যদি এমনটা ভাবা হয়, রৌদ্রময় দিন উত্তেজক কর্ম-কোলাহলের প্রতীক, তবে হিমালয়-ফেরতা মেঘদল যখন বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে বর্ষণ শুরু করে, ঠিক তখনই কর্মের উত্তেজনার সাথে মিশ্রিত হয় বেদনার মায়াকাজল। আর আমার মতো এক অলস কবি, যদি ঘুম থেকে জেগে দেখে সকাল সকাল অঝোরে ঝরছে বারিধারা, তখন আড়মোড়া না ভেঙে পাশ ফিরে শোয়াটা মোটামুটি এক সুনিশ্চিত পরিণতি মানতেই হয়৷ কেননা বৃষ্টির ফলে প্রকৃতির মাঝে যে শিরশিরে অনুভূতি তৈরি হয়, তা ক্রমশ দেহ মনে এসে ভূতের মতো ভর করে।
পৃথিবীর বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চলগুলোর কবিরা মূলত বৃষ্টিকেই প্রেরণার উৎস ভাবেন। কিন্তু আমি এই বৃষ্টিসিক্ত বদ্বীপে জন্মেও বৃষ্টির ভেতর কোনো প্রেরণার উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। তবে কি আমার প্রেরণা হারিয়ে গেছে বৃষ্টিবিমুখ বৈদেশিক কুটনৈতিক সম্পর্কের মাঝে? মনে এই সংশয় রেখে, শরণাপন্ন হলাম কবিগুরুর নিকট। যদি তাঁর মতো আমিও এই বৃষ্টিকে অনুপ্রেরণার আনন্দ-আসনে বসাতে পারি— মনে এই সরল বাসনাটুকু এখনো বজ্ররেণুর মতো ঝলক দিচ্ছে আর কী। কিন্তু ঘটনা ঘটল পান্তাভাতে ঘি ঢালার মতো। ঠিক যেন গুলিয়ে গেল সব। যে-ই না বৃষ্টি নিয়ে কবিগুরু গান শুনতে গেলাম, বিপত্তি ঘটে গেল শুরুতেই। যে গান প্রথম যৌবনে আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা যোগাত অথচ অবাক লাগছে, আজ আমার পোক্ত যৌবনের তবে কী দোষ হলো!
‘পাগলা হাওয়া বাদল দিনে’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটি অধিকাংশ রবীন্দ্রসংগীত প্রেমীদের পছন্দের তালিকায় প্রথমে থাকার কথা। গানটির ভেতর এক গভীর কৈশোর লুকিয়ে আছে৷ কিন্তু আমার তো যৌবন। কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে যে গানের মাতমে, তা এখন আমার দিকে অজস্র রম্য-প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে, পাড়াতো ভাবিদের মতন। তাই অলস মনের আড়মোড়া ভাঙাতে, ভাবলাম, গানের বাণীগুলো ধরে ধরে, আমার মতো করে, আমার বর্তমান বাস্তবতার সাথে, গানের যে বিরোধ অবস্থান, তা নিয়ে কিছু ভেবে তো দেখা যেতেই পারে। দেখা যাক, আমার উপলব্ধির কিঞ্চিত ওস্তাদি কতদূর এগুতে পারে।
গান ধরে ধরে—
‘পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে’
পাগল হাওয়া, বাদল দিন সবই ঠিক ছিল কিন্তু আমার মন কেন যে জেগে উঠছে না এই বিষবাষ্পের মহানগরে, তাই ভাবছি। চারকোনা আধো-অন্ধকার গৃহে, আর বেলকনিতে জলবাতাসের ঝাপটায় গতরাতে শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো, ভেজা কলাপাতার মতো বধির না না করছে। আজ সপ্তাহের যে বারই হোক না কেন, আমার জন্য আলস্য বৈকি অন্য কিছু বয়ে আনার কথা নয়। তাই দেহ মন না জেগে, জেগেছে আলস্য, জেগেছে ভয়, হতাশা, জেগেছে মৃত্যু! ঢাকার বৃষ্টি মানে যতটা স্বস্তি, তার গোপনে বড়ো হা করা আতঙ্ক হলো ডেঙ্গু। লক্ষ কোটি মশা জন্ম নেবে আর বাড়তে থাকবে মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা।
এখন নাগরিক এই জলাবদ্ধতা নিয়ে আমার বাংলা কবিতার পাগল মন কী রূপে শমপ্রাপ্ত হবে আল্লামালুম। ঠাকুর নেই কিন্তু আমাদের আছেন দুই দুই-খান স্থায়ী মেয়র৷ তাদের সেবা ও কর্মকৌশলের বিরতি জুড়ে জন্ম নিচ্ছে লাখে-লাখে এডিস মশা৷ ফলে, মন জেগে ওঠার সাথে সাথেই তার মুণ্ড-উর্ধ্বে ঘূর্ণায়মান মশার দঙ্গল তাড়াতে তাড়াতে আমি আর কোথা যাইব। অবিনশ্বর জলজট, ডেঙ্গুসন্ত্রাসে আমি অসহায়ের মতো ইন্দিরা রোডের এক ছোট্ট ব্যাচেলর রুমে এখন মন জাগানোর যোগ-ব্যায়াম করব কি না ভাবছি৷
‘চেনাশোনার কোন বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে’
ভাগ্যিস মন। যদি এই রোগাশ্রয় দেহের কথা কবি বলতেন, তবে তো মরণ হতো, বাপরে!
