আতিকউল্লাহ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভুলে গেছে মুখের মধ্যে ব্রাশ চালাতে।
কী দেখছে ও? লাল নীল হলুদ বেগুনী সাদা রঙের…। বিস্ফোরিত দৃষ্টি, পলক পড়ে না চোখের। সকালের চকচকে কড়া রোদ চারদিকে মিছিল করছে। বাসাটা থেকে একটু দূরে, প্রধান সড়কের উপর বিরাট একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে সম্রাটের ডানায়। ডালে পাতা প্রায় দেখাই যায় না, আগুনরঙের ফুলে ঢেকে গেছে গাছটা। দাঁত ব্রাশ করতে করতে কৃষ্ণচূড়া থেকে দৃষ্টি আবার ফিরে আসে পাশের দুইতলা বাড়ির দোতলায়। দোতলায় বড়ো একটা জানালা। জানালাটা খোলা। খোলা জানালার বারান্দায় লম্বা করে টানানো রশির উপর দুলছে, একটু একটু করে নড়ছে ফালগুনের বাতাসে…।
ওই আতিক! সকালে তুই ওখানে কি করছিস? ঘাড় ভেঙে তাকায় উল্টোদিকে আতিক। দাঁড়িয়ে আছে রুমমেট শুভেন্দু গাঙ্গুলি। দাঁত ব্রাশ করতে করতে এসে দাঁড়িয়েছে বারান্দায়।
আতিক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়, গোপন এই রঙিন রাজ্যের খবর কোনো শালাকে দেওয়া যাবে না। জঞ্জালে পূর্ণ বারান্দা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসার জন্য প্রধান বারান্দার দিকে পা রাখে ও। আতিকের দ্রুত চলে আসা সন্দেহ তৈরি করে শুভেন্দুর করোটিতে।
আতিক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়, গোপন এই রঙিন রাজ্যের খবর কোনো শালাকে দেওয়া যাবে না। জঞ্জালে পূর্ণ বারান্দা থেকে দ্রুত বের হয়ে আসার জন্য প্রধান বারান্দার দিকে পা রাখে ও। আতিকের দ্রুত চলে আসা সন্দেহ তৈরি করে শুভেন্দুর করোটিতে। শালা, আমাকে দেখে আগেভাগে তাড়াহুড়ো করে কেন চলে এলো? নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে!
ঢাকা শহরের অভয়নগরের এই বাড়িটা পাঁচতলার। অনেক পুরানো বাড়ি। বাড়িঅলা জুনাইদুল হক নতুন ঢাকায় নতুন বাড়ি করে থাকেন। পিতার উত্তরাধিকারেরসূত্রে পাওয়া বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। তিন তলায় চারটে রুম নিয়ে মেস করে থাকে দশ পনেরো জন। মেসে থাকাদের বিচিত্র পেশা আর সঙ্গে ততধিক বিচিত্র নেশা। কেউ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফাঁকে টিউশনি করে, কেউ ম্যাথামেটিকসে মার্স্টাস করে ওষুধ কাম্পানির রিপ্রেজেনটিটিভ, কেউ ফোন-ফটোকপির দোকানের কর্মী, কেউ ওয়াসায় চুক্তিভিত্তিক কাজ করে…। এই মেসের কোনো নাম নেই। কেবল বাড়িঅলা জুনাইদুল হকের নামে বলা হয়, জুনাইদ মিয়ার বাড়ি। জুনাইদ মিয়ার বাড়ির ডান পাশে রাস্তার দিকে মুখ করা বাড়িটা দোতলা। এইটাও পুরোনো বাড়ি। শোনা যায়, বাড়িটা এই অঞ্চলের সব চেয়ে পুরানো বাড়ি।
