কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে যে আলোচনায় আমরা প্রবৃত্ত হতে চলেছি, যতীন সরকারের ষোলটি প্রবন্ধ নিয়ে লেখা ‘আমার নজরুল অবলোকন’ তার উপজীব্য। লেখকের ইতঃপূর্বে প্রকাশিত সাতটি গ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা নজরুল সম্পর্কিত ভাবনাগুলোর সমষ্টিই এই গ্রন্থ। নজরুলের সাহিত্য-সমালোচনায় সাহিত্যবোদ্ধারা যেসব যুক্তি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন সেগুলোকে সামনে রেখেই লেখক এগিয়েছেন এবং নিজস্ব যুক্তিবোধ দিয়ে ধারণাগুলোকে কখনো গ্রহণ, কখনো খণ্ডন করবার চেষ্টা করেছেন। যুক্তি খণ্ডনের ফাঁকে ফাঁকে নজরুলকে নিয়ে লেখকের ব্যক্তিগত উপলব্ধিগুলোও বইতে বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে।
প্রথমেই ‘আমার নজরুল অবলোকন’ যে অসামান্য ভূমিকাটির দৌত্যে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে তার কথা উল্লেখ করতে হয়। যাঁরা নজরুলচর্চা করেন এবং যাঁরা নজরুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন উভয়পক্ষের জন্য গ্রন্থটি কেন জরুরি সেটিই সুচিন্তিত ভূমিকার মাধ্যমে লেখক বলবার চেষ্টা করেছেন।
১৯৭৬ সালে কাজী নজরুল ইসলাম প্রয়াত হলেও তাঁর কবি-জীবনের অবসান ঘটে ১৯৪২ সালে। সে-বছর জুলাই মাসে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে মূক হয়ে গিয়েছিলেন, ১৯৭৬ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নজরুল কেবল দেহ ধারণ করেই ছিলেন, কর্মক্ষম ছিলেন না। যতীন সরকার এর তাৎপর্য কল্পনা করে বলেন, মানুষ প্রধানত মননের মাধ্যমেই বেঁচে থাকে। একইসঙ্গে এক অনামা প্রাচীন ভারতীয় কবির কথা ধার করে তাঁকে বলতে দেখা যায়— ‘গাছপালাও বেঁচে থাকে, পশুপাখিও বেঁচে থাকে, কিন্তু সত্যি বাঁচা সেই বাঁচে যার মন মননের দ্বারা জীবন্ত।’
মননের দ্বারা জীবন্ত নজরুল তাঁর কবিতা ও গানে ধর্মকে বিশাল স্থান দিয়েও মৌলবাদী হননি। ‘বেঁচে’ থাকাকালীন সময়গুলোতে আপন-পর সবপক্ষই তাঁকে আক্রমণ করেছেন। এমনকি দেহগত মৃত্যুর পরও তাঁর প্রতি অশ্লেষা আক্রমণ থেমে থাকেনি, বরং দীর্ঘকাল ধরে কলমকে ছুরি বানিয়ে নানাপক্ষ নজরুলের নিন্দা করেছেন, সব দেখেশুনে চতুর্দিক থেকে আক্রান্ত নজরুলকে উদ্ধার করতেই যেন যতীন সরকারের কলম ধরা।
নজরুল-মূল্যায়নে তাঁর সাহিত্যকৃতির প্রশংসার বিপরীতে বিভেদ-বিড়ম্বিত বিচার বিশ্লেষণেরও কোনো শেষ ছিল না। অকারণ নজরুল সমালোচনায় অনেকের সংস্কারগ্রস্ত মানসিকতার স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে লেখক আধুনিক কবিদের সর্বপ্রথম সামনে রাখেন।
কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই, যেমন মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ বিদ্বজ্জন নজরুলের কবিতার মৌলিকত্বে চমৎকৃত হন। যতীন সরকার ব্যথিত হন যখন দেখেন, মোহিতলাল এককালে নিকট সম্পর্ক বজায় রাখলেও অপ্রকাশ্য ক্ষোভে হঠাৎ করেই যেন দূরত্ব বাড়িয়ে তোলেন।
সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণের পর কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন, কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই, যেমন মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ বিদ্বজ্জন নজরুলের কবিতার মৌলিকত্বে চমৎকৃত হন। যতীন সরকার ব্যথিত হন যখন দেখেন, মোহিতলাল এককালে নিকট সম্পর্ক বজায় রাখলেও অপ্রকাশ্য ক্ষোভে হঠাৎ করেই যেন দূরত্ব বাড়িয়ে তোলেন। একইসঙ্গে, তরুণ বুদ্ধদেব আগে যেভাবে নজরুলের কবিতার প্রশংসা করতেন বয়স হতে হতে একদিন পুরনো সম্পর্কের সামীপ্য ভুলে নজরুলকে ‘প্রতিভাবান বালক’ হিসেবে চিহ্নিত করলেন।
