মিরপুর বাংলা কলেজে খুব একটা ক্লাস হতো না। সোহেল রানা সেই অবসরে তখন অভিনয় শিখতে মঞ্চে যেতে লাগলেন। মিরপুর থেকে লোকাল বাসে করে প্রায় প্রতিদিন নাগরিক, তারপর যাওয়া হতো প্রাচ্যনাটে। ২০০৯ থেকে প্রাচ্যনাটে নিয়মিত হবার পর মঞ্চের এপাশ-ওপাশের ব্যস্ত কর্মী বনে যান। মঞ্চে নিয়মিত কাজ করলেও মেইন স্ট্রিম মিডিয়ায় ইন করতে সময় লেগে যায় ১০ বছর। এসময় সোহেল টিভি ফিকশন অস্থির সময়ের স্বস্তির গল্পের ‘শ্যাওলা’ নাটকটিতে কাজ করে ইন্ডাস্ট্রির মানুষজনের কাছে বেশ পরিচিতি পান। এরপর আবার বিরতি। মাঝে পেট চালাতে কাজ করেছেন সম্পাদনারও, তবে নজর ছিল অভিনয়েই।
অনেকেই হয়তো জানেন না, বর্তমান সময়ের অন্যতম ব্যস্ত এই অভিনেতা সোহেল মণ্ডলের বড়োপর্দায় কাজ শুরু ‘আয়নাবাজি’রও আগে। প্রথমে ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’ এ শিমুর প্রেমিক হিসাবে, তারপর ২০১৬ সালে নির্মাতা আশিকুর রহমানের পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ছবি ‘মুসাফির’ এ ভিলেনের নেশাগ্রস্থ ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। তবে মিডিয়ার লাইমলাইটে আসেন ‘তাকদীর’-এর ‘ভাইসা’ হয়েই। হইচই প্ল্যাটফর্ম তাকে ‘তাকদীর’ এনে দেয়, এরপর ‘বলি’-তে এক ওয়েস্টার্ন কস্টিউমে আচানক উদয় হওয়া যুবকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সর্বশেষ মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত ‘রিফিউজি’, যে সিরিজের নির্মাতা ইমতিয়াজ সজীব। নির্মাতা ছাড়াও শো রানার হিসাবে আছে আদনান হাবিব আর কান ফেস্টিভাল মাতিয়ে আসা ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর নির্মাতা আবদুল্লাহ মুহাম্মদ সাদ। সাম্প্রতিককালের অন্যতম সাহসী এই কনটেন্টটিতে ‘ইকবাল’ চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা পাচ্ছেন সোহেল। ঢাকার মিরপুরে বসবাসরত বিহারিদের জীবনসংগ্রাম প্রথমবারের মতো তাদের ভাষায় এত খোলাখুলি উঠে এসেছে এই সিরিজে।
শ্রী-র অনুরোধে ‘রিফিউজি’ এবং মেজবাউর রহমান সুমনের মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমা ‘হাওয়া’ নিয়ে সোহেল মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলেছেন মারুফ ইমন। আজ থাকছে সাক্ষাৎকারটির প্রথম পর্ব।
প্রশ্ন: ‘রিফিউজি’ সিরিজের দর্শক হিসাবে উন্মুখ হয়ে ছিলাম ওদের ভাষাটা অভিনয়শিল্পীরা কীভাবে আয়ত্ত্ব করেন সেটা দেখার জন্য। সিরিজ দেখার পর মনে হলো বেশ ভালো ও একটা পরিকল্পিত কাজের ফল পাওয়া গেছে। পরে জানলাম ভাষা শিক্ষকও ছিলেন ‘রিফিউজি’ টিমে। তো আপনার জন্য এটা আয়ত্ত্ব করা কতটা চ্যালেঞ্জের ছিল?
