শুক্রবার, নভেম্বর ২২

মোস্তাক শরীফ অনূদিত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প : মন্তিয়েলের বিধবা বউ

0

গল্পটি ইংরেজিতে ভাষান্তর করেছেন জে. এস. বার্নস্টাইন। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ছোটোগল্পের সংকলন ‘বিগ মামা’স ফিউনারেল’ (Los funerals de la Mama Grande)। `মন্তিয়েলের বিধবা বউ’ (La Viuda de Montiel) গল্পটি এ সংকলনেরই অংশ। জে. এস.বার্নস্টাইনের ইংরেজি অনুবাদে গল্পটি স্থান পেয়েছে মার্কেসের ছোটোগল্পের সংকলন ‘কালেক্টেড স্টোরিজ’ (পেঙ্গুইন)-এ। স্বৈরশাসকের সহযোগী, দুর্নীতিবাজ হোসে মন্তিয়েলের মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীর মানসিক যাতনা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহই গল্পটির উপজীব্য। ১৯৭৯ সালে এ গল্পের ওপর ভিত্তি করে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেন ম্যাগুয়েল লিটিন, ত্রিশতম বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শত হয় যেটি।


হোসে মন্তিয়েলের মৃত্যুর পর তার বউ ছাড়া সবারই মনে হলো যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে, যদিও সে যে সত্যিই মরেছে এটা বিশ্বাস করতে ঘণ্টাকয়েক লাগল সবার। ভয়ংকর রকমের গরম ঘরটায় বালিশ আর লিনেনের পর্দায় ঠাসা তরমুজের মতো গোল কানাওয়ালা হলুদ কফিনে শোয়া মরা লোকটাকে দেখার পরও ঘটনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল কেউ কেউ। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো, পরনে সাদা পোশাক, পায়ে চকচকে মসৃণ চামড়ার জুতো— এমন জবরদস্ত দেখাচ্ছিল তাকে যা জ্যান্ত থাকতেও কখনও দেখায়নি। ফি রোববার আটটা বাজে প্রার্থনার সময় গির্জায় হাজির হওয়া সেই চিপ মন্তিয়েলই, তফাৎ বলতে তখন তার হাতে ধরা থাকত ক্রুসদণ্ড আর এখন ঘোড়দৌড়ের চাবুক। স্ক্রু দিয়ে কফিনের ঢাকনা এঁটে পারিবারিক সমাধিমন্দিরের চারদেয়ালে তাকে আটকে ফেলার পরই কেবল শহরের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল, মরার ভান নয়, আসলেই মরেছে লোকটা।

ফি রোববার আটটা বাজে প্রার্থনার সময় গির্জায় হাজির হওয়া সেই চিপ মন্তিয়েলই, তফাৎ বলতে তখন তার হাতে ধরা থাকত ক্রুসদণ্ড আর এখন ঘোড়দৌড়ের চাবুক। স্ক্রু দিয়ে কফিনের ঢাকনা এঁটে পারিবারিক সমাধিমন্দিরের চারদেয়ালে তাকে আটকে ফেলার পরই কেবল শহরের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল, মরার ভান নয়, আসলেই মরেছে লোকটা।

