবে!
কার দোষ?—নাচে যেইজন, কিংবা তাকে যে নাচায়?
না নাচিলে একজন অন্যজনে ধরিয়া নাচায়।
অস্বীকার হয় যদি, তলাশ করিয়া ফেরে তবে অন্যজন,
যতোখন পুতুলার মতো কোনো মানুষ না পায়;
একবার নাগাল পাইলে তার, তাকে ধরি নাচায় সবায়।
কিন্তু নাচে যেইজন? নাচে ক্যান? বেকুব নোয়ায়
—না লাগে হামার ভালো, কিছু মোর মনোতে না খায়।
একদিন, দুইদিন, এক বচ্ছর দুই বচ্ছর নয়, এ যে বিশ-বাইশ বছর আগের কথা। দেখো, এখনও কেমন ফকফকা মনে আছে সব সংলাপ। সৈয়দ শামসুল হক নাই, তবু তার সংলাপ রয়ে গেছে। মানুষ থাকে। থাকে সংলাপ, থাকে নাটক, থাকবে এই মঞ্চ।
হা হা, এতো সোজা না তো এই আসাদরে আটকানো! আমারে আটকাবা? মারী, মরা, মড়ক দিয়া? এত্তো সোজা! একটা জীবন আমি পার করে দিয়েছি নাটক করতে করতে। এখন বুঝি আমি শো না করে থাকব। হুহ! এত্তো সোজা না! কিসের প্যানডেমিক! কিসের মহামারি! কিসের ভাইরাস! কী দিয়ে আটকাবে জীবনের নাটক। একদিন, দুদিন, এক মাস, দুমাস, এক বছর, দুবছর… আর কতো…. নাটক আমি করবই! জানি, সব বন্ধ। লক ডাউন চলছে। সামাজিক দূরত্ব। তাই বলে কি নাটক করব না! আমার রক্তে যে থিয়েটার! থিয়েটার। স্টেজ। ড্রামা। লাইট, সেট। এই তো জীবন।
বহুত আচ্ছা, কেয়া বাত, ঘটনা কিন্তু মজার! এ বড়ো রঙ্গ! আমি আনোয়ারকে বলছি, আজ রাতে শো হবে, স্টেজ খুলে দাও। আনোয়ার দাঁত কেলিয়ে বলে, ভাইজান, হলরুমের চাবি আমার কাছে, কিন্তু হলরুম খোলার মালিক তো আমি না! আমি একটা দারোয়ান। দুয়ারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে আনোয়ার! সে মালিক নয়। কেয়া বাত! আমি তারে বললাম, আনোয়ার মিয়া এই তো সুযোগ! তুমি মালিক হয়ে যাও। এক রাতের জন্য তুমি মালিক। তুমি হল খুলে দেবে। স্টেজে উঠব আমি। অভিনয় করব।
মানুষ খেতে পায় না। মঞ্চ নাটক হবে কী করে! কে দেখতে আসবে মঞ্চ নাটক। কিন্তু আমি! আমার রক্তে যে মঞ্চের নেশা। আমি তো থিয়েটার করতে না পারলে মরে যাব। ঘরে বসে বসে কতো আর ইডিপাস সাজব! রক্তকরবীর রাজার মতো আড়ালে কাটিয়ে দেবো একটা জীবন! নাহ! কাভি নেহি! কাভি কাভি মেরা দিলমে খেয়াল ইয়ে আতা হ্যায় ক্য জ্যায়সে তুঝকো বানায়া গ্যায়া হ্যায় মেরে লিয়ে? কিস লিয়ে? কিসকে লিয়ে? এই মঞ্চের জন্য। আমাকে বানানো হয়েছে মঞ্চের জন্য।
আমি নাটক করব। অভিনয় করব। ডিরেক্টর বলবে, আসাদ, প্রজেকশন, গলার আওয়াজ কই। আমি বলব, ইয়েস বস! প্রজেকশন, ভয়েস মডিউলেশন! হা, আমাকে শম্ভু মিত্র শিখিয়েছেন। না। কোনো পনের দিন সাতদিনের ওয়ার্কশপ নয়, আমি শেখেছি, তাঁকে কাছ থেকে দেখে। তাঁর অভিনয়, আবৃত্তি দেখে, শুনে। তিনি যেন দ্রোনাচার্য, আমরা একলব্য, দূর থেকে শিখেছি তাঁর কাছ থেকে। তিনি একা কেন, কে শেখায়নি আমাদেরকে! ছটলু ভাই, সেও শিক্ষক। মার্লোন ব্রান্ডো, সেও তো কম বড়ো শিক্ষক নয়।
‘So you didn’t need a friend like me. Now you come and say “Don Corleone, give me justice.” But you don’t ask with respect. You don’t offer friendship. You don’t even think to call me “Godfather.” You come into my house on the day my daughter is to be married and you ask me to do murder – for money.’
