মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

লেখালেখি, অনুবাদ এবং সাংস্কৃতিক মিথিস্ক্রিয়া বিষয়ে ঝুম্পা লাহিড়ীর সঙ্গে আলাপ

0

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : টেলর কোয়েন
ভাষান্তর : এমদাদ রহমান


ঝুম্পা লাহিড়ীঝুম্পা লাহিড়ী ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যের একজন প্রতিনিধিত্বশীল লেখক। ডায়াসপোরা সংকট ঝুম্পার কথাসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট দিক; বাঙালি-আমেরিকানদের যে জীবনধারার বর্ণনা করেছেন ঝুম্পা, তাতে যে সংকট উপজীব্য হয়েছে তা আমাদের ভাবিত করে। অভিবাসী সংকট ও প্রজন্মের মধ্যকার দ্বন্দ্বটি ধরতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। ঝুম্পা বলেন— ‘সাহিত্য হচ্ছে অন্যের জীবন ও মন, আশা ও চিন্তাধারার দিকে চোখ রাখার এক প্রগাঢ় উপায়। বই আমার জন্য বহু দরজা খুলে দেয়, প্রাত্যহিক জীবনের নানান সীমাবদ্ধতার কারণে আমি যেখানে কখনও যেতে পারব না, বই আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারে।’ সাহিত্যকর্মের জন্য ও’হেনরি পুরস্কার, হেমিংওয়ে পুরস্কার, ও’কোনার ইনটারন্যাশনাল শর্ট স্টোরি পুরস্কার, দ্য প্রাইজ ফর সাউথ এশিয়ান লিটারেচার-সহ বহু পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। গল্প-সংকলন ‘ইনটারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ’-এর জন্য ২০০০ সালে পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার। জন্ম—যুক্তরাজ্যে, ১৯৬৭ সালে। ‘ইন্টারপ্রেটার অফ মেলাডিজ’, ‘দ্য নেমসেক’, ‘আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ’ এবং ‘দ্য লো-ল্যান্ড’—এ পর্যন্ত এই চারটি ফিকশনের লেখক ভারতীয়-আমেরিকান লেখক ঝুম্পা লাহিড়ী। ইন আদার ওয়ার্ডস এবং দ্য ক্লদিং অফ বুকস— তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ গদ্যের বই। দ্য পেঙ্গুইন বুক অফ ইটালিয়ান শর্ট স্টোরিজ— নামে তাঁর সম্পাদনায় বইটি বেরিয়েছে ২০১৯-এ। এ-বছর পেঙ্গুইন থেকে বেরিয়েছে তাঁর উপন্যাস— হোয়ারঅ্যাবাউটস। ২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত কলাম লেখক এবং অধ্যাপক টেলর কোয়েনের সঙ্গে ঝুম্পার লাইভ প্রচার হয় ‘কনভারসেশন্স উইথ টেলর’ সাইটে। সেদিনের দীর্ঘ আলাপের কিছু অংশ আজ এখানে অনূদিত হলো।


টেলর: আমাদের আজকের আলাপের শুরুতেই তোমাকে ধন্যবাদ। নিজের একটি দেশ, নিজের একটি ভাষা না-থাকা নিয়ে তুমি প্রচুর লিখেছ; এমনকি নিজস্ব একটি সংস্কৃতি না-থাকা নিয়েও তোমার লেখা আমরা পড়েছি; সে পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে, এবং তোমার লেখার পুনর্পাঠ করতে গিয়ে প্রায় সময়ই ভেবেছি যে— ঠিক কীভাবে তোমাকে আমি আমার পাঠবোধিতে আনবো, তোমাকে ফ্রেম করব! আমি এখানে বলব যে তোমাকে আমি একজন রোড আইল্যান্ডার লেখকই মনে করি, কারণ তুমি এ অঞ্চলেই বেড়ে উঠেছিলে। তোমার জন্ম ইংল্যান্ডে হলেও এখানে, এসেছিলে মাত্র তিন বছর বয়সে, রোড আইল্যান্ডেই তোমার জীবনের বিস্তার। এ সম্পর্কে আজ আমাদেরকে কী বলবে?

ঝুম্পা: সত্যি! আসলে, এ-সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই কেন যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি, অস্বস্তিতে ভুগি। হ্যাঁ, এ তো সত্যি কথাই।

তোমাকে আমার শ্রদ্ধা, এবং আজ এখানে উপস্থিত প্রত্যেককে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি, আমাকে সাদরে গ্রহণ করবার জন্য। আপনাদের উষ্ণ অভ্যর্থনার জন্য আবারও ধন্যবাদ।

আচ্ছা, এখন মনে করা যাক যে সত্যিই আমি ক’বছর ওখানে ছিলাম! হ্যাঁ, সে আমার তিন থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত।

 

টেলর: হ্যাঁ।

ঝুম্পা: তাহলে, পনের বছর।

 

টেলর: তারপর তুমি বার্নার্ডে চলে গেলে, তাই না?

ঝুম্পা: হ্যাঁ, একদম তাই; ঠিক যেমন আমি নিউইয়র্কের মতো জায়গায় বহুবছর ধরে ছিলাম ঠিক তেমন করেই তো রোড আইল্যান্ডেও ছিলাম; কিন্তু চাইল্ডহুড তো চাইল্ডহুড, যে কারও জীবনেরই এক অন্যতম সময়, এই সময়ে কেউ একজন নিজেকে নিজেকে গড়ে নিতে পারে, পরবর্তীতে আর সেভাবে গড়াটা সম্ভব হয় না, অভিজ্ঞতাগুলি পরে আর এমনভাবে পাওয়া যায় না। তবে, আমি আজ যা কিছু হতে পেরেছি, এ-আমি আসলে সেসবেরই অংশ, ভগ্নাংশ। তবে স্বীকার করব যে এ-জায়গাটির সঙ্গে সব সময়ই আমার একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ক ছিল।