তিন তলার মেসের সদস্যরা দিনে যে যাই করুক, সন্ধ্যা বা রাতের ফিরে যে যার মতো সারাদিনের অভিজ্ঞতা রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করে। সাদেক আলীর রুমটা একটু বড়ো, ওর রুমেই মেসের আড্ডাটা জমে ওঠে। মূলত এই আড্ডাটাই মেসের মানুষদের বেঁচে থাকার উৎস। গত রাতের আড্ডায় ইমন বোমা ফাটিয়েছে। অভয়নগরের প্রধান সড়কের পাশে বিশাল জয়তী মার্কেট। জয়তী মার্কেটের নিচ তলায়, একেবারে কোনার দিকে দ্বিমুখি একটা রুম নিয়ে ফোন ফটোকপির দোকান ওর। ইমন ইন্টারমিডিয়েট পাশ, গায়ের রংটা আফ্রিকানদের মতো কালো। কপালটা চওড়া। চুলগুলোও কোকড়া। চোখদুটোতে মায়া ছড়িয়ে আছে। আর হাসলে কালো মুখে ঝকঝকে দাঁতে ভীষণ অন্যরকম লাগে। এই ধরনের ব্যবসার মূল পুঁজি মিষ্টি ব্যবহার। সেটা ও জানে। জয়তী মার্কেটের নিচতলায়, দশবারোটা দোকান ফোন ফটোকপির। ইদানিং মোবাইলে টাকা দেওয়া নেওয়ারও ব্যবসা শুরু করেছে। খাটতেও পারে প্রচুর। অভয়নগরের অধিকাংশ ক্রেতা ওর দোকানেই আসে। ক্রেতাদের সঙ্গে ইমন কখনো বিরক্ত হয় না। সব সময়ে হাসি মুখে আলাপ করে। একটা ফটোকপির জন্য এলেও খুব বিনয়ের সঙ্গে কাজটা করে দেয়। ফলে, ভিড় লেগেই থাকে ওর ছোটো দোকানটা ঘিরে।
দিন শেষে রাতে সাদেক আলীর রুমে কেবল আড্ডাটা জমে উঠেছে, গোসল সেরে ট্রাউজার পরে, স্যান্ড্রো গেঞ্জি গায়ে রুমে ঢোকে ইমন। মুখে সারল্যমাখা হাসি। বসে হরিপদ মিস্ত্রির খাটে।
ইমনের অবাক হাসি লক্ষ্য করে আতিক প্রশ্ন করে, ওই ইমন গাধার মতো হাসছিস কেন?
অনেক দিন পরে আমার বড়শিতে মাছটা গেঁথেছে ভাই—
কোন মাছটা? রাস্তার ওই পারের বাড়িঅলার বড়ো বোনটা?
মাথা নাড়ায় ইমন, হ্যাঁ। আজকে মোবাইল নাম্বরটা দিয়ে গেছে।
রুমের আট নয়জন এক সঙ্গে হৈ হৈ করে ওঠে। সবাইকে সরিয়ে দিয়ে মোটকু ইনসান কোমড় দুলিয়ে নাচ দেয় কয়েক পাক। ইনসানের নাচ শেষে সাদেক আলী মোটা পেটের উপর হাত বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করে, মেয়েটা নাম জুলেখা না?
