মানুষ জীবন-দর্শনের যতগুলো পথ উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছে, তার মধ্যে মরমীবাদ সর্বাধিক সমাদৃত ও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের মরমীবাদ তার নিজস্ব ভঙ্গিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। মরমীবাদের ভাবনা প্রতিটি ধর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত বা বলা যায় প্রতিটি ধর্মেই মরমীবাদ বলে একটি চূড়ান্ত দিক আছে, যা মূলত আত্মজ্ঞান লাভ হিসেবে পরিচিত।
কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদের সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ‘যখন কিছুই ছিল না’। যার কবিতাগুলো মরমীবাদ বা আত্মজ্ঞান লাভের যে জীবনদর্শন, সেই দার্শনিক অবস্থানকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। অজানা নয় যে, মরমীবাদ জীবসত্ত্বা বা মানবসত্তার সাথে পরমের যে সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের পথে যে বাধা এবং এই বাধা পেরিয়ে যাবার যে মুহূর্ত ও অবস্থানের নানা রূপ, তা নিয়ে আলোচিত হয়। আর সে সময়ের আত্ম-আর্তি ও পূর্ণতা লাভের পর মুক্তির নানাপ্রকাশ শিল্পের আশ্রয় হয়ে থাকে। সে গান হতে পারে। কবিতা হতে পারে বা অন্য কিছু।
কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদ তাঁর আত্ম-আর্তির কথাগুলো কবিতার আশ্রয়ে বলতে চেয়েছেন এই কাব্যগ্রন্থে।
‘যখন কিছুই ছিল না’ কবিতা গ্রন্থের নামটি পড়ে আমার মনে হলো, শূন্যতার স্মৃতিচারণের ভেতর দিয়ে এক পূর্ণতার আভাস তিনি দিতে চেয়েছেন। ‘যখন কিছুই ছিল না’ এক অতীতের কথা নির্দেশ করছে আর এর বিপরীতে বর্তমানে অনেক কিছুই আছে এমন কথা ইঙ্গিত করতে চাচ্ছেন কি কবি?
গ্রন্থের ভূমিকা-স্থলে বুদ্ধের বাণী দিয়ে একটি ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে হয়তো। রূপ ও শূন্যতা এবং রূপ ও শূন্যতা যে ভিন্ন কিছু নয়, তার সাথে অনুভূতি, উপলব্ধি, তাড়না এবং চৈতন্য যে অভিন্ন— এমন কথা বলেছেন বুদ্ধ।
বইটিকে কবি তিনটি পর্বে উপস্থাপন করেছেন।
‘আয়নামহল’, ‘অন্তরমহল’ এবং ‘রূপমহল’
আর এই তিনটি পর্বের সঙ্গে একটি করে গানের লাইন যুক্ত করেছেন, যা—
আয়নামহল [বেঁধেছে এমন ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে, লালন ফকির]
অন্তরমহল [সুয়া উড়িলো উড়িলো জীবের জীবন, সুফি শিতালং শাহ]
রূপমহল [রূপ দেখিলাম রে দুই নয়নে আপনার রূপ দেখিলাম, হাছন রাজা]
আমি মূলত প্রতিটি পর্ব আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করতে চাইছি—
আয়নামহল
মরমীবাদে আয়নামহল বলতে হৃদয়ের সেই গৃহ বা অবস্থানকে ইঙ্গিত করা হয়, যেখানে প্রেম-দর্পণে মুর্শিদ বা পরমের প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়। সাধারণত প্রেমহীন ক্বলবে সে ছবি ধরা দেয় না। মুর্শিদের প্রেমে ফানা হওয়া হৃদয়, সেই আয়নামহলের সন্ধান পায়। কবি যেহেতু আয়নামহল দিয়ে শুরু করেছেন, এর অর্থ, তিনি পরমের অনুসন্ধানে সেই আয়নামহলের খোঁজ করছেন। আর সে আয়নামহল থাকে দমের হাওয়া ঘরে।
‘ওখানেই নামতে চাই
যেখান থেকে এসেছি’
এমন আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ, অনুসন্ধিসু পঙ্ক্তি দিয়ে কবিতা শুরু করে, শেষে গিয়ে বলছেন—
‘নাই হয়ে যাব—
লা শরিকে’
লা-শরিক অর্থ অংশীদারহীন বা সমকক্ষহীন অবস্থানে উপনীত হওয়া। অন্তরাত্মার পবিত্র অবস্থান হলো লা-শরিক। সেই লা-শরিক অবস্থান প্রথমে তৈরির পর, তিনি একধরনের শূন্যতা বা শূন্য মোকাম তৈরির মধ্য দিয়ে, সেই আয়নামহল খোঁজার পথে অগ্রসর হতে চেয়েছেন।
‘অথৈ সাগরে ভেসে
ঢেউয়ে ঢেউয়ে
হাবুডুবু খেয়ে
সামান্য তীরে আসতে চাইছি’
এই যে বাঁচতে চাওয়া, সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারে মুর্শিদ বা সেই প্রেমিক— যিনি প্রেমের নদীতে মাঝি। আয়নামহলের আয়না।