আর ভাবো তো স্যার লরেন্স অলিভিয়ারের কথা! কী তাঁর কণ্ঠ! কী তাঁর দেহের ভাষা! সমুদ্রের সামনে, হাতে একটা ছোরা, সামনে উত্তাল ঢেউ। অভিনেতার ভেতরেও ঢেউ, উত্তাল ঊর্মিমালা। যুবরাজ হ্যামলেট বলে যাচ্ছে:
‘To be, or not to be, that is the question:
Whether ’tis nobler in the mind to suffer
The slings and arrows of outrageous fortune,
Or to take Arms against a Sea of troubles,
And by opposing end them: to die, to sleep
No more; and by a sleep, to say we end
The heart-ache, and the thousand natural shocks
That Flesh is heir to? ‘Tis a consummation
Devoutly to be wished. To die, to sleep,
To sleep, perchance to Dream; aye, there’s the rub,
For in that sleep of death, what dreams may come,
When we have shuffled off this mortal coil,
Must give us pause. There’s the respect
That makes Calamity of so long life’
হারমনিয়াম ধরে আমাদেরকে অভিনয় শিখিয়েছিল রংপুরের নীহারদা। দাদা সেই মফস্বলে একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন অভিনয় করতে করতে। যে কারো সংলাপশুনে বলে দিতেন, কোনটা চড়া সুরে বাঁধা, কোনটা কোমল, কোনটা কড়ি সুর। বাচিক অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। পঞ্চাশ বছর ধরে তাঁর শিক্ষা কাজে লাগাচ্ছি। প্রমাণ চাও? এই দেখো, একই লাইন কেমন সারগামে বাঁধি। শোনো,
ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দারমালিকা,
হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা
মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ,
আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন…
এই লাইন কটা উচ্চারণ করছি, সা ধরে,
এবার দেখো,
পর পর রে গা মা ধরে শুনাই…
ম্লান হয়ে এলো কণ্ঠে মন্দারমালিকা,
হে মহেন্দ্র, নির্বাপিত জ্যোতির্ময় টিকা
মলিন ললাটে। পুণ্যবল হল ক্ষীণ,
আজি মোর স্বর্গ হতে বিদায়ের দিন…
আনোয়ারের সংসার চলে না। খেতে পায় না। কেমন করে খাবে? হল বন্ধ। বেতন অর্ধেক দেয়। বকশিস নাই। আমি বললাম, আনোয়ার, কেউ তো কিছু জানছে না। তুমি, আমি আর খোকন। পাপ্পুকে চেনো না? আলোকসম্পাত করে। লাইন ডিজাইনার। আমরা তিনজন থাকব। তুমি দর্শক সারিতে, খোকন আলো জ্বেলে দেবে। লেট দেয়ার বি লাইট!
And the earth was without form, and void; and darkness was upon the face of the deep. And the Spirit of God moved upon the face of the waters. And God said, Let there be light: and there was light. And God saw the light, and it was good; and God divided the light from the darkness.