‘নজরুলের রচনায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহ আছে, কিন্তু সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই’, যতীন সরকারকে হতবাক করেছে বুদ্ধদেবের এই বক্তব্যও।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ নজরুলের হাতে হয়ে ওঠে মুক্তবন্ধ নৃত্যপাগল ছন্দ। ‘বাসুকির ফণা’, ‘স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা’র প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করে নজরুলের লেখায় সাহিত্যিক বিদ্রোহ নেই, বুদ্ধদেবের এই বক্তব্য যতীন সরকারের সমুচিত মনে হয় না।
তিরিশের আরেক মহীরূহ জীবনানন্দ দাশ নজরুলের কবিতার গুণগ্রাহী ছিলেন, তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায় নজরুলের কাব্যকৃতির ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনিও ক্রমশ অন্য পথে পা বাড়ান। অন্যসব কবিরা নজরুলের মূল্যায়ন করা দূরে থাক তাঁর সম্পর্কে প্রায় নীরবই রইলেন।
আধুনিকদের পর যতীন সরকার সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করান মার্কসবাদীদের।
উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও নজরুল কমিউনিস্ট ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভাববাদী এবং ধর্মবিশ্বাসী। তবে ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী সমাজতন্ত্রের বিরোধী নয় বলেই নজরুল ইসলামী ঐতিহ্যের সমাজতন্ত্রমুখী ভাবধারাকে সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। পাশাপাশি তিনি হিন্দু ঐতিহ্যের সঙ্গেও একান্তভাবে মিশে যান। শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় একই ধারায় প্রবাহিত হতে শুরু করে।
যতীন সরকার লেখেন—
‘আধুনিক বাংলাকাব্যে হিন্দু পুরাণের পুনর্জন্মের সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদনের হাতে, রবীন্দ্রনাথের হাতে তাতে তার সফল পরিণতি। নজরুল ইসলাম পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটান তাতে সমাজতন্ত্রের প্রাণবায়ু সঞ্চারিত করে।’
চল্লিশের দশকে সমালোচনা সাহিত্যের নতুন বিচারধারার প্রবর্তক মার্কসবাদীরাও যে নজরুলের সাহিত্যের পর্যালোচনা ও বিচারে খুব বেশি সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন তা বলা যাবে না। লেখক এদেশে মার্কসবাদীদের চরিত্র-বিচার করতে গিয়ে যান্ত্রিকতা ও চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত মার্কসবাদী ধারার অভাব অনুভব করে মার্কসবাদের মূলমর্ম নিহিত ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দর্শনকে প্রয়োজনীয় মনে করেছেন।
তবে চল্লিশের দশকে সমালোচনা সাহিত্যের নতুন বিচারধারার প্রবর্তক মার্কসবাদীরাও যে নজরুলের সাহিত্যের পর্যালোচনা ও বিচারে খুব বেশি সুবিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন তা বলা যাবে না। লেখক এদেশে মার্কসবাদীদের চরিত্র-বিচার করতে গিয়ে যান্ত্রিকতা ও চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত মার্কসবাদী ধারার অভাব অনুভব করে মার্কসবাদের মূলমর্ম নিহিত ডায়ালেকটিক বস্তুবাদী দর্শনকে প্রয়োজনীয় মনে করেছেন। এই দর্শনের মাধ্যমে যদি নজরুলের শিল্প-সাহিত্য বিচার করা যায় তাহলে হয়তো নজরুলকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব বলেও যতীন সরকার মনে করেন।