জি ভাই, ইমনের মুখে গর্বিত হাসি। মেসের অনেকেই জানে জুলেখার প্রতি অনেক দিনের আকর্ষণ ইমনের। অনেক চেষ্টার পর আজ মোবাইল নম্বরটা আদায় করার আনন্দে ও আপ্লুত।
মোটা পেট নিয়ে আধশোয়া থেকে উঠে বসে সাদেক আলী; নায়িকা নাম্বার দিয়ে গেছে, খুব ভালো। আমরা আনন্দিত। লাগে তোর জন্য মিছিল করব। হরতাল ডাকব। এখন আমাদের এই খুশির সেলিব্রেট কর।
সাদেকের কথা শেষ হতে পারে না, রুমের সবাই এক সঙ্গে চিৎকার করে সমর্থন জানায়। কেউ কেউ নাচতে থাকে ধেই ধেই। বাধ্য হয়ে ইমনকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়। জুনাইদুল হকের বাড়িটার তিনতলায় সাদেকের রুমে প্রতি রাতে এইসব ক্ষয়ে যাওয়া বিপন্ন তরুণদের আনন্দযাত্রা চলে। রাতে বুয়ার হাতের রান্না করা চাল, আর যেকোনো তরকারি, মাছ বা ডাল দিয়ে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায় তেল চুপচুপে স্যাঁতস্যাঁতে বিছনায়। সকালে উঠে ঝাঁপিয়ে পরে নতুন করে, জীবনের ভিন্ন আশায়।
বাড়িটার তিনতলার পূর্ব দিকের বারান্দায় ভাঙা চেয়ার টেবিল, পরিত্যক্ত সোফাসেট রাখা। কয়েক বছরের ব্যবধানে ওইসব পুরোনো আসবাবপত্রের ছায়া বিস্তারের কারণে কয়েকটা পরগাছাও জন্ম নিয়েছে। পরগাছাগুলোও মাথা উচুঁ করে বেশ ডালপালা ছড়িয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বারান্দার ওদিকে, কোনায় খুব প্রয়োজন না হলে কেউ যায় না। গেলে অনেক কিছু ডিঙ্গিয়ে কসরত করে যেতে হয়। সাধারণত ওদিকে যাবার কারো প্রযোজনও হয় না। দাঁতে ব্রাশ চালাতে চালাতে আতিক সকালে ওইসব ডিঙ্গিয়ে ব্যালকনির ওদিকে গেছে, একটা রিনিকঝিনিক হাসির শব্দের অনুসরণ করে। দাঁত ব্রাশ করতে করতে সামনের বারান্দায় দাঁড়াতেই, শোনে পাশের দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে হালকা বাতাসে ভেসে আসা নারী কণ্ঠের হাসির শব্দ। অবাক আতিক, কারণ গত দুই তিন বছরে পাশের বাসার দিকে তাকানোর সুযোগ হয়নি। তাকাবে কখন? সকালে বের হয়ে যায়, নানা ধান্ধায় দিন কাটিয়ে রাতে ফিরে এলে, পাশের বাসার খবর নেওয়ার সময় বা সুযোগ কোথায়? গত রাতে একটা অবাক স্বপ্ন অবশ্য দেখেছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর সেই স্বপ্নটা করোটিতে কেমন জট পাকাচ্ছে! কোনোদিন ভাবেনি, কিন্তু স্বপ্নটা তো দেখেছে! অবাক ঘটনা! অবিশ্বাস্য!! দাঁত ব্রাশ করতে করতে সেই স্বপ্নটা ফিরে ফিরে আসছিল ওর চোখের ক্যানভাসে, সেলুলয়েডের পর্দায় একের পর এক। উজানগাঁওয়ে, নিজের গ্রামের বাড়িতে আপন চাচাতো বোন শিমলা এসেছিল ওর রুমে। শিমলা খুব সুন্দরী। চাচারও আর্থিক অবস্থা ভালো। ফলে, এসএসসি পরীক্ষার পর পরই বিয়ে হয়ে যায়। জামাই পুলিশে চাকরি করে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় শিমলার পুলিশ জামাই ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। শোকের সময় কেটে গেলে বছর দুয়েক পরে আবার বিয়ে হয়। জামাই মোহন মিয়া সিঙ্গাপুরে জাহাজ তৈরির কারখানায় কাজ করে। আগে দরিদ্র ছিল মোহন