বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

মোস্তফা হামেদীর কবিতা

0

সুর

যখন নিভে গেল হারকেনের আলো
তাকে স্পষ্টই দেখতে পেলাম
চাঁদের ঠিক নিচে
করমচা গাছের ছায়ায়—

বাগানের সমস্ত পাতারা জিকিরে রত
বাতাসে লেগে লেগে সে ধ্বনি বহুদূর ছড়ানো
টের পাই আমার ভেতরে
কারো গুনগুন;

পুকুরের স্বচ্ছ প্রদাহ ভেঙে কুচা চিংড়ি
যেভাবে হেঁটে যায় শব্দরহিত,

এমন নিষ্কম্প সময়ে

স্নায়ুভেজা কিছু হাওয়া, কিছু আলো, কিছু সুর
বয়ে এনেছে রাতের মুশায়েরা।

পন্টুনে

দুটি জাহাজের মাঝখানে বৃষ্টি হচ্ছে
পানিরা গায়ে গায়ে লেগে ফুলে উঠছে খুব
সেই ফাঁক ধরে দাঁড়িয়ে আছি
বাকরহিত খুঁটির মতোন;

মূক নগরীর তটে
এক স্মিতবাক পাখি বিমূঢ় হয়ে আছে
কুলিরা-মাঝিরা তামাশা দেখেছে কেবল
পন্টুনে দুপুরের ঘুম দীর্ঘায়িত—

ছোট ছোট ঢেউ হাত বুলিয়ে চলেছে পিঠে
ভেবেছি, এক স্বর্ণতোয়া নদী
কোথাও বেয়ে যায়

আমাদের অভীপ্সার লাল ফুলকা ছুঁয়ে ছুঁয়ে

আভা

মৃত ফুলের ঝাড় থেকে খসে পড়ছে রোদ
এক অনুক্ত দুপুর
মেঘে নিপাট হয়ে আছে;
আমি তার সঙ্গী হই—

এক হতশ্রী গাছের মতো বিগত গানগুলো
গেয়ে চলেছি
ডুবে থাকা বিল কিছু ধ্বনির যোগান দিয়ে যায়,

যখন মন্দ্র মুহূর্ত
ছিন্ন কোনো ঋতু ফুরিয়ে এসেছে এখানে,

যেন খসা ফল
স্রোতে বহুদূর ভেসে গেল;

তার আভাটুকু লেগে আছে এই এখানে—
পাতায়, ডালে, স্মরণঘরের গোলায়।

পরাগ

এই কন্দমূল, গোল গোল পাতা, উজ্জীবনী কোনো সুরে ঘন হয়ে থাকা—
পয়মন্ত কোনো ঋতুর গান।

পরাক্রম লোককথায় মাথা ডোবানো হাঁস—খুঁজে চলে রূপময় মোটিফ।

মহলে মহলে বেজে ওঠে রাগ। ওস্তাদেরা আঙুলে ছড়িয়ে দেন পরাগ।

সুরকণা ভেঙে ভেঙে গড়া এ দেহ।—ঘ্রাণ!

ফিনফিন বয়: ছড়ায়-জংলায়।

তুলে আনি, ডাল নোয়ায়ে ফুল, যেন কেউ রাখে মনে,

সহসা রঙিন হয় গাছ। ঘর থেকে ঘরে, ইত্যবসরে গাঁথা হয় আলো। ঝলমলো—

ঝালরের নিচে গুনগুন আওয়াজ। পাখিকুঞ্জের পাশে যেমন শোনা যায়।
এলো, সহস্র সহচরসহ সাধু।

হলো, গভীর কোনো রান্ধন।
চুলায় বাসনা ওড়ে, বাসনা পুড়িয়ে পুড়িয়ে, কারা যে পেরিয়ে গেলো বন—

আলোক রেখার মতো তারা আচমকাই এসেছিল এই কন্দমূল অধ্যুষিত, এই বহুভঙ্গিম গ্রামে।

সমাধি

ঝুপ করে সে লুকিয়ে পড়লো।
দৃশ্যের সমাধিতে হরিৎ ছায়া।
কাঁপাকাঁপা আলোর কণায় ঝিলমিল ধুলি।
ডাকছে হালের পশু।

আদিম গৃহস্থবাসের পাশে ফুটে আছে
ভুঁইচাপা ফুল, মনোভঙ্গির অনুরক্ত হয়ে।
যে ঘ্রাণ চাই তা এ রকম:

ধ্বনি ও রঙে ধোয়া,

গড়িয়ে চলেছে কোনো ফুলের স্মৃতি
বাসনাবাগান বেয়ে

তারে দেখি নাই
দেখার চেয়ে সে বেশ দর্শনীয়।

হৈম রাগ

এসব হেমন্ত কোথায় ফুটেছে?
কাঁচা হলুদে মাখা;