কবর দেওয়া হয়ে যাবার পর মন্তিয়েলের বউ ছাড়া বাকি সবার কাছে যে ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো তা হচ্ছে অপঘাতে নয়, স্বাভাবিকভাবেই মরেছে হোসে মন্তিয়েল। সবাই যেখানে আশা করেছিল চোরাগুপ্তা হামলায় পিঠে গুলি খেয়ে মরবে, কেবল তার বউ-ই নিশ্চিত ছিল বুড়ো থুত্থুরে হয়ে বিছানায় মরবে তার মরদ, পাদ্রির কাছে অপরাধ কবুল করে, ব্যথাবেদনা ছাড়া, হাল জামানার কোনো সাধুসন্তের মতো। দু-একটা ব্যাপারেই কেবল আন্দাজ মিলল না তার। হোসে মন্তিয়েল মারা গেল দোলবিছানায় শুয়ে, ১৯৫১-র আগস্ট মাসের দুই তারিখ বেলা দুটোয়, খেপে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাওয়ার কারণে, কড়া মানা ছিল যা ডাক্তারের। বউ আশা করেছিল গোটা শহর এসে ভেঙে পড়বে তার স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, মানুষের আনা ফুল রাখার জায়গা হবে না ঘরে। ঘটনা হলো, তার দল আর ধর্মীয় সংঘের সদস্যরাই কেবল এলো আর একমাত্র ফুলের তোড়াটি জমা পড়ল পৌরসভার তরফ থেকে। জার্মানিতে বাণিজ্য দূতের পদে থাকা হোসে মন্তিয়েলের ছেলে আর প্যারিসে থাকা দুই মেয়ে তিন পাতার টেলিগ্রাম পাঠাল। বোঝা যাচ্ছিল টেলিগ্রামগুলো দাঁড়িয়ে লেখা, টেলিগ্রাফ অফিসের অঢেল কালি ব্যবহার করে, এ-ও বোঝা যাচ্ছিল মগজ হাতড়ে বিশ ডলারের সমপরিমাণ শব্দ খুঁজে বের করার আগে টেলিগ্রামের অনেকগুলো ফর্ম ছিঁড়তে হয়েছে তাদের। বাড়িতে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়নি কেউই। সে রাতে, বাষট্টি বছর বয়সে, তাকে সুখী করা মানুষটি যে বালিশে মাথা দিত সে বালিশে চোখের জল ফেলতে ফেলতে মন্তিয়েলের বিধবা বউ এই প্রথমবারের মতো বুঝল কষ্ট কাকে বলে। সারাজীবন তালা মেরে ঘরে বসে থাকব, নিজেকে বলল সে, যেন হোসে মন্তিয়েলের বাক্সে আমাকেও ভরে রেখেছে তারা! দুনিয়া সম্বন্ধে আর কিছু জানার ইচ্ছে মরে গেছে। কোনো ভানভণিতা না জানা, টোকা দিলেই ভেঙে পড়ার মতো সেই মহিলার হৃদয় ছিল কুসংস্কারে বিদীর্ণ, বাস্তবতার সঙ্গে যার প্রত্যক্ষ যোগ ঘটেনি কখনো। কুড়ি বছর বয়সে বাবা মা-র ইচ্ছেয় বিয়ে হয়েছিল তার ফুট তিরিশেকের মধ্যে আসার অনুমতি ছিল এমন একমাত্র পাণিপ্রার্থীর সঙ্গে।

স্বামীর শরীর ঘর থেকে নিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সে বুঝল, শক্ত হতে হবে, যদিও কী করবে তার কোনো দিকদিশা পেল না। কেবল এটি বুঝল, শুরু করতে হবে একেবারে শুরু থেকে। হোসে মন্তিয়েল অগুনতি যে রহস্য নিয়ে কবরে গেছে তার মধ্যে একটি হলো তার সিন্দুক খোলার সূত্রটি। সমস্যাটি সুরাহার উদ্যোগ নিল শহরের মেয়র। উঠোনে, দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে সিন্দুকটা রাখার হুকুম দিল সে, দুজন পুলিশ গুলি চালাতে শুরু করল সিন্দুকের তালায়। মেয়রের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক গুলির চাপা শব্দ শোবার ঘরের জানালা থেকে সারা সকাল শুনল বিধবা।

আর কী বাকি থাকে এরপর! ভাবল বিধবা। পাঁচ বছর ধরে খোদার কাছে আর্জি জানালাম গোলাগুলি বন্ধ হোক, এখন আমার বাড়িতেই গুলি চালানোর জন্য ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে কয়েকটা লোককে।

আর কী বাকি থাকে এরপর! ভাবল বিধবা। পাঁচ বছর ধরে খোদার কাছে আর্জি জানালাম গোলাগুলি বন্ধ হোক, এখন আমার বাড়িতেই গুলি চালানোর জন্য ধন্যবাদ জানাতে হচ্ছে কয়েকটা লোককে।

সেদিন প্রাণপণ চেষ্টা চালাল সে মৃত্যুকে ডেকে আনার কিন্তু জবাব এলো না কোনো। ঘুমিয়ে পড়ছিল, এমন সময় পিলে চমকানো একটা বিস্ফোরণের শব্দ বাড়ির ভিত পর্যন্ত নাড়িয়ে দিল। সিন্দুকের ওপর ডিনামাইট ফাটাতে হয়েছে লোকগুলোকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল মন্তিয়েলের বিধবা বউ। টানা বৃষ্টিতে ভরা অক্টোবর মাসটা শেষ হবে না মনে হচ্ছে। যেন দিশে হারিয়ে ফেলেছে, হোসে মন্তিয়েলের চোখ ধাঁধানো তবে অগোছালো বাড়িতে বেতালের মতো ঘুরে বেড়াল। কারমাইকেল নামে পুরনো আর পরিশ্রমী এক বন্ধু মন্তিয়েলের তালুক দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে।