কীভাবে মার্কসীয় সমালোচনার দৃষ্টিতে নজরুলের সাহিত্য মূল্যায়ন করা সম্ভব এর নিরিখে যতীন সরকার কিছু প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন—
প্রথমত, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— জীবনানন্দ দাশের স্মরণযোগ্য বক্তব্যটিকে সামনে রেখে তিনি উসকে দেন নানান ভাবনা। ‘কেউ কেউ কবি’, এটা হয়তো আমরা সবাই জানি কিন্তু ‘কেউ কেউ কেন কবি নন’, সেটা অনেকেই জানি না।
যতীন সরকারের মতে, ‘কেউ কেউ কেন কবি নয়’, এই বিষয়টি ডায়ালেকটিক বস্তুবাদ ভিত্তিক পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান সামান্য হলেও ব্যাখ্যা করতে পারে। পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানের মতে, যোগাযোগ এবং অনুভূতি বিনিময়ে মানুষের রয়েছে দুই ধরনের সাংকেতিক তন্ত্র। প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ। অপ্রত্যক্ষ অর্থাৎ, দ্বিতীয় সাংকেতিক তন্ত্রের মাধ্যমেই মানুষ তার যুক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনা ইত্যাদির প্রয়োগ করে।
অপরদিকে মানুষ-ভিন্ন অন্য প্রাণীর রয়েছে কেবল একটি সাংকেতিক প্রবণতা। এই প্রত্যক্ষ সাংকেতিক প্রবণতা দিয়ে মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য এবং অনুভূতিগ্রাহ্য হবার বহু পূর্বে প্রকৃতির কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়গুলো অন্য প্রাণীদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়, এভাবে তারা অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে।
মানুষের প্রথম সাংকেতিক প্রবণতার দ্বারা এই অতিরিক্ত অনুভূতিটির পরিচয় পাওয়া যায় না। পাভলভীয় মনোবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, কবি-সাহিত্যকরা গড়পড়তা সাধারণ মানুষের চেয়ে প্রথম সাংকেতিক স্তরের প্রাধান্যের কারণে ‘অতিমাত্রায় সংবেদনশীল’ হয়ে পড়েন। স্নায়ুতন্ত্রের এই শক্তির বলেই ‘কেউ কেউ কবি’। আর তাই নজরুল মূল্যায়নে পাভলভীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে নজরুলের ব্যক্তিত্বের ধরন, পারিবারিক-সামাজিক পরিবেশ বিবেচনা করে তাঁর মানসগঠন বুঝে তাঁকে বিচার-বিশ্লেষণ করতেই লেখক আগ্রহী।
দ্বিতীয়ত, এদেশের শিল্প-সাহিত্যে ঐতিহাসিকভাবেই হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল, একসময় মুসলমান লেখকরাও মুসলিম ঐতিহ্য নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেন। তবে যতীন সরকারের মতে, নজরুলের আগে-পরে আর কেউই হিন্দু-মুসলমানের অখণ্ড ঐতিহ্য নিয়ে সাহিত্যচর্চা করেননি। নজরুল হিন্দু-মুসলমানের জন্য কেবল পৃথক কবিতা লেখেননি, বরং একই কবিতার একটি পঙ্ক্তিতে হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যকে একত্রে মিলিয়ে দিয়েছেন। এখানেই লেখকের মতে, নজরুলের অনন্যতা বিদ্যমান।
তৃতীয়ত, আধুনিকদের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক নির্ণয়ে সমালোচকরা সবচেয়ে বেশি অবিচারের জন্ম দেন। তাঁর মতে—
‘বর্ধমানের গাঁয়ের লেটোর দল থেকে উঠে আসা চারণকবিটিকে “আধুনিক” বলে মেনে নিতে গিয়ে তাঁরা খুব বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে যান। পশ্চিমা পুঁথির পাতা থেকে তাঁরা আধুনিকতার যেসব সংজ্ঞা মুখস্থ করেছেন, সেগুলো তাঁদের মাথায় সারাক্ষণ গিজগিজ করতে থাকে বলে নজরুলকে আধুনিকতার পঙ্ক্তিভোজনে শামিল করে নিতে তাঁদের আভিজাত্যে বাধে!’
যতীন সরকার আধুনিকদের মনোভাবের ওপর ডায়ালেকটিক বস্তুবাদের আলো ফেলে বলেন, নজরুলের মধ্যে আধুনিকতার সমস্ত উপকরণই ছিল। নৈরাশ্য এবং অবক্ষয়কে প্রাধান্য দেননি বলে এবং নজরুলের কবিতা দুরূহ নয় বলে সেটি আধুনিক নয়, আধুনিকদের এই মতও যতীন সরকারের কাছে অযৌক্তিক ঠেকে। দেহ সম্পর্কে শুচিবাই নজরুলের ছিল না, আধুনিকদের মতো তিনিও দেহজ কামনা ও ইন্দ্রিয়ঘন চেতনায় নিমজ্জিত থেকে কবিতা রচনা করেছেন। ‘মাধবী প্রলাপ’, ‘অনামিকা’ ইত্যাদি কবিতার নামোল্লেখ করে যতীন সরকার দেখিয়েছেন নজরুল কেবল আধুনিক নন, আধুনিকোত্তম।
নজরুল সমালোচকরা যেমন নজরুলকে অবজ্ঞা-অবহেলা করেছেন, উল্টোদিকে নজরুলপ্রেমীরাও যে কবির প্রতি খুব সদয় ছিলেন সেটা বলা যাবে না। তাঁদের কেউ কেউ নজরুলকে বলেছেন সাচ্চা মুসলমান, কেউ বলেছেন তিনি কাফের। নজরুলের কবিতার মুসলমানিকরণ নিশ্চিত করতে তাঁর কবিতায় কাঁচি চালাতে অনেকেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন। শ্যামাসংগীত রচনায় কেউ তাঁর প্রতি প্রীত হয়েছেন, কেউবা হয়েছেন রুষ্ট। কেউ বলেছেন তিনি প্রগতিশীল, কারো বিবেচনায় তিনি বিবেচিত হন প্রতিক্রিয়াশীল বলে। তাঁর সাহিত্যিক-প্রতিভার মূল্যায়নে চারদিকের এতসব ভ্রান্তির বিপরীতে বিনয় সরকারকে, যাঁকে প্রাতঃস্মরণীয় বললে অত্যুক্তি ঘটে না, (যিনি বিখ্যাত তাঁর ‘বিনয় সরকারের বৈঠকে’ গ্রন্থের জন্য) যতীন সরকার আবিষ্কার করলেন ব্যতিক্রমরূপে।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পড়ে বিনয় সরকার তাঁকে ‘বিপ্লবী’ আখ্যা দেন। তবে কৌতুহলের বিষয় হলো, বিনয় সরকার নজরুলের কবিতার বিদ্রোহী রূপ লক্ষ করে তাঁকে এই অভিধা দেন তা নয়, বরং নজরুলের ‘ভালোবাসার কবিতা’র জন্যও তাঁকে তিনি বিপ্লবী কবি বলে চিহ্নিত করেন। তিনি নজরুলকে ‘যুগপ্রবর্তক’ কবি বলেও তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন। যতীন সরকার লেখেন, ‘শুধু ‘বাঙালি ধর্ম’ নয়, নজরুলের মধ্যে তিনি এক ধরনের ‘অ-ধর্মকে’ও শনাক্ত করেছিলেন। সেই অ-ধর্মই সকল মানুষের প্রকৃত ধর্ম।’
তবে নজরুলের কাব্য-প্রশংসার বিপরীতে ‘অগ্নিবীণা’, ‘সর্বহারা’ প্রসঙ্গে বিনয় সরকার এগুলো উচ্চতম শ্রেণির কাব্য নয় বলে আলোচনা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেন। সত্যেন দত্ত এবং নজরুলকে সমান্তরাল জায়গায় রেখে সিদ্ধান্ত দেন, এঁদের দুজনের কেউই উচ্চতম শ্রেণির কবি নন।
যতীন সরকার লোকসাধারণের ভেতরে সক্রিয় আবহমান বাংলার সনাতন ধারার কবিরা, যাঁরা কেবল গ্রামপ্রধান নয় বরং বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন জুড়িয়েছেন, উনিশ শতকের সেই বিখ্যাত কবি লালন ফকির, দুদ্দু শাহ, পাগলা কানাই, বিশ শতকের হরিচরণ আচার্য, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, হাসন রাজা, জালাল উদ্দিন খাঁ’র নামোচ্চারণ করে বলেন, এঁরা খাঁটি-বাঙালি কবিত্ব নিয়ে যেভাবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছেন সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
বিনয় সরকারের অভিপ্রায়কে লেখকের সহজগ্রাহ্য যুক্তি মনে হয় না। উক্তিটি সম্বন্ধে আপাত-সৌজন্য বজায় রেখে তিনি বলেন—
‘বিনয় সরকারের এসব বক্তব্য আমরা মানতেও পারি, না-ও মানতে পারি। তাঁর সঙ্গে চুলচেরা তর্কেও নেমে পড়তে পারি। বিনয় সরকারের সব কথা মানা বা না-মানা কিংবা তাঁর সঙ্গে তর্কে করবার অধিকার আমাদের আছে অবশ্যই। তবু তাঁকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। তাঁকে উপেক্ষা করা হবে একান্ত আত্মঘাতি।’
বইতে নজরুলের কবিতা গ্রহণ-বর্জনের সঙ্গে আরেকটি বিষয় উঠে এসেছে, সেটি হলো তিনি কতটা ‘খাঁটি বাঙালি কবি।’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা সংগ্রহ’ বইটির ভূমিকায় খাঁটি বাঙালিত্ব বলতে তিনি যা উপলব্ধি করেন তার অনেকখানি ঈশ্বরগুপ্তের কবিতায় পেয়েছেন জানিয়ে খাঁটি বাঙালিত্ব যে আর পাওয়া যাবে না সে বিষয়ে নিজের অবস্থান দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের এই নির্ণয়কে একপ্রকার নাকচ করে যতীন সরকার লোকসাধারণের ভেতরে সক্রিয় আবহমান বাংলার সনাতন ধারার কবিরা, যাঁরা কেবল গ্রামপ্রধান নয় বরং বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মন জুড়িয়েছেন, উনিশ শতকের সেই বিখ্যাত কবি লালন ফকির, দুদ্দু শাহ, পাগলা কানাই, বিশ শতকের হরিচরণ আচার্য, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, হাসন রাজা, জালাল উদ্দিন খাঁ’র নামোচ্চারণ করে বলেন, এঁরা খাঁটি-বাঙালি কবিত্ব নিয়ে যেভাবে সমাজে প্রভাব বিস্তার করেছেন সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যতীন সরকার বিশেষভাবে উল্লেখ করেন ভাওয়ালের কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাসের কথাও, ‘স্বভাব কবি’ অভিধাপ্রাপ্ত এই কবিও তাঁর মতে একজন খাঁটি বাঙালি কবি।
তবে যে কবিকে একান্তভাবে খাঁটি বাঙালির জয়মুকুট দিয়ে যতীন সরকার অভিষিক্ত করতে চান, তিনি বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব হওয়া কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুল ‘লেটো’ নামের এক ধরনের লোককবিতার দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। মূলত এখান থেকেই খাঁটি বাঙালিত্বের বীজ নজরুলের অন্তরে বপন হয়। বাংলার লোকসাহিত্যের ধারাকে অনুসরণ করে লেটোর দলে জড়িত নজরুল অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত থেকে যেমন ‘কারবালা’র বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে পালা রচনা করেন, তেমনি ‘মেঘনাদবধ’ পালাও তিনি রচনা করেছিলেন।