সেই ডালটিকে নাড়িয়ে দেখি
তট ঘেঁষে যে বেঁকে আছে,

যেন কোনো প্রসারিত হাত
ভেসে থাকা মাছটির ঘ্রাণ ছুঁয়ে
ডেকে এনেছিল মন্দ মন্দ আলো;

ঝোল ঝোল সালুনের ভাঁপে
ঝুপড়ি ঘরের পাশে ছিটকে এসেছে
চূর্ণ কোনো হৈম রাগ,

মন্থরতর দিন
হেলে আছে সবজি চাষের লোলে।

মোহ

সেই পথটা খোলা হলো।

গাছের প্রাচীন ঝাড় বেয়ে যে সরীসৃপ শুয়ে আছে, তার গায়ে রোদ জ্বলছে।

বহুদূর থেকে দেখছি। ফুলের বর্ণিলতার ফাঁকে সেই আলো কেমন মোহ ছড়িয়ে যায়!

যেতে হবে পা টিপে টিপে। পঁচা পাতার গন্ধ গায়ে মেখে।

সমূহ সৌরভ কোথাও ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। তার দিকে ধেয়ে চলেছি।

ঋজু কোনো গাছ উচ্চতার ধারণায় দণ্ডায়মান।
ঘাসের মাথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটা অপার ছাগশিশু তাকে ঘিরে নেচে ওঠে।

দুপুরের প্রলম্বিত শরীরে বিছিয়ে দিয়েছি ধ্যান।

আলো নিভে আসে। আর ফুটে ওঠে সান্ধ্য লিপিতে ঘনবদ্ধ গান।
পাপড়ি ছিঁড়ে ছিঁড়ে হাওয়া সে সমস্ত বিলিয়ে চলে…

শরণার্থী

সমস্ত সংসার ভ্যানে তুলে আকাশের নিচে দাঁড়াই

রোদ তেরচা হয়ে পড়ছে

শূন্যে ভাসমান এই মৃদু ঢেউয়ের ওপর
মনে হয় এই এখুনি তলিয়ে যাব

গড়িয়ে চলেছে টায়ারের সরু চাকা
পুলসিরাত পার হচ্ছে যেন
পিছনে স্মৃতির কুঠুরি
শূন্যতার গমগমে বেজে চলা পাখোয়াজ

অরূপের পথে মৃদু পদস্পন্দ

চিরকালীন শরণার্থীর মতো কোথাও জানটুকু
কোথাও ছোট এক ভ্যান
সঙ্গে চলেছে…

দুর্লক্ষ্যে

সামনে কিছু নাই—
এমনভাবে শুরু হলো সব
একটা হাওয়াই যানের উপর সব চাপিয়ে দিয়ে
—দুর্লক্ষ্যে;

জলপাই গাছের নিচে চাকভাঙা পথ
কেবল খুঁড়িয়ে হাঁটা যায়—

শামুকের খোল ভেঙে মাংস ছাড়ানোর মতো
খুঁড়ে চলেছি একেকটা পথ

প্রহর গড়িয়ে পড়ছে শিউলিপাড়ের মাঠে—

দুই-একটা ফুল কুড়াই

একটা নিরাসক্ত বাছুর জিভ চাটছে

বহুদূর ছড়ানো বিচালির ঘ্রাণ এখানের হাওয়ায়

একটু একটু করে ভাঙ্গছি পথ
জমানো থেকে খরচা করার মতো—

পূর্ণ হতে হতে একদিন ফুরিয়ে যায়
পৌঁছানোর পর মনে হয় শুরুই করি নি।

কৌমুদী

সমুদ্র কত দূর?

নদীতে বইতে থাকা জোছনার জোয়ারে মুখ ভিজিয়ে মনে হয়,
বালিয়াড়ির বিস্তৃত শূন্যতায় হাওয়া বয়ে চলেছে দূর দেশের দিকে

সেখানে ভিন্ন কোনো গ্রাম,
তাদের বাচনভঙ্গির দুর্ভেদ্য ইশারার মতো নড়ে ওঠে ধু ধু লণ্ঠন
রাতের জঙ্ঘার ভিতর সাঁতরে চলেছে
এক নিশি রাজহাঁস—
তার পিঠে
যেন কোনো কৌমুদী
ধীবরের শরীরের ঘ্রাণে মোদিত—

যাত্রাপথ সরু হয়ে আসে
কোথাও কিছু দেখা যায় না

হাতলের লোহার উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়,
এই স্টিমার পৌঁছাবে না মঞ্জিলে
ভেসে ভেসে যাবে মহিষের দুধের ধারায়
বিস্মৃতির বহতা গ্রামে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম  ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি. চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে নোয়াখালীর সরকারি মুজিব কলেজে বাংলা বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন পার করছেন। প্রকাশিত বইসমূহ: মেঘ ভবঘুরে খরগোশ [কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫], তামার তোরঙ্গ [কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮], জড়োয়া [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯], শেমিজের ফুলগুলি [কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০]

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।