সত্যিই আর নেই স্বামী, অবশেষে এই বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হবার পর বাড়ি দেখভালের জন্য শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো বিধবা। সাজসজ্জা সব সরিয়ে নিল, আসবাবগুলোকে ঢেকে দিল শোকের রঙে, দেয়ালে ঝোলানো মৃত মানুষটির ছবিতে ঝুলিয়ে দিল অন্ত্যেষ্টির ফিতে। স্বামীর শেষকৃত্যের পর গেল দু’মাসে নখ কামড়ানোর অভ্যাস হয়েছে তার। বাড়াবাড়ি রকমের কান্নাকাটিতে একদিন চোখ এতটাই লাল হলো আর ফুলে গেল যে সে ঠাহর করল, খোলা একটা ছাতা হাতে নিয়ে কারমাইকেল ঢুকছে বাড়িতে।

‘ছাতাটা গোটান, কারমাইকেল সাহেব,’ সে বলল। ‘একটার পর একটার গজবের পর আপনার খোলা ছাতা নিয়ে বাড়িতে ঢোকাটাই কেবল বাকি ছিল!’

ছাতাটাকে এক কোণায় রেখে দিলেন কারমাইকেল। বুড়ো এক নিগ্রো তিনি। চকচকে ত্বক, সাদা পোশাক, পায়ের গেঁজের চাপ কমানোর জন্য ছুরি দিয়ে জুতোর এখানে ওখানে ছোটো ছোটো খাঁজ কাটা। ‘কেবল শুকানোর সময়টাতেই খোলা রাখি ছাতা।’

স্বামীর মৃত্যুর পর এই প্রথম জানালা খুলে দিল বিধবা।

‘এমন বদনসিব, তার ওপর এই শীত!’ বিড়বিড় করল সে, নখ কামড়াচ্ছে। ‘ভাবগতিকে মনে হচ্ছে আকাশ আর পরিষ্কার হবে না।’

‘আজকালের মধ্যে হবে না,’ কারমাইকেল বললেন। ‘গেঁজের জ্বালায় ঘুমাতে পারিনি কাল রাতে।’

কারমাইকেল সাহেবের গেঁজের আবহাওয়াসংক্রান্ত পূর্বাভাসে আস্থা আছে মন্তিয়েলের বিধবার।

ছোটো, জনশূন্য চত্বর আর ঝিম মেরে থাকা ঘরবাড়িগুলোর কথা ভাবল সে, হোসে মন্তিয়েলের শেষকৃত্য দেখার জন্য খোলেনি যার দরজাগুলো।

ছোটো, জনশূন্য চত্বর আর ঝিম মেরে থাকা ঘরবাড়িগুলোর কথা ভাবল সে, হোসে মন্তিয়েলের শেষকৃত্য দেখার জন্য খোলেনি যার দরজাগুলো। ভীষণ হতাশ বোধ করল সে— নিজের নখ নিয়ে, বেশুমার সয়-সম্পত্তি নিয়ে এবং স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া হাজারও বাধ্যবাধকতা নিয়ে যা সে কখনোই পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারবে না।

‘ভুল সবই ভুল,’ ফুঁপিয়ে উঠল বিধবা।

বাড়িতে তার সঙ্গে যারা দেখা করতে এসেছে তাদের ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে পাগল হয়ে গেছে সে। কিন্তু এখনকার চেয়ে সুস্থির সে আর কখনোই ছিল না। রাজনৈতিক খুনোখুনি শুরু হবার আগে থেকেই নিজের ঘরের জানালায় বসে অক্টোবরের সকালগুলো কাটাত সে; মৃতদের প্রতি সহানুভূতি বোধ করত আর একথা ভাবত যে রোববারে বিশ্রাম না নিলে খোদা হয়তো দুনিয়া তৈরির কাজটা আরও ভালোভাবে শেষ করতে পারতেন, এখানে সেখানে যে দু-একটা ফ্যাঁকড়া রয়ে গেছে ঠিক করতে পারতেন সেগুলো। বিশ্রামের জন্য তো অনন্তকাল পড়ে ছিল!
স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র যে পরিবর্তনটা এসেছে বলে মনে হয়, এ ধরনের বদচিন্তার জন্য সুনির্দিষ্ট একটা কারণ তৈরি হয়েছে তার।