একটু আগেই তো তুমি ‘স্টেট বাই স্টেট’ বইয়ের লেখাগুলোর কথা উল্লেখ করছিলে, পুরো বইটিই এ-দেশের লেখকদের বেড়ে ওঠার জায়গাগুলোর কথাকে ধারণ করেছে, আমিও বলেছি; আমি বলেছি— রোড আইল্যান্ডের কথা। লেখকদের বর্ণনায় এসব জায়গার চমৎকার ডিসপ্লে হয়েছে। আমাকে খুবই স্পর্শ করেছে এই বইয়ের বিষয়-আশয়। এ-এন্থোলজিতে আমাকে রোড আইল্যান্ড সম্পর্কে লিখতে বলা হয়েছিল, অন্য লেখকরাও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন যার যার জায়গা নিয়ে লিখতে, যাদের সঙ্গে এসব জায়গার খুব ঘনিষ্ট সংযোগ ছিল। আমাকে রোড আইল্যান্ড নিয়ে লিখতে বলা হয়েছিল, এবং আমি লিখেওছি কিন্তু আজকের আলাপের শুরুতেই এ বিষয়টির উল্লেখের কারণে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম।

 

টেলর: ঝুম্পা, আমরা তোমার সর্বশেষ লেখাটির কাছেও পৌঁছে যাব। তোমার কাজের মধ্যে বিশেষ একটি ব্যাপারকে আমার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়, যা তুমি তোমার প্রায় সমস্ত লেখায় ধরতে চেয়েছ— তুমি তোমার নিজেকেই সন্ধান করো, সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করো, এবং আমাদেরকেও তুমি তোমার লেখায় ধরতে পারো। তোমার লেখার এ-দিকটি আমার সবচে পছন্দের। আজ আমি এখানে তোমার সমগ্র লেখকজীবনকে আরও বেশি করে ধরতে চাই, অনুসন্ধান চালাতে চাই, এরকম একটি প্রশ্নের মাধ্যমে আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই- তোমার যখন পনের বছর বয়স, সেই সেই সময়ে তোমার প্রিয় উপন্যাস কোনটি ছিল এবং কেন?

ঝুম্পা: তাই! আচ্ছা, ঠিক আছে; সেই বয়সে তো আমি রুশ সাহিত্য পড়তে শুরু করেছি। আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর তিনটি সন্তান ছিল— তিন কন্যা; তাদের একজন বয়সে আমারচে একটু বড়, তখন সে কলেজে পড়ে। তাদের বাড়ি গিয়ে তার ডেস্কের ওপর দস্তইয়েভ্‌স্কি এবং টলস্টয়ের বিশাল ভল্যিউমগুলো দেখতাম। এগুলো ছিল নর্টন ক্রিটিক্যাল এডিশন। এই ভল্যিউমগুলোর ভেতর এমন একটা কিছু ছিল, একটা প্রবল হাতছানি, কিংবা টান, যে-টানকে আমি কিছুতেই অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। আমার ভেতর তারা কী যেন করে ফেলতো। কেমন এক তাড়ণার জন্ম হতো। সে-অমোঘ-টানেই রুশসাহিত্যের কাছে যেতে হয়েছিল আমাকে, পড়তে হয়েছিল।

রুশসাহিত্যের পাঠক হলেও হওথর্নকেও খুব পছন্দ করতাম। পনেরোয়, আমি তখন গ্রেড ১০-এ পড়ছি, সেই বয়সে গ্রেট গ্যাটসবি (১৯৫২, এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড) পড়ে ফেলেছিলাম এবং ঠিক পরের বছরই (টমাস) হার্ডির লেখাপত্রের সঙ্গে আমার পরিচয়; ক্রমশই তিনি আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক লেখক হয়ে উঠবেন। সুতরাং সেই বয়সেই, আমি জ্যোতির্ময় লেখকদের শ্রেষ্ঠ লেখার পাঠক হয়েছিলাম, আর এ কথা আজ বলতেই হবে যে- তারা এমনই সব শ্রেষ্ঠ লেখক, যারা সব সময় আমার সঙ্গে আছেন, অবিরাম যারা আমার জীবনে আলো জ্বালছেন, এবং প্রতিদিন আমাকে নতুন নতুন জন্মের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, নতুন লেখার প্রেরণা দিচ্ছেন।

 

টেলর: তুমি বিভিন্ন সময়ে এমন কিছু অভিমত ব্যক্ত করেছ, সে তোমার পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকেই এসেছে; এমনও কিছু মন্তব্য আছে, যার ভেতরে একটি মন্তব্য আমার কাছে বিশেষ, যেমন : ‘স্কারলেট লেটার’ সম্পর্কে তোমার অভিমত। ‘স্কারলেট লেটার’ বাস্তবিক অর্থেই এক ‘অভিবাসী উপাখ্যান’ (ইমিগ্রান্ট ফিকশন), উপন্যাসের চরিত্ররা ইমিগ্রান্ট না হলে ঠিক এরকম আচরণ কখনওই করতো না; তারা বহিরাগত। এমনকি হার্ডি’র লেখাতেও এমন বিষয় প্রচুর, বিশেষত ‘টেস’ (টেস অভ দ্য ডার্বারভিল), তোমার খুবই প্রিয় একটি উপন্যাস; এটাকেও তুমি অভিবাসী উপন্যাস হিসাবে পড়তে পারো। চরিত্ররা কান্ট্রিসাইড থেকে আগত, তারপর কোথাও বেশ অদ্ভুতভাবে স্থানান্তরিত, বহিরাগত এবং অচেনা; চরিত্ররা অভিবাসী না হলে তাদের আচরণ কেমন হতো- হয়তো হার্ডি তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন; তিনি তাদের দেখবার জন্য এমন এক ভঙ্গি ব্যবহার করেছেন যে-ভঙ্গিটি না হলে চরিত্রদের আচরণকে পাঠকের কাছে কিম্ভূত লাগবে, অচেনা লাগবে। এখন, এই যে কথাটি— ‘অভিবাসী উপাখ্যান’, তোমার লেখার মধ্যে দিয়ে তাদের পড়তে পারাটা কিন্তু আমাদের মতো পাঠকদের জন্য বিশাল ব্যাপার, তোমার চোখে তাদের দেখা, তোমার কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে। ফিকশনে এই ‘অভিবাসী’ ব্যাপারটিকে তুমি ঠিক কীভাবে মোকাবেলা করো?

