বুধবার, নভেম্বর ২০

রিচার্ড সিকেনের কবিতা : ভূমিকা ও ভাষান্তর : লায়লা ফারজানা

0

Richard Sikenরিচার্ড সিকেন আমেরিকান কবি, চিত্রশিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা—জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, নিউ ইয়র্ক শহরে। তাঁর কবিতাসংগ্রহ ‘ক্রাশ’ (ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৫) ২০০৪ সালে ‘ইয়েল সিরিজ অব ইয়ং পোয়েটস প্রাইজ, ল্যম্বডা লিটারারি অ্যাওয়ার্ড’ ( সমকামী লেখকদের জন্য প্রযোজ্য) জিতে নেয়। ২০১৫ সালে কপার ক্যানিয়ন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কবিতার বই, ‘ওয়ার অফ দ্য ফক্সেস্’। তাঁর কবিতা ‘স্থানচ্যূত ঘর (The Dislocated Room)’ আমেরিকার শ্রেষ্ঠ কবিতা ২০০০ (The Best American Poetry 2000) এ অন্তর্ভুক্ত।

বর্ণনামূলক এবং দৃশ্যময়তায় পরিপূর্ণ রিচার্ড সিকেনের অধিকাংশ কবিতা আতঙ্কজনক আবহ সৃষ্টি করে। লুইস গ্লিক ‘ক্রাশ’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন ‘এটি একটি আতঙ্কের বই।’ তবে রিচার্ড সিকেনের অধিকাংশ কবিতা জুড়েই থাকে প্রেম, বেদনা, কামনা আর আকাঙ্ক্ষার কথা। তিনি তাঁর কবিতায় কামনা এবং প্রেমাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে বলেন ‘যা লাল, যেমন একটি আপেলের টুকরো, একটি চুম্বন এবং রক্ত।’ বলেন অসুস্থতা, ক্ষুধা এবং নদী থেকে টেনে তোলা লাশের দুঃস্বপ্নের কথা, কবিতার জন্য প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা আর অদ্ভুত বেদনার কথা। কবিতার কলাকৌশল, ফর্ম নিয়ে নানারকম নিরীক্ষার ক্ষেত্রে সিকেন একজন মায়েস্ত্রো। ফর্ম আর বিষয়বস্তুর সার্থক সমন্বয় তাঁর প্রতিটি কবিতাকে করে তোলে জলপ্রপাতের মতো বহমান।


 

স্থানচ্যূত ঘর (Dislocated Room)


অনেক মাইল রাতের পর বেগুনি আকাশে ফুটল আসল তারারা,
যেমন ছোটো ছোটো নৌকাগুলো
বাইতে বাইতে অনেক দূরে অদৃশ্য হতে শুরু করে।
আর সেখানে, সেই দূরত্বে, কোনো প্রতিশ্রুত জমি নয়, আছে এক হলিডে ইন,
সঙ্গে একটি পুল, আর চেইন লিঙ্কে ক্রমবর্ধমান
বোগেনভিলিয়া।

খোলা দরজা; জোড়া বিছানা, যমজ বাতি, সেলোফেনে মোড়ানো
জোড়া প্লাস্টিকের কাপ,
সে বলে ওঠে, ‘না হেনরি, এটা করো না।’
তুমি কি ঐ রুম থেকে আসা একটি প্লট দেখতে পাও, ভঙ্গুর লাইনের বিন্দুগুলির মতো?
এখানে এই রক্ত ধুয়ে ফেলার সিঙ্ক,
এই হুইস্কি,
এই ছিঁড়ে যাওয়া শার্ট,
বাথরুমে মেঝের টালি,
ড্রেনের ছিদ্র দিয়ে খোঁচানো ডিস্ক,
এখানে এই মাংসের বস্তার মতো ছেলেটি,
এখানে এই ইঞ্জিনেরা,
এই ছোটো ঘর—যেটি ঘর নয়,
হেনরি—যে কোনো হেনরি নয়
যে হেনরি সুঁই-সুতো চালাতে থাকে ফাঁপা ছেলেটির উপর,
সার্বজনীন বিছানার চাঁদরের উপর হুঁশ হারিয়ে পরে আছে যে।
এখানে তাকে আবার সেলাই করা হচ্ছে।
সুতরাং আমরা এখন একটি মহা যুদ্ধক্ষেত্রে,
উত্তাপ—এখনো জ্বলছে আগুন,
আর গরম ধোঁয়ার মতো পালিয়ে যাচ্ছে ভাঙা প্রতিশ্রুতিরা।

এই সেই অংশ যেখানে তুমি আবার নিজের
পোশাকে জেগে ওঠো,
এই সেই অংশ যেখানে তুমি ভবনের ভিতরে
থাকার চেষ্টা করো।
‘আপাতত ঘরে থাকো’, সে বলে, ‘আপাতত ঘরে থাকো’।
এই সেই স্থান, তুমি নিজের মনে বলো, যেখানে সবকিছুর শুরু,
ক্ষতগুলি প্রকাশ করে একটি পুরু ত্বক আর হঠাৎ পায়ের নিচে অদৃশ্য হয়ে যায় মেঝে।
এদিকে, ভবনের তলদেশে একটা কিছু তোমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টায় ব্যাস্ত—
একজন মানুষ যার বাদামি চোখ
আর মেরুদণ্ডের দৈর্ঘ্য জুড়ে সঞ্চালিত একটি জিপার।
তুমি লিনোলিয়ামে তার ছায়া দেখতে পাও—
ধীরে ধীরে টাইলস বেয়ে যাওয়া নৌকার মতো,
আর তার বাহুর মাস্তুলগুলো জানালার সাথে ধাক্কা খায়।
এক গ্লাস দুধ হাতে সে তোমার দিকে ইশারা করে,
যেন সে বলতে চায় তোমার গভীরে সমাহিত
এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে এখন ছুরি দিয়ে খনন
করতে হবে তার।
ঘণ্টা বেজে ওঠে, কুকুরের গর্জন এবং তারপর কুণ্ডলিত বাতাস,
আলো পড়ে জ্বলজ্বল করে তার মুখ,
তারপর কুকুরের কান্না,
নোংরা বৃষ্টির বিরুদ্ধে শক্তভাবে জানালাকে
বন্ধ করে সে।
এখানে হলওয়ে, এখানে দরজা এবং এখানে ভয়
—অন্য এক অস্তিত্বের,
এক অদমনীয় অস্তিত্বের,
তোমার শরীর তলিয়ে যায় মাধ্যাকর্ষণে।

একটি মধ্যবর্তী অবস্থান,
দুটি স্থানের মধ্যে কিছু ঘটার অপেক্ষা,
একটি নোটের সাথে পরবর্তী নোটের যে দূরত্ব,
যেখানে তুমি বিভ্রান্ত: ঘরকে তার হাত ভেবে,
কুকুরকে মানুষ ভেবে,
আর রক্তকে ছিঁড়ে যাওয়া আকাশ।
তোমাকে ঘরে রাখতে তোমার উপর হাত রাখে সে।
এখন অনেক রাত। এখন দুপুর। সে গাড়ি চালায়।
শুরু থেকে আবার ঘটতে শুরু করে সব।

এটি প্রেম, নয়তো নয়। এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
তুমি একটি গাড়িতে। তুমি আবার আগাছায়,
একটি এলোমেলো রাস্তায়,
চারিদিকে অপরাধীরা বিপদ আর সমস্যার খোঁজে।
‘হেনরি, সে বলে– কে কথা বলছে?
আমি ভেবেছি দাঁতের সাথে বরফের সংঘাতের শব্দ শুনছি।
আমি ভেবেছি আমি কাচের সাথে দাঁতের সংঘাতের
শব্দ শুনছি।’

