পাগলা কানাই আমাদের লোকসাহিত্যের একজন কিংবদন্তী। তাঁর গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশ হতে দেশান্তরে। তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন এবং তা বর্তমানেও বিমলিন হয়ে যায়নি। পাগলা কানাই ১৮০৯ সালে (বাংলা ১২১৬ সালের ২৫ শে ফাল্গুন) ঝিনাইদহ জেলা শহরের পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বেড়বাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কুড়ন শেখ, মাতা মোমেনা বেগম। এই পবিত্রভূমিতে— যেখানে পাগলা কানাই দেহ রেখেছেন; আমার অনেকবার যাওয়া হয়েছে। বুকের কোণে কি এক শক্তি যেন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তবে পাগলা কানাইয়ের গানে তৎকালীন মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ত্বের যে বীক্ষণ ধরা পড়ে তা সমকালের বাস্তবতায়ও অনেকটা প্রযোজ্য।
পাগলা কানাইয়ের গানের বাণী যশোর-ঝিনাইদহের আঞ্চলিক ভাষার রচিত হলেও তা আজ অতিক্রম করেছে নিজেদের সীমারেখা। ছড়িয়ে পড়েছে দেশ হতে দেশের বাইরে। ছোটবেলা থেকেই সাধক-মহাজনদের মুখে মুখে শুনেছি লালন, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাইয়ের গান। ছুটে গিয়েছি তাদের ধামে— যেখানে তারা দেহ রেখেছেন। তাদের গানের এমন মোহনীয় শক্তি যে সবকিছু ভুলিয়ে মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে এক করে দেয়। একদিন পাগলা কানাইয়ের মাজার দেখতে গিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম পাগলা কানাইকে নিয়ে কাজ করব। শুরু হল তথ্য সংগ্রহ করা— কে কে পাগলা কানাইকে নিয়ে কাজ করেছেন তাদের খুঁজে বের করা। কয়েক মাসের অনুসন্ধানে পেয়েও গেলাম কিছু প্রবন্ধ ও গ্রন্থ। সর্বপ্রথমেই উল্লেখ করতে হয় লোকগবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মযহারুল ইসলামের কথা। যিনি সর্বপ্রথম পাগলা কানাইকে নিয়ে ‘কবি পাগলা কানাই’ নামে একটি সুদীর্ঘ গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘কবি পাগলা কানাইয়ের-জীবন’ প্রবন্ধটি সেখান থেকেই নেওয়া হয়েছে।
কবি জসীম উদ্দীন ১৯২৪ সাল এবং ১৯৫৩ সালে পাগলা কানাইয়ের বাড়িতে যান এবং তথ্যসংগ্রহ করে তাঁর ‘জারিগান’ গ্রন্থে দীর্ঘ এক ভূমিকায় পাগলা কানাইয়ের জীবন ও মাজার নিয়ে আলোকপাত করেন— ‘গত ১৯২৪ সনে যখন আমি আই.এ. ক্লাশে পড়ি তখন একবার পাগলা কানাইয়ের বাড়ি গিয়া তাঁহার বিষয়ে কিছু খবর একটি খাতায় টুকিয়া লইয়াছিলাম। সেই খাতাখানা হারাইয়া যাওয়ায় এতদিন আর পাগলা কানাইয়ের বিষয়ে কিছু লিখিতে পারি নাই। গত ২৩.১২.