সোহেল মণ্ডল: যেকোনো নতুন ভাষা আয়ত্ত্ব করাটাই ভীষণ চ্যালেঞ্জের। যারা পারফর্ম করেন বা এই প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যান, তাদেরকেই ডিল করতে হয়। রিফিউজির ক্ষেত্রেও আমাদের ভাষা নিয়ে অনেক কাজ করতে হয়েছে। ভাষা শিক্ষক হিসাবে ছিলেন আবদুল গণি, বিহারি ক্যাম্পেই থাকেন উনি। এই বিহারি ক্যাম্পে বসবাসরত লোকদের ভাষা এখন অনেকটা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে সেটা না-উর্দু আবার না পুরোপুরি হিন্দী, অনেকটা হিন্দী-উর্দুর মিশেল। এছাড়া অনেক বাংলা শব্দও তাদের কথ্য ভাষায় ঢুকে গেছে। এখন নতুন একটা টোনালিটি বা বলার ধরন তৈরি হয়েছে তাদের ভেতরে। তাই ওই বিষয়টাও আমাদের ডিল করতে হয়েছে। একেবারে ঠিক হিন্দী বা উর্দুর মাঝে থাকতে পারিনি। তাই আমার জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল প্রোপার একসেন্টটা ফলো করা। আমরা যে কজনই বিহারি ক্যাম্পের ভেতরের চরিত্র হয়ে কাজ করেছি, সবারই কমবেশি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এই ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে। আমাদের হাতে খুব একটা সময়ও ছিল না। পনেরো থেকে বিশ দিনের মতো সময় পেয়েছিলাম। ওই ভাষা, সংস্কৃতি, বলার ভঙ্গি এবং ঠিকঠাক ভগ্নাংশগুলো মানে কতটা অপভ্রংশ হয়েছে, কতটা হয়নি— সেটা ওই সময়ের মাঝে যতটা পারা গেছে ততটা চেষ্টা করেছি। শুরুর দিকে আমরা কিছুটা সংশয়েও ছিলাম এটা ভেবে যে কতটা আমরা ঠিকঠাক করতে পারছি তাদের মতো।
প্রশ্ন: ‘ইকবাল’ চরিত্রে দ্বিমুখী একটা দ্বন্দ্বের জায়গা ছিল সবসময়। আপনি ঠিক যে ধরনের চরিত্র এখন পর্যন্ত করেছেন, তা থেকে এই ‘ইকবাল’ চরিত্রটির জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়েছে কি না?
সোহেল মণ্ডল: হ্যাঁ অবশ্যই, ‘ইকবাল’ চরিত্র করার জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয়েছে এবং নেওয়াটা দরকারও ছিল। কারণ চরিত্রটা যেহেতু আমার সংস্কৃতির কোনো লোক না, আমার পরিচিত গণ্ডির মধ্যকার কোনো চরিত্রও না। আমার একদমই অদেখা একটা পরিবেশের আলাদা সংস্কৃতির চরিত্র হচ্ছে ইকবাল। তার ভাষা, উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, বাক্য ছুঁড়ে দেওয়াটা একেবারেই আমার থেকে আলাদা। পাশাপাশি ইকবালের নিজের যে সংগ্রাম, আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা সেটাও চরিত্রে উঠে এসেছে। আর চরিত্রগতভাবে একজন বিহারি যে আধিপত্যের শিকার হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বাঙালিদের দ্বারা বা একটা দেশে নাগরিকের স্বীকৃতি ছাড়া বেড়ে ওঠার যে মানসিকতা এই চরিত্রে ছিল— সেটাকে নিজের ভেতর মানিয়ে নেওয়াটা ছিল চ্যালেঞ্জিং। আর গণি ভাই (ভাষা ট্রেইনার) ভাষার পাশাপাশি বিহারিদের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো নিয়েও আমাদের বলেছেন, দেখিয়েছেন। আমরা নিজেরাও বিহারি ক্যাম্পে গিয়েছিলাম বোঝার জন্য, দেখার জন্য যে তারা কোন পরিবেশে থাকেন, কীভাবে কথা বলেন। অতটা তো দেখাও যায় না এই সময়ের মধ্যে আবার নানারকম সীমাবদ্ধতাও আছে। যতটা পারা গেছে পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝে সেভাবে ইকবালকে একটা ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছি। বাকিটা দর্শক বলতে পারবেন।
প্রশ্ন: সিরিজের নির্মাতা ইমতিয়াজ সজীবের এটা প্রথম কাজ। আবার শো রানার হিসাবে আছেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ এর নির্মাতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের মতো মানুষ, আছেন আদনান হাবিব। তো নতুন একটা টিম, তাদের কাজের ধরন নিয়ে কিছু বলেন।