ঝুম্পা: লেখকদের অবিরাম স্থানান্তর কিংবা দেশান্তরের বিষয়টিকে মাথায় রেখেই কিন্তু আমি অভিবাসী উপাখ্যান সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছি যা মোটামুটি প্রায় সব লেখক সম্পর্কেই খাটে, এমন কি উইলা ক্যাথারকেও তুমি এইভাবে পড়তে পারো; হোমারকেও পারো। এভাবে বহু লেখককে পাঠ করা যায়। কয়েক বছর আগে ঠিক এই বিষয়েই, মানে ‘ইমিগ্রান্ট ফিকশন’ সম্পর্কে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ’-এর এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল! প্রশ্নের অভিপ্রায় ছিল- অভিবাসী সাহিত্য সম্পর্কে আমার অবস্থান কী, এই সাহিত্যের সমস্যা কোথায়, কীভাবে আমি বিষয়টিকে দেখি, এবং আমি যে অভিবাসী উপাখ্যান টার্মটিকে মেনে নিই না, বিশ্বাস করি না— সে সম্পর্কে বেশ উদ্ধত মন্তব্য করেছিলাম।


পাঠকের সুবিধার জন্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে সেই সাক্ষাৎকারের অংশটুকু এখানে দেওয়া হলো—


দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস: ইতোমধ্যে পড়েছেন এবং নিজের লেখালেখির ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এমন কোনো ‘ইমিগ্রান্ট ফিকশন’ আছে কি?

ঝুম্পা লাহিড়ী: আমার সত্যিই জানা নেই ঠিক কীভাবে এই ‘অভিবাসী উপাখ্যান’ (ইমিগ্রান্ট ফিকশন) টার্মটির জন্ম হয়েছে! লেখকরা সবসময়ই যে মহাদেশ থেকে এসেছেন, তা নিয়েই লিখেছেন। সমস্ত লেখকই তো দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বেড়ে উঠেছেন; এক সময় তারা তাদের উৎসভূম ছেড়ে অন্য প্রান্তে চলে এসেছেন চিরিস্থায়ীভাবে, নিজেরাই বেছে নিয়েছেন তাদের পছন্দের জায়গা, কোথাও আশ্রয় নিয়েছেন, কখনও হয়তো চলে আসাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল কিংবা কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে দেশত্যাগ করতে হয়েছে—তারপর তারা সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন উপন্যাসে, গল্পে, তাদের স্মৃতিকথায়। এখন যদি কয়েকটি নির্দিষ্ট বইকে ‘ইমিগ্রান্ট ফিকশন’ নামে বিশেষ টার্মে ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে বাদবাকি বইগুলোকে আমরা কী বলব? নেটিভ ফিকশন? পিউরিটান ফিকশন?

এই সহজ চিহ্নিতকরণ বিষয়ে কেউই আমার সঙ্গে একমত হবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের যে ইতিহাস আমরা জেনেছি, তাতে এই মহাদেশের সমস্ত উপন্যাসকেই ‘ইমিগ্রান্ট ফিকশন’ হিসেবে শ্রেণিভূক্ত করে ফেলা যাবে। নাথানিয়েল হথর্ন অভিবাসীদের নিয়ে লিখেছেন, উইলা ক্যাথারও লিখেছেন; সাহিত্যের একেবারে সূচনা লগ্ন থেকেই কবি ও লেখকরা তাদের ন্যারেটিভের ভিত্তি হিসেবে এক জায়গায় থিতু হয়ে থাকবার পরিবর্তে সীমান্ত অতিক্রম, দীর্ঘ অভিযাত্রা, দেশত্যাগ, নির্বাসন ইত্যাদি বিষয়কেই বেছে নিয়েছেন। ‘আগন্তুক’ হচ্ছে মহাকাব্য এবং উপন্যাসের আর্কেটাইপ। বিচ্ছিন্নতা এবং মিলনের মধ্যেকার যে মানসিক টানাপোড়েন, সাহিত্যে সেটাই মৌলিক থিম।]

‘ইমিগ্রান্ট ফিকশন’ সম্পর্কে আমি যা বিশ্বাস করি, সেদিন তাই বলেছিলাম। লেখকজীবনের শুরু থেকে আমি যা কিছুকে সত্য বলে জেনেছি, মেনেছি— আমি সেভাবেই আমার জবাব দিয়েছি। সাহিত্যের প্রতি আমার যদি ঠিক এরকম সংবেদন না থাকে, এরকম প্রতিক্রিয়া না থাকে— তাহলে, এইসব মহৎ লেখকরা আমার ভেতর ক্রিয়া করতেন না, লিখতে প্রেরণা দিতেন না; তারা যেভাবে তাদের কাজ করে গেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা, তাদের সময় এবং আমার অভিজ্ঞতা ও সময়ের মিথস্ক্রিয়ায় আমার এমন প্রতিক্রিয়ার জন্ম হতো না। বড় লেখকরা তাদের পরবর্তী লেখকদের ভেতর ক্রিয়াশীল থাকেন। সাহিত্য মানচিত্রের সীমা মেনে চলে না, তার কাজ এর ঠিক বিপরীতে; সাহিত্য একটি অসামান্য উপায়ে, এক ঐন্দ্রজালিক উপায়ে আমাদেরকে জনজীবনের দেশের মানচিত্রের সীমানারেখাগুলোকে অতিক্রমের উস্কানি দেয়।


টেলর: ‘লো ল্যান্ড’-এর স্মৃতি তোমার আছে, তোমার বেড়ে ওঠার সঙ্গেই সে মিশে আছে, কারণ এ তোমার শিকড়, তোমার বাংলা; তাহলে এবার আমি ‘বাংলা’ সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই। যদি কেউ ভারতবর্ষে বেড়াতে যেতে চায়, আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, পরামর্শ চায়, আমি তাকে নির্দ্বিধায় কলকাতা যাওয়ার কথা বলি, বলি যে— ‘তোমাকে অবশ্যই একবার কলকাতায় যেতে হবে।’ তুমিও কি ঠিক এভাবেই কলকাতাকে অনুভব করো? কী বলবে যদি জানতে পারো কেউ কলকাতা যাচ্ছে?

ঝুম্পা: কলকাতা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। জীবনের নিত্য জঙ্গমতা, তার সংস্কৃতি, তার ইতিহাস, সবই তার একান্ত নিজস্ব— এ সমস্ত-কিছু-নিয়ে কলকাতা এমন এক শহর, পৃথিবীর অন্যান্য শহর থেকে যে একদমই আলাদা। কলকাতা জটিল, এবং সুন্দর; তার এ সৌন্দর্য প্রথাগত নয়। যে লোকটি সেখানে যাবে, তার কাছে হয়ত শহরটিকে বিশেষ কিছু মনে হবে না। কিন্তু আমার কাছে?