অন্ধকার থেকে আলোর বিভাজন ঈশ্বরের কাজ। খোকন, তুমি ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ঠ হও, আলো দাও, আমাদের মঞ্চে। আমাদের যেন দেখতে পায় আগত দর্শকরা। আলো ছাড়া কী নাটক করা যায়! নাটক হবে। আলো আসবে। আমি অভিনয় করব।
এই মঞ্চে একটু না দাঁড়ালে আমি যে মরে যাব। কেউ কিচ্ছু জানবে না। বিনিময়ে, তোমাকে আমি দেবো পাঁচ হাজার টাকা। পুরো হল ভাড়াটাই পাবে তুমি একা। তোমার অন্তত এক মাসের চাল, ডাল, তেল, নুনের খরচ উঠে যাবে। বলো আনোয়ার, দেবে না খুলে! কোথায় তুমি, আনোয়ার, আনোয়ার…
হাহ, ঘুমিয়ে পড়েছে! দারোয়ান ব্যাটা দুয়ার খুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নির্ঘাত। ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া, কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া, অবনী বাড়ি আছো?’ আনোয়ার, ঘুমিয়ে পড়েছ? দুয়ার খুলেই। হাহ।
আচ্ছা ঘুমাক। শান্তিতে ঘুমাতে পারে কজন। যুথীর কথাই ধরো! কতো বড়ো ঘরের মেয়ে। বাবা ছিল এমপি। জামাই ডিআইজি। গাড়ি, বাড়ি, ক্ষমতা সব আছে তার করতলে। রূপ, গুণ তো ছিলই। আমি বলেছিলাম, যুথী আমাকে ভালোবাসবি? কী যে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিল! ঠোঁটের কোণাটাকে একটা বাঁকা তলোয়ারের মতো করে যেন কান পর্যন্ত টেনে দিয়েছিল! জোকার সিনেমার হিথ লেজারের মতো কান পর্যন্ত হাসি। তবে হাসিটা ছিল একদিকে। বাঁকা। মুখ বাঁকিয়ে অমন করে হাসলি কেন যুথী? আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নই?
কী বলেছিল আমাকে জানেন? ‘যাও যাও নাটক কোরো না আমার সাথে। তোমার ওইসব একশ টাকার অভিনয়ের জাদু আমার উপরে খাটবে না।’ অভিনয়, জাদু। হাহ এইসবের মানে যুথী কি জানে! দেখা হয়েছিল সেদিন। এই মহামারিকালেই। পিপিই পড়ে সুপার শপে এসেছে। ট্রলি ভর্তি সদাই। টিস্যু, টয়লেট পেপার, হ্যান্ডওয়াশ, সাবান, ডেটল আরো কতো কী! অতো বড়ো লোকের বউ, নিজে কেন দোকানে এসেছে! কাজ নেই। তাই হবে। পয়সা আছে, অভাব নেই, কাজ নেই। জীবনে আনন্দও নেই। ঘুমাতে পারে না। কাজ না থাকলে মানুষ ঘুমাতে পারে? আমাকে বলে, ভালোই আছি। তবে ইনসোমনিয়া হয়ে গেছে, ঘুমাতে পারি না আসাদ। কোনো কোনো রাতে মনে হয়, তুমি আমাকে অভিশাপ দিয়েছো।
অভিশাপ! আমি! হাহ, যুথী! আমি শিল্পী। আমি থিয়েটার আর্টিস্ট। আমি অভিনয় করি। কিন্তু অভিশাপ দিতে শিখিনি।
: তোমা ‘পরে
এই মোর অভিশাপ— যে বিদ্যার তরে
মোরে কর অবহেলা সে বিদ্যা তোমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ; তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ;
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।
: আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে।
: আরে সাবাস খোকন! সাবাস! তোমার মুখস্থ আছে বিদায় অভিশাপ!
খোকন: বড়ো ভাই চিরকাল তো আড়ালেই থাকি। দূর থেকে আপনাদের উপর আলো নিক্ষেপ করি। আপনারা হয়ে ওঠেন নাটকের তারকা!
