বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

মৃত্যুর অধিকার : মোস্তাফিজ ফরায়েজী

0

Utsob-Songkha_Motifআমি গত তিনশত বছর ধরে মরতে চাই, কিন্তু পারছি না।

একটা দন্ডায়মান তালগাছ বেয়ে উপর উঠে একটা তাল হয়ে টুপ করে পড়ে, কিংবা রাস্তায় চলতে চলতে চলন্ত বাসের চাকার নিচে কুকুরের মতো মাথা ঢুকিয়ে, কিংবা একটা ছিপের বড়শি খাওয়া মাছের মতো তোমার বড়শিতে আমি মাছ হয়ে উঠলে কিই-বা দোষ হতো! সব প্রচেষ্টাই করেছি। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। একবার আমি ঠিক করলাম, ওসব কিছু আর করব না, আমি এবার আমার মৃত্যুর পথ তৈরি করব একটু ভিন্নভাবে। তাই আমি একটা মশা হয়ে উঠলাম। মশা হবার কারণ হচ্ছে, মশা বেশিদিন বাঁচে না। সর্বোচ্চ এক মাসে তার জীবনচক্র শেষ হয়। মশা হয়ে আমি এক গৃহস্থের বাড়িতে যাই ‘পু-পু’ শব্দ তুলে। কিন্তু বিধি বাম! গৃহস্থ কন্যার সেই ‘পু-পু’ সঙ্গীত পছন্দ হয় না, তার হাতের তালুর আঘাতে মশাটি মরে যায়। কিন্তু আমি মরি না, কারণ মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমি গৃহস্থ কন্যার প্রেমে পড়ে যাই। তার চিকন দেহপল্লব, পটলচেরা চোখ আমার ভালো লাগে। তাই নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলি গৃহস্থের উঠোনের জবাগাছের জবাফুলের ওপর বসা মৌমাছির ভেতর। মৌমাছি হবার পর গৃহস্থ কন্যাকে আমার কাছে জবাফুল মনে হয়, তাই জবাফুলের মধু পান করতে করতে আমি ভুলে যাই আমার মৃত্যুর কথা।

তার চিকন দেহপল্লব, পটলচেরা চোখ আমার ভালো লাগে। তাই নিজেকে ঢুকিয়ে ফেলি গৃহস্থের উঠোনের জবাগাছের জবাফুলের ওপর বসা মৌমাছির ভেতর। মৌমাছি হবার পর গৃহস্থ কন্যাকে আমার কাছে জবাফুল মনে হয়, তাই জবাফুলের মধু পান করতে করতে আমি ভুলে যাই আমার মৃত্যুর কথা।

ইদানীং আমি বড্ড পানসে হয়ে গেছি। আমার মধ্যে কারও প্রতি প্রেম কাজ করে না, কাম কাজ করে না। চোখ বন্ধ করলে আমার ভেতর বোধ জাগ্রত হয়— কত বিচিত্র পথই না বেছে নিয়েছি আমি নিজেকে নিঃশেষ করার জন্য!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন? আমি ‘কী করছি’ তার চেয়ে, ‘কেন করছি’ প্রশ্নটি বেশি জরুরি হলেও আপনারা নিশ্চিতভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন না। আপনাদের মাথায় আসছে, আমি আজগুবি গল্প ফেঁদে আপনাদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টায় রত বা আপনাদের ধোকা দিতে এসব গালগল্প করছি।

