মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

শববাহকের ছেলেবেলা : দ্বিতীয় পর্ব

0

Rana Roychowdhury_Pro Picদূরের পাটীগণিত, কাছের তানপুরা
রাণা রায়চৌধুরী


০১.
এঁচোড়ে পাকা আমি কোনোদিনই ছিলাম না। কিন্তু এঁচোড়ে পাকাদের প্রতি আমার খুব কৌতূহল ছিল অল্পবয়সে।

সেই এঁচোড়কে জব্দ করে রান্না করলাম আজ। নিরামিষ। কোমরে বেল্ট পরে, টকদই টমেটো গরমমশলা আদাবাটা গোলমরিচ ইত্যাদি।

রান্না একটা অভ্যাস। অনভ্যাসে নুনের মাপ কম হয়েছে। গরম মশলা সামান্য বেশি হয়েছে। মনটা খুঁতখুঁত করছিল। (মানে লেখাটা দাঁড়াল না)

এঁচোড়ে পাকা বন্ধুদের আমি মনে মনে ভয়ও পেতাম। সিনিয়রদের সামনে ফস করে সিগারেট ধরানো সেই পাকামির একটা লক্ষণ ছিল। পান-বিড়ির দোকানে দড়ি ঝুলছে, দড়ির মুখে আগ্নেয়গিরি, দোকানদার বাবার বয়সী, বাবাকে চেনেও, ঠিক তার দোকানের দড়ি থেকেই ভার্জিনিয়া (উলফ নয়) বা প্লেন চারমিনার ধরানো চাই। কী সাহস!

আমি এই সাহসকে, ভয় পেতাম, ঘৃণাও করতাম, আবার এই সাহসকে মনে মনে ডেস্পারেট স্ট্রাইকারের সম্মানও দিতাম। আসলে কোনটা ঠিক বুঝতে বুঝতে কংগ্রেস আমল গিয়ে বামফ্রন্ট এসে পড়েছিল আমাদের জীবনে।

এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চনও কানচাপা চুলে। সেলুনের চুল কাটার কারিগর, কারোর কান না কেটেই অদ্ভুত দক্ষতায়, কোথাও একমাত্রা কম-বেশি নেই, কী দারুণ সব কানচাপা চুলের বাঙালি হিরো তারা বের করতেন সেলুন থেকে।

এসেছিলেন অমিতাভ বচ্চনও কানচাপা চুলে। সেলুনের চুল কাটার কারিগর, কারোর কান না কেটেই অদ্ভুত দক্ষতায়, কোথাও একমাত্রা কম-বেশি নেই, কী দারুণ সব কানচাপা চুলের বাঙালি হিরো তারা বের করতেন সেলুন থেকে।

আজ এঁচোড়কে জব্দ করতে গিয়ে মনে পড়ল সেইসব কথা

 

০২.
বৃষ্টি আসছে। বৃষ্টি আসত আমাদের ছোটোবেলায়, সে এক দেব অথবা দেবী অথবা আনন্দময়ীর আগমন।

রাজীবপুরে গ্রামের বাড়িতে বসে দেখতাম দূর ধানখেত ধরে তেরচা হয়ে সে আসছে, এখনো আমাদের উঠোনে আসেনি। এখনো তরুলিয়া গ্রাম ছাড়ায়নি, এইবার ছাড়াল, কালীভূষণ হিন্দু হোস্টেল পার হলো, যেন ইছাপুর স্টেশন ছাড়ল, পরবর্তী স্টেশন পলতা। আগলা স্টেশন পলতা, নেক্সট স্টেশন ইজ পলতা।

বৃষ্টির শব্দটা ভিতরে তবলার মতো বাজত। গ্রামে গিটার ছিল না, বব ডিলান ছিল না, ছিল রেডিওর মানবেন্দ্র শ্যামল হেমন্ত, ফলে বৃষ্টির শব্দ ‘রানার ছুটেছে ওই ঝুমঝুম’ এইরকম বাজত, একটা গোপন আনন্দ।