: তারকা! বেশ বলেছ খোকন। কীসের তারকা! তারকা কি জানো? অযুত নিযুত কোটি কোটি গ্যাস, আগুনের সম্ভার। আর আমি! অযুত নিযুত কোটি কোটি ব্যথা, বেদনা, অপমানের সম্ভার। যদি লিখতে পারতাম খোকন, তাহলে মহাকাব্য লিখতাম। আমার মহাকাব্যের নাম হতো ব্যথাসমগ্র।
ওই যে, অভিশাপের কথা বলছিলে! অভিশাপ দিয়েছিল আব্বা। আব্বা চিৎকার করে বলেছিল, ওই নাটকই তোকে খাবে! শেষ করে দেবে, ধ্বংস করে দেবে! নাটক করেই মরবি তুই! আব্বা, আব্বা গো, এই দেখো, তোমার অভিশাপ মাথায় পেতে নিয়েছি আশীর্বাদের মতো। তোমার আসাদ নাটক করতে করতেই মরবে। আজকের এই নাট্যজগতে তোমার আসাদকে মঞ্চমুকুট বলে। সেলিম আল দীনের মতো নাট্যকার আমাকে বলেছেন, মঞ্চমুকুট। দেশসেরা পত্রিকায় আমার অভিনয়ের আলোচনা হয়। তিনজন নাট্যকার আমাকে বই উৎসর্গ করেছে। রাষ্ট্রীয় কোনো পুরস্কার নেই থিয়েটারের জন্য। কিন্তু যে ক’টি ছোটো বড়ো পুরস্কার নানা দল প্রবর্তন করেছে তার সবগুলো আমি পেয়েছি।
: আসাদ ভাই, আপনি সেরা। আপনার অভিনয় বিস্ময়কর! মেথড এক্টিংয়ে যেমন তুখড় তেমনি আপনি স্টাইলাজ এক্টিংয়েও রাজা। সাঈদ আহমেদের শেষ নবাবে আপনার অভিনয় এখনও আমার চোখে লেগে আছে। বাদল সরকার, উৎপল দত্ত, মামুনুর রশীদ… সবার সংলাপই আপনার মুখে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আপনি এই মঞ্চে প্রাণ ঢেলে দিয়েছেন।
: কিন্তু খোকন, কী দিন এলো বলো তো! এখন যে মানুষের প্রাণ নিয়েই টানাটানি! এই সভ্যতাই আমরা চেয়েছিলাম! দু’চারদিনের জ্বর, কাশি, বুকে কফ, নিউমোনিয়া, ব্যস মরে যাবে মানুষ। কেউ কাছে আসবে না। ঠিকমতো লাশের সৎকারও হবে না। একটা প্যাকেটের ভেতর আটকে মানুষকে কোনো রকমের মাটিচাপা! এ কেমন রোগ! এ কেমন সভ্যতা! নিরাময় নাই? ওষুধ নাই? বিজ্ঞান পারে না, মানুষ পারে না, অতি ক্ষুদ্র একটা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করতে! কতো আয়োজন এই জন্মের, কতো আয়োজন এই জীবনের আর এইভাবে ঝরে যাবে একেকটা প্রাণ। ছটলু ভাই মরে গেল, ইশরাত আপা মরল, মাসুম ভাই চলে গেল… মহামারি, মহামারি নিয়ে যাবে আমাদের প্রিয় প্রাণগুলো! তাও এমন অবহেলায়। জানো, বেলা আপাকে একটু দেখতে চেয়েছিলাম আমি! শেষবার ওর মুখটা কেমন হয়েছিল! দেখতে দেয়নি। দুদিন ফ্রিজারে রেখেছে। ওর ছেলেটা আসতে পারেনি বিদেশ থেকে। কী করে আসবে! সব প্লেন বন্ধ। আহা, বেলা আপা রিহার্সেলের ফাঁকেও একটু ঘুমিয়ে নিতেন। পাঁচ-দশ মিনিটের ঘুম। আমরা হাসতাম। বলতেন, ওরে তোরা চারপাশে আছিস, তাই একটু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিতে পারি। সেই বেলা আপা! আহা!
এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
কে? কে ওখানে? কথা বলো না কেন? কে? কে তুমি? বেরিয়ে আসো।
: স্যার আমি নার্গিস।
: নার্গিস!
: স্যার আমি ক্লিনার। ঝাড়–মোছা করি।
: তুমি এইখানে থাকো?
: না স্যার। বাসাবো থাকতাম। বাড়ি ভাড়া বাকী পড়ছে তিন মাস। এখন ওই বারান্দার কোণায় থাকি। কেউ জানে না। স্যার আপনে কাউরে কইয়েন না।
: প্রণমি তোমারে আর্যে। রাজমাতা তুমি,
কেন হেথা একাকিনী। এ যে রণভূমি,
আমি কুরুসেনাপতি।
: জ্বি স্যার?
: নার্গিস। বসে পড়ো। প্রথম সারিতে গিয়ে বসো। তোমাকে আজ আমি অভিনয় দেখাব। আমার অভিনয়। তুমি আমার একান্ত দর্শক। তুমি নমস্য। যাও। বসো।
শুকুর চান বলে, এট্টুখানি পায়ের পাতা দেখা যায় গো চাচা। কে জানে বয়স কত। কিন্তু সে ভয়ে বলে না এই মৃতের বয়স তারই কাছাকাছি। শুকুর চানের কাঁধে বড়ো পুটুলী পায়ের পাতায় এখানে ওখানে শেষ রাতের শুকনো বেলে কাদা। সে সহসা থুতনী উচ্চে তুলে ধরে—নীল মহানীলে চোখে গেঁথে যায় ওর। আহা চাটাই মোড়া এই লোকটি কি ভালোবাসতো কাউকে? সেই দূর গাঁয়ে যেতে যেতে রাত হবে। হয়তো সে তখন শোবার আগে চুল আঁচড়ে নিচ্ছে ঠোঁটে চুল বাঁধুনী সূতো কামড়ে। ভাঙা আয়নায় মুখ দেখে না রাতে যদি প্রিয়জনের মৃত্যুর সময় কাছে থাকতে না পায়! পেতলের মাজাবাতি সামনে স্থির। শিখা চালের দিকে উঠে যাচ্ছে। কখনও কখনও দীর্ঘ নিশ্বাসের আঘাতে কাপে শিখা। চুলে সুগন্ধি তেল মাখে। কাচের বাটিতে লালচে মতো তেল। এমন সময় চীৎকার হবে। তার চুলে আটকে যাবে চিরুনী।
কি হয়েছে গো চাচী
মা গো শফিকের লাশ এইসছে এলংজানি হাসপাতাল থিকে।
হাতের প্রদীপ উঁচু করে ধরেছিল এবার পড়ে যায়। ঘরের ঘন অন্ধকারে কান্নার কেরোসিন ছড়িয়ে পড়ে। শুকুর চান বলে উঠে কম্পিত মেয়েটির দুঃখে— আহ্ হা…
কই গো নার্গিস! কেমন হলো? হাততালি দাও। ধন্যবাদ। আমি নতশিরে কুর্নিশ করি তোমায়।
শ্রুতিদর্শকমণ্ডলি, তোমাদের করতালিতে আমাদের জীবন পূন্য হোক। ওহে খোকন, আলোটা একটু কমাও। দাঁড়া, আরেকটু অভিনয় করি… কতোকাল পর আমি মঞ্চে দাঁড়ালাম। আনোয়ার, আনোয়ার… তুমি কই? ঘুম? হাহ… ঘুমও দরকারি।
ঠাকুর, সময় নষ্ট হয়। যাও এবে
মন্দিরের কাজে। প্রচার করিয়া দিয়ো
পথে যেতে যেতে, আমার ত্রিপুররাজ্যে
যে করিবে জীবহত্যা জীবজননীর
পূজাচ্ছলে, তারে দিব নির্বাসনদণ্ড…
তোমার কী মনে হয় পাপ্পু? আমরা কি আজ অদৃষ্টের হাতে বলির পশু? এতো প্রাণ ঝরে যাবে আর বিধাতাপুরুষ নিরব রয়ে যাবেন? নাকি এ-ও এক প্রকৃতির প্রতিশোধ। নার্গিস, বলো তো আর কতো প্রাণ যাবে এই মহামারিতে? আর কতোকাল বন্দি হয়ে থাকব আমরা নিজের তৈরি খাঁচায়?