দরজা খোলো, আলো আসুক ভিতরে,
মুখ খোলো, আলো বেড়িয়ে যাক।
সে তোমার উপরে। সে তোমার পাশে,
আসলে সে একদম কাছাকাছি।
নরম ত্বকে পুরোপুরি মোড়ানো সে।
এটা সে নয়। এটা তুমি নও। তুমি এখন পড়ে যাচ্ছ।
তুমি সাঁতার কাটছ। পরিস্থিতি অনুকূলে নেই।
তুমি নিশ্বাস নিচ্ছ না।
তুমি আবার ক্লোরিনযুক্ত পুল বেয়ে উঠছ।
আমাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত সংকেত দেওয়া হয়নি।
আমাদের কিছুই দেওয়া হয়নি।

আমরা সারা রাত গাড়ি চালিয়েছি।
আমরা দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালাচ্ছি।
আমরা থামতে চাই। আমরা পারি না।
এসবের কি কোনো গ্রহণযোগ্য পরিণতি আছে?
আমরা কি আসলেই তা বলি যা বলতে চাই?
এটা কি যথেষ্ট যে আমরা শব্দের কম্পন?
বাম হাতে কাঁটাচামচ মুখের কাছে উঠছে,
তোমার কণ্ঠনালীতে মাংস নিচে নামার অনুভূতি,
তুমি ভাবছ
‘আমার কণ্ঠনালী, এই আলোর কোণে
সবকিছুই আমার।’

অ্যাশট্রে এবং ভাঙা বাতি, ঘিনঘিনে কমলা পর্দা এবং তার নোংরা শার্ট।
আমি তোমার শরীরে ছিলাম, সোনা, এবং সেটি ছিল স্বর্গ।
আমি তোমার শরীরে ছিলাম এবং সেটি ছিল
কার্নিভাল রাইড।
তারা থামতে চায়, কিন্তু থামতে পারে না।
তারা জানে না তারা কি করছে।
এটি ঝুঁকিহীন নয়,
এটি কীভাবে স্পর্শ করা যায়,
আমরা চাই না আমাদের চোখের সামনে থেকে
পর্দা পুরোপুরি উঠে যাক,
ততটুকুই উঠুক গর্ত দেখতে যতটুকু যথেষ্ট।

ক্লান্ত এবং কালশিটে, ভুল পথে ঘষে ঘষে রক্তাক্ত, কম্পিত আলোতে।
তারা থামতে চায়, কিন্তু থামে না।
বুলেটটি বের করতে পারে না।

আমাকে কেটে খুলে দাও
এবং আলো প্রবাহিত হোক।
আমাকে সেলাই করে দাও
এবং সেলাইগুলির মধ্যে আলো প্রবাহিত হোক।

সে পারে না, বুলেটটি বের করতে
সে ভাবে সে অপারগ,
তারপর সে সক্ষম হয় একটি সামান্য নুড়ি থেকে একটি মুক্তা গড়তে।
জুনের মধ্যরাত। জুলাইয়ের মধ্যরাত।
তারা এখন কয়েক দিন ধরে তাই করছে।

বের করা হচ্ছে বুলেট।
বুলেট খুঁড়ে আলো, আলোর কাছে মেলে ধরা।
বুলেট খুঁড়ে আলোর কাছে মেলে ধরা।


প্রার্থনা-সংগীতে যেসব থাকতে নেই
(Litany in Which Certain Things Are Crossed Out)


প্রতিদিন সকালে ম্যাপেলের পাতা ঝরে।
প্রতিদিন সকালে, একটি নতুন অধ্যায়,
নায়কের পদোন্নতি।
প্রতিদিন সকালে, সেই একই ছোটো-বড়ো শব্দে আকাঙ্ক্ষার ব্যাখ্যা আর উপস্থাপন—
তুমি সবসময়ই একা এবং একাই মারা যাবে।