এই এসে গেল। একদম ঝেঁপে। উঠোন ভিজে যাচ্ছে। এও এক অল্পবয়সী যৌনতা। (আমি যতোবার যৌনতা টাইপ করি হয়ে যায় মৌন। টাইপো। অক্ষর মনে করিয়ে দেয় অবসরের সময় আগত, ঊনষাট)। যাই হোক, মাটির উঠোন ভিজে যাচ্ছে, বৃষ্টি যেন প্রেমিক তার, আবেগঘন দৃশ্য, উঠোন চূড়ান্ত মুহূর্তে কাদাকাদা। আমি অবোধ বালক, ক্লাস সেভেন কি এইট কি নাইন কি ক্লাস টেন… বৃষ্টির শব্দটা ভিতরে তবলার মতো বাজত। গ্রামে গিটার ছিল না, বব ডিলান ছিল না, ছিল রেডিওর মানবেন্দ্র শ্যামল হেমন্ত, ফলে বৃষ্টির শব্দ ‘রানার ছুটেছে ওই ঝুমঝুম’ এইরকম বাজত, একটা গোপন আনন্দ। যা মনে মনে ভাবছিলাম বা কায়মনোবাক্যে ডাকছিলাম, ঠিক তাই কারেন্ট চলে গেল, আর পড়তে হবে না, হ্যারিকেনে আর কতদ্দুর হবে, হারিকেনে বাংলাটা হবে শুধু, বড়োজোর বীজগণিত… এমন বৃষ্টি যে পড়তেই বসতে হলো না, ধানখেত ধূসর, আকাশ মেঘে আঁকা বিদ্যুৎ চমকে আঁকা এক অজানা আত্মীয়।

তারপর সন্ধে। ব্যাঙের ডাক। শিয়ালের ডাক। কাছেই চন্দ্রবোড়া তার মায়ের সঙ্গে জলজ ঝোপে খাবার-সন্ধানে বেরিয়েছে। গা ছমছম।

আরও রাতে আমি জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি, আকাশ ধানখেত নারকেল সারি কেমন যেন ভূতভূত সেজে ভয় দেখাচ্ছে।

বালকের ভয়, তার মধ্যে সরলতা ছিল, সহজ ভয় বৃষ্টি হয়ে এসেছিল, আরও সহজতার দিকে যাবে বলে।

 

০৩.
জীবনের প্রতি মুহূর্ত যে আনন্দ ‌হয়ে এসেছে তা নয়, তাকে স্যানিটাইজ করে আনন্দস্বরূপ করে নিয়েছি।

সবসময় আমি আমার সামনের একটি অদৃশ্য তারে ‘দুঃখ আমার নাই’-কে টাঙিয়ে রাখি।

স্ক্রল করে করে নিচে নামি। হঠাৎ কোনো লেখাকে বন্ধু মনে হয়। এইভাবে জীবনের দিনগুলোকেও স্ক্রল করে নিচে নামছি। হঠাৎ আমবাগান বিরাট জলাশয় বা উপাসনা-ঘর বা শেষকৃত্যের স্থান দেখতে দেখতে যাই, ক্লান্তি এলে ক্লান্তির সঙ্গে সহবাস করি। এইভাবে একদিন এক দাঁড়কাককে দেখি আমার বুকসেল্ফে জেগে আছে সে, আমি হঠাৎ জাপিজ পয়েন্ট ফাইভ-এ ভর করে ডানা পাই দাঁড়কাকের স্নিগ্ধতার।

জীবনের শেষ প্রান্ত, জীবনের উপান্ত, জীবনের মধ্যভাগ, জীবনের শুরুর দিক— এইসব বাংলা শব্দবন্ধ দেখি স্যুইমিং কোচের কাছে সাঁতার শিখছে।

অহংকার এক অসহায় অবস্থার নাম। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি আলমারির লকারে বাবার ডেথ-সার্টিফিকেট খুব যত্নে রেখেছি। এখনো মৃত্যুর শংসাপত্র চকচক করছে। নিশ্চয় কাজে লাগবে একদিন। দাঁড়কাকের তৃষ্ণা আমাকে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

অহংকার এক অসহায় অবস্থার নাম। এইসব ভাবতে ভাবতে দেখি আলমারির লকারে বাবার ডেথ-সার্টিফিকেট খুব যত্নে রেখেছি। এখনো মৃত্যুর শংসাপত্র চকচক করছে। নিশ্চয় কাজে লাগবে একদিন। দাঁড়কাকের তৃষ্ণা আমাকে আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে সাহায্য করে।

নিষ্কাম কর্ম। লোকমান্য হওয়ার লোভ— কী সব ভারি ভারি কথা! আমার মাথা নিচু করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে— এইসব একটা নশ্বর টিকটিকির কাছে গচ্ছিত রেখে আমি কিছুদিনের জন্য বেড়িয়ে পড়ি যেখানে অরুন্ধতী নক্ষত্রের কুটির, সেই সেইখানে…

সেখানে এক পুকুরের ধারে দেখি একটা একত্রিশ ডিগ্রির সবুজ সেলসিয়াস গাছ বেশ তরতরিয়ে উঠছে।

 

০৪.
এই ঘর, এই বিছানাই আমার পুরুলিয়া বনগাঁ বাঁকুড়া বর্ধমান চন্দননগর সোনারপুর, এই ঘরই আমার ভ্রমণপিপাসু মন।

মন কল্পনায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। যেমন আমাদের দেয়ালের টিকটিকিটার— আমাদের বাড়িটাই ওর ‘বাঁকুড়া পুরুলিয়া কলকাতা’, এই বাড়ির মধ্যেই সে ‘আপেল শহরের সম্রাট’-কে খুঁজে বেড়ায়, এখানেই তার ‘অশ্রুতরবার’ পড়ে আছে, এখানেই তার ‘অঙ্কে যতো শূন্য পেলে’ ভাইবোন খেলা করে দেয়ালে দেয়ালে।

এখানেই তার ‘মায়াকানন’। এখানেই তার জন্য অপেক্ষা করে পৃথিবীর সব ‘উদাসীন পাঠকের ঘর’… আমি ‌মনে মনে তার সঙ্গে ‘নিঃশব্দে অতিক্রম করি’ এই প্রতিদিনের জীবন, এই ‘দেবদারু কলোনি’! ‌ আমাদের মনের দেয়ালে ‘হারুর মহাভারত’ চিত্রিত রয়েছে।

‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর আকাশের সব তারার নাম জানত। আমি আর টিকটিকি সব তারার নাম জানি না। আমরা এই সংসারের ভিতর ভ্রমণ করতে করতে, তারাদের নাম জানার চেষ্টা করি, আলমারি ফ্রিজ ইঁদুর মারার বিষাক্ত ম্যাট— এদের কাছে জানতে চাই তারা ও নক্ষত্রদের নাম।

‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর আকাশের সব তারার নাম জানত। আমি আর টিকটিকি সব তারার নাম জানি না। আমরা এই সংসারের ভিতর ভ্রমণ করতে করতে, তারাদের নাম জানার চেষ্টা করি, আলমারি ফ্রিজ ইঁদুর মারার বিষাক্ত ম্যাট— এদের কাছে জানতে চাই তারা ও নক্ষত্রদের নাম।

যাইনি কোনোদিন, কিন্তু কল্পনায় ভেবে নিই, আসলে মনে চলে আসে, কেমন হবে আমার না-দেখা বনগাঁ বা জলপাইগুড়ি! এইরকম সব মানসিক ভ্রমণের ‘খেলা চলে’ মনের ভিতর, ‘কথার সন্তান’ উহারা মনের ভিতর গুটিগুটি ভ্রমণে ব্যস্ত…

সামনাসামনি জলপাইগুড়ি বা নকশালবাড়ি-কে বা রাজাভাতখাওয়া-কে দেখার পর কল্পনার ঘোরটা কেটে যায়, তৈরি হয় নতুন এক চোখের ও মনের ঘোর। এইটাই মজার! সবচেয়ে মজার না-যাওয়া। কল্পনায় যা আছে থাক, মনে মনে ‘কার্নিভালের পাখিগুলি’ উড়ুক, মনে মনে ‘বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে’ চলুক এই নিত্যদিন, এই নিত্য-অনিত্যের আনন্দ ঘুরুক, ঘুরে মরুক নিজের ভিতর।

এইরকম আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে নিজের ভিতর একটা প্রদীপ জ্বলে ওঠে, সে প্রদীপ আমার জন্মদাত্রী চিরকালের মা… সেই মানসিক ‘দয়াময়ীর কথা’ ময়নাগুড়ি জলপাইগুড়ি বা আউসগ্রামে বা ঢাকায় আমাকে নিয়ে যায় প্রত্যহ, নিয়ে চলুক প্রত্যহ…

 

০৫.
দিনের প্রতিটা ক্ষণ ভালো করে দেখলে খুব সুন্দর।

রাত্রিকে আমার বেশি ভালো লাগে।

বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে, আমি জানলা দিয়ে দেখি, রাত দুটোর পাড়া, স্তব্ধতারও একটা শব্দ আছে, রাস্তায় গাছের পাতা চুঁইয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো একা পড়ে আছে। সেই আলো মাড়িয়ে গভীর রাতের অগভীর ‌নাইটগার্ড তার দুঃখ ভরা জীবনের বাঁশি বাজাতে বাজাতে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়, দেখে ভোর আসছে, মানে তার ছুটি, ছুটি মানে আনন্দ।

বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে, আমি জানলা দিয়ে দেখি, রাত দুটোর পাড়া, স্তব্ধতারও একটা শব্দ আছে, রাস্তায় গাছের পাতা চুঁইয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো একা পড়ে আছে। সেই আলো মাড়িয়ে গভীর রাতের অগভীর ‌নাইটগার্ড তার দুঃখ ভরা জীবনের বাঁশি বাজাতে বাজাতে হঠাৎ আকাশের দিকে তাকায়, দেখে ভোর আসছে, মানে তার ছুটি, ছুটি মানে আনন্দ।

বর্ধমানের গভীর রাত আর ব্যারাকপুরের গভীর রাতে তফাত আছে। মিলও আছে। পুরুলিয়ার আলোছায়াময় গভীর রাতের যে স্তব্ধতা তা কেমন আবেগমাখা‌ ভিজে ভিজে।

কিশোর বয়সে তারুণ্যে বিকেলকে আমার খুব ভালো লাগত। বিকেলের মধ্যে অনেক মনখারাপ শোক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও তাকে আমার ভালো লাগত এই জন্য, কারণ বিকেলবেলার ছাদে তরুদি আর তার স্নিগ্ধ মা পায়চারি করত, তরুদি ছিল সুন্দর, তরুদি ছিল মূক ও বধির, তরুদি চোখে কাজল পরত, বিকেল হলে তরুদির মা তরুদির জন্য অপূর্ব বেণী বাঁধত।

আর দুপুরবেলার সৌন্দর্যকে বুঝতে গেলে আমাদের মিন্টুর মতো সাহসী হতে হবে।

মিন্টু দুপুরবেলার নারকেল গাছে উঠতে উঠতে একবার প্রায় সূর্যকে ছুঁয়ে ফেলেছিল।

আমরা কম সাহসী নারকেল-লোভীর দল, নিচ থেকে তাকে উৎসাহ দিচ্ছিলাম…

দুপুরকে বুঝত মিন্টু। সারা দুপুর সে এ-বাগান ও-বাগানের ভূত-পেত্নীদের সঙ্গে কথা বলত। অনেক ভূত-পেত্নী-বম্মদত্যির সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় ছিল।

মিন্টু কথা দিয়েছিল, একটা নিরহংকারী বম্মদত্যির সঙ্গে… একটা জাঁদরেল ভূতের সঙ্গে আলাপ করাবে, বাড়ি নিয়ে যাবে তাদের।

কিন্তু ‘নিয়ে যাব নিয়ে যাব’ করে সে বিয়াল্লিশ হাজার দুপুর পার করেও নিয়ে যায়নি আমাদের।

মিন্টু পরে ‘দুপুর বিশেষজ্ঞের’ চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যায়। আমরা পড়ে থাকি এই বাংলার নিত্য-অনিত্য দুপুর রাত্রি সকাল ভোর আর অনেক বিষণ্ণ বিকেলের পারে, ধারে, তীরে…

 

০৬.
দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটু পলতা স্টেশনে গিয়ে হাঁটব, একটু লাল চা, জলজিড়ে দিয়ে সঙ্গে বেকারি বিস্কুট, একটু ইছাপুরের দিকের ঠান্ডা হাওয়া, একটু ছোটোবেলার ঠান্ডা ও নির্ভরযোগ্য নিরাপদ বাতাস এসে গায়ে লাগবে, মনটা ভালো হয়ে যাবে।

কত মাস পলতা স্টেশনে হাঁটিনি। যাইনি জীবাণু সংক্রমণের ভয়ে। ভয় আতঙ্ক কাটিয়ে উঠি, আবার গ্রাস করে তা।

পলতা স্টেশনে গেলে বাঁচার ইচ্ছে বেড়ে যায়। (ভাস্করদা বলেছিলেন, পলতা স্টেশনে এসে আড্ডা দেবেন, হয়নি তা)!

কত দূরপাল্লার ট্রেন যায়, নর্থ বেঙ্গল, বিহার গৌহাটি— আমিও মনে মনে দূরপাল্লায় দূরে চলে যাই। ভ্রমণের বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান করি। বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানে প্রচুর ইমিউনিটি পাওয়ার। চাঙ্গা মন। বাড়ি গিয়ে শান্তিদেব ঘোষের গান শুনব। হঠাৎ গরীবরথ খুব জোরে ছুটে আসে; আমার শান্তিদেব শোনার ইচ্ছেকে নিয়ে গরীবরথ ছুটে যায় নৈহাটি পেরিয়ে। আমি ধুলোর শরীর নিয়ে পড়ে থাকি আজকের ডেট-এ; থাকি কালকের ডেট-এর জন্য। আবার রামপুরহাট আসে, জোরে ছুটে যায়, লোকেরা বৃদ্ধেরা শান্ত বসে থেকে এই আসা-যাওয়া দেখে।

সন্ধের আলো জ্বলে ওঠে। স্টেশনে কেউ সন্ধেবাতি দেয়, প্রদীপ জ্বেলে এই যাওয়া ও আসার দীর্ঘ জীবন কামনা করে। ভালোর কামনা একটা অভ্যেস। অনেকটা শান্তিদেব ঘোষের গানের মতো।

সন্ধের আলো জ্বলে ওঠে। স্টেশনে কেউ সন্ধেবাতি দেয়, প্রদীপ জ্বেলে এই যাওয়া ও আসার দীর্ঘ জীবন কামনা করে। ভালোর কামনা একটা অভ্যেস। অনেকটা শান্তিদেব ঘোষের গানের মতো।

রাত বাড়ে। চার নম্বরে থ্রু ট্রেন। প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে সরে দাঁড়াবেন। ঘোষণা।

থ্রু ট্রেন দ্রুত মানুষকে শিয়ালদা বা জলপাইগুড়ি পৌঁছে দেয়। থ্রু ট্রেন দ্রুত মানুষকে পরপারেও পৌঁছে দেয়। আমি আমার দীর্ঘ পলতা স্টেশন পায়চারির জীবনে দেখেছি তা।

ট্রেন ডাউনে যায়, ট্রেন আপে যায়। মানুষ আপ ডাউন করতে করতে দিশা হারিয়ে ফেলে। সে বোঝে না, আসলে সে কোথায় যেতে চায়। আপ ডাউন, ডাউন আপ। মানুষ পটল কিনে ডিম কিনে ছোটো মেয়েটার জন্য ক্যাডবেরি কিনে বাড়ি ফেরে। কেউ কেউ ফেরে না। থ্রু ট্রেন তাদের চিরকালের জন্য নিয়ে যায়।

রাত গভীর হয়। পলতা স্টেশন গভীর হয়, জেগে থাকে সে। আমি ছোটোবেলা থেকে দেখছি, পলতা স্টেশন জেগে আছে।
জেগে থাকতেই হবে। সে মাস্ক পরে হলেও থাকতে হবে।

 

০৭.
অনেক বছর আগে ‘রক্তমাংস’ পত্রিকায়, অকাল প্রয়াত কবি প্রমোদ বসু একটি গদ্য লিখেছিলেন। সেখানে প্রমোদ কবি শম্ভু রক্ষিত-এর কথা বলেন, সেই প্রথম আমি কবি শম্ভু রক্ষিত-এর নাম শুনি, আমি তখন প্রথম লিখব লিখব করছি, সব কবিদের নাম জানি না, চিনি না। প্রমোদের লেখায় যতটুকু‌ কবি শম্ভু সম্পর্কে পড়েছিলাম, তাতেই আমি চমকিত হই। সেদিনের সেই কবিতা কবিতা খেলনাবাটি আমার নিজের ছিল, খেলার ও মজার দিন ছিল— আমার পঞ্চাশোর্ধ বাবা-মা সেসবের কিছু জানতেন না।

কবিতা লিখতে এসে শুধু কবিতা পড়া নয় অনেক অল্প পরিচিত কবির জীবন ‌ও যাপন আমাকে আড়াল-প্রস্তুতির পরামর্শ দেয়। এবং এই সব কবিরা আমার পিসতুতো মাসতুতো দাদা হয়ে ওঠেন। এঁদের কষ্টে আমি কষ্ট পাই। এঁদের হঠাৎ আত্মহত্যার খবরে আমি বেদনায় দুমড়েমুচড়ে যাই। এইসব ‘বড় বেদনার মতো বাজনা’ ঘরের এক কোনে আমার থাকত গোপনে, আমার দুঃখের খেলনাবাটি।

প্রমোদ বসুর কবিতা আমার ভালো লাগত, তার চেয়েও ভালো লাগত মানুষটাকে। দূর থেকে দেখতাম। লোকটি আনন্দবাজার-এ চাকরি করত, কিন্তু খুব আড়ালের নিরাভরণ কবি। সেই কবি শেষমেশ কোত্থেকে এক দড়ি খুঁজে আত্মহত্যার বাজনা বাজিয়ে দিলেন হঠাৎ। আমি আবার আমার নিজস্ব—ছোটো কবিতা-জগতের বেদনায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। আমার কবিতা জগতের এক পিসতুতো দাদা চলে গেলেন আমাকে কষ্টে ফেলে। আনন্দবাজারের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা প্রমোদ সম্পর্কে লিখলেন, ‘গতকাল হাওড়ায় এক প্রবীণের দেহ পাওয়া গেছে, পুলিশ অনুমান করছে, এটি আত্মহত্যা!’ আমি প্রবীণ কাকে বলে বুঝতে পারি না।

আমার কাছে কবি মানেই, সে চির-তরুণ! প্রমোদ বসু অভিমানে দুঃখে অপমানে একটা দড়ির সন্ধান করেছিলেন।