চেনাজানা শহরের পথ সব ডুবে গেছে জলে৷ আর পানিতে নিরবিচ্ছিন্ন ভাসছে অসংখ্য সিগারেটের অবশেষ, পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, স্যালাইন প্যাকেট, মরা জন্তু, কনডম, মানুষের মল মুত্রের সার-রস। রোগাশ্রয় দেহ নিয়ে রুচির বিপরীতেও সেই জল ডিঙিয়ে কোথাও যাওয়া বড়োই দুষ্কর।
এদিকে আমি রোগগ্রস্থ মন নিয়েই বা কোন পথে যাব? বর্তমান বাস্তবতায় আমার মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত বেকার যুবকের মন, নিশ্চয় ভালো থাকার কথা নয়। সেই মন চেনাশোনার ভেতর হোক বা বাইরে, কোথাও যেতে পারছে না। কেননা এ সময় দৃশ্যত অদৃশ্য এক সিজারে তার ডানা কেটে নিচ্ছে। কেটে নিচ্ছে হাত, পা, জিভ, লিঙ্গ অস্তিত্ব।
আর ছুটবোই বা কোথায়, রাস্তা ভরা জ্যাম, ফুটপাত সব অব্যবস্থাপনার দখলে। এদিকে, পথ যেখানে নাই, সেই পথহীন সকল পথই গিলে নিয়েছে রিয়াল-এস্টেট ডাইনোসর। তবে কি শুধুই ভাববাদী হবো? আমি যে বেঁচে আছি এটা শুধুই কি আমার ভাবনা, না বাস্তব। তবে কি আমার ভাবনাই শুধু সত্য? আর বাস্তব জীবন এক নিখুঁত দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিচ্ছু না! ভাবছি, আবার ভাবছি, হৃত্বিক ঘটকের নির্দেশনায়৷
‘ঘরের মুখে আর কি রে
কোনো দিন সে যাবে ফিরে
যাবে না, যাবে না
দেয়াল যত সব গেল টুটে’
ঘর? কোথায় আমার ঘর? কোন গ্রামে? কোন দেশে? প্রথমত, ঘর কি, তা বুঝতেই দেখি জীবন চলে যাবে আমার। ঘর বলতে সে কি আমি? শূন্যের উপর? আমার মন কি আমার ঘর, নাকি আমার দেহ? তবে আমার দেহের ঘর কোথায়? কোনো গ্রামে? কোনো দেশে? হায়রে দেশ!
যার ফেরা নেই, তার আবার ঘর৷ যদি ধরি, আমার ঘর আছে, আছে মন। তবে, আমি কি তাকে নিয়ে এই কটাক্ষের নগর ছেড়ে গ্রামে চলে যাব? সেই দলহারা শিমুল তুলোর পিছু পিছু… আমার হাতে বানানো, সুতোকাটা সেই থতমত ঘুড়ি, এখনো উজ্জ্বল স্মৃতির গোধূলির ভেতর ডুবে যেতে দেখি আমি। সাহেব-বুলবুলি, সেই লম্বা লেজওয়ালা পাখি, যার পিছন পিছন আমি গিয়েছিলাম দুপুরের বাঁশবন আর পিতরাজ জঙ্গলের অজানা গহীনে। তখন ছিল না ফেরার ভয়, তবু ঘর ছিল, ছিল মাতৃসদন।
অথচ এই বর্তমান বাস্তবতায় কোথায় আমার গৃহ? চারিদিকে তো শুধু দেয়াল আর তারকাঁটা। বৈদেশিক নিষেধাজ্ঞা, দেশের নিষেধাজ্ঞা। আর বারবার জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার সীমা কতটুকু। এই সীমা শুধুই দৈহিক নয়, তা আমার চিন্তা, মনন, মেধা আর পাগল মনেরও। মাথার উপর থেকে অদৃশ্য কেউ বারবার বলছে, মন পাগল হলে, মনকে হত্যা করো। তোমার মন থাকতে নেই। মন শুধুই শৌখিনদের জন্য। আমার মতো পুচকে কবির মন থাকতে নেই। শুধু থাকা চাই দাসত্ব।
‘বৃষ্টি নেশা-ভরা সন্ধ্যাবেলা
কোন বলরামের আমি চেলা
আমার স্বপ্ন ঘিরে নাচে মাতাল জুটে
যত মাতাল জুটে’
বৃষ্টি কি আদতেই নেশা? নাকি বৃষ্টি কোনো বিষ! আজ বৃষ্টি বিষ হয়ে ঝরছে। লাঙল কাঁধে আর কিভাবে হবো আমি বলরামের চেলা? এমনি কি কৃষ্ণ অনুরাগী হবারও উপায় নেই। লাঙল বদলে এসেছে কৃষি-বিপ্লব। কীটনাশক আর আধুনিক সব কৃষিযন্ত্র। সময় বদলে যায় তার আপন নিয়মে, আমিও বদলে যাচ্ছি বিষযুক্ত কৃষি উৎপাদনে৷ আমার পা ফেলার জন্য, কোথাও কি আছে বিষমুক্ত মাটি৷ চারিদিকে যেন শুধুই এসিড বৃষ্টি৷ আমি নাচব কোন বৃষ্টিতে! কোথায় আমার সকল মাতাল জুটে? চারিদিকে এতো এতো দোসর, ভয় হয়। জানি না কার নাচে লুকিয়ে আছে সাপের নাচন। জানি না, কে আড়াল করে সর্পজিভ!
‘যা না চাইবার তাই আজি চাই গো
যা না পাইবার তাই কোথা পাই গো’
কী চাইব? কার কাছে চাইব? চাওয়া পাওয়ার মাঝে জেগেছে সংশয়। আমি কি আমার খাদ্য চাইব? আমি কি চাইব আমার চিকিৎসা? আমার সুস্থ শিক্ষা? আমার অধিকার?
কার কাছে চাইব? কোথায় পাইব?
নাকি আমি মনে মনে সবকিছু চাইব পরকালে! ভাবনার গভীরে রঙিন চশমা পড়ে, চাইব নাকি রঙিন প্রজাপতির ডানা, হরেক বেলুন, হাওয়ায় মিঠাই— আমার হারানো অতীত চাইব? নাকি চাইব সরকারি চাকরি? নিরাপদ সড়ক? বাকস্বাধীনতা? গনতন্ত্র?
হে রবীন্দ্রনাথ— আমি কি চাইব, আমাকে একটু বলে দেবেন প্লিজ।
‘পাবো না, পাবো না, আ মরি
অসম্ভবের পায়ে মাথা খুঁটে’
এই তো এবার আমার অবস্থানে এসেছেন। আপনাকে স্বাগতম কবিগুরু। পাবো না-র দলে এবার নেমে আসুন। আসুন আমাদের চেতনার তীক্ষ্ণ তরবারির ধার হয়ে। আপনার রেখে যাওয়া সোনার বাংলায়, আজ তার সব সোনা জব্দ হয় বিমানবন্দরের বাথরুমে। আপনি কি এসব জানেন ঠাকুর?
আমাদের আর পাগলা হাওয়ার বাদল দিন নেই৷ আপনার আর আমার মাঝে বয়ে গেছে অতিকায় এক নোংরা নয়ান-জুলি। তাতে ভেসে যায় তরুণের ভবিষ্যৎ, গ্রামীণ বাল্যবিবাহ, সাম্প্রতিক বিদ্বেষ, আমাদের মৌলিক চাহিদা, হতাশা আর তীব্র ঘৃণা।
আপনি কি শুনছেন আমার কথা? কবিগুরু! কবিগুরু! আপনি কোথায় গেলেন!
হে রবীন্দ্রনাথ!
কবিতা লেখেন মূলত; পাশাপাশি গদ্য লিখতে চেষ্টা করেন। প্রকাশিত বই: যামিনী ও মরমী ধনুক ( কবিতা)।