ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত মার্কিন প্রতিভাবান নারী লেখক, কবি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী সাংবাদিক রীম ফারহাত। তাঁর জন্ম ২০০০ সালে। তিনি নিউ ইয়র্কের ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক শিক্ষা এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন। প্যালেস্টিনিয়ান আমেরিকান কমিউনিটি জার্ণাল ‘ফালাস্তিন ম্যাগাজিন’-এর প্রধান সম্পাদক এবং সেখানে একাধিক গল্প প্রকাশিত হয়েছে। ছোটোগল্পের জন্য তিনি ২০১৯ সালে ‘NY MSA Showdown’ প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কে বসবাস করছেন।
গল্পসূত্র: ‘রক্তে ভেজা ঋণ’ গল্পটি রীম ফারহাতের ইংরেজিতে ‘এ ব্লাড সোকড্ ডেট্’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্যালেস্টিনিয়ান আমেরিকান কমিউনিটি জার্ণাল ‘ফালাস্তিন ম্যাগাজিন’-এ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।
তাকে প্রায় স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল, যেন কোনো কিছুই ঘটেনি। যদি সে যেভাবে হাঁপাচ্ছিল, তা না হতো এবং যেভাবে তার চোখ সচেতনার মধ্যে নিমজ্জিত ও কেন্দ্রিভূত ছিল, তাহলে পরের এক সেকেন্ডেই তা হয়তো কঠিন হয়ে যেত। এমনকি তারিক ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করতে পারেনি। কিন্তু সে ডান দিকে ঝুঁকে আছে, যেন তার এক হাত বাম দিক ধরে আছে। তার গায়ের নীল শার্ট বেয়ে টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখেমুখে বেপোরোয়া অভিব্যক্তি ফুটে আছে।
‘তুমি আমার কাছে ঋণী।’ সে পুরোপুরি শান্ত ছিল, যা তারিককে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
‘তুমি আমার কাছে ঋণী,’ তারিকের দিকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আরেক কদম এগোনোর সময় পুনরায় সালিহ বলল। শীতল আবহাওয়ার জন্য চারদিকে কনকনে ঠান্ডা বাতাস এবং সালিহর চাহনীর তীব্রতার জন্য তারিক রীতিমতো কাঁপছিল। সে জানত, সালিহর কথা সত্য। সে আরও জানত যে, যা ঋণ আছে, তা পরিশোধ করার জন্য তার কিছুই করার নেই। কিন্তু, এটা?
জন্মের পর থেকে তারা দু’জন বন্ধু। তারিক জানত যে, সালিহর অন্য কোনো ব্যবস্থা থাকলে সে ঋণ পরিশোধ করার জন্য বলত না।
‘আসো।’
সালিহ দৃষ্টি উঁচিয়ে তার কাজিনের দিকে তাকায়। তার চোখে বেপয়োয়া ভাব, অনুনয়-বিনয়ের আর্জি এবং ভয়ার্ত, ‘তুমি জিজ্ঞেস করবে না?’
নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে তারিক ক্লান্ত পায়ে এক ধাপ পিছিয়ে যায় এবং সালিহকে ঘরে ঢুকতে সুযোগ করে দেয়। যখন সালিহ ঢোকার জন্য কসরত করছিল, তখন তারিক তার কাজিনের হাত নিজের কাঁধের উপর রাখে এবং বিছানায় যাওয়ার জন্য সাহায্য করে।
‘এখানে অপেক্ষা করো। আমি প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপত্র নিয়ে আসছি,’ কাজিনকে বিছানায় বসিয়ে তারিক বলল।
‘আমার কাছে তেমন কোনো উপায় নেই, আছে কী, ইবনে অমি?’ উত্তেজনা এবং ক্ষত উপলব্ধি করার আগে সালিহ হাসতে হাসতে বলল।
একটু পরে তারিক প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে আসে এবং তার কাজিনের ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে পট্টি বেঁধে দেয়।
‘ধন্যবাদ,’ যুবক কাজিনের চোখের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় সালিহ বলল।
‘এখানে …’
ডিং।
তীক্ষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার শব্দ শোনা যায়। তারিকের হাত চেপে ধরে সালিহ উদ্বিগ্নতা উপেক্ষা করার চেষ্টা করে। কোনো শব্দ না করার জন্য তারিক তার ঠোঁটে আঙুল তোলে এবং বিছানা থেকে নামার জন্য সালিহকে সাহায্য করে। বাড়ির পেছনের দিকে আঙুল উঁচিয়ে সে নির্দেশ করে এবং তার কাজিন দৃষ্টির সীমানার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। তারপর সে দরজার কাছে যায়।