আপনাদের এই জিজ্ঞাসার ক্ষোভ প্রশমিত করতে প্রথমে আমাকে বলতে হবে, আমি কেন নিজের মৃত্যু চাই? এর ব্যাখ্যা আমি আপনাদের কাছে দেবো না, কারণ আমি আপনাদের বাধ্য নই। আমি শুধু আমার বাধ্য। আপনাদের দাবির প্রেক্ষিতে আমাকে যদি সবকিছু বলতে হয়, তাহলে আমার আর কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকে না। আমার গল্পের আর কোনো কারণ থাকে না। আমার এই গল্পের নায়ক হয়তো আপনি। আর আমি হয়তো আপনি! আপনি হয়তো আপনার জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছেন না। আপনি হয়তো প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অফিসে যান, কাজ করেন, ফিরে আসেন, স্ত্রীর সাথে সঙ্গম করেন তারপর ঘুমান। দিনের পর দিন রাতের পর রাত আপনার এই জীবন চলতেই থাকে চলতেই থাকে। তারপর আপনি একদিন বুঝতে পারেন, আপনি একটা চক্রের মধ্যে আছেন। আপনি বুঝতে পারেন, আপনি অফিসে না যেতে চাইলেও জীবন জীবিকার তাগিদে আপনাকে অফিসে যেতে হয়। আপনি বুঝতে পারেন, প্রতিদিন অপ্রয়োজনীয় যে কাজগুলো করতে চান না, সেগুলো অফিসে বসে আপনাকে করতেই হয়। আপনি বুঝতে পারেন, আপনি না চাইলেও দিন শেষে আপনাকে বাড়িতে ফিরতে হয়, চাইলেই আপনি সেইন্টমার্টিনে একা একা ঘুরতে চলে যেতে পারেন না। আপনি বুঝতে পারেন, সঙ্গম আপনি করতে না চাইলেও আপনার শরীর তা চায়। আপনি বুঝতে পারেন, ক্লান্তি আপনার চোখ দুটোকে বন্ধ করে দিচ্ছে, আপনাকে উধাও করে দিচ্ছে এই পৃথিবী থেকে প্রতিদিন।

তাই একদিন সন্ধ্যাবেলা আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন মৃত্যুবরণ করবেন। তবে ধর্মে যেহেতু রয়েছে আত্মহত্যা মহাপাপ তাই আপনি মনস্থির করেছেন সেই পথ বেছে নেবেন না। তাহলে আপনার জন্য কোন পথ খোলা রয়েছে? আপনি ধর্মগুরুকে বলেছেন, আপনি ধার্মিক ও বিশ্বাসী, অথচ পৃথিবী থেকে চলে যেতে চান। ধর্মগুরু আপনাকে পথ দেখাবে বলে আশ্বস্ত করেন। তিনি গ্রন্থের পর গ্রন্থ পাঠ করেন, লাইনের পর লাইন বিশ্লেষণ করেন এবং তিন বছর পর তিনি আপনাকে বলেন— ‘বৎস্য, এই মায়ার ভুবন ছেড়ে কেই-বা যেতে চায়! স্রষ্টা তোমায় সব দিয়েছেন, তবে স্বেচ্ছা মরণের অধিকার দেন নাই। তাই করজোড়ে আমি মিনতি করি, তুমি ফিরে এসো এই জীবনের পথে।’

আপনি ধর্মগুরুর কথা শুনে থ বনে যান৷ আপনার তিন বছর অপেক্ষার ফলাফল শূন্য ভেবে নিজেকে নিঃস্ব ভাবতে শুরু করেন। ধর্মগুরু আপনাকে পথ দেখাতে ব্যর্থ, তথাপি আপনি আপনার নিজের সিদ্ধান্তে অটল।

তাই ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার ঘুরতে গিয়ে আপনি আপনার স্ত্রীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দিলেন। আপনি সাঁতার কাটতে থাকলেন। আপনার ইচ্ছা যে করেই হোক আপনি সাঁত্রে বঙ্গোপসাগরের জলরাশি পার হবেন। আপনি জানতেন, আপনি তা পারবেন না। তারপরও আপনি তা করলেন। অতঃপর আপনি উধাও হয়ে গেলেন। আপনার পরিবার, আপনার সন্তানেরা আপনার আর কোনো খোঁজ পেল না দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। তারা ভেবে নেয়, আপনি সমুদ্রের জলের স্রোতে ভেসে গেছেন, জলের ঝাঁপটায় মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা শোক পালন করতে থাকে। মসজিদে মসজিদে প্রতি বছর আপনার হারিয়ে যাবার দিনটাকে আপনার মৃত্যুদিবস ঘোষণা করে তারা মিলাদ দিতে থাকে।

অথচ আপনি সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার পরও মরেননি। আপনি মৃত্যুর বদলে একটি অজানা দ্বীপে চলে গেছেন ভুলক্রমে। সেখানে নতুন নতুন মানুষের বসবাস। আপনি চাইলেই সেখান থেকে শহরে ফিরতে পারেন, তবে আপনি আর পূর্বের পৃথিবীতে ফিরতে চান না, আপনার পূর্বের অফিসে ফিরতে চান না। আপনি নতুনভাবে বাঁচতে চান। এবার জেলে হতে চান। সমুদ্রে যারা মাছ শিকার করে তাদের কাছ থেকে আপনি কায়দা কানুন শিখতে থাকেন।