‘জলে মুখ করে তাকালে
সে আয়না হয়
আমার আয়না নাই’
আয়নামহল অংশে কবি তাঁর ‘আয়না নই, বলার মধ্য দিয়ে মূলত আয়না কামনা করছেন। মরমীবাদের প্রথম ধাপ হলো ‘নাই’, অর্থাৎ শূন্যতার পথে অগ্রসর হওয়া এবং শূন্যতাকে অর্জনের মধ্য দিয়ে পরমের দিকে যাত্রা। আয়নামহলের কবিতাগুলো তেমনটাই ইঙ্গিত করে।
অন্তরমহল
আয়নামহলের পরবর্তী ধাপ হলো অন্তরমহল। যা পূর্ণতা প্রাপ্তির সূচনা পর্যায়। আর তা ধীরে ধীরে নির্বাণের দিকে অগ্রসরমান। যখন শূন্যতাপ্রাপ্তির পথ শুরু হয়, তখন অহং বিনাশ হয়। আর জ্যান্তে-মরার পথ উন্মোচিত হতে থাকে। তখন আমরা তাকে সুয়া পাখি বানিয়ে উড়িয়ে দেই।
‘দুঃখের মতো শূন্যতার
নরম শরীরে—
মিলিয়ে গেলো মানুষের মুখ।
সুয়া উড়িলো রে’
কবি অন্তরমহল পর্বে তার সুয়া উড়িলো বলার মধ্য দিয়ে অন্য এক প্রাপ্তির কথা বলতে চাইছেন। আর সেখানে তাঁর কথা হচ্ছে আপন হৃদয়ের সাথে। বুদ্ধি বা মগজের জটিলতা সেখানে থাকে না। থাকে প্রেম ও পরমের অনন্ত-সুর। প্রেমলীলা—
‘হৃদয় বামে থাকে।
মগজটাকে সরিয়ে রেখে
হৃদয়ের কথা শুনতে হয়’
প্রেমের জন্য হৃদয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যা বুদ্ধির মতো যুক্তির জটিলতা আরোপ করে না। যা প্রবাহমান বাতাসের মতো। নদীর মতো বহতা…
‘আমার কোনো দশা নাই
বেদিশা হয়ে
পূর্ণাশা লয়ে ভেসে যাই
নির্দেশনাহীন—’
এই যে ‘পূর্ণাশা’ শব্দ দ্বারা কবি নিজের নতুন আশার কথা ইঙ্গিত করেছেন কিন্তু নির্দেশনাহীন ভেসে যাওয়ার যে কথা তিনি বলেছেন, তারই সূত্র ধরে আমাদের তিনি নিয়ে যান তাঁর অন্তিমপর্ব রূপমহলে—
রূপমহল
কবিতাগ্রন্থের অন্তিমধাপ হলো রূপমহল। এই রূপমহল হলো নিজের রূপ দর্শন বা নির্বাণ প্রাপ্তির পর্যায়।
‘আমরা রূপের ধারে গেছিলাম’
এমন পঙক্তি দিয়ে শুরু হয়েছে রূপমহলের অংশ। কবি রূপের দেখা পেয়েছেন সে কথাই বলছেন কিন্তু তা আমি হয়ে নয় বরং আমরা হয়ে। কিন্তু কেন আমরা? আমি কেন নয়?
মরমীবাদে একক সত্তা যখন পরমের সাথে মিলিত হয় এবং রূপ দর্শন করে, তখন সে আর একক সত্তা হিসেবে থাকে না। তখন তার একক আমি বহুবচন আকারে ‘আমরা’ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে থাকে।
যখন নির্বাণ প্রাপ্তি হয়, তখন নির্বাণপ্রাপ্তি সত্তা কথা বলতে থাকে, অনেকটা উপদেশের স্বরে। রূপমহলেও সে ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়—
‘নাই মায়া, নাই আল্লাহবিধাতা
নাই ভগবান, ঈশ্বর— নাই যদি মানুষ,
ভাবি মনের অরূপের রূপ
শূন্য উদয় হয়,
মানুষে মানুষে আল্লাহ জেগে রয়।’
সম্পূর্ণ বইটা পড়তে গিয়ে আমরা যদি প্রথম থেকে খেয়াল করি, তবে দেখতে পাব প্রথম আয়নামহল অংশে কবি আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করছেন। তারপর অন্তরমহলে তা আধো-পূর্ণতার রূপ পেয়েছে। আর সর্বশেষে রূপমহলে তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে এবং তখন বলার ভঙ্গিতে উপদেশের স্বর পরিলক্ষিত—
কবি আহমেদ স্বপন মাহমুদের এই কবিতাগ্রন্থ কোনো নতুন দর্শন নিয়ে লেখা নয় বা আমাদের নতুন কোনো দার্শনিকতার দিকেও নিয়ে যায় না। বরং আমাদের চিরচেনা সুফি বা মরমী দর্শনের পথেই তাঁর (নিজের) ধারাবাহিক জার্নি নিয়ে কথা বলছে।
কবিতাগুলো অতিসরল ভঙ্গিতে লেখা বা বলার চেষ্টা করা হয়েছে। হতে পারে তা দুর্বলতা বা সফলতা। তবে প্রবাহমানতা চমৎকার হওয়ায় পুরো-গ্রন্থে এক গীতময়তার পরিভ্রমণ আছে। কয়েকটি কবিতায় কুরআনের আয়াতাংশ আবার কতগুলোতে গানের লাইন ব্যবহার করা হয়েছে। এও হতে পারে সফলতা বা দুর্বলতা। তবে বোঝা যায়, তা কাব্যের প্রয়োজনে এসেছে এবং নতুন অর্থ তৈরি করেছে বটে।
আগুনের ফুলকির মতো নয়, বরং ফুল ও মধুর সরল অর্থবহ সম্পর্কের মতোই এই কবিতাগ্রন্থ। যার আস্বাদ কেবল প্রেমিক ভ্রমরই নিতে পারে!
কবিতা লেখেন মূলত; পাশাপাশি গদ্য লিখতে চেষ্টা করেন। প্রকাশিত বই: যামিনী ও মরমী ধনুক ( কবিতা)।