এভাবেই, মন্তিয়েলের বিধবা বউ যখন দিগদারিতে নিজেই নিজেকে ভাজাভাজা করছিল, কারমাইকেল সাহেব তখন আসন্ন সর্বনাশ ঠেকাতে গিয়ে পেরেশান হচ্ছিলেন। অবস্থা সুবিধের নয়। হোসে মন্তিয়েল, যে কিনা গা জোয়ারি করে এলাকার সব ব্যবসাবাণিজ্য দখল করেছিল, তার দিক থেকে আর কোনো বিপদের ভয় না থাকায় প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে শহরের মানুষ। আসা বন্ধ করে দেওয়া ক্রেতার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে উঠানে সার বেধে রাখা জগভর্তি দুধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মৌচাকে শুকিয়ে যাচ্ছে মধু, পনিরঘরের অন্ধকার আলমারিতে পড়ে থাকা পনির খেয়ে মোটাতাজা হচ্ছে পোকামাকড়।

বৈদ্যুতিক বাতি আর নকল মার্বেলে তৈরি দেবদূতের মূর্তিতে সাজানো সমাধিমন্দিরে শুয়ে ছয় বছরের খুন আর অত্যাচারের মাশুল গুনছে হোসে মন্তিয়েল। এ দেশের ইতিহাসে এত অল্প সময়ে এত টাকা বানায়নি আর কেউ। একনায়কের প্রথম মেয়র যখন শহরে এলো, হোসে মন্তিয়েল তখন সব সরকারের কড়া সমর্থক। নিজের ধানকলের সামনে অন্তর্বাস পরা অবস্থায় অর্ধেক জীবন কাটিয়েছে যে। কোনো এক সময় ভাগ্যবান আর ঈশ্বরভক্ত হিসেবে খ্যাতি ছিল তার, যেহেতু লটারি জিতলে গির্জায় সাধু জোসেফের প্রমাণ সাইজের একটা ছবি দান করবে বলে ওয়াদা করেছিল। ওয়াদা রক্ষার জন্য দু’হপ্তা পর ঠিকই মোটা অংকের পুরস্কার জিতল একটা। বিরোধীদের সবংশে নির্মুল করার পাকা হুকুম নিয়ে বর্বর আর ধূর্ত এক পুলিশ সার্জেন্ট নতুন মেয়র হয়ে শহরে আসার পরই জীবনে প্রথম জুতো পরতে দেখা গেল মন্তিয়েলকে। মেয়রের গোপন সংবাদদাতা হিসেবে নবযাত্রা শুরু করল সে। নধরকান্তি শরীরের সাধারণ সেই ব্যবসায়ী, যার নির্মল কৌতুক অস্বস্তি জাগাত না কারো মনেই, নিজের শত্রুদের ভাগ করেছিল ধনী আর গরিব— এ দুভাগে। গরিবদেরকে শহরের চত্বরে গুলি করে মারত পুলিশ আর ধনীদেরকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেওয়া হতো শহর ছাড়ার। দিনের পর দিন মেয়রের অফিসে দমবন্ধ করা গরমে বসে এসব হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা আঁটত হোসে মন্তিয়েল, ওদিকে গুলি খেয়ে মরা মানুষদের প্রতি সমবেদনা জানাত তার বউ। মেয়র অফিস থেকে চলে যাবার পর স্বামীর পথ আটকাত সে। ‘লোকটা একটা খুনী,’ সে বলত। ‘সরকারি দলে তোমার লোকজনকে বোঝাও, শুয়োরটাকে নিয়ে যাক এখান থেকে। শহরের একটা মানুষকেও বাঁচতে দেবে না সে।’

সে সময় বড্ড ব্যস্ত থাকত হোসে মন্তিয়েল, বউয়ের দিকে না তাকিয়েই একপাশে সরিয়ে দিত তাকে। বলত, ‘গর্দভের মতো কথা বলো না।’