পর্যটকের চোখ দিয়ে তো আমি কলকাতাকে দেখি না। সে উপায় আছে? এখান থেকেই আমাদের পরিবারটি এসেছে। আমি তো কলকাতা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারতাম না, যদি না ছোটবেলায় দাদা দাদি এখানে থাকতেন; মামা কাকারা, ভাই বোনেরা, যদি না থাকতেন। আমার কিছুই জানা হতো না। এই আত্মীয়পরিজনরাই আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছেন। পূর্ণ করেছেন। সুতরাং, এ শহরের সঙ্গে আমার নিজস্ব একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমেরিকায় থেকে নিউইয়র্ককে চেনা বা না-চেনার সঙ্গে তাকে মেলালে চলবে না। এ হচ্ছে আপন মাটি— জন্মসূত্র; এ শহর পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেনি, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের জন্যও এ শহর নয়। কলকাতার এমন এক ঘ্রাণ আছে, এমন এক শক্তি আছে, যা দিয়ে নিজেই নিজেকে সে প্রতিদিন শুদ্ধ করে নেয়, ঋদ্ধ করে নেয়।

 

টেলর: পূর্বের ইতিহাসের প্রতি কতটা সংবেদনশীল হয়ে তুমি বাংলার সঙ্গে বন্ধন অনুভব করো? ১৯০৫-এ [জর্জ] কার্জনের দেশভাগে এখন যা পশ্চিমবঙ্গ, যা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তুমি কিন্তু খুব সহজেই বিকল্প-ইতিহাস কল্পনা করতে পারো যেখানে ঠিক এ-বিচ্ছেদ ঘটেনি, বাস্তবের ঠিক বিপরীতে গিয়ে, আবার দু’বাংলার বিচ্ছিন্নরেখার কথাও ভাবতে পারো, যে-বাস্তব আমরা দেখতে পেয়েছি। এ কি কেবলই এক বিমূর্ত ইতিহাস তোমার কাছে? দেশভাগের মাধ্যমে বাঙালি নিজেই বাঙালির কাছ থেকে পৃথক হয়েছে— বিষয়টিকে তুমি ঠিক কীভাবে দেখো? এমন কি কখনও মনে হয় যে এই বিচ্ছেদ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তোমার অস্তিত্বের কিংবা সম্পর্কের কোনও অংশ নয়?

ঝুম্পা: এই বিষয়টি আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে আমার যে-সম্পর্ক, তার দুটি দিক রয়েছে, এক— ইতিহাসের স্পর্শ থেকে দূরে ছিলাম বলে এ-সম্পর্কে আমার বহুকিছুই জানা হয়নি, স্টাডিও যে খুব গভীর অর্থে যা বোঝায় তাও করে উঠতে পারিনি; কারণ আমি ভারতবর্ষের বাইরে বেড়ে উঠেছি। বাইরে বড় হওয়ার কারণে এক ধরণের আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছিল; অন্যদিকে— এখানে আমি আমার পরিবারের সঙ্গেই এসেছি যারা মাঝে মাঝেই কলকাতায় ফিরে যেতেন, আমাদের আত্মীয়পরিজনরা তাদের দেশ, তাদের শহর, তাদের ইতিহাস এবং দেশ-সম্পর্কিত-ঘটনাবলী-সম্পর্কে প্রচুর কথা বলতেন, যার ফলে এটা হয়েছে— ভারতীয় ইতিহাসের এই অবিশ্বাস্য বেদনাদায়ক ঘটনা সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম এবং দেশভাগ— সর্বোপরি এর অর্থ কত গভীর, কী গভীর দুঃখের, তা আমাকে অবশ্যই স্পর্শ করেছে; বাবা কাকাদের পরিবারের দিক থেকে, দেশভাগ যে কতো মর্মান্তিক, তাও জানি; যেখানে আমার বাবা বেড়ে উঠেছিলেন, যে-পাড়াটিতে… ‘লো ল্যান্ড’-এ এর কিছুটা বিবরণ আমি দিয়েছি।

আমাদের পরিবারে কিংবা আত্মীয়পরিজনদের মধ্যে এখনও এমন কিছু মানুষ বেঁচে আছেন, তারা এখনও এমন সংবেদনশীল… যারা দেশভাগের ঘটনাবলীর দ্বারা ক্ষতবিক্ষত। দেশভাগের ক্ষত… আমাদের পরিবার, পূর্ব বাংলা এবং মুসলিমদের সঙ্গে বিচ্ছেদ… এ কেবল শিকড়েই গভীর আঘাত করা নয়, একদম চিরস্থায়ী বৈরীতা, বিভক্তি… আমি উপলব্ধি করি বাঙালি সংস্কৃতিতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সেই অস্বস্তিকর সম্পর্ক এখনও বদলায়নি। বিভক্তি বেঁচে আছে। আমার মেয়ের নাম নূর, ফারসি নাম। মেয়ের এমন নাম রাখার জন্য আমাদের আত্মীয়রা অনেক কিছু বলেছেন, আমি শুনিনি, গায়ে মাখিনি; আমি বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছি।

 

টেলর: নূর ফারসি নাম বলেই?

ঝুম্পা: হ্যাঁ, সে জন্যই। মুসলিম নাম, ফারসি নাম ইত্যাদি ইত্যাদি… এই জাতীয় ঘৃণা, অসহিষ্ণুতা, কুসংস্কার এখনও আমাদের পরিবারের রান্নাঘরে, ডিনার টেবিলে রয়েছে। বাবা মা মোটেও তেমন নন। তাঁরাই আমাকে এ ধরণের মনোভাব থেকে মুক্ত থাকতে শিখিয়েছেন।

 

টেলর: সৃজনশীল লেখালেখি, তুলনামূলক সাহিত্য এবং ইংরেজি— এই তিনটি বিষয়ে তোমার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে আমরা জেনেছি, এদের যেকোনও একটির জন্য তোমাকে আশাপূর্ণা দেবীর ছ’টি গল্পের অনুবাদ করতে হয়েছিল; যিনি বাংলা ভাষার একজন অন্যতম প্রধান নারী লেখক, এবং তিনি সম্ভবত বিশশতকের সবচে জনপ্রিয় বাঙালি লেখক। তাঁর লেখালেখির সঙ্গে যোগাযোগটা কীভাবে হলো, তুমি কীভাবে তাঁর কাজের সঙ্গে এভাবে একাত্ম হতে পারলে?