সব গুণ বিচার করে নজরুলকে গ্রহণ করলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তিনি তাঁর নামে কাব্যনাটিকা উৎসর্গ করেছিলেন।
নজরুল দোভাষী পুঁথির মাধ্যমে কবিতা রচনা করেন, হিন্দু পুরাণ এবং ইসলামী ঐতিহ্যও তাঁর কবিতায় সমান্তরালভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। যতীন সরকারের মতে, এই সবকিছুর বিচারে নজরুলের নামের সঙ্গে খাঁটি বাঙালিত্বের উপমা সমার্থক হয়ে ওঠে।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তবে কোন সমাজ বাস্তবতায় তিনি জাতীয় কবি হয়ে উঠলেন এর উত্তর খুঁজতে যতীন সরকার তুলে ধরলেন উনিশশো একষট্টি সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পাকিস্তানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের সাহিত্যবোধহীন কথাবার্তার নমুনা। সে-সবের মধ্যে একটি ছিল, রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানের জাতীয় কবি নন, তাই পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করার অর্থ হলো পাকিস্তানবিরোধিতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন পাকিস্তানপন্থী শিক্ষাবিদ হয়েও তখন এই কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, জাতীয় কবি হওয়া কোনো মহৎ কবির জন্য গৌরবজনক নয়, রবীন্দ্রনাথ মহৎ কবি বলেই তিনি কোনো দেশের জাতীয় কবি নন।
পকিস্তানপন্থীরা তখন ‘ইকবাল’কে জাতীয় কবি অভিধা দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। কিন্তু জনরোষে বিজাতীয় ভাষার কবি ইকবালকে কোনোভাবে সেখানে প্রতিস্থাপিত করা গেল না। হাতের কাছে পাওয়া গেল একজন মুসলমান কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। কিন্তু তিনি ইসলামী গজলের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এই অবস্থায় যা করা হলো, নজরুলের লেখা হিন্দুয়ানি শব্দকে কেটে ছেঁটে মুসলমানিকরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হলো। যেমন ‘নবনবীন’কে ‘তাজাবতাজা’, ‘মহাশ্মশান’কে ‘গোরস্তান’ ইত্যাদি।
উত্তরকালে পাকিস্তানপন্থীদের ক্রিয়াকলাপ থেমে থাকেনি। পঁচাত্তরের আগস্টে এদেশে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর নতুনভাবে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত চেপে বসে। ১৯৭৬ সালে সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয়। যতীন সরকার এ উদ্যোগকে হাস্যকর বলে চিহ্নিত করেন।
