বিষ জমে, চাঁদ জমে রাতের ডগায়। বিষটুকু পাহারা দেবার কথা ভেবে সেউজগাড়ি মহল্লার অধিবাসীরা অতি অস্থিরতায় চাঁদ ভুলে যায়। চাঁদ ভুলে গেলে তাদের রাত আরও অনিরাপদ হয়, রাতের বিষ আরও অনিরাপদ হয়। চাঁদ ভুলে তারা ভেবেছে রাত কেবল তাদের বিষ ও ঘুমের আশ্রয়স্থল। তারপর তারা তাদের বিষ ও ঘুমের নিরাপত্তার জন্য নির্মাণ করতে চেয়েছে নানারূপ রাত। আর নানারূপ রাতের নিরাপত্তার জন্য গড়ে তুলেছে নানারূপ নিরাপত্তাকর্মী— রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয়, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন।
এখন বলি এই কথা; তারা তাদের বিষ রক্ষার জন্য, ঘুম রক্ষার জন্য দু’জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেয়। তাদের বিষ ও ঘুম রাতের ডগায় জমা থাকলে, তারা রাত পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ দেয় দু’জন নিরাপত্তাকর্মীকে। নিরাপত্তাকর্মী দু’জনকে বিষ ও ঘুম পাহারা দেয়ার কথা জানানো হয় না। শুধু জানানো হয় তাদেরকে রাত পাহারা দেয়ার কথা। তারা ভাবে বিষ আর ঘুম বিষয়ে নিরাপত্তাকর্মীদেরকে কিছু জানালে বিষয়টা হয়তো আরও অনিরাপদ হয়ে যাবে।
রাত কীভাবে পাহারা দিতে হয় তা সে দু’জন নিরাপত্তাকর্মী জানে রূপকথার গল্প থেকে কিংবা হাজার এক রাত্রির গল্প থেকে। তাদের মা, যদি মা না হয় তবে তাদের দাদী, রাত পাহারা দেবার গল্প তাদেরকে শুনিয়েছিল যখন তারা ঘুমানোর আগে চাঁদ দেখতে চাইত।
রাত কীভাবে পাহারা দিতে হয় তা সে দু’জন নিরাপত্তাকর্মী জানে রূপকথার গল্প থেকে কিংবা হাজার এক রাত্রির গল্প থেকে। তাদের মা, যদি মা না হয় তবে তাদের দাদী, রাত পাহারা দেবার গল্প তাদেরকে শুনিয়েছিল যখন তারা ঘুমানোর আগে চাঁদ দেখতে চাইত। নানা রকম চাঁদ। যে গোলাপ ঝরে গেছে তার সুঘ্রাণ ধারণ করে যে চাঁদ, যে নদী দূরে গেছে তার প্রবহমান স্রোত ধারণ করে যে চাঁদ, যে খেলা খেলা হয়নি তার আনন্দ ধারণ করে যে চাঁদ, আরও আরও জানা না-জানা চাঁদ। সব রাতে চাঁদ না পাওয়া গেলে তাদের মা, তাদের দাদী, চাঁদ খুঁজে আনতো কথার সাথে কথা জোড়া দিয়ে, মিথ্যার সাথে মিথ্যা জোড়া দিয়ে।
বাঁশি বাজে। শুরু হয় তাদের রাত পাহারা দেয়া। তাদের দু’জনের হাতে দু’টো বাঁশি। এ বাঁশির শব্দ সেউজগাড়ী মহল্লার সকল রাতের কাছে পৌঁছে যায়।
২.