ঝুম্পা: তাঁর সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম মায়ের কাছ থেকে, তিনি ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী’র রচনার এক নিবিষ্ট পাঠক; মা আমাকে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন। ব্যাপারটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।

মা প্রচুর বই পড়তেন যার বেশিরভাগই বাংলা, ইংরেজিতে একদমই কিছুই পড়েননি তিনি; আর আমার পক্ষে তো ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে কীভাবে তিনি কলকাতা যাওয়া থেকে শুরু করে বইয়ের অর্ডার করার প্রচেষ্টা— এসব বিপুল ঝক্কি সামলাতেন! কতকিছুকে যে তিনি বইয়ের সঙ্গে জড়াতেন… আমার যে কাকাকে তিনি বইয়ের তালিকাটি দেবেন, সে কাকার কলেজস্ট্রিটের প্রায় সমস্ত বইবিক্রেতার সঙ্গে চমৎকার যোগাযোগ ছিল। এ ব্যাপারটি বেশ নাটকীয়ও— সেখানকার বইয়ের দোকানগুলোয় যাওয়া, প্রকাশদের কাছ থেকে বইয়ের তালিকা সংগ্রহ, চাহিদা জানানো, অপেক্ষা করা, রিকশায় করে বাড়িতে বই নিয়ে আসা, বাঁধাছাঁদা করা, তারপর— যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা…

এভাবে বই হাতে পাওয়া যে কী একটা ব্যাপার ছিল তার কাছে, সে তো আমি দেখেছি; এটা বুঝেছি যে— এই বইগুলোই তার আনন্দবেদনার মশলাপাতি। কাঙ্ক্ষিত বইগুলি তাকে জোগাড় করতেই হতো, কারণ এখানে সেসব সহজলভ্য ছিল না আর এই বইগুলো ছিল তার জীবনরেখা।

সে যা-ই হোক, মা প্রায়ই তার প্রিয় লেখকদের সম্পর্কে কথা বলতেন, এবং তিনি যেসব বিষয়ের ওপর জোর দিতেন, তা অনেকটা বর্ণনা দেওয়ার মতো করেই বলতেন তিনি, সেসব বর্ণনার প্রতি আমি গভীরভাবে আকর্ষিত হয়েছিলাম, প্রভাবিত হয়েছিলাম। আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প এবং উপন্যাসে দারুণ কাজ করেছেন, তার কিছু কিছু গল্পে দেশজ গার্হস্থ্যজীবন সমস্ত খুঁটিনাটিসহ উপস্থিত হয়েছে। আমি মনে করেছিলাম—এমন মনে করাটা ভুল—তিনি হচ্ছেন কেবল নারীদের লেখক; আসলে তা নয়। তাঁর লেখায় অনেক বেশি বিশ্বজনীন শক্তি এবং দৃষ্টি আছে।

ট্রান্সলেশন ওয়ার্কশপে আমাকে কিছু অনুবাদ করতে বলা হয়েছিল, মূলত সে কারণেই…

 

টেলর: কিন্তু তুমি তো বাংলা পড়তে পার না, তাহলে কীভাবে?

ঝুম্পা: আমি তো পড়তেই পারি না, সত্যিই পারি না, এমন কি লিখতেও পারি না; ফলে আমাকে খুব কষ্ট করে অনুবাদের কাজটা করতে হয়েছে। করতাম কী, মাকে একেকটি গল্প জোরে জোরে পড়তে বলতাম, তিনি পড়তেন আর আমি রেকর্ড করলাম। তারপর— আমি সেই পাঠ শুনতে লাগলাম, বারবার করে…এভাবে শুনে শুনে গল্পগুলোর অনুবাদ শেষ করলাম। বাংলা পড়াটা আমার কাছে এখনও সহজ হয়নি, খুবই ধীর গতিতে পড়াটা আমার এগোয়। মায়ের গল্পপাঠের রেকর্ড শোনার পাশাপাশি টেক্সটগুলো দেখতে লাগলাম, গল্পের কলকব্জাগুলো অর্থাৎ শৈলী দেখতে লাগলাম গভীর মনোযোগে— কীভাবে গল্প বলা হয়েছে, লেখক কোথায় থেমেছেন, কীভাবে জীবনকে তিনি দেখেছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি…এমনও হয়েছে— মাকে সঙ্গে নিয়েই গল্পগুলোর পাঠ শুনেছি।

অনুবাদের কাজটি সত্যিই অন্যরকম একটা ব্যাপার ছিল যার শুরুটা এভাবেই…

 

টেলর: রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্রের সঙ্গে আপনার সাহিত্যিক কিংবা আবেগিক মানসিক সম্পর্ক কেমন? রবীন্দ্রনাথ বাংলার বৌদ্ধিক ইতিহাসের এক মহীরুহ, এক স্তম্ভ। তোমার/আপনার প্রায় প্রতিটি গল্পে কেউ না কেউ প্রতিদিন তাঁর কবিতা পড়ছেই। তাঁর অনেক থিম নিয়ে আমরা তোমাকেও লিখতে দেখেছি, যেমন তাঁর একটি উপন্যাসের নাম ‘ঘরে বাইরে’; যেখানে ব্রহ্মাণ্ড এবং তার অন্তঃস্থ নানামুখী চরিত্রদের ভেতরকার অনিবার্য দ্বন্দ্বের অদ্ভুত মিশ্রণ। এমনকি তিনি বইয়ের অলঙ্করণের কাজেও পারদর্শি ছিলেন। প্রকৃত অর্থে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জ্ঞান এবং প্রজ্ঞার আশ্চর্য সমন্ব (পলিম্যাথ)। বিশ্বের বহুকিছু তিনি পড়েছেন, স্পর্শ করেছেন; নিবিড় অধ্যয়ন করেছেন। তোমার ক্ষেত্রে কি তাঁর কোনও প্রভাব কিংবা…

ঝুম্পা: দেখো, একটা চিরন্তন ব্যাপার কী, তুমি যদি বাঙালি হও, তবে অত্যন্ত তাৎপর্যময় অর্থে রবীন্দ্রনাথ তোমার পরিবারের একজনের মতো; দেবতা তিনি, এক ঈশ্বর; তিনি দখল করে আছেন সর্বদেবতার মন্দির, তবুও… আমি বলি— দেবতা তো তিনি নন, মানুষ।

আমার মা বাবা কেউই সে অর্থে ধর্মপ্রাণ ছিলেন না, তারা আমাকে ধর্মের কথা শেখাতেও চাননি, ইচ্ছাও করেননি; তারা যা করতে পেরেছিলেন তা হচ্ছে— মহান মনের ও মহান স্বপ্নদর্শীদের কীভাবে সম্মান করতে হয় তা শেখানো। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ হলেন মহান স্বপ্নদর্শীদের একজন, এবং সবচে বড় সত্যটি হলো— তিনি খাটি বাঙালি হতে পেরেছিলেন, সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন…এবং নিজেকে তিনি বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন…

আমার দাদু এবং কাকারা ছিলেন পেইন্টার। ঘরবাড়িতে এত চিত্রকর থাকায় আমরা বেড়ে উঠেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি দেখতে দেখতে। এখানে আমাদের বাড়িতেও তাঁর একটি প্রতিকৃতি আছে, কাকুর করা জলরঙ। কয়েকদিন আগে মা খুব সুন্দর একটি ফটো দিয়েছেন, ফটোটি আমার আরেক দাদুর তোলা, যিনি প্রেস ফটোগ্রাফার ছিলেন; জনসমক্ষে রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ বক্তৃতার সময় ছবিটি তিনি তুলেন। এখন যখনই লিখতে বসি, পাশে ঠাকুরের ছবিটি আমি এনে রাখি; তাঁর আমার জীবনের ধ্রুবতারা মনে করি, শক্তি মনে করি; মনে করি— তিনি তো কাছেই আছেন।

ঠাকুরকে আমি এভাবেই দেখি, এভাবেই পাই।

আবার, এ-কথাও তো সত্য যে—বাংলা সাহিত্যের খুব গভীর পাঠক হওয়ার ক্ষেত্রে আমার সীমাবদ্ধতা আছে, সত্যিকার অর্থে এ সাহিত্যের সাবলীল পাঠক আমি হতে পারিনি। ফলে— তাঁকে আমি অনুবাদেই পড়েছি, তাঁর কথাসাহিত্য, কবিতা…বাড়িতে ২৪ ঘণ্টা তাঁর গান শুনে শুনেই তো বড় হয়েছি। এখন, আমার ওপর তাঁর কোনও সচেতন প্রভাব পড়েছে কি না সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু— কাকেই-বা বলে সচেতন প্রভাব আর কাকেই-বা বলে অচেতন, অবচেতন! এসব স্পষ্ট করে বলা কি সম্ভব?

 

টেলর: বেশ! এবার আমার প্রিয় বই ‘ইন আদার ওয়ার্ডস’ (ঝুম্পার গদ্যের বই) নিয়ে কথা হোক, যে-বইটিতে তোমার ইতালিও ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের সংস্কৃতি, সে দেশের ভাষায় লেখালেখি করার মতো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়গুলো এসেছে, স্মৃতিমন্থনের মতো। অত্যন্ত চমৎকার একটি বই। আমি এখন ইতালির কয়েকজন লেখকের নাম বলতে চাচ্ছি, তাদের সঙ্গে তোমার যদি কোনও সংযোগ থেকে থাকে, তাহলে আমাকে বলতে হবে কেন তারা তোমাকে টানেন বা আকর্ষণ করেন, তারা কীভাবে তোমাকে প্রভাবিত করেন, প্রেরণাদায়ক হয়ে ওঠেন; যেমন আমি এখানে গ্রাজিল্লা লালা রোমানোকে স্মরণ করতে চাইছি।

ঝুম্পা: রোম থাকাকালীন কখনই তার কথা শুনিনি। একদিন খবরের কাগজে তাঁর সম্পর্কে লিখিত একটি নিবন্ধ পড়লাম, সেটা দারুণ ছিল। তাঁর নামটি নোট করলাম, তারপর বইয়ের দোকানে চলে গেলাম, তাদের বললাম— ‘আমি এই লেখককে পড়তে চাই’, এবং তারা বলল— ‘ও হ্যাঁ, কিন্তু তাঁর লেখা খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন, তাঁর বইগুলো সবখানে পাঠানো হয়নি’। সে যা-ই হোক, তাঁর কিছু বইয়ের অর্ডার করলাম। সত্যিই তাঁর বইগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, যিনি গদ্যটি লিখেছিলেন, পরে তার মাধ্যমেই…ইতালি এমনই দেশ— এখানে সবাই সবার চেনা, অপরিচয় নেই। সেই তিনি, যিনি গদ্যটি লিখেছিলেন, তাকে আমি জানতাম; তাকে গ্রাজিল্লার বই সম্পর্কে বললাম, তিনি তাঁর স্বামীকে চিঠি লিখতে বললেন, যার কাছে সবগুলো বইই আছে, তাদের বাড়িটি নাকি বইয়ের বিশাল গুদাম। তার কথায় কাজ হল— গ্রাজিল্লার স্বামীকে একদিন চিঠি লিখলাম, উত্তরে তিনিও লিখলেন। কিছুদিন চিঠি লেখালেখি চলল। মিলালো থেকে বই পাঠানো হলো, কিন্তু সে বই আর রোমে এলো না… কেন জানি কেবল বইয়ের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়!