মিয়ারা। কিন্ত সিঙ্গাপুরে জাহাজের কারখানায় কাজ করে অনেক জমি কিনেছে। গ্রামে ইটের বড়ো বাড়ি করেছে। মোহন মিয়া বিয়ের জন্য দেশে এসে শিমলাকে দেখে বিয়ে করতে রাজি হয়। বিয়ে হয়ে যায় ধুমধামের সঙ্গে। কিন্তু এক বছরের মাথায় সিঙ্গাপুরে জাহাজের কারখানায় আগুন লাগে। সেই আগুনে বিশজন মারা যায়, বিশ জনের মধ্যে শিমলার জামাই মোহন মিয়াও…। সেই ঘটনাও ঘটেছে তিন বছর তো হবেই। শিমলা বয়সে তিন থেকে চার বছরের বড়ো আতিকের। সেই শিমলা গতরাতে স্বপ্নে এসেছিল তেল চিটচিটে রুমে। বসেছিল পাশে। কপালে রেখেছিল নরম ঠান্ডা হাত। বলেছিল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে? জড়িয়ে ধরেছিল, চুমু দিয়েছিল…।
স্বপ্নটা শেষ হওয়ার সঙ্গে ঘুম ছুটে যায় আতিকের। রুমের দুইজন খাটে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। খাট থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসছিল না কোনোভাবেই। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিল। রাতে স্বপ্ন আর সকালে পাশের বাড়ির দোতলা থেকে অমন উথাল-পাথাল হাসি! হাসির শব্দের অনুসরণে অনেক কষ্টে যখন দাঁড়ায় ব্যালকনিতে— চোখের তারায় কোনো নারীর দেখা পায় না।
স্বপ্নটা শেষ হওয়ার সঙ্গে ঘুম ছুটে যায় আতিকের। রুমের দুইজন খাটে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছে। খাট থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে আবার শুয়েছিল। কিন্তু ঘুম আসছিল না কোনোভাবেই। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিল। রাতে স্বপ্ন আর সকালে পাশের বাড়ির দোতলা থেকে অমন উথাল-পাথাল হাসি! হাসির শব্দের অনুসরণে অনেক কষ্টে যখন দাঁড়ায় ব্যালকনিতে— চোখের তারায় কোনো নারীর দেখা পায় না। বিমর্ষ বিরহের কাতরতায় যখন ফিরে আসবার জন্য চোখ ফেরায়, তখনই চোখে পড়ে, বাড়ির দোতলায় জানালা দিয়ে, ভেতরে রশির উপর কয়েকটা নানা রঙের রঙিন ব্রা ঝুলছে।
দাঁত ব্রাশ করা থামিয়ে বিস্ফোরিতে দৃষ্টিতে দেখছে আতিক ব্রাগুলো। লাল নীল হলুদ বেগুনী সাদা..পাঁচ রঙের পাঁচটা ব্রা। অনুমান করার চেষ্টা করে, কতো সাইজের? কিন্তু দুই বাড়ির মধ্যে কমপক্ষে দশ গজের দূরত্ব। সেই দূরত্ব পার হয়ে কেবলমাত্র দৃষ্টিতে ব্রা’র সাইজ পরিমাপ করা কঠিন। আতিক অনুভব করছে, শরীরের কোষে কোষে এক ধরনের তৃষ্ণা, এক ধরনের লবণের স্বাদ, এক ধরনের আকুলতা জেগে উঠছে। দাঁত ব্রাশ করা ভুলে তাকিয়ে দেখছে আর দেখছে…। চোখ ভরে দেখতেও পারল না, শালা শুভেন্দু এসে হাজির। মেজাজ খিঁচড়ে যায় আতিকের।
আতিকের তাড়াহুড়োয় শুভেন্দু গাঙ্গুলি বুঝতে পারে, ও কিছু একটা লুকাতে চাইছে। আতিক দ্রুত কোনোভাবে ওই ব্যালকনিতে ফিরে এলে শুভেন্দু পা বাড়ায় পুরানো আসবাপত্রের জঙ্গলের দিকে। হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাতটা ধরে আতিক, কই যাইতেছিস?
তুই ওই জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে কি দেখেছিস?
ওখানে দেখার কিছু আছে? দেখেছি ঘোড়ার আন্ডা!