: স্যার আমি মুখ্যূ।
: না। তুমি মূখ্য। আমরাই গৌণ। এই নাট্যমঞ্চ ধোঁও-মোছ, পরিস্কার করো তুমি। তুমি ত্রাতা।
: জি স্যার!
: মা গো, শুধু তুই আর আমি! এ মন্দিরে
সারাদিন আর কেহ নাই— সারা দীর্ঘ দিন!
মাঝে মাঝে কে আমারে ডাকে যেন।
তোর কাছে থেকে তবু একা মনে হয়!
: স্যার। আমি যাই। আপনার কথায় ঘুম ভাইঙা গেছিল। নাটক-ফাটক তো বন্ধ। ভাবলাম ঘটনা কী! তাই চইলা আসছি।
: যাও নার্গিস। ঘুমাও। নাটক-ফাটকের সময় এখন নয়। খোকন, অনেক অভিনয় অভিনয় খেলা হলো। চলো। আমাদেরও যে ফিরতে হবে। আনোয়ার, আনোয়ার… কুম্ভকর্ণের ঘুম কে ভাঙায়! দেখো তো আনোয়ারকে পাও কি না… শেখভের সেই নাটকের কথা মনে আছে তোমার? আমি আর লিলি অভিনয় করতাম। সেই যে বৃদ্ধ এক অভিনেতা… মাতাল… অভিনয় থেকে অবসর নিয়েছে… তাকে উৎসর্গ করেই অভিনয় সমাপ্ত হয়েছে… অদ্য শেষ রজনী… কি যেন নাম? সোয়ান সঙ। রাঁজহাসের গান। মজার না নামটা। রাজহাঁস নাকি শেষকালে গান গায়? মরার কালে গান গায়। কিন্তু তোমার আমার শেষকাল কি এলো? বলো তো মঞ্চে অভিনয় করতে করতে কে মরে গেল! থাক, সে সব কথা, শোনো, শেখভের সেই সংলাপ। অনুবাদখানা করেছে আমাদের এক তরুণ নাট্যকর্মী। শোনো—
এই মঞ্চের ক্লাউন হওয়ার আগে আমি তরুণ ছিলাম। সুদর্শন, আকর্ষণীয়, সাহসী! কই গেল সেই সব দিন? দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না… এই মঞ্চ, এই মঞ্চ গিলে খেল সব! সব মনে পড়ছে আমার। ৪৫ টা বছর। আমার জীবনের ৪৫ বছর চাপা পড়ে আছে এই মঞ্চের কবরে, কী জীবন আমার! নিকিতুষকা! একদম তোমার মুখের মতো পরিষ্কার সব দেখতে পাচ্ছি আমি। যৌবনের পরমানন্দ, আত্মবিশ্বাস, আবেগ, ভালোবাসা, নারী, হ্যাঁ, নারীর ভালোবাসা! নিকিতুষকা!