 

টেলর : তারা এখনও ট্রেনে, মিলানোর আশাপাশে কোথাও…

ঝুম্পা: হ্যাঁ, আমিও অপেক্ষা করছিলাম আর তারাও আসছিল না। তাকে লিখলাম— বইগুলো তো এখনও পাইনি…এত কষ্ট করে পাঠালেন…কিন্তু…তারপর একটু অন্যরকম কিছু হলো, আমি নিজেকে একদিন মিলানোয় খুঁজে পেলাম— যে হাঁটছে, ঘোরগ্রস্ত। আমি মিলানোয় এসেছি জেনে তিনি বললেন, তুমি কোথায়? বাড়িতে চলে আসছো না কেন? আমি তাদের বাড়িতে চলে গেলাম।

আমি ঘুরে ঘুরে এবং এক প্রবল ঘোরে লেখকের বাড়িটি দেখছি! তাঁর লেখার ঘর, ঘরের চেয়ার টেবিল, তাঁর পেইন্টিংস, ব্যবহারের জিনিসগুলি দেখছি আর দেখতে দেখতে কত কিছু নিয়ে যে আমরা কথা বলছি! ভদ্রলোক তাঁর সমস্ত বইয়ের একটি করে কপি উপহার দিলেন— হাতেটানা এক্কাগাড়ি যেন বইয়ে বইয়ে ভরে গেল! ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই দারুণ উত্তেজনার।

একদিন খুব আগ্রহ নিয়ে বইগুলো পড়তে শুরু করলাম।

গ্রাজিল্লা নিঃসন্দেহে একজন আধুনিকতাবাদী লেখক। তার ভাষা প্রত্যয়াতীত, পড়তে গেলে ভাষার প্রাণস্রোতে বিস্মিত হয়ে যেতে হয়। তিনি এমন একটি অসামান্য বই লিখেছেন, যদি আমার জীবন যথেষ্ট দীর্ঘ হয় এবং কাজের সময় থাকে, তাহলে বইটিকে আমি অনুবাদ করতে চাই, বইটির নাম— চরম সমুদ্রে (Nei mari estremi); দু-খণ্ডে লিখিত মেমোয়ারটি তাঁর প্রথম স্বামী-হারানোর গভীর বিষাদে ভরা। তুমি তো জানোই যে— এমন অনেক বই আছে যেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে হারানোর গভীর বেদনা, প্রেমের দুঃসহ যন্ত্রণা এবং এরকম আরও কিছু ব্যাপার…ভেতরটাকে যা নাড়িয়ে দেয় কিন্তু সেসব বই তো বহুকাল আগে লিখিত হয়েছে, জনজীবনের প্রবল স্রোত পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে যাওয়ারও বহুকাল আগে, সংস্কৃতির অংশ হওয়ারও আগে, তবুও বলি— ‘চরম সমুদ্রে’ একটি আশ্চর্য বই। তাঁর উপন্যাগুলিও অসাধারণ।

 

টেলর: তাঁর বিষয়-আশয়ের অনেক কিছুই এখন এক্সিস্ট করছে না।

ঝুম্পা: তবুও বলবো যে তিনি বিশাল মাপের কাজ করেছেন। তাঁর যে-ব্যাপারটি আমাকে হতভম্ব করে দিয়েছিল তা হচ্ছে শেষ জীবনে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি এতোই অদম্য ছিলেন যে একদিনের জন্যও লেখালেখি বন্ধ করেননি, লেখায় অবিচল ছিলেন। তখন তাঁর স্বামী, তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, তিনিই তাঁকে বহুযত্নে টিকিয়ে রেখেছিলেন, ভদ্রলোক বলেছেন— ঠিক সেই সময়ে, যখন গ্রাজিল্লা প্রায় অন্ধই, জীবনের একদম অন্তিম প্রান্তে পৌঁছে গেছেন, তখনও তিনি লিখেছেন— প্রতিদিন কয়েকটি মাত্র শব্দ, একটি কি দুটি মাত্র বাক্য। তখন তার হাতের কাছে প্রচুর কাগজ রাখা ছিল, যাতে তিনি কেবল কয়েকটি শব্দ, একটি দুটি বাক্য লিখতেন, সারাদিনে; সেইসব শব্দ, বাক্য জ্বলছিল জীবনের ভীষণ উত্তাপে, জ্বলছিল তারা জীবনের সঙ্গে, এবং শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসত্ত্বেও নিজেকে প্রকাশ করার তীব্র প্রয়োজনেই ছিল সেইসব একটি দুটি শব্দ কিংবা বাক্য।

এ লেখাগুলো নিয়ে পরে একটি সংকলন বেরিয়েছিল ‘দেয়ারিও উলতিমো’ (শেষ ডায়েরি) নামে, তাতে ছিল ছোট ছোট অনুচ্ছেদ, টুকরো টুকরো লেখা, কখনও এপিগ্রামের মতো, এইসব; সেই টুকরো লেখাদের কোনও একটি এমন কথাও বলে— ‘লা মিআ ক্যোয়াসি চেচিতা উঁন পুন্তো ডি ভিস্তা’, যার মানে হলো— আমার অন্ধত্ব আমারই একটি দৃষ্টিভঙ্গি।

 

টেলর: সিজারে পাভেসে সম্পর্কে কিছু…

ঝুম্পা: পাভেসে বিশাল। তিনি মবি-ডিক অনুবাদ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে, আমরা যখন সিসিলি থাকতাম, তখন একবার এওলিয়ান দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে ঘুরতে গিয়েছিলাম; একদিন আলাপ করছিলাম আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে, দীর্ঘ কথোপকথন করেছিলাম আমরা, পাভেসে ছিলেন আলাপের মূল বিষয়; তো আমাদের ক্যাপ্টেন বলছিলেন, পাভেসের মোবি-ডিকের অনুবাদ মেলভিলকে ছাড়িয়ে গেছে!

 

টেলর : সত্যিই তা হয়েছে?