নজরুল বলেছিলেন, ‘বাংলা বাঙালির হোক’, তাই নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করার পর তিনি আর বাঙালির কবি থাকেন না, বাংলাদেশের কবি হয়ে যান। লেখক প্রশ্ন উত্থাপন করেন, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যে কোটি কোটি বাঙালি পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন নজরুল কি তাঁদের কবি নন? জাতীয় কবির ছাপ মেরে তাঁর বিশিষ্টতাকে উপেক্ষা করে সরকারি কবিতে পরিণত করার বিষয়টিকে তিনি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করে, ‘বাংলা বাঙালির হোক’ বলে যে চেতনা নজরুল বুকে ধারণ করতেন তাঁকে জাতীয় কবি ঘোষণা করে সেই বাণীর মাহাত্ম্য খর্ব হয়েছে বলে উষ্মা জানান।
সারাজীবন স্তাবক ও নিন্দুক উভয় পক্ষেই অনেকে নজরুলকে ভুল বুঝেছেন। তাঁর সমগ্রতাকে অনুধাবন করতে না পেরে খণ্ডিত নজরুলকে নিয়ে মেতে থেকেছেন। হতে পারে অখণ্ড নজরুলের ব্যাপ্তি এবং বিভা এমনই যে সেটিকে ধারণ করার ক্ষমতা গড়পড়তা বাঙালির নেই। তাই নজরুলের স্তব ও নিন্দা উভয়ই আংশিক এবং বিকৃত।
সারাজীবন স্তাবক ও নিন্দুক উভয় পক্ষেই অনেকে নজরুলকে ভুল বুঝেছেন। তাঁর সমগ্রতাকে অনুধাবন করতে না পেরে খণ্ডিত নজরুলকে নিয়ে মেতে থেকেছেন। হতে পারে অখণ্ড নজরুলের ব্যাপ্তি এবং বিভা এমনই যে সেটিকে ধারণ করার ক্ষমতা গড়পড়তা বাঙালির নেই। তাই নজরুলের স্তব ও নিন্দা উভয়ই আংশিক এবং বিকৃত। যতীন সরকারের কৃতিত্ব এ জায়গায় যে, অখণ্ড ও সমগ্র নজরুলকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন তিনি, হিন্দু ও মুসলিমের অখণ্ড ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে নজরুল কীভাবে মহৎ কবিতে রূপান্তরিত হলেন সেটি দেখিয়েছেন। নজরুলের মূল্যায়নে মার্কসীয় সমালোচনার নতুন দ্বারোন্মোচন করেছেন তিনি; পণ্ডিতম্মন্য আধুনিক সমালোচকরা যে দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুলকে মূল্যায়ন করেছেন, যেভাবে খণ্ড, ক্ষুদ্র ও হেয় করার চেষ্টা করেছেন নজরুলকে, তারই প্রবল প্রতিবাদ আছে যতীন সরকারের লেখায়। এদিক দিয়ে দেখলে, মানুষ নজরুল, কবি ও লেখক নজরুল, অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রকৃত বার্তাবাহী নজরুলের প্রতি ইতিহাসের দায়মোচন করেছেন যতীন সরকার। আমাদের ঐকান্তিক ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন প্রাপ্য তাঁর।
নজরুলের কবিতায় আছে—
‘জবা-কুসুম-সঙ্কাশ রাঙা অরুণ রবি
তোমরা উঠিছ; না-আসা দিনের তোমরা কবি।
যে-রাঙা প্রভাত দেখিবার আশে আমরা জাগি
তোমরা জাগিছ দলে দলে পাখী তারির লাগি।
স্তব-গান গাই আমি তোমাদেরি আসার আশে,
তোমরা উদিবে আমার রচিত নীল আকাশে।
আমি রেখে যাই আমার নমস্কারের স্মৃতি—
আমার বীণায় গাহিও নতুন দিনের গীতি।’
না-আসা দিনের কবির জন্য কাজী নজরুল ইসলাম অপেক্ষায় ছিলেন। যতীন সরকারের অনুধাবনে নজরুলের সাহিত্যকৃতির তুলনা করার মতো প্রতিভা কাব্যাঙ্গনে আর নেই। সে কারণে নজরুল যেমন অপেক্ষায় ছিলেন, যতীন সরকারও না আসা দিনের সেই কবির জন্য এখনো অপেক্ষায় আছেন।