তাই হয়তো আমি তোমাকে অনির্ধারিত কর্মের
একটি ক্যাটালগের চেয়েও বেশি কিছু দিতে চেয়েছিলাম,
হতাশা ছাড়াও অন্য কিছু।

লক্ষ্মীটি, যাই হোক না কেনো,
আমি দুঃখিত, আমি তোমার জীবনে থাকতে পারিনি।
লক্ষ্মীটি, যাই হোক না কেনো,
আমি দুঃখিত যে আমি তোমার জীবনে এসেছি,
তোমাকে প্রলুব্ধ করেছি এবং তোমাকে ক্ষতবিক্ষত
এবং ধ্বংস করে রেখেছি,
লক্ষ্মীটি কতটা অসহায় আজ তুমি!

তুমি একটি সুখের গল্প চাও। কে না চায়?
তাহলে একটা অরণ্যের গল্প হোক।
সুন্দর গাছ। আর এক নারীর। গান গাইছে।
পানির উপরে প্রেম, পানির নিচে প্রেম, প্রেম, প্রেম ইত্যাদি।
কী মিষ্টি সুকণ্ঠী নারী। গাও সুন্দরী, গাও!
অবশ্যই, সে ড্রাগনকে জাগিয়ে তুলছিল।
প্রেম সবসময় ড্রাগন জাগিয়ে তোলে এবং হঠাৎই আগুন লেগে যায় সব জায়গায়।
আমি বলতে পারি তুমি ইতিমধ্যেই ভেবে নিয়েছো আমিই সেই ড্রাগন,
যে হয়তো অবিকল আমারই মতো, কিন্তু না, আমি ড্রাগন নই।
আমি রাজকুমারীও নই।
কে আমি? আমি শুধু একজন লেখক।
আমি বিষয়গুলোকে লিখে রাখি।
আমি তোমার স্বপ্নের মধ্য দিয়ে হাঁটি আর ভবিষ্যত উন্মোচন করি।
অবশ্যই, আমি ডুবিয়ে দেই প্রেমের নৌকা, কিন্তু সেটা পরের কথা।
আর হ্যাঁ, আমি কাচ গিলেছি, কিন্তু সেটাও পরের কথা।
আমি তোমাকে জোর করে দেয়ালে ঠেলে দিব
এবং তোমার শরীরের প্রতিটি অংশ ইটের সাথে ঘষে ছিলে যাবে।
চুপ করো, আমি সেই মুহূর্তে প্রবেশ করছি।

আমি কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে ড্রাগন ভেবেছিলাম।
আমার মনে হয় আমি তোমাকে এখন বলতে পারি।
কিছু সময়ের জন্য, আমি এটাও ভেবেছিলাম আমি রাজকন্যা,
গোলাপি কটন-ক্যান্ডির মতো, আমার ঘরে বসে আছি, দুর্গের টাওয়ারে,
তারুণ্য, সৌন্দর্য আর প্রেম নিয়ে,
আত্মবিশ্বাসের সাথে অপেক্ষা করছি তোমার জন্য,
কিন্তু রাজকন্যা তো কেবল আয়না দেখে,
আর আমি এখানে বাইরে পরে থাকি কাদায় নিমজ্জিত হয়ে,
নিশ্বাসে আগুনের প্রবেশ,
আর আমাকে ছুরির আঘাতে আঘাতে হত্যা করা হয়।

সুতরাং, ঠিক হলো: আমি ড্রাগন।
এটা একটা বিশাল ব্যাপার।
তোমাকে এখনও নায়কের ভূমিকা পালন করতে হবে।
তোমাকে জাদুর গ্লাভস দেওয়া হয়েছে!
যোগাযোগের জন্য দেয়া হয়েছে একটা মাছ।
মশালের মতো চোখ আছে তোমার!
বলো এর বেশি তোমার আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে?
আমি তোমার প্যানকেক তৈরি করি, তোমাকে শিকারে নিয়ে যাই,
তোমার সাথে এমনভাবে কথা বলি যেন
তুমি সত্যিই সেখানে।
তুমি কি সেখানে, প্রিয়তম?
তুমি কি আমাকে চেনো?
এই মাইক্রোফোনটি কি জীবন্ত ?

আমাকে একবারের জন্য সব আগের মতো করতে দাও,
প্রমাণের জন্য, আমাকে ক্রিম এবং তারা দিয়ে
এমন কিছু তৈরি করতে দাও যা হয়ে যায়, তোমার বর্ণনায় — স্বর্গ।

তুমি শুনতে পাও তোমার মাথার মধ্যে ফোন বাজছে
আর চোখ খুলে দেখো বিস্তীর্ণতায় একটি হরিণ।
হরিণ, তোমাকে স্বাগতম!

তোমার মাথার ভিতর কাচের শব্দ,
একটি গাড়ি-দুর্ঘটনার শব্দ,
কতগুলি ট্রাক গড়িয়ে ধীর গতিতে বিস্ফোরিত হওয়ার শব্দ।
লক্ষীটি, সে কারণে আমি দুঃখিত।
হাড় বেড়িয়ে যাওয়া কনুইয়ের জন্য আমি দুঃখিত,
দুঃখিত এজন্য যে আমরা এখানে ছিলাম,
আমি দুঃখিত সিঁড়ির নিচের সেই দৃশ্যের জন্য
এবং কিভাবে আমি সবকিছু নষ্ট করেছিলাম সেটা
প্রকাশ করে তার জন্য।
বিশেষ করে সেটি আমার জানা উচিত ছিল।
দেখো, আমি যে অংশগুলো মনে রাখি
সেগুলোকে আবার একসাথে সেলাই করে এমন একটি প্রাণী তৈরি করতে চাই;
যে আমি যা বলি তাই করবে
কিংবা আমাকে ভালোবাসবে আমার ভালোবাসার প্রতিদানে।

আমি জানি না কেনো এমন চাই
তবে এই সংস্করণে কালো আকাশে কাঁটা খুঁচিয়ে নিংড়ানো সামান্য আলোর জন্য
নিজেকে একজন খারাপ লোকের কাছে সমর্পণ করবে না তুমি।
আমি তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
কাঠের হলগুলো কফিনের মতো। এগুলি নিম্নস্তরের পরিভাষা।
আমি সেগুলো তোমার কাছ থেকে ফেরত নিচ্ছি।
এই ছবিতে প্রেমিকা বারবার মরে যায়।
ক্রসআউট।
অন্ধকার ঘরে আনাড়ি হাত।
ক্রসআউট।
ফ্লোরবোর্ডের নিচে যা কিছু।
ক্রসআউট।
এবং এখানে থাকবে একটি পুনর্গঠিত তাম্বু।
এই দৃশ্যে সবাই সব সময় সুখী
এবং আমাদেরকে ক্ষমা করা হয়েছে।
যদিও আমরা সে ক্ষমার যোগ্য নই।

তুমি শুনতে পাও তোমার মাথার মধ্যে একটি ফোন বাজছে
আর চোখ খুলে দেখো একজন অপরিচিত ব্যক্তির বাথরুমে,
তুমি নিজেকে পরিষ্কার করছো, একটি হলুদ তোয়ালে জড়িয়ে,
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, তোমার জানা সবচেয়ে নোংরা জিনিস থেকে
মাত্র বিশ মিনিট দূরত্বে।
এই একটি ছাড়া দুর্গের সব কক্ষ, কেউ বলে, এবং হঠাৎ অন্ধকার,
হঠাৎ শুধু অন্ধকার।
বসার ঘরে, ভাঙা উঠোনে, গাড়ির পিছন দিয়ে আলো চলে যায়।
বিমানবন্দরে বাথরুমের গার্গেল — ফ্লাশ,
একটি ফার্মেসিতে স্নান করা অপ্রাকৃত আলো,
আমার হাত অদ্ভুত, আমার মুখ অদ্ভুত,
আমার পা অনেক অনেক দূরে।
আর তারপর বিমানে,
ডানার উপরের জানালার সিটের জানালায় ডানার দৃশ্য,
একটি ছোটো চিনাবাদামের ফয়েল ব্যাগ।

আমি যখন শহরে পৌঁছলাম, তুমি স্টেশনে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলে,
তুমি এমনভাবে হেসেছিলে যে, তোমার হাসি আমাকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।
আমি গলির নিচে, তোরণের চারপাশে, ভবনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিলাম
ভাঙা কলসহ ছোট্ট সেই ঘরে,
তোমার আঁকা ছবি, তোমার সমস্ত জিনিস,
আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে বললাম, “এটা বাড়ির থেকে আলাদা মনে হচ্ছে না,”
কারণ তা ছিলো না, কিন্তু তারপর আমি লক্ষ
করলাম কালো আকাশ এবং সেই সব আলো।

আমরা বাড়ির ভেতর দিয়ে এলিভেটেড ট্রেনে উঠলাম।
এইসব দালান, সেইসব কাচ আর চকচকে সুন্দর যান্ত্রিক বাতাস।
ট্রেনে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তখন তুমিও কেঁদেছিলে, তুমি হেসেও ছিলে
আর এমনভাবে হাসছিলে আর কাঁদছিলে, যা আমাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিল।
তুমি বলেছিলে,
‘আমি যা চেয়েছি তাই পেতে পারতাম, কিন্তু বলতে পারিনি।’

প্রকৃতপক্ষে, তুমি বলতে পেরেছিলে লক্ষ্মীটি,
যা তোমার কাছে, সাধারণ রোমান্টিক
ভালোবাসার চেয়েও বড় বেশি কিছু। প্রায় ধর্মের মতো।
আর তাই ভয়ের।
আর তাই কেউ কখনও তোমার অন্তরঙ্গতা চাইবে না।

ঠিক আছে, তুমি যদি এতই মহান, তবে একটা কাজ করো,
এখানে একটা পেন্সিল,
এটাকে ব্যাবহার করো….
যদি জানালাটি তোমার ডান দিকে থাকে তবে তুমি নিজের বিছানায় আছো।
যদি জানালাটি তোমার হৃদয়ের উপরে থাকে আর যদি আঁকা আর রং করা হয়
এভাবে যেন জানালাটি বন্ধ, তাহলে আমরা দম ভরে নিচ্ছি নদীর জল।
আমার জন্য একটি শহর নির্মাণ করো আর নাম দাও জেরুজালেম।
আমাকে আরো একটি শহর নির্মাণ করে দাও আর তার নাম দাও
জেরুজালেম।

আমরা জেরুজালেম থেকে ফিরে এসেছি,
যেখানে আমরা পাইনি যা চেয়েছিলাম,
তাই এটি শেষ করে দাও, আমাকে অন্য সংস্করণ দাও,
একটি ভিন্ন রুম,
আরেকটি হলওয়ে,
বহুবার রঙের উপর রং করা একটি রান্নাঘর,
আরেক বাটি স্যুপ।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার পুরো ইতিহাস বলতে প্রায় সত্তর মিনিট সময় লাগে।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের কাছে সেই পরিমাণ সময় নেই।

ভুলে যাও ড্রাগন, বন্দুকটি টেবিলে রেখে যাও,
এর সাথে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই।
চলো সোনালি আলোয় এপিফ্যানির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাই,
ক্যামেরা যখন ঝুকে আসে লেকসাইডে, অ্যাকশন এবং ব্যাকলিট,
সবই ফ্রেমের মধ্যে পড়ে যায়,
এতটাই কাছাকাছি যে কুৎসিত কিছু বললে,
আমার চোখের নীল বলয়টি দেখতে পাওয়ার মতো।