বাঁশি বাজে। রাত বাজে। বাঁশি সেউজগাড়ি মহল্লার মানুষদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় তাদের বিষ ও ঘুম পাহারার কাজ চলছে। তারা অনেকদিন থেকে অনুভব করছে তাদের শরীরের, তাদের রাতের বিষ ও ঘুম কমে যাচ্ছে। ঘুমেরা, বিষেরা কেন তাদের শরীর থেকে চলে যাচ্ছে তা তারা বুঝতে পারে না। ঘুম আর বিষ শরীর থেকে হারাতে থাকলে তারা তাদের অতীত হারাবে, ভবিষ্যত হারাবে, ঐতিহ্য হারাবে, ইতিহাস হারাবে, অর্থনীতি হারাবে, রাজনীতি হারাবে, ধর্মনীতি হারাবে— এরকম ভাবে তারা। তাদের ইতিহাস, তাদের সাহিত্য, তাদের সংস্কৃতি, তাদের রাজনীতি, তাদের ধর্মনীতি ঘুম ও বিষের চর্চা করেছে। এসব ঐতিহ্য, এসব গৌরব মহল্লা ও মহল্লাবাসীদের জন্য অতি জরুরী। তারা মনে করেছে ঘুম ও বিষ পালিয়ে যায়, কমে যায় রাতের বেলা। তাই তারা রাত পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছে বাঁশিওয়ালা দু’জন বামনকে।
কয়েকদিন আগে, এক সন্ধ্যাবেলায় দু’জন বামন এসে জানায় তারা পাহারাদারের কাজ করে। তারা এসে দাঁড়িয়েছে এ মহল্লার নজরুলের দোকানে। সেউজগাড়ির নজরুলের মুদি দোকান এই মহল্লার তথ্যকেন্দ্র। এ মহল্লার সকল তথ্য, সবার তথ্য এখানে জানা যায়। মহল্লার মাতব্বরেরা এ সময় নজরুলের দোকানের নিকটেই ছিল। তারা অনেকদিন ধরে মহল্লার রাত পাহারা দেয়ার জন্য পাহারাদার খুঁজছিল। এখন এ দু’জনকে পেয়ে নিয়োগ দিতে চায় পাহারাদার হিসাবে। কয়েকটি প্রশ্নের সাহায্যে তাদের দক্ষতার বিষয়টা পরিমাপ করতে চায় তারা। সেউজগাড়ি মহল্লার মাতব্বরেরা তৈরি করেছে সেউজগাড়ি উন্নয়ন সমিতি। সেউজগাড়ি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আনিস আলী, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আলী এ দু’জন বামন পাহারাদারকে প্রশ্ন করে। তারা কোথা থেকে এসেছে? পাহারাদারদের গ্রাম থেকে। কতোদিন যাবৎ তারা পাহারা দেবার কাজ করছে? দীর্ঘদিন থেকে। কোথা থেকে শিখেছে তারা রাত পাহারা দেয়া? তাদের গ্রামে রাত পাহারা দেয়া শেখানোর বিদ্যালয় আছে। পাহারা দেয়া বিদ্যালয়ের সনদ আছে কি? আছে।
আনিস আলী ও জয়নাল আলী খুব বিস্মিত হয় এবং তাদের খুব ভালো লাগে যে কোথাও রাত পাহারা দেবার বিদ্যালয় আছে। যে বিদ্যালয়ে পাহারা দেয়া প্রশিক্ষণ শেষে সনদপত্র দেয়া হয়। তারা জানে সনদপত্রের গৌরব। তাদের মহল্লায় চালু আছে রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সনদপত্র। শুধু নাই রাত পাহারাদার সনদপত্র। তাদের এ সময় ইচ্ছা হয় পাহারা দেয়া বিদ্যালয় দেখার। একই সংগে কয়েকজন বালককে সেখানে পাঠানোর ইচ্ছা হয় এ বিদ্যা অর্জন ও তার সনদপত্র আনার জন্য।
বামন দু’জনের সংগে একটা লিখিত চুক্তি হয় রাত পাহারা দেয়ার জন্য। নির্ধারিত হয় তাদের বেতন। এর পর সেউজগাড়ি মহল্লার সেউজগাড়ি যুব সংঘের মাইক থেকে বামন পাহারাদার দু’জনের নিয়োগের বিষয়ে কয়েকবার ঘোষণা দেয়া হয়। মহল্লার সবাই জেনে যায় তাদের রাত পাহারা দেয়ার জন্য পাহারাদার নিয়োগ দেয়া হয়েছে, আর তারা তো আগেই জানে, রাত পাহারা দেয়ার অর্থ তাদের ঘুম ও বিষ পাহারা দেয়া। তারা স্বস্তি নিয়ে নিজেদের শরীরের দিকে তাকায়। শরীর কী অদ্ভুত যে সে রাত পোষে, ঘুম পোষে। আর শরীরকে পাহারা না দিলে সে তার ঘুম ও বিষ হারায়।