আমিও দেখমু— এক ঝটাকায় হাতটা ছাড়িয়ে শুভেন্দু লম্বা করে পা বাড়িয়ে পৌঁছে যায়। আতিকের তুলনায় বেশ খানিকটা লম্বা শুভেন্দু। সুতরাং পা উচিয়ে যেতে ওর পরিশ্রম কম। তাকায় পাশের বাড়ির দিকে। কয়েক পলকের দৃষ্টিতে দৃশ্যকাতর কিছু দেখতে না পেয়ে বিরক্তির সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার উদ্যোগ নিতেই দেখতে পায়, পাশের বাসার বারান্দায় ঝুলছে লাল নীল হলুদ বেগুনী সাদা রঙের পাঁচ পাঁচটা ব্রা। শুধু ঝুলছে না, ব্রাগুলো হাসছেও। মনে হলো একটা ব্রা— নীল রং যেটার, একটু হাসছেও! আচমকা চোখে আগুন লাগার ঘটনায় কয়েক মুহূর্ত তড়িতাহত থাকে শুভেন্দু গাঙ্গুলি। মুখ থেকে অস্ফুট বের হয়ে আসে, যাহ শালা! হেভি জিনিস তো!!
শুভেন্দু গাঙ্গুলি ইংরেজিতে মার্স্টাস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কলেজের অধ্যাপক হবার জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুটি টিউশনি করায় বনানীতে। শাম্মী টাকাওয়ালার মেয়ে। দারুণ স্মার্ট আর সুন্দরী। পড়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওকে পড়ানোর সময়ে কাঁধের উপর দিয়ে ব্রা’র ফিতে দেখতে পায়, শরীর জ্বলে উঠতে চায় কিন্তু সামলে নেয়। মাস শেষে আট হাজার টাকা হারাতে চায় না অন্তত এই সময়ে— যখন পিতা বিছনায়, পক্ষাঘাতে। আড়চোখে দেখেছে, শাম্মীর অধিকাংশ ব্রা’র ফিতে লাল অথবা কালো। আর মেয়েটি পরে প্রায়ই সাদা রঙের জামা। নুয়ে খাতার ওপর লেখার সময়ে ব্রা’র ফিতে অনেকখানি বের হয়ে এলে ওর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দ্রুত কামিজের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। এক পলক দেখে আঙুলের কারুকাজ। জ্বলে ওঠে কাম। সামলে নেওয়া ছাড়া শুভেন্দুর কিছু করার থাকে না। কিন্তু ভাবে শাম্মীর কি কোনো…। সাদার বিপরীতে লাল বা কালো ফোটে চোখে, স্বচ্ছ স্ফটিকের ধারালো সন্ন্যাসে, মেয়েটি কি আমাকে গাঁথতে চায়?
আতিকের আবিষ্কারের পর শুভেন্দু গাঙ্গুলির চোখের পাঁচ রঙের সুখ ছড়িয়ে পরে সারাটা মেসে। গোপন আর রইল না গোপেনে। যখন যে মেসে থাকে, সময় পেলেই চলে যায় এতো দিনের অব্যবহৃত ব্যালকনিতে। দেখে, পাশের বাড়ির বারান্দায় ঝুলে থাকা, হাওয়ায় দোলানো রঙিন ব্রাগুলো।
আতিকের আবিষ্কারের পর শুভেন্দু গাঙ্গুলির চোখের পাঁচ রঙের সুখ ছড়িয়ে পরে সারাটা মেসে। গোপন আর রইল না গোপেনে। যখন যে মেসে থাকে, সময় পেলেই চলে যায় এতো দিনের অব্যবহৃত ব্যালকনিতে। দেখে, পাশের বাড়ির বারান্দায় ঝুলে থাকা, হাওয়ায় দোলানো রঙিন ব্রাগুলো। অনেক সময় তিনটি ব্রা ঝুলতে দেখে, দুটি নেই। কখনো কখনো দুটি ব্রা থাকে, তিনটি নেই। রং নিয়ে গবেষণাও চলে মেসের সদস্যদের মধ্যে। কেবল ব্রা দেখেই কি ক্ষান্ত হয়?