‘দরজা খোলো,’ দরজার বাইরে একজন চিৎকার করে বলল।
দরজা খোলার আগে তারিক নিজেকে সামলে নেয় এবং চশমার কাচ পরিষ্কার করে। একজন সৈনিক তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। সৈনিকটি খাপ থেকে রাইফেল বের করে এবং জমাট বাঁধা বরফের উপর দাঁড় করিয়ে রাখে। সে সামনের পকেট থেকে তার পরিচয়পত্র বের করে, যেন মিলিটারী সম্পর্কে তারিকের কোনো ধারনাই নেই কিংবা উপস্থিত সৈনিকের বেশভূষা দেখে সে আদৌ চিনতে পারেনি যে লোকটি একজন সৈনিক।
ভয়ে তারিকের দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়া অবস্থা। তারপরও সে বলল, ‘আমি কোনো কিছুই করিনি।’
‘আমরা একজনকে খুঁজছি।’
‘এখানে অন্য কেউ নেই।’
সৈনিকটি উপহাস করে। তারপর সে তার সশস্ত্র কোমড়ের ভারী বেল্ট ঠিকঠাক করে। ‘তুমি আদৌ জানো না আমি কার খোঁজে এসেছি।’
তারিক নিশ্চুপ।
‘এখানে তোমার ভয় করার মতো কিছু নেই।’
বলেই সৈনিকটি তার বন্দুক উপরে তোলে এবং তারিকের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আসন্ন বিপদ ও আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করে। কিন্তু সৈনিকটি বন্দুক ঘুরিয়ে সামনের নলটি নিচের দিকে রাখে। মেঝেতে বরফ জমে আছে এবং সেখানে কয়েক ফোঁটা রক্তের দাগ লেগে আছে।
‘সরে দাঁড়াও।’
বলেই সৈনিকটি রাইফেলের বাট দিয়ে তারিককে পাশে সরিয়ে দেয়। তারপর সে সারা বাড়ি খুঁজতে শুরু করে। সে ঘরের জিনিসপত্র একদিক থেকে অন্য দিকে সরিয়ে এমন ভাবে দেখে যেন কোনো জায়গা বাদ না যায় এবং কিছু যেন না ভাঙে। তাকে দেখে মনে হয় যে, সে শীঘ্রই খোঁজাখুঁজি করা থামিয়ে দেবে এবং সেই সময় চাপা কাশির শব্দ তার মনোযোগ আকর্ষণ করে। চিলেকোঠা থেকে শব্দটা আসছিল। চিলেকোঠায় যাওয়ার দরজাটি আলমারির থেকে মাত্র কয়েক কদম সামনেই রয়েছে। সৈনিকটি তারিকের দিকে বন্দুক তাক করে।
‘হাঁটো,’ সৈনিকটি ফিসফিসিয়ে আরবীতে তারিককে বলল। তারিকের কানে সৈনিকের মুখে উচ্চারিত শব্দটি অশ্লীল শোনায়। তারিক আলমারির দিকে মন্থর গতিতে এক পা এগিয়ে যায়, যেদিকে চিলেকোঠায় ওঠার দরজা রয়েছে। সে মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করে। সৈনিকটি আলমারি খোলে এবং ভেতরে না ঢুকেই সে বন্দুকের মাথা ঢুকিয়ে কোনো কিছুর উপস্থিতি ঠাহর করার চেষ্টা করে। আলমারির নিচে মেঝেতে জমাট বাঁধা রক্ত লেগে আছে। সৈনিকটি হিব্রু ভাষায় বিড়বিড় করে অভিশাপ দেওয়ার মতো একটা কিছু বলল। তারপর সে সদর দরজার দিকে যায়। যাওয়ার পথে সে প্রতিটি টেবিল এবং চেয়ার সরিয়ে রাখে। তারিক স্বস্তির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে। সে জানে না, বুকের মধ্যে দম আটকে রেখেছিল কি না। সৈনিকটি লক্ষ্য করেনি যে, আলমারির উপর দিকে চিলেকোঠায় যাওয়ার দরজাটি রয়েছে। সালিহ বেঁচে গেছে! তারিক উপরে ওঠার সময় চিলেকোঠার দরজাটি ঠেলে সরিয়ে দেয় এবং উপরে ওঠে।
চিলেকোঠায় রক্ত জমে আছে এবং রক্তে জায়গাটি সয়লাব হয়ে গেছে। তারিক জানত না যে, একজনের শরীর থেকে এত বেশি রক্তপাত হওয়ার পরেও সে কিভাবে বাঁচতে পারে। কিন্তু সালিহকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। চিলেকোঠার কোণে এক জায়গায় রক্তে লেখা একটা বার্তা।
‘আমরা এখন সমান সমান।’
গল্পকার, ছড়াকার এবং অনুবাদক। লেখালেখির শুরু সত্তরের মাঝামাঝি। ঢাকার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে তার মৌলিক এবং অনুবাদ গল্প। এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে দুটি গল্পের সংকলন, চন্দ্রপুকুর (২০০৮) ও কতটা পথ পেরোলে তবে (২০১০)। এছাড়া, তার অনুবাদে আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৩), নির্বাচিত নোবেল বিজয়ীদের সেরা গল্প (২০১৩), ইরানের শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), চীনের শ্রেষ্ঠ গল্প ও নির্বাচিত ম্যান বুকার বিজয়ীদের সেরা গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছে।