১.
আনুমানিক প্রায় ৩৭৫ বিসি-তে রচিত প্লাতোর ‘রিপাবলিক’-এর কথা মনে পড়ে। সেখানে Book-X-এ প্লাতো (তথা সক্রাতেস) আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনায় কবিদের নির্বাসন দিচ্ছেন সত্য থেকে বিচ্যুতির কারণে। কবিরা যা লেখেন তা সত্য নয়, বরং নকলের নকল— ‘appearances’, যা সত্যের অস্পষ্ট বা বিকৃত রূপ (indistinct expression of truth)। কথাগুলি বলেছিলেন অবশ্য পেলেপোনেশিয়ান যুদ্ধের (৪৩১-৪০৪ BC) প্রেক্ষিতে, যখন আথেনস তাদের সামরিক শক্তি হারিয়ে স্পার্টার কাছে পরাস্ত হয়েছিল। বহুকাল অতিক্রান্ত হয়েছে তারপর। তবুও কবিদের নির্বাসনের প্রসঙ্গটি থেকে গেছে, তাঁদের স্রষ্টা এবং দ্রষ্টা ভূমিকার পাশাপাশি। যদিও নির্বাসনের প্রসঙ্গটি বাঁচিয়ে রেখেছে প্লাতো বা সক্রাতেসের মতো কোনো জ্ঞানী দার্শনিক নয়, বরং ক্ষমতাসীন কিছু অন্ধ, শুভচিন্তায় দীন কিছু মানুষ। ঠিক তারই বিপ্রতীপে শঙ্খ ঘোষ তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় বলছেন—‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার’। কবি যখন লিখতে শুরু করলেন তার আগেই ঘটে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ (পঞ্চাশের মন্বন্তর), ৪৬-এর দাঙ্গা এবং অবশ্যই ভারতের স্বাধীনতা ও দেশভাগ। তারপর ঘটতেই থেকেছে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং সাধারণ মানুষের নিপীড়ন। এই ক্লিশিত সময়ের মাটি থেকেই উদ্ভূত হচ্ছে শঙ্খ ঘোষের সত্য বলা। সত্য বলাই তাঁর অস্তিত্বের পাশুপত। কীভাবে বলা? কবিতার নিবিড় গহন গভীর নৈঃশব্দ্যের ভাষায়। শব্দ সেলাই করে করেই পৌঁছতে হয় সেই নৈঃশব্দ্যে, যেখানে এসে মিলিয়ে যায় অস্তিত্বের বিবিধ স্বর। তাই কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার ভাষায় ফুটে উঠেছে গভীর চিন্তার ছাপ, ধ্যানমগ্ন খোঁজ এবং তাঁর উপলব্ধ সত্যের বিবিধ রূপ। কখনো তা বিদ্ধ মানবতার বেদনা, কষ্ট ও যন্ত্রণার; কখনো-বা ক্ষমতাসীন শাসকের প্রতি বিদ্রূপের, শ্লেষের। কখনও আবার তাঁর ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে এক আত্মিক সত্যানুসন্ধান; কখনো-বা সমগ্র অস্তিত্বের জন্য হৃদস্পন্দন, শুভবুদ্ধির প্রতি লড়াইয়ে বেঁচে থাকবার আহ্বান। আমরা এখন এই বিবিধ রূপগুলিকে তাঁরই কবিতার আলোয় দেখার চেষ্টা করব।
কবিও কল্পনা করেন আদর্শ রাষ্ট্রের তথা পৃথিবীর। কিন্তু ক্রূর রাষ্ট্রনায়ক ও ভীরু মানুষের রচিত বাস্তবতা তার থেকে বহু যোজন বিচ্যুত, মিথ্যা ও হিংসা দিয়ে গড়া। কল্পিত জগৎ এবং মিথ্যা ও হিংস্র পৃথিবী— এই দুইয়ের নিরন্তর সংঘর্ষ কবির মনে জন্ম দেয় অক্ষম ক্রোধ, যার উল্টোপিঠে লুকোনো থাকে অস্ফুট কান্না। কবি বিভক্ত হয়ে যান বিভিন্ন অস্তিত্বের খণ্ডে। শুরু হয় কথপোকথন। সেই কথপোকথনের বিরাট অংশ জুড়ে থাকে আত্মধিক্কার। অজস্র মৃত্যুর মাঝে আপন মৃত্যু চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না তাঁর। কবি লিখছেন, “‘দি ব্রাদার্স কারামাজফ’-এ ডসটয়েভ্স্কি যেমন লিখেছিলেন যে মানুষ তার সম্পূর্ণ আত্মজ্ঞান তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতার চেয়ে বরং নির্বাচন করে নেবে স্বস্তি, মৃত্যু।”—( কবিতার আমি, শব্দ আর সত্য )।
আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা
লজ্জা লুকাই কাঁচা মাটির তলে—
গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার
সবটুকুতে শস্য যেন ফলে।
কবর ।। দিনগুলি রাতগুলি
এমনকি মৃত্যুর পরেও কবি রক্তমাংসের শরীরে শস্য ফলাতে চাইছেন। ফলাতে চাইছেন কবিতার সত্য। এই ‘কবর’ কবিতার শেষে তিনি বলছেন—
‘মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে অস্ত্র গোড়ো,
আমায় কোরো ক্ষমা।’
দধীচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কবি তাঁর হাড়েমজ্জায় সঞ্চিত সম্পদ দিয়ে বজ্র গড়তে চাইছেন প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য। সেই বজ্রটির নামই সত্য। ১৭ বছর বয়সে লেখা ‘কবর” কবিতাটির প্রতিধ্বনি উঠে আসছে ৮১ বছর বয়সে লেখা ‘বহুস্বর স্তব্ধ পড়ে আছে’ কাব্যগ্রন্থের ‘ধান’ কবিতার শেষ পঙক্তিতে— ‘আমার মাটির ওপর তুমিই তো হয়ে উঠছ চিরকালীন ধান’। অর্থাৎ সারাজীবন এই সত্যকেই তিনি মনেপ্রাণে বহন করেছেন।
এই মৃত্যুচেতনায় ডুবে গিয়ে কবির মনে পড়ছে আর এক মৃত্যুচেনা কবিকে- কবি জন কিটসকে( John Keats)। মনে পড়ছে কিটসের সমাধিলিপিটিকে: ‘এখানে ঘুমায় এক মানবহৃদয়, তার জলে লেখা নাম।’ (Here Lies One, Whose Name Was Writ in Water)। কিন্তু কবি যখন বলছেন— ‘কবি তুমি যোয়ো না যেয়ো না’- তখন বেদনার গাঢ় রসে কিটসই হয়ে উঠছেন কি কবি শঙ্খের অল্টার ইগো? তিনি যেন নিজেই নিজের মৃত্যুকে রোধ করতে চাইছেন। বলছেন নিজেকেই- ‘কবি রে তোর শূন্য হাতে/ আকাশ হবে পূর্ণ’। তখন জীবনমৃত্যুর এক অমোঘ টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। যে কোনো প্রকৃত কবি প্রতি কবিতাতেই একবার মৃত্যুবরণ করেন। প্রতি কবিতার শেষে মনে হয় জীবনীশক্তি বুঝি নিঃশেষ হয়ে এল, দেহ-মন বুঝি শিথিল হয়ে এল, অর্গাজমের মতো, যা আসলে মৃত্যুরই নামান্তর বলে মনে হয়। আবার মৃত্যুর গর্ভ থেকেই কবি আরও একবার নবজন্ম লাভ করেন সেই কবিতাতেই। কবি সেই মৃত্যুকে আহ্বান করেন, কবিতায় নবজন্ম লাভের জন্যই। সৃজনের এই শাশ্বত আবর্তনটি বাস্তবের অস্তিত্ব সংগ্রামেও প্রতিবিম্বিত হয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষের ও আদর্শ রাষ্ট্র-কল্পনার লাশের নির্মম বাস্তবতায় কবি অসহায় বোধ করেন এবং আত্মধিক্কারে মৃত্যু চেয়ে ফেলেন। আবার বেঁচে থাকার আদিম আহ্বানে সাড়া দিয়ে খুঁজতে চান একটুখানি জীবনের ছায়া। জীবন-মৃত্যুর এই চিরায়ত চক্র এবং টানাপোড়েন কবি শঙ্খ তাঁর কবিতায় অদ্যাবধি বহন করে চলেছেন। একদিকে তাঁর ‘বন্ধমোহ গতশ্বাস আলুথালু বাঁচা’কে তিনি চাইছেন না ‘অবিশ্রাম ক্লীবত্বের জ্বালাময় দৈন্যে পুঞ্জ’ করতে; অন্যদিকে বলছেন: ‘ কবি রে, আজ প্রেমের মালায় / ঢেকে নে তোর দৈন্য!’। একদিকে তিনি ‘সুনিবিড় তমস্বিনী ঘনভার রাত্রি’ কে বলছেন তাকে আঘাত করতে, অন্যদিকে সেই আপন তমস্বিনীর গর্ভে যন্ত্রণাকে রেখে বলছেন: ‘বহো রে আলোর মালা গগনে দাও ছড়িয়ে’। জাগ্রত হচ্ছে বোধি- ‘কবিতা সূর্যলতা হৃদয়ে চক্ষে জ্বলে’। ‘দিনগুলি রাতগুলি’ শীর্ষক কবিতায় কখনো অক্ষরবৃত্তে কখনো মাত্রাবৃত্তে কখনো আবার পঙক্তির বিচিত্র বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে কবি ফুটিয়ে তোলেন অস্তিত্বের বিবিধ ‘আমি’কে। এবং তাদেরই সমগ্রে ‘জেগে ওঠে ধীরে ধীরে একখানি তপ্তহত পরিপূর্ণ মুখ’। কবিতার, চঞ্চল কল্পলতার, আপন যন্ত্রণাবাঁধা অন্ধকারে যখনই জাগ্রত হয় এই পরিপূর্ণতার বোধ, তখনই ‘রাত্রির কলস ভেঙে প্রভাত গড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে।’
এই জীবন-মৃত্যুর প্রকাশে কোথাও রোমান্টিকতা চোখে পড়ছে না সেভাবে। চোখে পড়ছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, যা ভীষণরকম অ্যান্টিরোমান্টিক। তাঁর কবিতার ভাষা একদিকে যেমন ব্যঙ্গ বিদ্রুপ আর শ্লেষে কীর্ণ—
‘এত কিসের গর্জে আকাশ
চিন্তা ভাবনা শরীরপাত?
বেঁচে থাকলেই বাঁচা সহজ,
মরলে মৃত্যু সুনির্ঘাত!’—
ব’লে একটু চোখ মটকে,
তাকান মত্ত মহাশয়-
‘ঈষৎ মাত্র গিলে নিলে
যা সওয়াবেন তাহাই সয়।’
পাগল ।। নিহিত পাতালছায়া
অথবা
‘…মত কাকে বলে, শোনো। মত তা-ই যা আমার মত।
সেও যদি সায় দেয় সেই মতে তবে সে মহৎ,
জ্ঞানীও সে, এমনকী আপনলোক, প্রিয়।…’
মত ।। লাইনেই ছিলাম বাবা
অন্যদিকে তেমনি প্রতিবাদে ভীষণ। যখনই নেমে এসেছে শাসকের দানবীয় অনাচার, গর্জে উঠেছেন তিনি। তবে সে গর্জন কখনোই কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি পক্ষপাতমূলক আনুগত্য নির্ভর করে নয় বরং এক মানবিক দায়বদ্ধতা থেকে। তিনি তাঁর সময়ের নিপীড়িত মানুষের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন বলেই ব্যথিত হয়েছেন, ক্রুদ্ধ হয়েছেন, এমনকি পথেও নেমেছেন। তবুও কলমকেই বেছে নিয়েছেন সময়ের হাতিয়ার হিসেবে। এবং যথার্থ কবির মতোই ভাবনায় মিশিয়ে দিয়েছেন ইতিহাসচেতনা ও মিথের নির্যাস। এখানেই তিনি তাঁর পূর্বজ ও সমসাময়িক কবিদের থেকে আলাদা এবং স্বতন্ত্র। এভাবেই তিনি অতিক্রম করেছেন সমসময়ের বেড়াজাল এবং ঢুকে পড়েছেন প্রবহমান বিশ্বলোকে, অনন্ত মহাসময়ের ভিতর। সেই ১৯৭০-এ তিনি কোনো এক ‘বিকেলবেলা’র স্বপ্নে দেখেছিলেন— ‘… কাগজের তৈরি আমার ভাইয়ের মুখ ঝুলে পড়ে কার্নিশ থেকে বাইরের হাওয়ায় আর দেখতে দেখতে অবেলার ঘুম ভেঙে যায়…’( বিকেলবেলা, আদিম লতাগুল্মময়)। ২০১৬ সালে এসেও তাঁকে লিখতে হচ্ছে—
‘ রেখা বলতে মনে পড়ল ঝুলে-থাকা লম্বমান উপোসি শরীর।
একটা-দুটো-তিনটে নয়,সারি সারি, স্বপ্নের ভিতরে—
কিছু তার বাস্তবেরও ঘরে।’
নিরুত্তর চিঠি ।। এও এক ব্যথা-উপশম
দুঃস্বপ্নের বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু পাননি তিন এই ছেচল্লিশ বছরে। ১৯৭২-৭৩-এ কবি লিখেছিলেন এই মিথ হয়ে যাওয়া লাইনগুলি—
‘তার মাঝখানে পথে পড়ে আছে ও কি কৃষ্ণচূড়া?
নিচু হয়ে বসে হাতে তুলে নিই
তোমার ছিন্ন শির, তিমির।’
তিমির বিষয়ে দু-টুকরো ।। মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়
আর ২০১৬-১৭-তে এসে লিখলেন—
‘পথে পথে এখানে-ওখানে শুধু রঙের ফোয়ারা উঠছে তোড়ে
মানুষের মাংসপিণ্ড থিকথিক জমে আছে মানুষেরই শবের উপরে।
ফোয়ারা ।। এও এক ব্যথা-উপশম
২০০১-০২ নাগাদ ‘ জলই পাষাণ হয়ে আছে’ কাব্যগ্রন্থের ‘জাতক’ শীর্ষক কবিতায় তিনি তুলে এনেছিলেন দ্বাদশ শতকের শেষ লগ্নে তুর্কিদের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস, গ্রন্থাগার পোড়ানো ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হত্যার ইতিহাস। ওই একই কবিতায় তুলেছেন ১৯৩৬-এ জার্মান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতৃত্বে নাৎসিদের পুস্তক পোড়ানোর ইতিহাসও। ২০১৬-১৭-তে এসেও তাঁকে লিখতে হচ্ছে—
‘… কোনোখানে কালবুর্গি,
কোথাও-বা গৌরী লঙ্কেশের
খরা জরা জলস্রোতে রক্তস্রোতে ভেসে যায়
স্বপ্ন যত ভবিষ্য দেশের।’
তিসরা ঝাঁকি ।। এও এক ব্যথা-উপশম
তাঁর কবিজীবনের কমবেশি সত্তর বছরের জীবনে এই সব মৃত্যুর, চিতার, শবের, শববাহকের, রক্তস্রোতের, বিষের, আত্মহত্যার প্রতিমা ব্যবহার করে করে তিনি ক্লান্ত। তবুও এর প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয় না। ঘুরেফিরে আসে দান্তের ইনফার্নোর ভয়াবহতা। দান্তে-ভার্জিল অথবা Prufrock-এর দ্বিধাবিভক্ত সত্তার মতো কবিও হেঁটেছেন ইনফার্নোর অন্ধকারে। সে অন্ধকারেই কুচবিহারের মেয়ে ( যমুনাবতী) আজ এতদিন পরে সবরমতীর মেয়ে হয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘একলা চলো’ গানকে ব্যর্থ করে দিয়ে বেছে নেয়, নিতে বাধ্য হয়, আত্মহননের পথ। কবি বলেন— ‘তবু লিখে যাই / (কারণ) এও এক ব্যথা-উপশম’। আর তিনি লেখেন বলেই আমরা পাই সত্য থেকে সংঘে যাবার সংকল্প। যে সংকল্পের সন্ধান তিনি রেখেছেন তাঁর কবিতার বক্ষে, তা আজও, এই ঘন অন্ধকারেও, অনেক তরুণ তরুণীর স্পর্ধাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় জোগায়:
…কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি ।। জলই পাষাণ হয়ে আছে
২.
এই প্রতিবাদ প্রতিরোধের বাইরে কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতার অন্তরে নিহিত আছে একজন একা মানুষের সত্যানুসন্ধান। এক আত্মিক খোঁজ, ‘আত্মানং বিদ্ধি’। শঙ্খের কবিতার ‘আমি’ ‘তুমি’ গুলিকে যদি নিবিড়ভাবে লক্ষ করা যায় তবে তাঁর সত্তার এই ভিন্ন অথচ সংযুক্ত দুই রূপ অনুধাবন করা যাবে। একদিকে তাঁর নির্বিশেষ ব্যক্তিগত আমি অভিজ্ঞতার সংঘর্ষে শতধাবিভক্ত হয়ে, মানুষের যন্ত্রণার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বহুস্বরিক আর্তনাদের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলছেন তাদের জীবন। ফুটিয়ে তুলছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে, অনেকটা এলিয়েটের নৈরাত্ম্য রীতির অনুসারী হয়ে। এই ‘আত্মনাট্য’ই— যাতে ফুটে ওঠে কবির এক নির্মীয়মান ব্যক্তিত্ব— আমরা এতক্ষণ দেখলাম। অন্যদিকে আছে তাঁর বিশেষ আত্মগত আমি, যা ওই ব্যক্তি আমির টুকরোগুলির সমগ্র। কিন্তু শুধুই সমগ্র হয়ে থেমে নেই। এই আত্মগত আমির ভিতর দিয়ে কবি খুঁজে বেড়াচ্ছেন আপন অস্তিত্বের অর্থ। অর্থাৎ এই অন্তর্গত আমি’রও আছে আরও গূঢ় কোনো খোঁজ, আরও কেন্দ্র বা উৎসের দিকে যাবার ইচ্ছে। তাই বলা যায় এই আত্মগত আমিও পরিবর্তনশীল, ক্রমজায়মান এক অস্তিত্ব, যা আসলে আরও পূর্ণতর ‘বড়ো আমি’তে মিশে যেতে চাইছে। এই আত্মিক খোঁজটিকেই আমরা এখন একটু বুঝে নিতে চেষ্টা করব।
কবি তাঁর কবিতার ভাষায় খুব সচেতনভাবেই ব্যাক্তি আমিকে যেমন ব্যক্ত করেছেন মানুষের খণ্ড ভ্রষ্ট অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে; তেমনি এই আত্মিক খোঁজটিকেও প্রকাশ করেছেন সুচারু অন্তরালে, একা হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
‘…যেসব শামুক তোমরা রেখে গিয়েছিলে
তার মধ্যে গাঢ় শঙ্খ কোথাও ছিল না
তোমরা এসেছ, তোমাদের বলি
গ্রহে-গ্রহে টানা আছে সময় বিহীন স্তব্ধ জাল
আমি চাই আরো কিছু নিজস্বতা অজ্ঞাত সময়।’
সময় ।। নিহিত পাতালছায়া
এই ‘গাঢ় শঙ্খ’টিই আসলে গূঢ় শঙ্খ, আত্মগত আমি। গ্রহে গ্রহে টানা সময়বিহীন স্তব্ধ জাল আসলে মহাসময় বা মহাশূন্য বা পরম জগৎ। তার মাঝে কবি আপন অস্তিত্বরঙ্গের সময়টুকু বুঝে নিতে চাইছেন, যা তাঁর কাছে এখনও অজ্ঞাত। অজ্ঞাত বলেই তার ভিতর জাগ্রত হচ্ছে জিজ্ঞাসা। আত্মজিজ্ঞাসার ফলশ্রুতি হিসেবে উঠে আসে যে চৈতন্য সেই তার অন্তরের শঙ্খ। সেই তার আত্মানুসন্ধানের কবিতা। চিরপ্রবাহী ভাষার মাঝে তাঁর, গূঢ় শঙ্খ থেকে নির্গত, পবিত্র কবিতাভাষার প্রথম আবির্ভাব।
‘… অন্তহীন এই নাস্তি যখন হা হা করে এগিয়ে আসে চোখের উপর, দুলে ওঠে রক্ত- তখন তুমি কথা বলো মহাশূন্যে অন্ধকারের ফুটে ওঠার মতন, সেই তোমার ভাষা হোক প্রথম আবির্ভাবের মতো শুচি, কুমারী-শষ্পের মতো গহন, গম্ভীর…’।
ভাষা ।। নিহিত পাতালছায়া
এখানে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে যে পরম অস্তিত্বের ছায়ায় নিজের অস্তিত্ব নির্ণয়ের অন্তহীন প্রচেষ্টার পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলছে কবির আরেকটি অস্তিত্বের বোধ। সেটি হল তাঁর ভাষাগত অস্তিত্ব। আবহমান বাংলা ভাষার স্রোতে নিজস্ব অস্তিত্বের বোধ, পবিত্র ধারা। এই চৈতন্য রবীন্দ্রনাথের ‘প্রথম দিনের সূর্য’ কবিতার ‘সত্তার প্রথম আবির্ভাবে’র মতোই শুচি। বাংলা ভাষার যা কিছু ‘ব্যবহৃত, জীর্ণ, উচ্ছিষ্ট’ তাকে বিসর্জন দিয়ে তিনি সৃজন করছেন নিজস্বতা। নিজস্ব ভাষার কবিতা। এই আত্মজিজ্ঞাসা এবং আবিষ্কারের শেষ নেই। আছে পরিবর্তন। তাই তাঁর ভাষাও আত্মগত ‘আমি’টির মতো ক্রমজায়মান। জন্ম-মৃত্যুর চিরন্তন চক্রকে কবি শুধু ভাষার নিরিখে নয়, মানবজীবনের অস্তিত্বের নিরিখেও উপলব্ধি করেছেন বারবার। তবুও, জীবনের বার্ধক্য পর্বে এসেও, এই অস্তিত্বরঙ্গের জন্যই তিনি অনুভব করেন গভীর এক মায়া, যা তাঁর কাছেও রহস্যঘন—
‘ মাটি তার বুক পেতে সবই নেবে বলে স্থির হয়ে আছে
ভাঙা পাঁচিলের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে
সমস্তই দেখি
অথচ তোমার জন্য মায়া আজও জটিলতাময়।’
মায়া ।। এও এক ব্যথা-উপশম
কার প্রতি এই মায়া? জীবনের প্রতি? অস্তিত্বের প্রতি? ‘তবে কি অস্তিত্ব বড়ো অস্তিত্বের বেদনার চেয়ে’? জীবনের সমস্ত ঘাত প্রতিঘাত, অপমান, হীনতা, পরাভবের স্রোতের ভিতর দিয়ে কবি চলেছেন, তিনি শুনতে পাচ্ছেন ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে’। চলতে চলতে কবি অনুভব করছেন—
‘আমি আছি, এই শুধু। আমার কি কথা ছিল কোনো?
যতদূর ফিরে চাই আদি থেকে উপান্ত অবধি
কথা নয়, বাঁচা দিয়ে সমূহ প্রবাহ পাব ব’লে
এই দুই অন্ধ চোখ ভিজিয়ে নিয়েছি অন্ধকারে।’
পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ ।। ১৩ সংখ্যক চতুষ্ক
তখন বুঝতে পারি এক পরম অস্তিত্বের বোধি কবির শূন্য অন্ধকারকে পূর্ণ করে ফেলেছে। কবি বোধহয় খুঁজে পেয়েছেন আরও বড় কোনো আমির সন্ধান- ‘আমার কোনো অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে’। জাগতিক সমস্ত ভাঙাগড়া, জীবন-মরণের ঊর্ধ্বে তিনি খুঁজে পান এক তরঙ্গময় জীবন স্রোত, এক পরম অস্তিত্বরঙ্গ—
‘এ যদি হয় সত্তা তবে অস্তিত্বের মানে
থাকা, কেবল থাকা, তুমি বিশ্বগোচর থেকো’।
সত্তা ।। নিহিত পাতালছায়া
এই আত্ম-আবিষ্কার, পরম অস্তিত্বের ভিতর আপন অস্তির বোধি— ‘আছি আমি আছি’— এবং আবহমান বাংলা ভাষায় নিজস্ব কবিতাভাষার অস্তিত্বের বোধ আমাদের কাছে সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়। সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু’র পরিবর্তমান চক্র পেরিয়ে, এক কবিতা থেকে আর এক কবিতায়, এক আমি থেকে আর আমিতে পৌছনোর অন্ধকারে ধ্রুবতারার মতো জ্বলে থাকে শুধু এই ‘থাকা’। বাঁচা। জীবন। সত্য।
আমার দুঃখের দিন তথাগত
আমার সুখের দিন ভাসমান!
এমন বৃষ্টির দিন পথে-পথে
আমার মৃত্যুর দিন মনে পড়ে।
আবার সুখের মাঠ জলভরা
আবার দুঃখের ধান ভরে যায়!
এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে
আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।
বৃষ্টি ।। নিহিত পাতালছায়া
কবি। বাড়ি বর্ধমান শহরে। পেশায় ইংরেজির শিক্ষক। কাব্যগ্রন্থ দুটি। প্রথমটি ‘বর্ণসেপাই’; প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে আর দ্বিতীয়টি ‘শেকড়ের দেশ’; প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখা প্রকাশিত হয়।