গল্পের শেষটা আমারও ভালো লাগেনি।
ভুল পথে প্রবাহিত হয়ে গেছে অনেক ভালোবাসা,
এবং আমি এমনও না যে বলতে চাই ওটা ভুল পথ।
কিন্তু এভাবে হয় না, এই বিস্মৃতি, বারবার কুঁচির ভাঁজ।
মেনে নিচ্ছি কিছু সুন্দর মুহূর্ত ছিল, সমস্ত লেমনড্রপ এবং
মেলোনবল, সিল্কের পায়জামা পরে হাসি এবং
টোস্টে চিনির দানা,
প্রেম ভালোবাসা বা যাই হোক না কেন, একটি বাছাই করো।
আমি দুঃখিত এটি একটি ক্ষয়ের গল্প।

ক্ষমা করো প্রিয়, তুমি জানো যে সম্প্রতি আমরা অসুবিধার সম্মুখীন,
আর তোমার কাছেও আমার অনেক প্রশ্ন।
আমি হাই স্কুলে একবার চেষ্টা করেছি, সেই দ্বিতীয় লাঞ্চে,
এবং তারপর আবারও কয়েক বছর পরে ক্লোরিনযুক্ত পুলে।
আমি এখনও তোমার সাহায্য চাই,
সেইসব বিলাসিতাও এখন আমার নেই।
আমি তোমাকে জানিয়েছি আমার অবস্থান,
সব পরখ করে দেখো।

আমরা আমাদের পেট আঁকড়ে ধরে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ি…
যখন আমি এই কথা বলি, এর অর্থ হাসি, বিষ নয়।
আমি আরো হাততালি চাই.
আমি নায়কদের জন্য আলাদা করে রাখা আরও আসন দেখতে চাই।
ক্ষমা করো প্রিয়,
আমি তোমার জন্য একটি প্লেট সাজিয়েছি।
উঠোনের চারপাশে ঘোরাঘুরি বাদ দাও,
ভিতরে আসো।


বুট থিওরি (Boot Theory)


একজন লোক বারে ঢুকে বলে:
‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে যান— অনুগ্রহ করুন।’
তুমি তাই করো।
তাকে বৃষ্টিতে বাইরে নিয়ে যাও
এবং তারপর তার প্রেমে পড়ে যাও
এবং তারপর সে তোমাকে ছেড়ে চলে যায়
এবং তারপর তুমি পরিত্যক্ত একা।

আন্ডারশার্টে তুমি একজন ভঙ্গুর মানুষ,
একটি কুশ্রী বিছানার চাদরে শুয়ে,
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছো উপরে,
সিলিং-এর জলের দাগের দিকে।
আর শুনতে পাও
তোমার উপরের অ্যাপার্টমেন্টের লোকটির
জুতা খুলে ফেলা।
তুমি শুনতে পাও তার প্রথম বুট
মেঝেতে আঘাত করে,
তুমি আবারও উপরের দিকে তাকাও,
অপেক্ষায় থাকো কারণ
তোমার ধারণা এটিকে অনুসরণ করবে আরও একটি বুটের শব্দ,
তোমার ধারণা সেখানে থাকবে কিছু যুক্তি,
যা সবকিছুকে একসাথে জুড়ে দিবে।
কিন্তু তারপর আমরা আবারও এখানে
আগাছায় নিমজ্জিত,
আমরা আবারও এখানে বিষয়টির কেন্দ্রবিন্দুতে:
মহাবিশ্বের যুক্তিহীনতায়।
এবং তারপরে পড়ে দ্বিতীয় বুট।
এবং তারপর তৃতীয়,
তারপর চতুর্থ,
তারপর পঞ্চম।