বাঁশি বাজে। সেউজগাড়ি মহল্লার সবাই জেনে গেছে ঘুম ও বিষ পাহারা দেয়ার যতোগুলো কৌশল তার একটা কৌশল বাঁশি বাজানো। বাঁশি বাজানো দিয়ে শুরু হয় ঘুম ও বিষ পাহারা দেয়া, রাত পাহারা দেয়া। যদিও মহল্লাবাসী জানে না পাহারা দেয়ার অন্যান্য পদ্ধতি।
বাঁশি শুনে মহল্লার বালকদের ফুটবল মাঠের কথা মনে আসে। ফুটবল খেলার কথা মনে আসে। তারা ফুটবল খেলার কথা মনে করতে করতে একবার ঘুমের কাছে যায় একবার জাগরণের কাছে যায়। একবার ঘুমকে মনে হয় একটা গোলপোস্ট। একবার জাগরণকে মনে হয় একটা গোলপোস্ট।
বাঁশি শুনে মহল্লার বালকদের ফুটবল মাঠের কথা মনে আসে। ফুটবল খেলার কথা মনে আসে। তারা ফুটবল খেলার কথা মনে করতে করতে একবার ঘুমের কাছে যায় একবার জাগরণের কাছে যায়। একবার ঘুমকে মনে হয় একটা গোলপোস্ট। একবার জাগরণকে মনে হয় একটা গোলপোস্ট। তারা খুবই আনন্দ অনুভব করে। তবে তাদের একটা সমস্যা এরকম যে, তারা ঘুমকে বুঝতে পারছে না। বাঁশি তাদের ঘুমকে পাহারা দিচ্ছে, তাদের রাতকে পাহারা দিচ্ছে। তারা ঠিক বোঝে না তাদের শরীরের বিষটুকু কোথায়, কীভাবে তার পাহারা হচ্ছে। তারপর অন্ধকার। তারপর ফুটবলসহ বালকেরা ঢুকে যায় অন্ধকারে যেখান ফুটবলটা চাঁদ হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
বাঁশি বাজে। সেউজগাড়ি মহল্লার তরুণদের প্রেম সংগ্রহের ইচ্ছা জাগে। এ মহল্লার কোথাও তো নদী আছে। নদীর ধারে রাতের বেলা তারা তো গিয়েছিল তাদের ঘুম নিয়ে, বিষ নিয়ে প্রেম সংগ্রহে। এরপর মহল্লার ঘুম হারাতে থাকলে, বিষ হারাতে থাকলে তারা স্থগিত করেছে প্রেম সংগ্রহ। মহল্লায় রাতের বেলা পাহারাদারদের বাঁশি বাজলে তাদের কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়। রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে নদীর পাশে মাছকে সাক্ষী রেখে লেখে ঘুমের কবিতা, বিষের কবিতা, প্রেমের কবিতা। এ মহল্লার কবিতা ছোটো হতে হতে দুই পঙ্ক্তিতে ঠেকলে তারা লেখে দুই পঙ্ক্তির অসংখ্য কবিতা। তারা সারারাত ফেসবুকে ছাপায় এ সকল দ্বিপদী। সে সময় কেউ কেউ বলে দেখো আমাদের জীবন, আমাদের প্রেম দুই পঙ্ক্তির কবিতা। তাদের কেউ কেউ এ সময় উর্দু কবিতার কথা বলে, ফার্সি কবিতার কথা বলে। তারা দুই পঙ্ক্তির কবিতার সাহায্যে নিজেদের কল্পনার জীবনী লেখে। একজন একদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয় দুই পঙ্ক্তির জীবন, দুই পঙ্ক্তির কবিতা। দুই পঙ্ক্তির অধিক সকল কবিতা অপাঠ্য। ফেসবুকের চিন্তা সংক্রামক হলে সবাই তাকে অনুসরণ করে, অনুকরণ করে। অতঃপর অনেকে মেনে নেয়, ব্যাখ্যা দেয় তাদের ঘুম ও বিষ কমে যাওয়ার কারণে তাদের কল্পনা কমে গেছে। কল্পনা কমতে কমতে ঠেকেছে দুই পঙক্তিতে। কবিতা যদি কল্পনার জীবনীগ্রন্থ হয়, তবে সেউজগাড়ি মহল্লার সকল কবি কল্পনার জীবনী লেখে দ্বিপদী কবিতার সাহায্যে। সেউজগাড়ি মহল্লার অসংখ্য দ্বিপদী কবিতা থেকে একটি দ্বিপদী কবিতা ভাইরাল হয়। সেই দ্বিপদী কবিতা মহল্লার সকল তরুণ ব্যবহার করতে চায় প্রেম সংগ্রহের জন্য। তারা চিঠিতে, রাস্তার পাশের দেয়ালে, গাছের কাণ্ডে খোদাই করে সেই দ্বিপদীটি। একজন সুরকার সে দ্বিপদী কবিতাটিকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতো গেয়ে ছড়িয়ে দেয় ইউটিউবে।