সোহেল মণ্ডল: সাদ, ইমতিয়াজ সজীবদের ‘সেন্সমেকার’ নামে একটা টিম আছে যারা ‘রিফিউজি’র মেকার। তাদের কাজের একটা আলাদা ধরন আছে। তারা আগে থেকেই বেশ প্রস্তুতি নিয়ে কাজটা শুরু করেন। আমি জানি না, সিরিজটা দেখে আপনারা কতটা বুঝতে পেরেছেন; তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা ভীষণরকম পরিশ্রম করেছি। বিহারি ক্যাম্পে পুরোটা গুছিয়ে শুট করা এবং প্রত্যেকটা চরিত্র ডেভেলপমেন্টের জন্য বিশেষ করে ওয়াসিম, ইকবাল বা মারিয়া চরিত্রটি হয়ে ওঠার জন্য আমাদের দশ পনেরদিনের একটা রিহার্সেল টাইম গেছে। ভাষা ও সংস্কৃতিগত জায়গাগুলো তো শিখতে বা দেখতেই হয়েছে যেটা বললাম। সবকিছু মিলিয়েই এই টিমটা খুব সাপোর্ট করেছে এক একটা চরিত্র হয়ে ওঠার জন্য। কস্টিউম থেকে শুরু করে মেকআপ বা অন্যান্য ব্যাপারে তাঁদের দিক দেখে যতটা ইনপুট দেওয়া দরকার সেটা সবসময় তারা দিয়েছেন। আলাদা করে বলতে গেলে সিরিজের পরিচালক সজীব খুব শান্তশিষ্ট একজন মানুষ। তিনি খুব ভালোভাবে লেখা একটা চিত্রনাট্য এনেছিলেন। একেবারে ঠিকঠাক ক্লিপহ্যাঙ্গার থেকে শুরু করে একটা ওয়েব সিরিজের স্ক্রিপ্ট যেভাবে হওয়া দরকার তিনি সেভাবেই করেছেন। সাদও তাঁর ইনপুট দিয়েছেন। অনেক সময় দেখা যায়, চিত্রনাট্য পরিমার্জন করার পর, প্রোডাকশন করার পর পোস্ট প্রডাকশনে এসে আবার নতুন এক ধরনের ডেভেলপমেন্ট হয়। সেখানে নির্মাতা অনেক সময় এক্সপেরিমেন্ট করেন, সেই চেষ্টাটা সব জায়গাতেই ছিল। সজীব অনেক গোছানো একজন নির্মাতা। পুরো সেন্সমেকার টিম খুব দায়িত্ব নিয়ে, পরিশ্রম করে কাজটা করেছে এটা আমার জায়গা থেকে বলতে পারি।
প্রশ্ন: ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘বিহারি নাগরিকত্ব’, ‘জেলের ভেতর যৌন নির্যাতন’— এগুলোর মতো স্পর্শকাতর অনেক ইস্যু উঠে এসেছে এই সিরিজে। সেদিক থেকে সিরিজটা একটু ‘কন্ট্রেভার্সিয়াল’ কি না!
সোহেল মণ্ডল: অনেকটা তেমনই মনে হতে পারে। অনেক স্পর্শকাতর বিষয় আছে যা নিয়ে আমাদের ভেতরও এক ধরনের দুর্বোধ্যতা ছিল। আমরা নিজেরাও চেষ্টা করছি যেন মূল ফোকাস থেকে দূরে সরে না যাই। নজর ছিল অযথা যেন কোনো কন্ট্রেভার্সি না তৈরি হয়। কারণ এখানে নানা অনুভূতির মানুষ আছেন যাদের সহজেই আঘাত লাগে। তো সেসব মাথায় রেখে, আমাদের যে মানুষ আর মানবতার গল্প, যেটা আমাদের মূল ফোকাস, তাতে যেন অযথা কোনো কন্ট্রেভার্সি না তৈরি হয়, সিরিজটির রাইটিং প্রসেস থেকেই তা আমাদের মাথায় ছিল। অভিনয়ের ক্ষেত্রেও আমরা বেশ সতর্ক ছিলাম। শুধু চেয়েছিলাম এই গল্পটা যেন মানুষকে ভাবায়। যাদের গল্প আমরা দেখি না, একইদেশে বাস করেও যাদের কথা আমরা খুব কম জানি, যাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে কম জানি, নানা কারণে যাদের কথা আমাদের কাছে খুব কম পৌঁছেছে সেগুলো যেন এই গল্পের মাধ্যমে কিছুটা হলেও আঁচ করানো যায়। মূলত সেই চেষ্টাই ছিল সবসময়।
[সোহেল মণ্ডলের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় অংশ খুব শীঘ্রই পড়তে পারবেন শ্রী-তে। চোখ রাখুন।]
দীপ্ত টিভিতে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসাবে কর্মরত। একজন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। জন্ম ময়মনসিংহে। এখন বসবাস ঢাকায়। ফিল্ম নিয়ে লেখালেখি করেন। এছাড়া ২০২১ সালে ঘাসফুল প্রকাশন থেকে ‘খেয়াবতী’ নামে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।