যখন আমি প্রথম এই মঞ্চে দাঁড়ালাম, যৌবনের সেই প্রথম আবেগে, মনে পড়ে, এক নারী আমার অভিনয়ের জন্যই আমাকে ভালোবেসেছিল। সে ছিল সুন্দর, প্রসন্ন, অল্পবয়স্ক, নিষ্পাপ, নিখাদ আর গ্রীষ্মের উষ্ণ ভোরের মতো উজ্জ্বল। তার হাসি অন্ধকার রাতকেও আলোকিত করতে পারত। মনে পড়ে, তার সামনে একবার দাঁড়িয়েছি, যেমন তোমার সামনে দাঁড়িয়েছি এখন। সেইদিনের মতো সুন্দর তাকে আর কোনোদিনই লাগেনি, আর সেদিন সে তার দুচোখ দিয়ে আমার সঙ্গে কতো কথা বলেছিল, কী সেই চাহনি! আমি কখনোই তা ভুলব না। না, কবরে গিয়েও আমি ভুলব না, কী কোমল, কী স্নিগ্ধ, কী গভীর, কী উজ্জ্বল আর তরুণ সে নারী! আহ! পরমানন্দ, প্রমত্ত। আমার মনে হলো হাঁটু গেড়ে বসি ওর সামনে, আমি তার কাছে আমার সুখ আনন্দ ভিক্ষা চাইলাম আর ও বলল, ‘এইসব নাটক-ফাটক ছেড়ে দিন!’ নাটক-ফাটক! ছেড়ে দেবো! বুঝতে পারলে তুমি?
ও একজন অভিনেতাকে ভালোবাসতে পারবে, কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারবে না! কখনো না! আমি সেইরাতে অভিনয় করছিলাম, এখনও মনে পড়ে, একটা বোকা সঙের চরিত্র, যেমন আমি অধিকাংশ সময় করে থাকি, আমার মনে হলো যেন আমার চোক্ষু উদয় হয়েছে, আমার দৃষ্টি খুলে গেছে। আমি দেখলাম শিল্পের সাধনা করছি আমি…
কেন অমন করে তাকিয়ে আছো, এসো। কেঁদো না! যেখানে শিল্প আছে আর প্রতিভা আছে সেখানে কোনো বয়স কাজ করে না, কিংবা কোনো নিঃসঙ্গতা কিংবা অসুস্থতা কাজ করে না সেখানে আর মৃত্যু সেই নিজেই তো খণ্ডিত … না, না নিকিতুষকা! আমাদের কী সব ফুরিয়ে গেছে! আমি কেমনতর প্রতিভা? আমি একটা শুকিয়ে যাওয়া লেবু, একটা ভাঙা বোতল আর তুমি, তুমি কি এই নাট্যশালার একটা প্রাচীন মূষিক… প্রমটর! কেবল আড়াল থেকে সংলাপ পাঠ করে যাবে! এসো!
: আসাদ ভাই, চলুন যাই। ভোর হওয়ার আগেই আমাদের চলে যাওয়া উচিত।
: চলো খোকন। আনোয়ারকে পেলে? না পেলে নাই। ও ঠিকই সময় মতো দুয়ার লাগিয়ে দেবে। লাগিয়ে দিক। কতোদিন বন্ধ থাকবে দূয়ার? কতোদিন বন্ধ থাকবে মঞ্চ? শো মাস্ট গো অন। আবার সবকিছু শুরু হবে। দেখো খোকন, আমি বলছি, এই মঞ্চে আবার দাপটের সঙ্গে দাঁড়াব আমি। বুক ভর্তি দম নিয়ে ফিরে আসব আমরা। দেখো।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মূল নাটকের ভাবনাটি এসেছে আন্তন শেখভের শেষ সংলাপ (swan song) একাঙ্ক থেকে। সেইসঙ্গে উইলিয়াম শেকসপিয়র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাঈদ আহমেদ, সৈয়দ শামসুল হক সেলিম আল দীন, প্রমুখের সংলাপ ব্যবহার করা হয়েছে অকাতরে। আমাদের নাট্য ঐতিহ্য আর বিশ্ব নাট্য ঐতিহ্যের প্রতি নিবেদিত এই প্রয়াস।
মুম রহমান একজন লেখক। সার্বক্ষণিক এবং সর্বঅর্থে লেখক। যা করেন লেখালেখির জন্য করেন। গল্প, নাটক, কবিতা, অনুবাদ, বিজ্ঞাপণের চিত্রনাট্য, রেডিও-টিভি নাটক, সিনেমার চিত্রনাট্য, প্রেমপত্র– সব কিছুকেই তিনি লেখালেখির অংশ মনে করেন। রান্নার রেসিপি থেকে চিন্তাশীল প্রবন্ধ সবখানেই তিনি লেখক।