একজন লোক বারে ঢুকে বলে:
‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে যান —অনুগ্রহ করুন।’
কিন্তু তুমি এবার তাকেই নাও।
নিয়ে যাও তোমার বাড়িতে,
এবং তাকে একটি চিজ-স্যান্ডউইচ তৈরি করে দাও,
এবং তার জুতা খুলতে চেষ্টা করো,
কিন্তু পরিবর্তে সে তোমাকে লাথি মারে
এবং সে তোমাকে লাথি মারতেই থাকে।
তুমি গিলে ফেলো ঘুমের ওষুধের একটি আস্ত বোতল।
কিন্তু কাজ হয় না।
মেঝেতে বুট পড়তে থাকে অবিরত—
তোমার উপরের অ্যাপার্টমেন্টে।
পরের দিন, কিছু হয়নি ভান করে কাজে যাও।
তোমার সহকর্মীরা জানতে চায় তোমার কুশল।
সবকিছু ঠিক আছে কিনা
এবং তুমি বলো সব ঠিক, শুধু ক্লান্ত।
এবং তুমি হাসতে চেষ্টা করো।
এবং তারাও হাসতে চেষ্টা করে।

একজন লোক বারে ঢুকে, বলে:
(এবং এই সময় ঘটনাক্রমে সেটা তুমি,)
‘ডাবল করে দিন একটা।’
একজন লোক বারে ঢুকে, বলে:
(এবং এই সময় ঘটনাক্রমে সেটা তুমি,)
‘আমার জুতায় এক মাইল হাঁটুন।’
একজন লোক একটি রকমারি দোকানে ঢোকে, বলে:
(এবং এখনও ঘটনাক্রমে সেটা তুমি,)
‘আমি সাধারণ কিছু চাই, সহজ কিছু…’
কিন্তু দোকানদার তোমাকে কিছু কিনতে
অথবা বেরিয়ে যেতে বলে।
একজন মানুষ তার কষ্টকে বয়ে নিয়ে যায় নদীতে,
একজন মানুষ তার কষ্টকে বয়ে নিয়ে যায়,
ছুঁড়ে ফেলে দেয় নদীতে,
কিন্তু তারপর সেই নদী নিয়েই ফিরে আসে।
একজন মানুষ তার হাত পেতে দুঃখ নেয়,
সেই দুঃখকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়
কিন্তু তারপরও রয়ে যায় তার হাত।


শেহেরজাদ (Scheherazade)


আমাকে সেই স্বপ্নের কথা বলো
যেখানে আমরা হ্রদ থেকে মৃতদেহদের টেনে তুলে
আবারও গরম কাপড় পরাই।
যেভাবে অনেক দেরিতেও,
কেউ ঘুমাতে পারেনি,
যেভাবে ঘোড়াদের ছুটে চলা যতক্ষণ না ভুলে যায় তারা ঘোড়া।
এতো আর গাছের শিকড় নয় যে কোথাও গিয়ে শেষ হতে হবে,
এ অনেকটা পুলিশের রেডিওতে একটানা গানের মতো,
নাচের জন্য আমাদের কার্পেট গুটানোর মতো
আর সেই উজ্জ্বল লাল দিনগুলিতে
আমাদের প্রতিটি চুম্বনের মুহূর্তে
টুকরো হওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত আরেকটি লাল আপেলের মতো।
জানালা দিয়ে আলোর দিকে তাকাও।
দেখো দুপুর হয়ে গেছে, অর্থাৎ আমরা অসহায়।
আমাকে বলো কিভাবে
এই সবকিছু, এমনকি ভালোবাসাও,
আমাদের ধ্বংস করবে।
আমাকে বলো, কিভাবে
এই সবকিছু, আমাদের আলো-আবিষ্ট শরীর,
(চিরদিনের নয়)
আমরা এতে অভ্যস্ত হব না!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন (আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকশন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা একজন নাট্যশিল্পী এবং শিল্প ও সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় রয়েছে তার সাবলীল যাতায়াত। নিউইয়র্ক-এর ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন) তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান, যেখানে তিনি ‘সাসটেইনেবল-আর্কিটেকচার’ এর চর্চা করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।