বাঁশি বাজে। সেউজগাড়ির তরুণীরা শাড়ি পরার চেষ্টা করে। তারা শাড়ি পরার কৌশল শেখার চেষ্টা করে। তাদের মনে হয় ঘুম ও বিষ শরীরে ধরে রাখার সংগে শাড়ি পরার একটা সম্পর্ক আছে। তরুণীদের নিজস্ব কোনো শাড়ি নাই। তারা তাদের মায়েদের, দাদীদের, নানীদের শাড়িগুলো অধিকার করার চেষ্টা করে। মায়েদের, দাদীদের, নানীদের বাক্স খোলে তারা। শাড়ির বাক্স। এ সকল বাক্স জাদুঘরের মতো। প্রতিটি নারীকে এ সময় তাদের জাদুঘর মনে হয়। আরেকবার মনে হয় প্রাচীন বাক্স। এ সকল বাক্সে শাড়ির সংগে আরও কতো কী যে আছে। সেউজগাড়ির তরুণীরা সে সকল জিনিসের নিকটে যেতে চাচ্ছে। স্তব্ধ মেঘ— তার নিকটে যাচ্ছে তারা; স্তব্ধ চুড়ি— তার নিকটে যাচ্ছে তারা; স্তব্ধ পাখি— তার নিকটে যাচ্ছে তারা। যেতে যেতে বৃষ্টি, পথ পিচ্ছিল। তারা ফিরে আসে বাক্সের কাছে।
সাদিয়া তাসনিম রুকু সেউজগাড়ির ফেসবুকের একজন জনপ্রিয় কবি। সে বাক্স ও শাড়ি নিয়ে দুই পঙক্তির একটা কবিতা লিখে ফেসবুকে পোস্ট করলে তাতে পাঁচ হাজার লাইক ও পাঁচ হাজার কমেন্ট আসে। ফেসবুকে সবাই জানতে চায় শাড়িটা দেখতে কেমন আর বাক্সের ভেতর শাড়ি ছাড়া আর কী কী আছে। এবার সাদিয়া তাসনিম রুকু দুই পঙক্তির কবিতার সংগে তার শাড়ি পরা কয়েকটা ছবি পোস্ট করে। এবং সবাইকে সে এটাও জানায় তাদের মহল্লার পাহারাদারেরা সত্যি ভালো পাহারা দিচ্ছে। তারা ঠিকমতো পাহারা দিচ্ছে বলে মায়েদের, দাদীদের, নানীদের শাড়ি, ঘুম ও বিষ সুরক্ষিত আছে, নিরাপদে আছে।
একদিন ঝমঝম বৃষ্টি। মেঘের গর্জন। মাছেরা পানি পান করে, গর্জন গ্রহণ করে। পাখিরা পানি পান করে, গর্জন গ্রহণ করে। সেউজগাড়ি মহল্লায় এতো পানি জমে। অনেকদিনের না হওয়া বৃষ্টি, না হওয়া গর্জন নেমে আসে সেউজগাড়ির পথে পথে। চেনা পথে, অচেনা পথে বৃষ্টির পানি প্রবাহিত হতে থাকে। পুরাতন কতো কিছু ভেসে যাবার জন্য অপেক্ষায় ছিল, সে সব ভেসে যায়। যাদের জানালা ছিল তারা জানালা দিয়ে ভেসে যাওয়া দেখে। বালকের দল— তারা দেখে ফুটবল ভেসে যায়, কতো কতো পুরাতন ফুটবল। তরুণের দল— তারা দেখে প্রেম ভেসে যায়, কতো কতো পুরাতন প্রেম। তরুণীর দল— তারা দেখে শাড়ি ভেসে যায়, কতো কতো পুরাতন শাড়ি। তারপর বৃষ্টি থেমে গেলে, রাস্তার জল সরে গেলে, সেউজগাড়ির রাস্তায় কতো সব মৃত ফুটবল, মৃত প্রেম, মৃত শাড়ি।
তারপর তারা ভাবে বামন দু’জনের উচ্চতা কতোটুকু— রাতের সমান। রাতের উচ্চতা কতোটুকু— যতোটুকু ঘুম, যতোটুকু বিষ। পেঁচা দু’টোর প্রজ্ঞা কতোটুকু— রাতের সমান। রাত কতোটুকু— প্রজ্ঞা যতোটুকু। বাঁশি দু’টোর সুর কতোটুকু— রাতের সমান। রাত কতোটুকু— বাঁশির সুর যতোটুকু।
সেউজগাড়ী মহল্লার তথ্যকেন্দ্র নজরুলের মুদি দোকানে আসতে হয় সবাইকে। সেউজগাড়ি উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আনিস আলী, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আলী এবং আরও অনেকেই মুদি দোকানের সামনে এসে পাহারাদারদেরকে মূল্যায়নে যায়। তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তাদের রাতগুলোকে পাহারা দেয়ার জন্য নিয়োগ দেয়া দু’জন বামন পাহারাদার সঠিকভাবে পাহারা দিতে পারছে কি না। পাহারা দেয়ার জন্য তারা কেবল বাঁশি ব্যবহার করে। অন্য কোনো অস্ত্র তাদের কাছে আছে কি না তা জানে না তারা। নজরুলের মুদি দোকানের সামনে আলোচনা করে কিভাবে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ পুনরুদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে। এ সময় সেখানে রাত পাহারা দেয়া বামন পাহারাদার দু’জন আসে। তাদের দু’জনের কাঁধে একটা করে পেঁচা