সত্যি বলতে, গরিবদের মারা নয়, তার মূল কাজ ছিল ধনীদের এলাকাছাড়া করা। বুলেটের আঘাতে তাদের ঘরের দরজা ঝাঁঝরা করে তাদের শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চব্বিশ ঘন্টা সময় দিত মেয়র, হোসে মন্তিয়েল তখন তাদের জমিজমা আর গবাদিপশু কিনে নিত নিজের ঠিক করা দামে।

সত্যি বলতে, গরিবদের মারা নয়, তার মূল কাজ ছিল ধনীদের এলাকাছাড়া করা। বুলেটের আঘাতে তাদের ঘরের দরজা ঝাঁঝরা করে তাদের শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য চব্বিশ ঘন্টা সময় দিত মেয়র, হোসে মন্তিয়েল তখন তাদের জমিজমা আর গবাদিপশু কিনে নিত নিজের ঠিক করা দামে।

‘বোকামি করো না,’ বউ তাকে বলত। ‘এদের মদদ দিতে গিয়ে নিজেকেই শেষ করবে, অন্য কোথাও গিয়ে ক্ষুধায় মরবে না ওরা, তোমাকে ধন্যবাদও দেবে না কখনও।’

হোসে মন্তিয়েল, যার তখন এমনকি হাসারও সময় ছিল না, বউকে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বলত, ‘বেশি ভ্যাজর ভ্যাজর করো না, রান্নাঘরে যাও।’

বছর গড়ানোর আগেই বিরোধীপক্ষ কচুকাটা হয়ে গেল এবং হোসে মন্তিয়েল বনে গেল শহরের সবচেয়ে ধনী আর শক্তিশালী লোক। মেয়েদের প্যারিসে পাঠিয়ে দিল সে, ছেলের জন্য জার্মানিতে বাণিজ্যদূতের একটা পদের বন্দোবস্ত করল, মন দিল নিজের সাম্রাজ্যকে পাকাপোক্ত করায়। তবে বিপুল এই ধনসম্পদ উপভোগ করার জন্য বছরছয়েকও বাঁচল না বেচারা।

তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী গড়ানোর পর যতবারই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনল বিধবা প্রতিটিই কোনো না কোনো দুঃসংবাদের সুবাদে। প্রতি সন্ধ্যায় কেউ না কেউ ঠিকই হাজির হতো। ‘আবারও ডাকাতের দল,’ তারা বলত। পঞ্চাশটা বকনা বাছুরের একটা পাল নিয়ে চলে গেছে গতকাল। দোলচেয়ারে নখ কামড়াতে কামড়াতে নিশ্চল বসে মনের মধ্যে গুমরাতে থাকা নৈরাশ্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল বিধবা।

‘তোমাকে বলেছিলাম হোসে মন্তিয়েল,’ নিজেকেই নিজে বলছিল, ‘নিমকহারাম শহর এটা একটা। কবরে এখনও শরীরটা ঠিকমতো ঠান্ডা হয়নি, এরই মধ্যে গোটা দুনিয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তোমার দিক থেকে।’

বাড়িতে ফিরল না কেউই। বৃষ্টিহীন, চরম একঘেয়ে এ ক’টা মাসে একমাত্র যে মানুষটার চেহারা দেখল, সে হচ্ছে চরম ধৈর্যশীল ডন কারমাইকেল, যে কখনোই বন্ধ ছাতা নিয়ে বাড়িতে ঢোকেনি। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি কোনো। মন্তিয়েলের ছেলের কাছে একের পর এক চিঠি লিখেছে ডন কারমাইকেল। পরামর্শ দিয়েছে দেনদরবারের দায়িত্বটা তাকে, অর্থাৎ কারমাইকেলকে দেওয়ার জন্য, একইসঙ্গে বিধবার ভালোমন্দ দেখার ভারও। এটা সেটা বলে সবসময়ই এড়িয়ে গেছে ছেলে। শেষে খোলাখুলিই জানিয়েছে ফিরলে গুলি খেতে পারে, কাজেই ফেরার ইচ্ছে নেই তার। অগত্যা বিধবার ঘরে গিয়ে ডন কারমাইকেল কবুল করল, মহিলাকে সর্বনাশের মধ্যে রেখেই চলে যেতে হচ্ছে তাকে।