সেই দ্বীপে এক জেলে পরিবারে আপনার আশ্রয় হয়। জেলের নাম স্বাধীন। সেই জেলে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তার এক গোপন কন্যার সাথে। তার নাম হিরিতা সোকো, সে হচ্ছে মৎস্যকন্যা। মাছ ধরতে ধরতে বিশাল নৌকায় স্বাধীন একবার নিজেকে আবিষ্কার করে একাকী, তার সঙ্গী সাথীরা সবাই উধাও হয়ে গেছে। তারপর সেখানে আবির্ভাব ঘটে মৎস্যদেবী হিরিতার। হিরিতা স্বাধীনের সাথে সঙ্গম করে। জন্ম হয় হিরিতা সোকোর।

হিরিতা সোকোর মা যেহেতু জলের আর বাবা যেহেতু স্থলের বাসিন্দা— ফলে সে জল ও স্থল উভয় জায়গাতেই বসবাস করতে পারে। পরিচয়ের পর দ্বীপের দক্ষিণপাশের জঙ্গলে আপনি হিরিতা সোকোর সাথে ঘুরে বেড়াতে থাকেন সঙ্গোপনে। আপনি তার রূপ যৌবনের ফাঁদে পড়ে যান। হিরিতা সোকোও আপনাকে ভালোবেসে ফেলে। তাই জঙ্গলে প্রতিদিন আপনাদের সঙ্গম হতে থাকে। আপনাদের সঙ্গমের শব্দে মুখরিত হয় দ্বীপ। সেখানকার প্রতিটি পাখি এবং প্রাণীরা আপনাদের সম্পর্কের কথা জেনে ফেলে।

তারপর একদিন আপনি সমুদ্রে মাছ ধরতে যান। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সমুদ্রে আপনার সংগ্রাম চলে, জঙ্গলে চলে সঙ্গম। তারপর আবার আপনার মাঝে একঘেয়েমি চলে আসে। সমুদ্র জীবনের কষ্ট আপনার কাছে বৃথা মনে হয়। এই দুনিয়ায় থাকার মানে আপনি খুঁজে পান না।

আপনি হিরিতা সোকোকে বলেন— আমি দুনিয়া ছেড়ে পালাতে চাই। আমি তোমাকে ছেড়ে পালাতে চাই।

হিরিতা সোকো রুষ্ট হয়, সে বলে— আমাকে ছেড়ে যদি যেতে হয়, তবে এসেছিলে কেন?

সেই ‘কেন’র উত্তর আপনি হিরিতা সোকোকে দেন না। কারণ সেই উত্তর দিতে গেলে আপনি আর আপনি থাকেন না। প্রকৃতপক্ষে আপনার হাতে মৃত্যুর কোনো বিকল্প নেই।

তাই এক ঝড়ের রাতে মাছ ধরার ট্রলার টলকাতে থাকলে আপনি আনন্দে আত্মহারা হন। এ যেন, এ যেন… মৃত্যু আপনার খুব সন্নিকটে। ঝড়ের কবলে ট্রলার বেসামাল। ট্রলার কোথায় যায় তার ঠিক নেই! আপনি কোথায় যান তার ঠিক নেই! ট্রলারের সাথে আপনার বিচ্ছেদ ঘটে।

আপনার নিখোঁজের সংবাদ পেয়ে হিরিতা সোকো আপনাকে খুঁজতে থাকে জলে এবং স্থলে। বছরের পর বছর সে আপনাকে খুঁজতে থাকে কিন্তু পায় না। আপনাকে না পেয়ে মাঝে মাঝে হিরিতা সোকো দ্বীপের ঘন জঙ্গলের মাঝখানে যেয়ে ক্রন্দন করে। দ্বীপের পাখি এবং প্রাণীরা হিরিতা সোকোর চারপাশে এসে হাজির হয়। তারা তার শোকের সাথী হয়। তারাও ক্রন্দন করতে থাকে।

সেই কথা আপনি জানতে পারেন না।

কারণ ট্রলার ডোবার পরদিন আপনি নিজেকে আবিষ্কার করলেন ব্রাজিলগামী এক বাণিজ্য জাহাজে। জাহাজের নাবিক এবং খালাসী সবাই ব্রাজিলিয়ান। তারা আপনাকে পুর্তগিজ ভাষায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি কে?’