আর হাতে একটা করে বাঁশি। সভাপতি আনিস আলী, সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আলী তাদের সংগে কথা বলে। বামন পাহারাদারদের কাছে তারা জানতে চায় রাত পাহারা দেয়া কেমন চলছে। তারা জানায় কাঁধের পেঁচা দু’টো জানে রাত কতোটুকু নিরাপদ অবস্থায় আছে। পেঁচারা রাতের ভাষা বোঝে। তারা পেঁচার ভাষা বোঝে। আর তাদের বাঁশি তাদের ভাষা মান্য করে। নজরুলের মুদি দোকানের সামনে উপস্থিত মহল্লাবাসীরা চমৎকৃত হয়। তারা প্রথমবারের মতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বামন পাহারাদার দু’জনকে, পেঁচাদু’টোকে, বাঁশি দু’টোকে। বামন দু’জন, পেঁচা দু’টো, বাঁশি দু’টো রহস্য নির্মান করছে এখন। রাতে তো তা করে। এখন দিনেও। রহস্য তো সর্বদা স্বল্পস্থায়ী ও পতন প্রবণ। এই রহস্যটুকু হারিয়ে যাবার আগে, ফুরিয়ে যাবার আগে মহল্লাবাসীরা পেঁচা থেকে, বাঁশি থেকে, বামন থেকে তুলে নেয় অচেনা অনুভব। তারপর তারা ভাবে বামন দু’জনের উচ্চতা কতোটুকু— রাতের সমান। রাতের উচ্চতা কতোটুকু— যতোটুকু ঘুম, যতোটুকু বিষ। পেঁচা দু’টোর প্রজ্ঞা কতোটুকু— রাতের সমান। রাত কতোটুকু— প্রজ্ঞা যতোটুকু। বাঁশি দু’টোর সুর কতোটুকু— রাতের সমান। রাত কতোটুকু— বাঁশির সুর যতোটুকু।
তারপর নিস্তব্ধতা। ক্লান্তি। কোথাও কোনো গাছের ডাল থেকে একটা পাতা কিংবা কয়েকটা পাতা ঝরে পড়তে গিয়ে পড়তে পারছে না। এখানে বামনেরা চাঁদের দিকে হাত বাড়ায়নি, পেঁচারা আকাশে আশ্রয় চায়নি, বাঁশি নদীর কাছে যাবার দাবি করেনি। সবাই তো চাকুরির ভক্ত। বামনেরা চাকুরি করে চুলার আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য। বামনদের চুলা কেমন। পেঁচারা চুলার ব্যবহার শিখেছে কবে। আর বাঁশি দূরে দূরে যায় চুলার দূরে।
উন্নয়ন সমিতির সভাপতি আনিস আলী বামন দু’জনকে জিজ্ঞেস করে কীভাবে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ পুনরুদ্ধার করা যায়। সে সময় একজন বামন পাহারাদার জানায় যেখান থেকে তারা এসেছে সেখানে একজন চিকিৎসক আছে, সে পুনরুদ্ধার করতে পারে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ। এবং তারও চাকুরি দরকার হলে সেও আসে সেউজগাড়ীতে চাকুরি করতে
৩.
এ রকম হয়, কেউ কেউ কোথা থেকে আসে জানা হয় না। গাছের শাখায় শাখায়, পাতায় পাতায় পাখিরা কোথা থেকে এসে কি বলে যায় জানা হয় না। তারপর শাখা মরে যায়, পাতা মরে যায়। অতঃপর পাখিদের কথাগুলো কার কাছে থাকে।
তার নাম জানা হয় রওশন আলী। চিকিৎসক হয় সে সেউজগাড়ির। সে সেউজগাড়ির হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ উদ্ধারের চিকিৎসক হিসাবে আসে চাকুরি করতে।
এখানে এ কথা বলা যায়, বলা উচিত সেউজগাড়ির আরও আরও উদ্ধারকর্মীর কথা, যারা ঘুম ও বিষ উদ্ধারে ক্ষয় করছে নিজেদের ঘুম ও বিষ। তারা রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, কবিতাবিদ, ধর্মবিদ, ইতিহাসবিদ। এখন এখানে এসেছে চিকিৎসাবিদ রওশন আলী।
চিকিৎসক রওশন আলী অবিবাহিত থাকলে মহল্লার যৌন নিরাপত্তার কারণে সে প্রথমে বিয়ে করে। বিস্ময় এ রকম যে সেউজগাড়ি মহল্লার একশত জন তরুণী তাকে বিয়ে করতে চায়। এ মহল্লার একটি পত্রিকা বিয়ে করতে ইচ্ছুক তরুণীদের সাক্ষাৎকার নিলে জানা হয় কেন একশত জন তরুণী তাকে বিয়ে করতে চায়।
—সে তো নদী পাড়ি দিয়ে এসেছে। নদী ভালো লাগে, তাই।