৫৩ তারিখে পাগলা কানাইয়ের জীবনী বিষয়ে মালমসলা সংগ্রহ করিতে আবার যশোর হইয়া মহকুমা ঝিনাইদহ আসিলাম। ঝিনাইদহ হইতে কানাইয়ের বেড়বাড়ি গ্রাম তিন মাইল। একটি সরু রাস্তা দিয়া বেপারীপাড়া, গণেশপুর, কুয়াপাড়া হইয়া বাড়িবাতানে আসিয়া পৌঁছিলাম। হাতের ডানদিকে ঢোলসমুদ্র। প্রবাদ আছে, এখানে মুকুটরাজা পুকুর কাটাইতে আরম্ভ করেন। ষোলটি হাতি সমানে পুকুর হইতে মাটি আনিয়া তাহার চারিপাড়ে ফেলিতে লাগিল। সেই পাড় এত উঁচু হইয়াছিল যে, পুকুরের তলায় কেহ ঢাক বাজাইলেও পাড়ের বাহির হইতে শোনা যাইত না। কিন্তু পুকুরে জল ওঠে না। রাজার পুত্রবধূ যামিনী ঠাকরুণ এই পুকুরের তলায় পূজা দিলে পুকুরে জল উঠিতে আরম্ভ করে। এই পুকুরের বিষয়ে আরও অনেক গল্প আছে। আজ টিউবওয়েল ও কলের জলের দিনে পুকুর কাটান যে মানুষের জন্য কত উপকারী তাহা আমরা ভুলিয়া গিয়াছি। অনেকক্ষণ এই পুকুরের ধারে বিশ্রাম করিয়া মনে মনে সেই মুকুটরাজার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইয়া আবার পাগলা কানাইয়ের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হইলাম। আমার সঙ্গে আসিয়াছিলেন স্থানীয় কলেজের সাত-আটজন ছাত্র।
কিছুক্ষণ হাঁটিয়াই রাজাপুর বেড়বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলাম। পাগলা কানাইয়ের নাতি ছানারদ্দীন বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করিয়া গত ১৯২৪ সনে আমি পাগলা কানাইয়ের বিষয়ে কিছু খবর টুকিয়া লইয়াছিলাম। তখন তাঁহার বয়স ৬০ বৎসরের কম হইবে না। এবার তাঁহার ছোটভাই মিনাজদ্দীন বিশ্বাসের নিকট হইতে পাগলা কানাইয়ের বিষয়ে উপাদান সংগ্রহ করিলাম। কবি জসীম উদ্দীনের ‘জারীগান’ গ্রন্থের ভূমিকা থেকে পাগলা কানাইয়ের অংশটুকু ‘পাগলা কানাই’ নামে এই গ্রন্থে অর্ন্তভুক্ত হল।
‘বাউল লালন ও পাগলা কানাই’ প্রবন্ধটি রথীন্দ্রকান্ত ঘটক চৌধুরীর ‘কয়েকজন লোককার এবং প্রসঙ্গত’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। যে গ্রন্থটি ১৯৮৪ সালের জুন মাসে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত।
‘লোকসংগীত-সাধনা ও পাগলা কানাই’ লেখাটি গবেষক ড. আবুল আহসান চৌধুরীর— ‘লালন সাঁই ও উত্তরসূরি’ নামক গ্রন্থ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষক ড. আবু ইসহাক হোসেন, প্রদীপ ব্যানার্জী, হাসানুজ্জামান, আজির হাসিব আমার অনুরোধে পাগলা কানাইকে নিয়ে তাদের লেখা প্রস্তুত করেছেন। তাদের লেখাগুলো শুধুমাত্র এই গ্রন্থের জন্যই গবেষকদের কাছ থেকে তাগিত দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে।
‘চারণ কবি পাগলা কানাইয়ের সম্ভাব্য কাল’ প্রবন্ধটি আব্দুল্লাহ আল শামস বিল্লাহ’র কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘লালন ও পাগলা কানাই-এর সম্পর্ক ও তাঁদের মানবপ্রেম’— প্রবন্ধটি লেখকের অনুমতি সাপেক্ষ তাঁর ‘লালন দর্শনে মানবতাবাদ’ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। ‘লালন শাহ ও পাগলা কানাই’— লেখাটি জাতীয়গ্রন্থ কেন্দ্রের পত্রিকা ‘বই’ থেকে সংগ্রহ কার হয়েছে। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল— ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে। ‘আধ্যাত্ম গানের প্রাণ পুরুষ মরমী কবি পাগলা কানাই’—প্রবন্ধটি গবেষকের ‘মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ’ গ্রন্থে থেকে নেওয়া হয়েছে। যেটি…. বলাকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। ‘মরমী কবি পাগলা কানাই ও তাঁর গান ‘পেয়ে ধন তুই করলি অযতন, চিনলিনে ওরে দিনকানা’— লেখাটি লেখকের কাছ থেকে সংগ্রহীত। যা দৈনিক সংবাদ পত্রিকায়ও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।