আপনি গরগর করে পুর্তগিজ ভাষায় উত্তর দেন, ‘আমি একজন পথহারা মৎস্যশিকারী। ঝড়ের কবলে পড়ে আপনাদের জাহাজে।’

আপনার মুখে সাবলীল পর্তুগিজ শুনে তারা পুলকিত হয়। আপনি তাদের পুর্তগিজ গান গেয়ে মাতিয়ে তোলেন। তারা গানের তালে তালে আপনাকে মাথায় তুলে নাচেন। তারা আপনাকে দিয়ে জাহাজের বিভিন্ন কাজ করাতে লাগল এবং আপনার কাছ থেকে প্রতিদিন পর্তুগিজ গান শোনার জন্য আবদার করতে থাকল। নতুন অভিজ্ঞতায় আপনি সিদ্ধ হতে থাকলেন। এভাবেই আপনার সমুদ্রযাত্রা চলতে থাকে।

আপনি একটা ভারী অস্ত্র তুলে নিয়ে তাক করেন টার্গেটে। আপনার বসসহ অনেকে আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আপনি শ্যুট করেন। বুলেট ছুটতে ছুটতে টার্গেটের মাঝ বৃত্তের মাঝখানে ঢুকে যায়। আপনার বস আপনার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘শাবাশ!’

জীবনে প্রথমবার ব্রাজিল পৌঁছে আপনি কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। রিও দি জেনেরোতে এক বস্তিতে আপনার জায়গা হয়। আপনি স্বেচ্ছায় হয়ে ওঠেন একজন অপরাধী। মাদক ব্যবসার সাথে আপনি জড়িত হয়ে যান। অস্ত্র চালনার ট্রেনিং করানোর জন্য আপনার বস আপনাকে নিয়ে যায় ইনডোর শ্যুটিং গ্রাউন্ডে। সেখানে বিভিন্ন অপরাধীদের ভিড়। তাদের কেউ কেউ নিজেদের ঝালিয়ে নিতে এসেছেন, কেউ আবার নতুন শ্যুটিং শিখতে এসেছেন। আপনাকে দেখে তাদের অনেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে থাকে। একজন বাঙালি আবার কেমন অস্ত্র চালাতে পারে! আপনি একটা ভারী অস্ত্র তুলে নিয়ে তাক করেন টার্গেটে। আপনার বসসহ অনেকে আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আপনি শ্যুট করেন। বুলেট ছুটতে ছুটতে টার্গেটের মাঝ বৃত্তের মাঝখানে ঢুকে যায়। আপনার বস আপনার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘শাবাশ!’

অন্যরা অভিযোগ করে, এটা নিছক ভুল কিংবা ভাগ্য। তাই আপনাকে পুনরায় অস্ত্র তুলে নিতে হয়। আপনি এবার পরপর তিনটি শ্যুট করেন। লক্ষ্য অব্যর্থ। টার্গেটের মাঝ বৃত্তের মাঝখানে ঢুকে যায় তিনটি বুলেট। আপনার বস আনন্দে আত্মহারা। এমন দক্ষ শ্যুটার তার গ্রুপে আর নাই। তারপর থেকে আপনাকে বিভিন্ন অপারেশনে যুক্ত করা হয়। আপনি একে ওকে গুলি করে হত্যা করতে থাকেন একের পর এক মানুষ।

অনিশ্চিত শঙ্কাভরা জীবন। সেখানে বেঁচে থাকা মানে বিলাসিতা। কখন কে মারা যায় তার ঠিক নেই। একজন দক্ষ শ্যুটার হলেই শুধু সেখানে বেঁচে থাকা যায় না। তবে আপনি মরেন না। আপনি মৃত্যুর জন্য বন্দুকের ঝররা গুলির সামনে বুক পেতে দিলেও গুলিগুলো কেন যেন স্লাইড করে এদিক ওদিক চলে যায়। আপনি বুঝতে পারেন, আপনার মৃত্যু সহজে হবে না। তাই এক পুলিশ কর্মকর্তার বউয়ের সাথে আপনি প্রেম শুরু করেন। তার সাথে সঙ্গম করতে থাকেন প্রতিনিয়ত। পুলিশ কর্মকর্তার বউ আপনাকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খায়। আপনি তাকে পুর্তগিজ ভাষায় প্রেমের গান শোনান। সেই গান প্রতিবেশীরা কান পেতে শোনে। এমন আবেগী কন্ঠস্বরের গান তারা কখনো শোনেনি বলে রটে যায়।