—সে তো সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসেছে। সমুদ্র ভালো লাগে, তাই।
—সে এতো লম্বা, জানে আকাশের খবর। আকাশ ভালো লাগে, তাই।
—সে এতো কথা জানে; আমার বর্ণনা কেবল সে-ই দিতে পারে। তাই।
—সে এতো ঘুম মানে, ঘুমের উদ্ধার সে-ই কেবল জানে। তাই।
—সে এতো বিষ মানে, বিষের উদ্ধার সে-ই কেবল জানে। তাই।
এতো সব সাক্ষাৎকার পড়ে শেষ না করা গেলে, শুধু সেই তরুণীটির কথা বলি, যাকে সে বিয়ে করে একটা মোমবাতি উপহার দিয়েছে। তার সম্বন্ধে আর কী কথা বলি, যখন তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না, কথা শোনা যাচ্ছে না। তরুণীটিকে বিয়ে করার পর রওশন আলী প্রথমে সে তরুণীটির ঘুম ও বিষ উদ্ধারের জন্য অনেকগুলো পোষাক পরিয়ে তার চেহারা ঢাকে অতঃপর তার কন্ঠ বন্ধ করে।
খ্যাতি বা অখ্যাতির কারণ বেশিরভাগ সময় বোঝা না গেলেও জানা হয় রওশন আলীর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে এক গল্প থেকে আরেক গল্পে। গল্পের চেয়ে আর কি-ই-বা ছড়াতে পারে মানুষের খ্যাতি। আর কথা এই যে, রওশন আলীর সকল কথা আত্মজীবনীমূলক।
সে বলে সঠিক ভাবে বীজ সংরক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বীজেই আছে সকল ভবিষ্যত। প্রতিটি ভালো বীজে জমা থাকে সঠিক মাত্রার ঘুম ও সঠিকমাত্রার বিষ।
সূর্য ওঠে, সূর্য নামে। সেউজগাড়ির লোকজন সূর্যের ওঠা-নামাকে দিন বলে, সপ্তাহ বলে, মাস বলে, বছর বলে। পার হয় দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর। রওশন আলী পার হয় স্ত্রী, পার হয় এক পুত্র, এক কন্যা। সেউজগাড়ীতে সে জমি কিনেছে। ক্লিনিক দিয়েছে। এতোদিন পর লোকজন ভুলে গিয়েছে কী কারণে রওশন আলী সেউজগাড়ীতে এসেছিল। সে এখন শিশু চিকিৎসক। শিশুদের সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সে সঠিক মাত্রার ঘুম ও বিষ সংরক্ষণ করতে চায়। সবাই তার এই চিন্তার সংগে একমত হয়। সে ধানের গল্প বলে। নানা রকম ধান ও ধানের জমি সে দেখেছে। সে ধানবীজ সংরক্ষণের গল্প বলে। সে বলে সঠিক ভাবে বীজ সংরক্ষণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বীজেই আছে সকল ভবিষ্যত। প্রতিটি ভালো বীজে জমা থাকে সঠিক মাত্রার ঘুম ও সঠিকমাত্রার বিষ। শিশুরা তো বীজ।
৪.
রাত কতোদিন বাঁচে? কতোদিন তার পাহারার প্রয়োজন হয়? এই দুই প্রশ্নের পর স্মরণ করি দীর্ঘদিন পর দু’জন বামন, দুই পেঁচা, দুই বাঁশির কথা। তারা রাত পাহারায় আছে এখনো। তাদের চাকুরি আছে। তাদের চাকুরি আছে এটা অনেকে ভুলে গেলে তারা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় তাদের চাকুরির কথা।
রাত্রির ভেতর তারা এতো রাত কী পাহারা দিয়েছে? রাত্রির সাপসমূহ, স্বপ্নসমূহ, বিষসমূহ, এবং যে সাপসমূহ তারাপুঞ্জ হয়। উপরে ওঠে, নিচে নামে না। চাঁদসমূহ হয়। উপরে ওঠে, নিচে নামে না। এই পাহারাদারেরা কি নামাতে চায় তারাসমূহ, চাঁদসমূহ।
পাহারা দিতে দিতে তাদের আজ রাতে দেখা হয় দিদার ফকিরের সংগে। সেউজগাড়ির মহল্লার একমাত্র ভিখারী সে। সে ঘুমায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ এর নিচে, নর্দমার গন্ধের নিচে, রাতের লেজের নিচে। সেকি সেউজগাড়ির ভাষা জানে। সেকি সেউজগাড়ির নিয়ম মানে। সেকি জানে তারা ছয়জন সেউজগাড়ির রাত্রির পাহারাদার।