পরিশিষ্টে একটি প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়েছে যেটি— নোরাডের অর্থানুকূল্যে প্রণীত বাংলা একাডেমি ‘লোকসঙ্গীত সংগ্রহ ও দলিলীকরণ’ প্রকল্পের অধীনে একাডেমির গবেষণা-সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের পরিচালক বিশিষ্ট লোকগবেষক জনাব শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে একটি সমীক্ষকদল ১৯৯১ সালের ২০ ও ২১ অক্টোবর পাগলা কানাইয়ের জন্মগ্রাম বেড়বাড়িতে গিয়ে পাগলা কানাই সম্পর্কে ক্ষেত্রসমীক্ষায় অংশ নেন। সমীক্ষকদের পক্ষে একাডেমির ফোকলোর বিভাগের সহ-পরিচালক জনাব শফিকুর রহমান চৌধুরী পাগলা কানাই সম্পর্কে নানা তথ্য ও তাঁর পদাবলী এবং কানাইয়ের গানের শিল্পীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। উক্ত প্রতিবেদনটি পাগলা কানাই চর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এই গ্রন্থে প্রতিবেদনটি সংযুক্ত করা হয়েছে।
পাগলা কানাইয়ের মৃত্যুর ১৩৩ বছর পরেও তাঁর গুরুত্ব আমাদের কাছে মলিন হয়ে যায়নি। ‘খেয়ালী বাউল পাগলা কানাই ও তাঁর তত্ত্বদর্শন’ গ্রন্থটি থেকে পাঠক, গবেষক লোককবি ও শিল্পী পাগলা কানাইয়ের জীবন-দর্শন-তত্ত্ব সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা পেলেও আমার কষ্ট সার্থক হবে।
কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১২ জুন, ১৯৯৩; ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার গোলকনগর গ্রাম। বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ঢাকা স্কুল অফ ইকনোমিকস থেকে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা ইন ইকোনমিকস ডিগ্রি এবং গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে গণহত্যার উপর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন। বর্তমানে সমাজসেবামূলক একটা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।
প্রকাশিত গ্রন্থ : ‘সংস্কৃতির দিকে ফেরা’ (প্রবন্ধ, ২০১৫), ‘লোক মানুষের গান ও আত্ম অন্বেষণ’ (গবেষণা, ২০১৬), ‘মানবতাবাদী লালন জীবন অন্বেষণ’ (প্রবন্ধ, ২০১৭), ‘হাওয়াই ডাঙ্গার ট্রেন’ (কবিতা, ২০১৮), ‘মনীষা বীক্ষণ ও অন্যান্য’ (প্রবন্ধ, ২০১৮), ‘অগ্রন্থিত রফিক আজাদ’ (সম্পাদনা, ২০১৯), ‘লণ্ঠনের গ্রাম’ (কবিতা-২০১৯), ‘যৈবতী কন্যা ইশকুলে’ (কবিতা, ২০২০), ‘কবিতার করতলে’ (প্রবন্ধ, ২০২০), ‘অন্ধ যাজক’ (কবিতা-২০২১), ‘ছোটবোয়ালিয়া-জয়ন্তীনগর-বসন্তপুর গণহত্যা’ (অভিসন্দর্ভ-২০২১), ‘কবিতায় ঘর-বসতি’ (প্রবন্ধ-২০২৩)।