তারপর থেকে পৃথিবীর সঙ্গে তার একমাত্র যোগাযোগের সূত্র মাসের শেষে মেয়েদের পাঠানো চিঠিগুলো। ‘খোদার গজব পড়া একটা শহর এটা,’ সে লিখত, ‘বাকি জীবন ওখানেই থাকো, আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। তোমরা সুখে আছ এটা জেনেই আমি সুখী।’ মেয়েরা পাল্টাপাল্টি করে জবাব দিত মায়ের চিঠির। তারা যে সুখে আছে ধরা পড়ত চিঠিতে; বিধবা যেন দেখতে পেত, উষ্ণ, আলোয় ভরা সব জায়গা থেকে লেখা হচ্ছে চিঠিগুলো। তার মনে হতো, একটু থেমে ঠাহর করলে হাজারটা আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্বকে জ্বলজ্বল করতে দেখবে মেয়েরা। দুজনের একজনও ফিরতে চায় না।

‘সভ্যতা তো এখানেই,’ তারা লিখত। ‘দুঃখজনক হলো, ওখানে ভালো কোনো মাধ্যম নেই আমাদের জন্য। রাজনৈতিক কুটকচালে মানুষ খুন হয় এমন বর্বর দেশে থাকা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।’

চিঠিগুলো পড়তে পড়তে মন্তিয়েলের বিধবার মন ভালো হয়ে যেত এবং মনে মনে মেয়েদের প্রতিটি কথায় সায় দিত।

মাঝেমাঝে প্যারিসের মাংসের বাজারের কথা বলত মেয়েরা। জানাত, গোলাপী সব শুয়োরকে মেরে, মুকুট আর ফুলের মালা পরিয়ে কীভাবে আনাম ঝুলিয়ে রাখা হয় দরজায়। শেষের দিকে, আলাদা একটা চিঠি যোগ করত মেয়েরা: ‘কল্পনা করো ব্যাপারটা, সবচেয়ে বড়ো আর সুন্দর কার্নেশন ফুলটা গুঁজে দেওয়া হয় শুয়োরের পাছায়।’

দু’বছরে এই প্রথমবারের মতো হাসে মন্তিয়েলের বিধবা বউ। ঘরের বাতি না জ্বেলেই শোবার ঘরে যায়, দেয়ালে ঝোলানো বৈদ্যুতিক পাখাটা চালিয়ে দেয় বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার আগে। বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে কয়েকটা কাঁচি, গজ ব্যান্ডেজ আর জপমালা।

পড়তে পড়তে, দু’বছরে এই প্রথমবারের মতো হাসে মন্তিয়েলের বিধবা বউ। ঘরের বাতি না জ্বেলেই শোবার ঘরে যায়, দেয়ালে ঝোলানো বৈদ্যুতিক পাখাটা চালিয়ে দেয় বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার আগে। বিছানার পাশের টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে কয়েকটা কাঁচি, গজ ব্যান্ডেজ আর জপমালা। ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের নখে পট্টি বাঁধে, কামড়ের চোটে ছালচামড়া উঠে গেছে ওটার। এবার প্রার্থনা করতে শুরু করে— পট্টির ভেতর দিয়ে জপমালার দানাগুলোকে ঠাহর করতে না পারায় দ্বিতীয় অংশে পৌঁছেই বাম হাতে চালান করে ওটাকে। মুহূর্তের জন্য কানে ভেসে আসে দূরাগত বজ্রধ্বনি। বুকের ওপর মাথাটা হেলে পড়া অবস্থাতেই ঢলে পড়ে ঘুমে। জপমালা ধরা হাতটা পড়ে যায় একপাশে, আর তখনই বড়মাকে দেখতে পায় উঠানে, কোলে সাদা একটুকরো কাপড় আর একটা চিরুনি, আঙ্গুলের নখ দিয়ে টিপে টিপে উকুন মারছেন।

‘কখন মরব আমি?’ বড়মাকে জিজ্ঞেস করে সে।

বড়মা মাথা তোলেন। ‘যখন তোমার বাহু থেকে শুরু হবে ব্যথা।’

*বড়মা: কাল্পনিক জনপদ মাকোন্দো-র স্বেচ্ছাচারী নারী শাসনকর্তা। মার্কেসের একাধিক গল্প ও উপন্যাসে উল্লেখ আছে তাঁর।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।