পাহারা দিতে দিতে তাদের আজ রাতে দেখা হয় দিদার ফকিরের সংগে। সেউজগাড়ির মহল্লার একমাত্র ভিখারী সে। সে ঘুমায় কুকুরের ঘেউ ঘেউ এর নিচে, নর্দমার গন্ধের নিচে, রাতের লেজের নিচে। সেকি সেউজগাড়ির ভাষা জানে। সেকি সেউজগাড়ির নিয়ম মানে। সেকি জানে তারা ছয়জন সেউজগাড়ির রাত্রির পাহারাদার। রাত নিজেই কথা বলতে চাইলে বামন দু’জন, পেঁচা দু’টো, বাঁশি দু’টো বসে দিদার ফকির যেখানে বসে আছে সেখানে। দিদার ফকিরকে বামন দু’জন জিজ্ঞেস করে সেকি সারারাত জেগে থাকে। দিদার ফকির হ্যাঁ বললে তারা জিজ্ঞেস করে সে সারারাত ঘুমায় না কেন। দিদার ফকির বলে সে রাতের পাহারাদার। এ কথায় তারা বিস্মিত হয়, চমকে যায় এবং ভয় পায়। কারণ সেউজগাড়ির রাতের পাহারাদার তো তারা। তাদের জীবিকার উপায় রাত পাহারা দেয়ার চাকুরি।
এক ফোঁটা শিশির পড়ে কিংবা কয়েক ফোটা, দিদার ফকিরের কথা থেকে। এরপর দিদার ফকির তার লম্বা চুল দেখায়। তার লম্বা চুল যেনো আরেকটি দিদার ফকির। এতো লম্বা চুল কারো হতে পারে আগে জানেনি বামনেরা। তার কালো চুলকেই এখন রাত মনে হয়, সেউজগাড়ির রাত। যে রাতের কোথাও আছে সেউজগাড়ির ঘুম, সেউজগাড়ির বিষ। দিদার ফকিরের চুল এতোদিন তারা দেখতে পায়নি কিংবা বলা উচিত দিদার ফকিরকেই তারা দেখতে চায়নি। আজ রাতে দিদার ফকির আগ্রহের দৃশ্য হয়। তাকে তাদের ভয় লাগে। তারা এখন বিভ্রান্ত এই যে তারা কি রাত চিনেছে। দিদার ফকির কি নিজেই রাত, কিংবা তার চুল, কিংবা অন্য কিছু। রাত না চিনলে কিভাবে তারা পাহারা দিয়েছে রাত। দিদার ফকির বলছে সে রাতের পাহারাদার। যদি সে রাতের পাহারাদার তবে তাদের চাকুরি কী? রাতের পাহারাদার কে, সে মীমাংসায় তারা যেতে চায় না। তারা শুনতে চায় দিদার ফকিরের কথা।
টুপটাপ কথা ঝরে। শিউলির মতো। এই ঝরে পড়া শিউলি ফুল পথ তৈরি করে। অজানা পথ, অচেনা পথ। সে পথে কি রাত বাস করে, ঘুম বাস করে, বিষ বাস করে। যেতে থাকে দিদার ফকিরের কথা, দিদার ফকিরের কথা যেদিকে যায় বামনেরা সে দিকে যায়। কে দেয় পাহারা এ পথ। দিদার ফকির জানায় এ মহল্লার রাত প্রথম যখন বিপদগ্রস্থ হয় তখন থেকেই সে এ মহল্লার রাতের পাহারাদার। রাতের সকল পলায়নের সাক্ষী তার চুল। আজ সন্ধ্যায় একজন কিশোরী ধর্ষিত হবার পর বেণী খুলে গেলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে রাতের জমে থাকা সকল ইতিহাস, কবিতা, গল্প, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি। বামনেরা দেখে দিদার ফকিরের লম্বা চুল থেকে বেরিয়ে আসছে তাদের না জানা রাত। দেখতে দেখতে দেখা শেষ না হলে হারিয়ে যায় তারাপুঞ্জ, চাঁদ সমূহ। কারো বাড়িতে একটা মোরগ জীবিত থাকলে সে সূর্যোদয় ঘটায়।
৫.
রওশন আলীর ক্লিনিকে অনেকগুলো পুলিশ। সেউজগাড়ির শিশুর সংখ্যা কমতে থাকলে সন্দেহ হয় শিশু চিকিৎসক রওশন আলীর উপর। পুলিশের কাছে ফোন যায়। ফোন করে একজন মা— শিশু লুপ্ত। ফোন করে আরেকজন মা— শিশু লুপ্ত। বিদ্যালয়ে শিশুশূন্যতা; খেলার মাঠে শিশুশূন্যতা। শিশুরা কোথায়। শিশুদের সন্ধানে পুলিশের দল ব্যর্থ হলে গতরাতে তাদের দেখা হয় দিদার ফকিরের সংগে। দিদার ফকিরের চুল থেকে গল্প বের হওয়ার সময় তারা একটা গল্প অনুসরণ করে পৌঁছে যায় শিশু সমাধিক্ষেত্রে। তারা সে সমাধিক্ষেত্রে আবিষ্কার করে অজস্র শিশুর কংকাল। তারা ঘুম হারিয়ে বিষ হারিয়ে গড়াতে গড়াতে চলে গেছে সমাধি ক্ষেত্রে। যদিও পুলিশেরা বোঝে না ঘুম হারালে, বিষ হারালে কেন শিশুরা কংকাল হয়ে সমাধিক্ষেত্রে যায়।
৬.
