এই মুহূর্তে কী লিখতে চাইছি?
মুক্তি, অশ্রু নাকি মৃত্যু?
অনতিদূরে ডাকবাক্সে দুয়েকটা চিঠি
স্বপ্নচূর্ণ নিয়ে পড়ে আছে
কার কাছে যাবে? যেন খামভর্তি পাখি
খুললেই নিজস্ব শিসে ঘুরিয়ে দেবে
হাওয়ার গতিপথ।
***
প্রেম আছে, এই ভেবে প্রতিদিন যাই—
এর কাছে ওর কাছে
নিজেকে পরিত্যক্ত করে রাখি নিজের কাছে
লাল কালিতে ওরা দাগিয়ে দেয় মুখ
সেই থেকে চিহ্নিত পড়ে রইলাম, মানুষের জঞ্জালে
চিরস্থির ‘বিপদজনক’ হয়ে…
***
কোথা হতে এসে কোন পাখি জানালার কাছে গাছটিতে বসে
আপন গানে জাগিয়ে তোলে বিকেলের আলো ও আভাস
সব ভ্রান্তিপ্রবণতা পায়ে ঠেলে পাতা ঝরে যায়
বাতাসের গায়ে লাগে প্রেমিক বাতাস
সামান্য পাখিটিও জানে, মৃত্যুর পর মানুষও চিঠি হয়ে যায়
সকলেই তাকে পড়ে অনায়াসে, দুর্বোধ্য লাগে না
***
তোমাকে চিনতে চেয়ে নিজেকে হারিয়ে এসেছি
সেই থেকে খোলশের ভেতরে খোলশ
জ্বরের ভেতর আরও জ্বর যাপন করি
পৃথিবীর পুরুষেরা কুয়াশা-সন্তান
মুঠোয় রোদ নিয়ে তাদের তাঁবুর দিকে অগাধ এ যাত্রা
পাখির পাশে বসে শিখেছি বসন্তশিস
নখ ও দন্তের ইশারা, অনন্ত শ্বাসাঘাত
আরও মূর্ত করে তোলে তীব্র বাঁশির ধুন
চাঁদের দিকে তাকালে পাথরের হৃদয় দেখি
নরম, শাঁসালো। প্রাণপ্রবাহে বিচল
পাথর চেনা হলে জানা যায় নিজেকে চেনার কৌশল
***
একবার নিজেকে হারিয়ে এলে আর ফিরে পায় না কেউ
উদাসীন সংসারে ধুলা জমে, দেখে যত চক্ষুষ্মান
চাবির ধ্বনির দিকে তাদের মাতাল মন কাত হয়ে আছে
সংসারে ফেরো! বাঁধো নিজেকে! বিঁধো কাঁটায়, কান্তারে
যারা জন্ম নিরক্ষর, তারা আমারই পূর্বপুরুষ
বেঁচে থাকা মানে এক চতুর বনবাস, তারাও বলেনি আগে
***
হলাহল কণ্ঠে রেখে চুমু খেলে
বৈরী হলো সময়, আর আমি বৈরাগী
চুমু কি মানুষ? এমন আঁকড়ে ধরে আছে!
চুমুর শত পা, কোটি হাত, আজীবনব্যাপী লতা
এমন পেঁচিয়ে ধরেছে, পাতার শ্বাসাঘাতে
আমার সহস্র মৃত্যু আমারই দিকে তাকিয়ে আছে চোখ গোল করে
***
নিজেকে লিখছি, না কি তোমাকেই?
উঁকি দিয়ে দেখো, তোমার ভেতরে আমি
কেমন দীর্ঘ নিদ্রার পর আড়মোড়া ভাঙছি!
কিশোরীর ঢঙে চোখ ঘুরিয়ে একটু জল চাইছি
আনন্দের নাকি মৃত্যুর ভণিতা চলছে দিনরাত
আলো নিয়ে আসা সূর্যটাও ছায়া রেখে চলে যায়
সুনসান অন্ধকার। আমাকে দেখি। আমার ভেতরে তুমি
তুমি আমি মিলে চলো ঘুরিয়ে দিই বাঁকা নদীর গতিপথ!
***
বেঁচে থাকা যেন ছেনালিপনা
বিক্ষত ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে ঘোরার মতোই
তোমার সরল গ্রীবায় যে চাঁদ মায়াবী নদীর মতো বয়ে চলে
সময়ে তারও গজায় বিষদাঁত, কণ্ঠে ফোটায় তার নিখিল নখর
হাসির বিভ্রম থেকে অপমৃত্যুর ছায়া ডাকনাম ধরে ডাকে
মোহময়ী সেই ডাকে ছুটে যাচ্ছি।
গ্রাম নেই, পথ নেই। প্রান্তরকুহেলি
নদীপথে চরে বেড়াই, যেন আদিম জলবেশ্যা
***
আমাদের হতে পারতো পাহাড়ি এক তাঁবুর জীবন
গানভাঙা পাড়, গলাভাঙা নদীর উল্লাস
আমাদের হতে পারতো ফুটফুটে চাঁদের সন্তান
জোছনার চটি পায়ে হাওয়ার বেড়ানো দেখে
আমাদের ঘুমও হতে পারতো স্বপ্ন-বিলোল রাক্ষস
শীতার্ত রক্তের দানা ঘষে ঘষে আগুন জ্বললে
আমরা রাঁধতাম প্রেম, আমূল মগ্নতা, জলদগান্ধার
বৃষ্টির চূড়ায় বসে জল দেখে দেখে
আমরাও খেতে পারতাম চেটেপুটে নিমগ্ন নিজেদের।
***
এমন মনোবিকাল, কান্নাপ্রবাহ ছুঁয়ে ভেসে গেছে
সম্পর্কের গাঙ পার হতে কতটা সময় লাগে
কতখানি শ্রম, কথার বিস্ফার!
জন্মমূর্খ, কিছুই জানি না।
কেবল ছোঁয়ার লোভ, চুম্বনতৃষাকাতর পাখির ছটফট
নিয়ে গিয়ে ফেলে গ্রামের সীমানা থেকে দূর বনধারে
সেখানে মেঘের পাড়ায় সারাদিন আমাদের অলীক সংসার
সারারাত নিদয়া বিরহধার, সম্ভোগ তোলপাড়
শ্রীগর্ভে ফুলের সন্তান, তোমার-আমার
উদ্বৃত্ত নীরবতা গায়ে জড়িয়ে খলবল হাসে—
সিজোফ্রেনিক প্রেমের অবতার
কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ৮ জুলাই ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। পেশায় তিনি একজন উন্নয়নকর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থ : লিলিথের ডানা [কবিতা, চৈতন্য, ২০১৬], কয়েক লাইন হেঁটে [কবিতা, জেব্রাক্রসিং, ২০১৮], ময়ূরফুলের সন্ধ্যা [কবিতা, বাতিঘর, ২০১৯], সুবেহ তারা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, ২০১৯], বিস্ময়চিহ্নের মতো [উপন্যাস, বাতিঘর, ২০২০], অনন্তকলহ [কবিতা, বাতিঘর, ২০২২]।