মেসের তিন নম্বর রুমের শৈবাল জানায় রাতের আড্ডায়, ‘ওই বাড়িতে আমি দুটি মেয়েকে আজ টেনিস খেলতে দেখেছি।’
বলিস কি? সাদেক আলীর রুমের প্রত্যেকে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকায়। ব্রা আবিষ্কারক হিসেবে আতিকের অধিকার বরাবরই বেশি পাশের বাড়ি সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে। গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে আতিক, কখন? কখন দেখলি তুই?
আজ দুপুরে।
মানে?
আমার শরীরটা ভালো ছিল না। ওয়াসায় বসরে ফোন করে জানিয়েছি, আজ আসতে পারব না। আমার মনে হয় জ্বর আসছে। বাসায় শুয়ে ছিলাম। দুপুরের দিকে মেসে কেউ নেই, নানী রান্না করছে। আমি উঠে বারান্দায় যাই, শুনি মেয়েদের হাসির শব্দ। তাকাই জানালা দিয়ে, দেখি বেশ সুন্দরী দুই মেয়ে টেনিস খেলছে।
মেয়ে দুটোর বয়স কতো হবে রে! এটম বোমা আবিষ্কারের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করে শুভেন্দু।
শৈবাল একটু ভাবে, একজনার বয়স ত্রিশ বছর আর একজনার বিশ বাইশ বছর হবে। দুজনেই সুন্দরী। হালকা পাতলা গড়নের।
সঙ্গে সঙ্গে শুভেন্দু, আতিক, ইমন, হরিপদ, সাদেক, ইনসান— প্রত্যেকে নিজের মতো করে দেখা ব্রা আর সেই দুই নারীর সাইজের সঙ্গে মিলিয়ে নেয়। মেলে কি? কখনো মেলে, কখনো মেলে না? নিষ্করুণ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মেসবাসী মনের ছাইদানিতে, ছাইচাপা আগুন পাশে রেখে।
জুনাইদুল হকের পাঁচ তলা বাড়ির তিন তলার মেসের সদস্যদের মধ্যে এখন একটা দায়িত্ব, তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুই তলার বারান্দায় চোখ রাখা। যে সদস্য যখন সময় পায়, রাতে দিনে, সকাল সন্ধ্যা বা গোধূলির কালে, কেউ কেউ দিনে সময় না পেলে রাতে হলেও একবার এসে দাঁড়ায় বারান্দায়। উকি মারে পাশের বাড়ির দোতলায়, জানালা গলে দেখে— ব্রাগুলো বেহায়া আদরে ঝুলছে তো ঝুলছেই। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না যদিও কিন্তু দায়িত্ব তো অবহেলা করা যায় না! ব্রা দেখা, না দেখা, সাইজ মনে মনে পরখ করা আর রঙের সঙ্গে রং মেলানোর এই মহৎ উৎসব যখন চলছিল মেস জুড়ে, সেই সময়ে বজ্রপাত।
ব্রা আবিষ্কারের তিন কি চার মাস পর বাড়িঅলা জুনাইদুল হক বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দেয়। নোটিশ পেয়ে প্রত্যেকের মাথায় আকাশ এবং পাহাড়— দুটোই ভেঙ্গে পড়ে। বাড়িঅলা পুরোনো বাড়ি ভেঙ্গে নতুন মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং বানাবে। বাড়িঅলার সঙ্গে তো বিবাদ করে টিকে থাকা যায় না ঢাকা শহরে। বাধ্য হয়ে দুই মাসের মধ্যে প্রত্যেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সঙ্গে নিয়ে যায় তীব্র আকুল বিরহের পাঁচ রঙের রঙিন ব্রা’র তিক্ত মধুর স্মৃতি।
