‘রূপকথার রাস্তাঘাট’-এর নির্মাণমুহূর্ত থেকে নিজের সঙ্গে নিজে কিছু বাতচিত চালিয়েছি, সেগুলো এক করলেই বুঝতে পারা যাবে কী আছে রূপকথায় মোড়া আমাদের ময়লা রাস্তঘাটে।
১.
কবিতা লেখার চেয়ে কঠিন যেন নতুন বইয়ের জন্য কবিতা বাছাই করা।

রূপকথার রাস্তাঘাট | পিয়াস মজিদ | ধরন: কবিতা | প্রচ্ছদ: আজহার ফরহাদ | প্রকাশক: বেঙ্গলবুকস
২.
কবি উৎপলকুমার বসুর সঙ্গে একবারই দেখা হয়েছিল আমার, ঢাকায়। ‘সুখ দুঃখের সাথী’ বইটা বেরুবার প্রস্তুতি চলছিল তখন। আমি জানালাম ‘পুরী সিরিজ’-এর প্রতি মুগ্ধতার কথা। আমার জন্মসাল জানতে চেয়ে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন ‘পুরী সিরিজ যখন বেরুচ্ছে তখন তুমি মাতৃগর্ভের গহীন আলোঅন্ধকারে সাঁতার কাটছিলে!’ হাসাহাসি শেষ হলে মতামত চাইলেন ‘সুখ দুঃখের সাথী’ নামটা কেমন, সে ব্যাপারে। আমি এরকম নামের বিষয়ে আপত্তি জানালে আবারও হাসি ছুটিয়ে বললেন ‘কলকাতায় আমার বন্ধুশুভাকাঙ্ক্ষীরাও বলছে— তুমি কি পুরোনো হিন্দি সিনেমার গানের মতো কিছু লিখছ কিনা! এরকম নাম কেন? তবে আমি সচেতনভাবে চাই বইয়ের নামে আর বিশেষ কোনো চমক না থাক৷ অতি সহজ ঝর্নাজল শুষে যেন পৌঁছুনো যায় এমনকি কঠিন পাথরের বনে।’
এইবার কবিতাবইয়ের নাম দিতে গিয়ে আমার থেকে থেকে উৎপলের কথাগুলো মনে হচ্ছে৷ আরও মাথায় রাখছি রবীন্দ্রনাথের এরকমের সেই কথাটাও ‘নাম হচ্ছে লাউয়ের বোঁটার মতো, ধরতে সুবিধা হয়।’
এইবার কবিতাবইয়ের নাম দিতে গিয়ে আমার থেকে থেকে উৎপলের কথাগুলো মনে হচ্ছে৷ আরও মাথায় রাখছি রবীন্দ্রনাথের এরকমের সেই কথাটাও ‘নাম হচ্ছে লাউয়ের বোঁটার মতো, ধরতে সুবিধা হয়।’
৩.
বইয়ের টেক্সটের চেয়েও আজকাল যেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিচ্ছে বইয়ের প্রচ্ছদ। হয়তো সঙ্গত কারণও আছে, হাজারও বইয়ের ভিড়ে বিশেষ করে দেখতে ও দেখাতে চায় সবাই তার বই। আমিও চাইতাম। কিন্তু এখন মনে হয়, ওই যে সাদা পৃষ্ঠার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু একটা হয়ে ওঠা লেখা— সেটাই সবচেয়ে জরুরি। আর দুনিয়ার কোনো একটা আর্টওয়ার্ক দিয়েই কি আর একটা আর্টওয়ার্ককে যথাযথ ব্যাখ্যা করা সম্ভব? একটা অতিসুন্দর প্রচ্ছদ নিজেই একটা অনন্য আর্টওয়ার্ক কিন্তু আমার তো অভীষ্ট বইয়ের অন্তত একটা কবিতা বা লাইনের পারফেক্ট আর্টওয়ার্ক হয়ে ওঠা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একসময় ত্যক্ত হয়ে চাইতেন তার বইয়ের প্রচ্ছদ এক কালারে হোক যেন বইয়ের ভেতরের লেখা তার বাইরের অঙ্গসজ্জার কাছে মার না খায় বা ভ্রান্ত কোনো অর্থ তৈরি না করে। ২০২৫-এ নতুন কবিতাবইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতকালে বারবার মনে আচ্ছে, আমার বিগত সব বইয়ের প্রচ্ছদগুলো আমার কবিতার সঙ্গে কীরকমভাবে যে বেঁচে আছে!
৪.
কবিতা থেকে প্রথম দূর করতে হবে অবাঞ্ছিত ‘আমি’।
তারপর দূর করতে হবে ত্যক্ত করা ‘তুমি’। কবিতা
থেকে অপ্রয়োজনীয় চর্বির মতো দূর করতে হবে ‘প্রেম’।
কবিতা হইতে দূর করতে হবে ‘কালের বিশ্বস্ত ছবি’।
কবিতা থেকে দূর করতে হবে ‘ন্যাকা-কাব্যিক’ যা যা কিছু।
তারপর অনুভবশূন্যতার মুখোমুখি হয়ে দেখা যাক এইসব— কবিতার দম কতটুকু, দৌড় কতটুকু, শূন্যের পর সে পাঠকের মনে যোগ করতে পারে কি না অন্তত একটা ‘এক’!
এমনটা ভাবনায় আসে পাণ্ডুলিপি দেখতে দেখতে আরকি কিন্তু এমন তো আর হয় না। ফিরে ফিরে আবার আসবেই তুমি, আমি, প্রেম…। আসুক না; একদিন কখনও তুমি, আমি কিংবা প্রেম মরে গেলে যেন এসব কবিতা থেকেই উদ্ধার করা যায় মৃত তুমি-আমি কিংবা আমাদের অতিমৃত প্রেম!
৫.
এইসব কবিতার মনের বনে রূপকথা চুপচাপ শুয়ে থাকে, ঘিরে ধরে অরণ্যঅন্ধ হাওয়া, গাছ, ফুল, পাখি আর জন্তুর বিভা। কে লিখনকার, কে পঠনকার— অবান্তর তর্ক তা। অনুভবের গায়ে লেগে থাকা অযথা অক্ষর, অক্ষরের গায়ে লেগে থাকা অযথা অনুভবের বিনাশ-সাধনা। তাহলে কী শেষে বা শুরুতে? শুধু বসে থাকা। আয়ুক্ষয় হতে যেতে দিয়ে কবিতার বন রুয়ে দেয়া। দুঃসহ জীবন মেনে না নিতে পেরে মৃত্যুকে মনে নিয়ে মন খুশ রাখা। মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে তোমাকেই তো দেখা যাচ্ছে রূপকথার রাস্তাঘাটে উড়ে চলা ধূলি বালি কিংবা কবিতা।
৬.
বেঙ্গলবুকস থেকে প্রকাশ পাচ্ছে ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন আজহার ফরহাদ।
পাঠক পড়েই সিদ্ধান্ত নিক কেমন দেখলেন আমার নির্মিত রূপকথা আর তাদের রাস্তাঘাট।

জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত। কবিতার বই আছে বেশ কিছু। লেখালেখির সূত্রে পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা, ঘুরেছেন বিশ্বের বেশ কিছু দেশ। piasmajid@yahoo.com