সেই গানের কথা পুলিশ কর্মকর্তা জেনে যান। তার বেডরুমে ঢুকে অন্য কোনো পুরুষ গান গায় বিষয়টাকে তিনি মারাত্মক গুরুত্বের সাথে নেন। তাই একদিন আপনি যখন তার বউয়ের সাথে সঙ্গমরত এমন সময় তিনি আপনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চলে আসেন নিজগৃহে। আপনাকে মেরে ফেলার জন্য দরজার ফাঁক গলিয়ে আপনাকে তাক করে তিনি রিভলভার ধরতেই তার বুকের বামপাশে ব্যথা অনুভূত হয়। তার হাত থেকে রিভলবার পড়ে যায়। আপনি ও তার স্ত্রী এসব খেয়াল করেন না, আপনারা সঙ্গম করতে থাকেন ঝোড়ো গতিতে। কোনো দিকে আপনাদের খেয়াল নেই। সঙ্গম শেষে আপনারা আবিষ্কার করেন দরজার সামনে মরে পড়ে রয়েছে সেই পুলিশ কর্মকর্তা। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায় স্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে।

অন্যদের এই সহজ মৃত্যু আপনাকে অবাক করে দেয়। আপনার ঘাড়ে পুনরায় একঘেয়েমি চেপে বসে। আপনি সিদ্ধান্ত নেন, আপনি আপনার মৃত্যুর খোঁজে নতুন পথে যাত্রা করবেন। পর্বতারোহণের অভিজ্ঞতা না থাকলেও আপনি এভারেস্ট চূড়ায় আরোহণ করবেন। কত মানুষ এভারেস্ট পর্বতে আরোহণ করতে যেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে তার ইয়ত্তা কী আছে!

এভারেস্টে আরোহণের উদ্দেশ্যে আপনি ব্রাজিল থেকে আকাশপথে নেপালের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বিমান আকাশে উড়তে থাকে, আপনিও আকাশে উড়তে থাকেন। আপনি ভাবতে থাকেন— মানুষ কী উড়তে পারে না! হ্যাঁ, পারে তো! সুপারম্যানেরা আকাশে উড়তে পারে। সিনেমায় বিষয়টি আপনি দেখছেন। বাস্তবে সুপারম্যান না দেখলেও তার অস্তিত্ব অসম্ভব নয়। আপনি মনে করেন একদা কোনো কোনো মানুষ উড়তে সক্ষম ছিল, এখন হয়তো সেই সক্ষমতা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে। আপনার সুপারম্যান বিষয়ক ভাবনার ইতি ঘটে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। রানওয়েতে বিমানের চাকা স্পর্শ করতে না করতেই কচকচ করে শব্দ হতে থাকে, তারপর গরগর শব্দ। কী হয় তা আপনি জানেন না, চারিদিকে আগুন দেখেন। পুড়তে শুরু করে বিমান, বিমানবালা এবং বিমানের যাত্রীরা। জোড়ায় জোড়ায় কিংবা একাকী মানুষেরা পুড়তে থাকে।

যে কয়েকজন বেঁচে থাকে তাদের মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি ছিলেন। এত সুন্দর মৃত্যু থেকে বঞ্চিত হয়ে আপনি আরও মুষড়ে পড়েন। আপনার কাছে মৃত্যু মানে পরিণতি কিংবা কষ্ট নয়। আপনার কাছে মৃত্যু মানে মুক্তি, মৃত্যু মানে উত্তরণ, মৃত্যু মানে সুন্দর।

অক্ষত অবস্থায় আপনি এভারেস্ট পর্বতের পাদদেশে চলে এলেন। একজন শেরপাকে নেপালি ভাষায় বললেন— ‘ওহে শেরপা! কত প্রাণ নিয়েছে এভারেস্ট তুমি কী বলতে পারো?’