সুখ দুঃখের অনেক আলাপের পর ব্রা’র স্মৃতি চলেই আসে। আহা পাঁচ রঙের ব্রা…। ফোনে আলাপের সময়ে দুজনেই সেই ব্যালকনিতে ফিরে যায়, দাঁড়িয়ে দেখে পাশের বাড়ির জানালায় দুলছে হালকা বাতাসে পাঁচ রঙের পাঁচ ধরনের ব্রা।
প্রায় বছর খানেক পর ঢাকা শহরের অভয়নগরের সেই পথ দিয়ে রিকশায় যাচ্ছে আতিক। কয়েক মাস আগে ভালো একটা চাকরি পেয়েছে ব্যাংকে। শুভেন্দু গাঙ্গুলির সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। সুখ দুঃখের অনেক আলাপের পর ব্রা’র স্মৃতি চলেই আসে। আহা পাঁচ রঙের ব্রা…। ফোনে আলাপের সময়ে দুজনেই সেই ব্যালকনিতে ফিরে যায়, দাঁড়িয়ে দেখে পাশের বাড়ির জানালায় দুলছে হালকা বাতাসে পাঁচ রঙের পাঁচ ধরনের ব্রা। ইমনের সঙ্গেও আলাপ হয়। জুলেখার সঙ্গে ইমনের মোবাইলে প্রেম জমে উঠেছে। বিয়ের সময় অবশ্যই নিমন্ত্রণ জানাবে— নিশ্চয়তা দিয়েছে ইমন। চাকরির কারণে আতিকের পকেটের অবস্থার সঙ্গে মনের পরিধিও বেড়েছে। জুনাইদুল হকের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময়ে দেখে, সত্যি সত্যি বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। পাশের দোতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। আতিক রিকশা থামিয়ে নামে দোতলা বাড়িটির সামনে। গেটে দারোয়ানকে প্রশ্ন করে, ভাই এই বাড়িতে কারা থাকে?
বয়স্ক দাড়িঅলা দারোয়ান ভ্রুকুচকে তাকায়, এই বাড়িতে কেউ থাকে না।
থাকে না মানে?
থাকে না মানে থাকে না।
কিন্তু আমরা যে দেখলাম, আতিক দারোয়ানকে বুঝিয়ে বলে, আমরা কয়েক বছর পাশের জুনইদুল হকের বাড়ির তিনতলায় ছিলাম। সেখান থেকে দেখেছি…
এটা অফিস। অফিসে কেউ থাকবে? আমি আর আমার সহকর্মী দিনে রাইতে থাকি।
কোনো মেয়ে বা নারী থাকে না? যারা টেনিস খেলে?
আপনার মাথা খারাপ হয়েছে ভাই। আমি এই অফিসে আট বছর ধরে আছি। দুই তিনজন আপা আছেন ঠিকই, তারা সকালে আসেন বিকালে চলে যান। আর টেনিস খেলবে কে? টেনিস খেলার কোনো জায়গা আছে? শিয়ালের চোখে খেকিয়ে ওঠে দারোয়ান— যান, চলে যান…
দারোয়ানের ধমক খেয়ে আতিক অপেক্ষায় থাকা রিকশায় ওঠে। রিকশা চলতেও শুরু করে কিন্তু আতিকের দৃষ্টির মনোগ্রামে সেই পাঁচ রঙের ঝুলন্ত রঙগুলো ঝুলতেই থাকে…।
জন্মেছেন ১৯৬৮ সালে পহেলা মে [সার্টিফিকেট অনুসারে] বৃহত্তর বরিশালের পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার বোথলা গ্রামে, প্রমত্ত কচানদীর পারে। শৈশব থেকে লেখালেখির শুরু। লিখছেন গল্প, উপন্যাস— ছোটোদের, বড়োদের। টিভি নাটক রচনায়ও খ্যাতিমান। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : পয়তাল্লিশটি। কামনা করেন প্রগতিশীল, সংস্কারমুক্ত বিদগ্ধ একটি সমাজ। পুরস্কার : নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার-২০০৮, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার-২০০৯।