রওশন আলীর ডাক্তারি সনদপত্র দেখতে চায় পুলিশ। রওশন আলী সনদপত্র দেখায়। কিন্তু কথা এ রকম যে রওশন আলীর চিকিৎসা বিষয়ক সকল সনদপত্র নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ। সে সময় সেউজগাড়ির নামহীন মানুষেরা রওশন আলীকে ঘুমচোর ও বিষচোর বলে। যার ঘুমচুরি ও বিষচুরির কারণে সেউজগাড়ি শিশুহীন হয়ে পড়েছে।
রওশন আলী জেলে যাবার পর সেউজগাড়ির সমস্ত লোকের সনদপত্র সনাক্তকরণের একটা আদেশ আসে। এই কথা এরকম যে, সেউজগাড়ির সবার নানা রকম সনদপত্র আছে। জন্মানোর জন্য জন্ম সনদ, রাজনীতির জন্য রাজনীতি সনদ, অর্থনীতির জন্য অর্থনীতি সনদ, ধর্মনীতির জন্য ধর্মনীতি সনদ, সাহিত্যের জন্য সাহিত্য সনদ, সন্ত্রাসের জন্য সন্ত্রাস সনদ, ধর্ষণের জন্য ধর্ষণ সনদ, চাকুরির সনদ। রওশন আলির সনদ নকল প্রমাণিত হওয়ার পর এখন বিবেচনা ও আদেশ এই যে সেউজগাড়ির সবাইকে প্রমাণ করতে হবে তাদের কাছে আসল সনদপত্র আছে।
এবার নিজেরা নিজেদের সনদ পরীক্ষা করার জন্য তাকায় নিজেদের সনদের দিকে। একজন তো জন্মেছিল সেউজগাড়িতে— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো কবি ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো ধার্মিক ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো অর্থনীতিবিদ ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো প্রশাসক ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো রাজনীতিবিদ ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ। একজন তো, একজন তো— মেয়াদোত্তীর্ণ, মেয়াদোত্তীর্ণ। এ সকল সনদ তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছিল।
সেউজগাড়ীর সবাই মোমবাতি নিয়ে নিজ নিজ বনে যায়, নিজ নিজ বৃক্ষের শিকড় খুলে নিজ নিজ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। এখন রাত। যে রাত পাহারা দেয়ার জন্য তারা দু’জন বামনকে, দু’টা পোঁচাকে, দু’টা বাঁশিকে পাহারাদার নিয়োগ করেছিল। তারা আরও স্মরণ করে তারা পাহারা দিতে চেয়েছে তাদের রাত, তাদের ঘুম, তাদের বিষ। এই রাত কী? এই ঘুম কী? এই বিষ কী? তারা জানে অথবা জানে না, বলবে না তারা। এবার নিজেরা নিজেদের সনদ পরীক্ষা করার জন্য তাকায় নিজেদের সনদের দিকে। একজন তো জন্মেছিল সেউজগাড়িতে— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো কবি ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো ধার্মিক ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো অর্থনীতিবিদ ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো প্রশাসক ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ; একজন তো রাজনীতিবিদ ছিল— মেয়াদোত্তীর্ণ নকল সনদ। একজন তো, একজন তো— মেয়াদোত্তীর্ণ, মেয়াদোত্তীর্ণ। এ সকল সনদ তাদেরকে নিরাপত্তা দিয়েছিল।
একজন অন্ধ মানুষ। সেউজগাড়ির একমাত্র অন্ধ মানুষ নিজস্ব সনদ খুঁজে না পেলে সে বলে মেয়াদোত্তীর্ণ নকল নিরাপত্তার কথা। ঠক, ঠক। লাঠি।
বাঁশি বাজে। সেউজগাড়ির রাত, ঘুম, বিষ পাহারা দিচ্ছে দু’জন বামন, দু’টা পেচাঁ, দু’টা বাঁশি। দিদার ফকিরের চুল রাতের সমান দীর্ঘ হলে ঠকঠক করে লাঠি হাতে তাদের পিছনে পিছনে আছে দিদার ফকির।
জন্ম ১৯৬৮, কুষ্টিয়ায়। বর্তমানে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। লেখেন বিভিন্ন লিটলম্যাগে। সম্পাদিত লিটলম্যাগ : নিজকল্পা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : জল আসে মানুষের দীঘিতে, মানচিত্রকর, আমাদের গ্রামে একটা পাখিচোর আছে, বিড়াল পোষা প্রতিবেশিনীরা, কোথায় কোথায় ঘুমিয়েছিলাম এবং মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ। উপন্যাস : কেউ মরছে না ।