শেরপা বলে— ‘নথিতে আছে তিন শতাধিক। তবে কত সহস্র প্রাণ তার শ্বেতশুভ্র গায়ে লুকিয়ে আছে, তা কে বলিতে পারে!’

আপনি কিছু খাবার নিয়ে একা একা উঠতে শুরু করলেন পর্বতে। উঠতে উঠতে আপনি উঠে পড়লেন এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায়। কিন্তু আপনি কোনো পতাকা ওড়ালেন না, আপনার মুখে বিজয়ের হাসি নেই। আপনার নাম উঠে গেল এভারেস্ট চূড়াজয়ী ব্যক্তিদের তালিকায়। তারপরও আপনি সন্তুষ্ট নন। কারণ আপনার প্রয়োজন ছিল তুষারঝড়ের। আপনার দরকার ছিল এমন মুহূর্ত যে মুহূর্তে আপনি বরফের নিচে ঢাকা পড়ে থাকবেন বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক। বরফের নিচে থাকার সহস্র বছর পর আপনার মরদেহ আবিষ্কার করবে কোনো এক বিজ্ঞানী, তারপর আপনার হাড়-গোড় নিয়ে গবেষণা করবেন তিনি। তা আর হলো না।

তাই আপনি বেশ কিছু বছর পর ফিরে এলেন আবার আপনার জন্মভূমি বঙ্গদেশে।

বঙ্গদেশে তখন খরা চলছে, মানবিকতার খরা। সেখানে ধনীরা খুবলে খুবলে খাচ্ছে দরিদ্রদের। দরিদ্ররা টুঁ শব্দটিও করতে পারছে না। যে দুই একজন টুঁ শব্দ করার প্রচেষ্টা করছে তাকে জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে।

বঙ্গদেশে এই অনিয়ম দেখে আপনি হতবাক হন না, আন্দোলন শুরু করেন না। আপনি বরং শহরে বসবাস করতে লাগলেন নিভৃতে একটা ছোট্ট ভাড়া করা ঘরে। দূর থেকে আপনি দেখতে লাগলেন আপনার স্ত্রীর ক্রীয়াকলাপ। তিনি পুনরায় বিয়ে করেননি, তবে সঙ্গম ছাড়েননি। তিনি শহরের বিভিন্ন উচ্চবিত্ত পুরুষদের সাথে মেলামেশা করেন, তাদের কাছ থেকে অর্থ নেন, সেই অর্থ ভোগ করেন। শুধু তাই নয়, আপনি জানতে পারেন আপনার দুই সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে। একজন হয়েছে মাতাল, আরেকজন রাজনীতিবিদ।

এতকিছুর পরেও আপনি হতাশ নন।

যারা আপনার সম্পর্কে জানে না তারা অবশ্য চাইলেই হতাশ হতে পারেন। এতক্ষণ যারা মনে করছে আপনার এই স্ত্রী আপনার প্রথম সহধর্মিণী, তারা নিশ্চয় ভুলের মধ্যে বসবাস করে চলেছে। আপনার মৃত্যুর প্রতি আকাঙ্ক্ষাকে যারা মনে করছে অযথা বা ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তারাও ভুলের সমুদ্রে নিমজ্জিত। তারা আসলে আপনার কিছুই জানে না, তারা জানে না আপনি একদিন জীবনকে ভালোবাসতেন। তারা জানে না আপনার প্রথম স্ত্রী জোলেখা ছিল আপনার একমাত্র প্রেমিকা। পাঁচশত বছরের অধিক পূর্বে যখন আপনি খড়ে ছাওয়া ঘরে বসবাস করতেন আর কৃষিকাজ করতেন তখন জোলেখা আপনার সাথেই জমিতে চাষ করত। কাজ শেষে আপনারা দুজনে খড়ের ঘরে যেতেন। সেখানে আগুন জ্বালিয়ে দুজনে মিলে রান্না করতেন। সেই রান্না করা খাবার খেয়ে আপনারা দুজনে পৃথিবীর সৌন্দর্য্যের গল্প করতেন। জোলেখা হয়তো কোনো এক রাতে আপনাকে বলত— তুমি কী আজ আমাদের খেতে উড়তে থাকা বিশাল প্রজাপতিটা দেখেছিলে? আমি আমার জীবনে কখনো এতবড়ো প্রজাপতি দেখিনি।