ঝুম্পা: অনুবাদটি আমি এখনো পড়িনি, পড়তে চাই; বুঝতে চাই সেটা কীভাবে সম্ভব হলো। পাভেসে ছিলেন তুরিনের এক বিশাল মাপের লেখক, তুরিন— সাহিত্যের সেই মহান ইতালিও শহর, যেখানে আরও ছিলেন প্রিমো লেভি, নাতালিয়া গিন্সবার্গ, এনাউদি (প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা)— যাদের প্রভাব ইতালি পার হয়ে ফ্রান্সেও পড়েছে।

পাভেসে যা লিখেছেন, তাঁর বেশির ভাগই আত্মজীবনীমূলক, তিনি মূলত এমন লেখাই লিখতে চেয়েছেন; আমি এখন মনে করি— লেখক যখন তাঁর লেখার চরিত্র হয়ে ওঠেন, ব্যাপারটা দারুণ হয়, আমরা যারাই লিখি, আমরা আসলে আমাদেরকেই লিখি, নিজেদের সম্পর্কেই লিখি, যার বেশিরভাগই মেমোয়ার। রোমন্থন। আর এসব এমন ব্যাপার, পাভেসে যা করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল এলোমেলো, ট্র্যাজিক। জীবন তাকে এতটুকু ছাড় দেয়নি, আমৃত্যু ভীষণ কষ্টে বেঁচে ছিলেন। খুবই গভীর ছিল সে সব। সুইসাইড করলেন। রেখে গেলেন এক অতলস্পর্শী লেখা— লেখকের নোটবুক, পাভেসের এক এক্সট্রাওর্ডিনারি কাজ, অত্যন্ত শক্তিশালী; খুব, খুব অন্ধকার; মর্মের অতল খাবলে ধরা একেকটি বাক্য, এবং ভয়ানক সব সত্য। তিনি প্রচুর ছোটগল্প লিখেছেন; নভেলা সিরিজ লিখেছেন। অনুবাদক হিসাবেও ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। কেবলমাত্র মার্কিন লেখকদের অনুবাদই নয়, ইংরেজি ভাষার সঙ্গেও তাঁর বর্ণাঢ্য সম্পর্ক ছিল, তাঁর তত্ত্বাবধানেও বহুসংখ্যক অনুবাদ হয়েছে, প্রকল্প হিসেবে।

 

টেলর: তিনি মার্কিন লেখকদের মতো লিখেছেন।

ঝুম্পা: হ্যাঁ, তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এই প্রভাবের ব্যাপারটি অন্যরকম। তিনি মেলভিলকে পড়তে পড়তে, এবং অনুবাদ করতে করতে প্রভাবিত হয়েছিলেন, এভাবে তিনি অন্যদেরকেও পড়েছেন; অনুবাদে তাঁর ইতালিও আত্মপরিচয়টি অন্যরকম শক্তি যুগিয়েছে। সেই পাভেসিও ফ্লেভারের অনুবাদ এবং ইংরেজি-ভাষাসম্বন্ধ— আজকের মার্কিন কথাসাহিত্যে অনুপস্থিত, অবশ্য কবিদের কাজের অনন্য মাত্রাটি এখনও বজায় আছে। মার্কিন কবিরা, যারা অনুবাদ করেছেন, এখন অনুবাদ করছেন, তাদের সময় ও শক্তি ব্যয় করছেন, তাদের কাজে সে-ফ্লেভারটি এখনও আছে। তারা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন অনুবাদের জন্য, তা সে এজরা পাউন্ড হোন কিংবা অন্য কেউ, কিংবা কবি ডব্লিউ. এস. মারউইন, মার্ক স্ট্র্যান্ড — তোমার কাছে এমন এমন কবির নামের উদাহরণ তো রয়েছে, যারা অনুবাদ করেছেন এবং অনুবাদকে তাদের সৃজনশীল কাজের অংশ করে তুলেছেন; তাদের এতোটাই ডেডিকেশন ছিল। বিপরীতে কথাসাহিত্যিকরা অনুবাদ নিয়ে ভাবা বা অনুবাদে যুক্ত হওয়া থেকে নিজেদের বিরত করেছেন।

এখন প্রায়ই মনে হয়— ইতালির লেখকদের সম্পর্কে জানাশোনাটা আমার জন্য বিশাল কিছু হয়েছে, আমার অনেক অদেখা অজানা জানালা, দরোজা খুলে গেছে। এই তো, মাত্রই আমি আমার উপন্যাসের অনুবাদ শেষ করেছি, ইতালিও থেকে ইংরেজিতে; কাজটি করতে গিয়ে আমার অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে— লেখার ফর্ম বিষয়ে। এ-অভিজ্ঞতার ফলে, শব্দ এবং সাহিত্য এবং ভাষা এবং আরও অনেককিছু সম্পর্কে আমার সচেতনতাও আরও গভীর হয়েছে। ব্যাপারটি আমাকে বহুদিন ধরে উত্তেজিত করে রেখেছে, এমন অভিজ্ঞতার পেছনে আছেন পাভেসের মতো মহান কিছু লেখক যারা আমার পথের আলোটুকু জ্বালিয়ে রেখেছেন।

 

টেলর: আজ আমরা তোমার অনেক কথাই শুনলাম, এখন তোমার পরবর্তী পরিকল্পলা নিয়ে কিছু বলো।

ঝুম্পা: হ্যাঁ, আমার নতুন কাজ…নতুন পরিকল্পনা…এখন অবশ্য দুটো কাজ করছি, একটু একটু করে; ইতালিয়ানো থেকে ‘লাচি’ উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেছি ‘টাইস’ (গিঁট) নামে; লাচি দমিনিক স্তেরনোনের উপন্যাস, যার সঙ্গে আমার বেশ গভীর বন্ধুত্ব, যাকে আমি ইতালির জীবিত এবং সচল লেখকদের মধ্যে সেরা মনে করি। এ অনুবাদের কাজটি এখন শেষ পর্যায়ে, আশা করি মার্চে শেষ হবে। এ-উপন্যাসটি, আমার মতে, পাঠককে বিস্ময়াভিভূত করবে। দু’বছর আগে, প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বইটি পড়েছিলাম। এর অনুবাদের সুযোগ পাওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ, সত্যিকার অর্থেই আবেগাপ্লুত, চরম উত্তেজিত। আর, দ্বিতীয় যে কাজটি আমি করছি— বেশ সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে, এবং নৈঃশব্দ্যে, গল্প লিখছি— ইতালিয়ানোয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৯ সালের ১ ডিসেম্বর, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে। লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ গল্প দিয়ে,, বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। এ পর্যন্ত প্রকাশিত দুটি বই : ‘পাতালভূমি ও অন্যান্য গল্প’ (চৈতন্য, সিলেট, ২০১৪); ‘নৈঃশব্দ্যের সংলাপ : বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার’ (অনুবাদ, গুরুচণ্ডালী, কলকাতা, ২০১৯),  বইটির বাংলাদেশ সংস্করণ বেরিয়েছে ঢাকার জলধি থেকে ২০২১-এ। বর্তমান নিবাস ফ্রান্সের প্যারিসের বুলভার ম্যাক্সিম গোর্কি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।