আপনি উত্তর দেন— আমি দেখেছি। আমি স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যদি মরে যাও তবে পরজন্মে যেন তুমি প্রজাপতি হয়ে ফিরে আসো।

এর দিন কতক পর আপনার স্ত্রী মৃত্যুবরণ করলে আপনি শোকে পাথর হয়ে যান, আপনার জীবকোষের বয়স স্থবির হয়ে পড়ে।

যারা আপনার বিরুদ্ধে মিথ্যে ঘটনা বর্ণনা করার অভিযোগ তুলছে, তারা জানে না, আপনার জীবনে কত প্রিয়জন ছিল, কত প্রিয়জন আপনার চোখের সামনে দিয়ে চলে গেছে অকাতরে। তারা জানে না, কত দুঃখ-সংগ্রাম আপনি অতিবাহিত করেছেন, কত যুদ্ধের আপনি সৈনিক ছিলেন। তারা জানে না, আপনি আপনার জীবনে কত দেশ ঘুরেছেন, কত ভাষা আপনার নখদর্পণে। তাছাড়া তারা এ-ও জানে না, একদিন আপনি মৃত্যুকে কতটা ভয় পেতেন।

এখন হয়তো সকলে বুঝতে পারছেন, আপনি এবং আমি এক নই। আমরা আলাদা। আপনার অস্তিত্ব প্রায় ছয়শো বছর ধরে। আমার অস্তিত্ব মাত্র সাড়ে তিনশো বছর। আমরা যে এই জগতে আছি তা অনেকেই জানে না। বুকে পাথর বেঁধে আমরা দিনের পর দিন পার করে চলেছি। মাসের পর মাস অভিনয় করে চলেছি। কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ এখন আর আমাদের আকর্ষণ করে না, কোনো নারী এখন আর আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, কারও দারিদ্র্য আমাদের আর কাদায় না, কারও উন্নতি আমাদের আর ঈর্ষান্বিত করে না। আমরা যে রয়েছি তাও কেউ জানে না, জানানোর চেষ্টাও আমরা করি না। শুধুমাত্র আমাদের বোধের সমকক্ষ কেউ আমাদের সামনে উপস্থিত হলে তাকে আমরা চিনতে পারি।

এই যেমন গতকাল একজনের সাথে আমার দেখা হয়েছিল গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে। তিনি একটা বটগাছের নিচে গামছা মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে ছিলেন। তার গরুগুলো সামনের মাঠে ঘাস খাচ্ছিল। তিনি একজন রাখাল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি— ‘কী করছেন চাচা!’

তিনি বলেন— ‘গরু রাখি, বাতাস খাই আর ঘুমাইবার চেষ্টা করি।’

আমি তাকে প্রশ্ন করি— ‘মানুষ কত এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই বড়ো হচ্ছে। আর আপনি এখনও এই গরু নিয়ে পড়ে রইলেন।’

চাচা মুচকি হাসেন, আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন— ‘জীবনের তুমি কী বোঝো! যারা দৌড়ের ওপর আছে তারা আমার এই বটগাছের নিচে ঘুমাইবার কী বোঝে!’

আমি চাচার কথা বুঝতে পারি। তার দ্বন্দ্বটা ধরতে পারি। তার দহনটা অনুভব করতে পারি।

আমার এই গল্প জীবনে প্রথমবার শোনার পর আপনারা আমাকে হতাশাবাদী বলে উঠতে পারেন। শোনা যায় শুধুমাত্র হতাশাবাদীরাই মৃত্যুবরণ করতে চায়।

তবে, আপনাদের বুঝতে হবে, মৃত্যুটা আমার প্রয়োজন। মৃত্যুটা আমার দাবি। আমি ধর্মের মধ্যে থেকেও এই দাবিটা পূরণ করার প্রচেষ্টায় রয়েছি। কিন্তু আমি কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আবার আমি হেরেও যাচ্ছি না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

১৯৯১ সালের ১৩ মে চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নওদাবন্ডবিল গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। সম্পাদনা করেন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সাহিত্যবিষয়ক অনলাইন পত্রিকা ‘দর্পণ’। 'পয়গম্বর' মোস্তাফিজ ফরায়েজীর প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।