তো সেই প্রমোদ বসুর লেখায় শম্ভু রক্ষিতকে চাক্ষুষ দেখে আমি তো অবাক। আমি আর কবিতার খেলনাবাটি খেলি না, একটু বড়ো হয়েছি, মানে কবিতাচর্চার মানসিক বয়স একটু বেড়েছে, কলকাতা কলেজস্ট্রিট কফিহাউস পাতিরাম এইসব দূর থেকে দেখি আর ভাবি একদিন এই পাতিরামের মতো বই থৈ থৈ কবি হবো। কলেজস্ট্রিট ঘুড়ে একা একা ছোটোপত্রিকা কিনে ট্রেনে পড়তে পড়তে বাড়ি ফিরে আসি।

বাড়ি এসে মা-কে কবি শম্ভু রক্ষিত-এর কথা বলি। মা কিছু শোনে, কিছু বোঝে, কিছু শোনে না, কিছু বোঝে না। মা ছেলের প্রতি স্নেহপরবশ হয়ে তবু শম্ভু রক্ষিত নামক এক কবির কথা অনেকটা বাধ্য হয়ে শোনে।

মা-কে যা বলেছিলাম : ‘জানো তো কবি মানেই যা জানতাম ইনি তার উল্টো। আমি তো বিদেশি কবি দেখিনি, কিন্তু বাংলার কবিরা খুব সুন্দর দেখতে, হেবি শিক্ষিত, হেবি পাঞ্জাবি, হেবি ফ্রেঞ্চকাট, দারুণ কবিময় গালভরা দাড়ি, গায়ে ঘামের গন্ধ নেই। আমি এই সব মাকে বলতে বলতে দাড়ি রাখতে শুরু করি। কবির জীবন কবিতার সঙ্গে সমান্তরাল আমি খুঁজতে থাকি। কবির জীবন কবিদের জীবনী পড়তে ভালো লাগে, আয়নায় দেখি, আমার কবিতার দাড়ি কত বড়ো হলো।

হ্যাঁ শম্ভু রক্ষিতেরও দাড়ি ছিল, কিন্তু সে বড়ো ‘সাজানো টেবিল’ তছনছ করে দেওয়া দাড়ি, না-মানার দাড়ি, সবকিছুকে অমান্য করার দাড়ি।

হ্যাঁ শম্ভু রক্ষিতেরও দাড়ি ছিল, কিন্তু সে বড়ো ‘সাজানো টেবিল’ তছনছ করে দেওয়া দাড়ি, না-মানার দাড়ি, সবকিছুকে অমান্য করার দাড়ি।

গায়ে নোংরা চাদর, মুখমণ্ডল সুন্দর নয়, আমার ইন্টারেস্ট জাগে কবির প্রতি।

তারপর শম্ভু রক্ষিত সয়ে যায়, সয়ে যান আমার ‘অন্ধকার কবিতা যাত্রা’-র পথে। মাঝেমাঝে দেখি তাঁকে। কথাবার্তা হয় দুটো; তিনটে অব্দি গড়ায় না তা।

শম্ভু রক্ষিতের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে আরও বোকা কেলাস অশিক্ষিত লাগে, যা অতোটা লাগে না কোনো প্রফেসর কবি-বন্ধুর সম্মুখে দাঁড়ালে।

আমি শম্ভু রক্ষিত থেকে পালিয়ে আসি।

আমি শম্ভু রক্ষিতের ঐ আড়ালকে মনে মনে আদর্শ বলে শ্রদ্ধা করি, এই-ই আমার রিয়েল হিরো।

মা থাকলে, মা-কে দেখাতাম, বলতাম, ‘দেখো এই সেই কবি, যিনি আমেরিকা ফ্রান্স জার্মানি যাননি কবিতা পড়তে, কিন্তু তিনি এখন যাচ্ছেন বাঁশের মাচায়, এক দীর্ঘ আড়ালের কবিতাকাশের দিকে, যে দিকে সূর্যের কবিতা-সংসার সেই দিকে…

আজ তাঁর অনাড়ম্বর খাটে (খাট-ও নয়, বাঁশের মাচা) গ্রামের পথ ধরে শ্মশান যাত্রার ছবি দেখলাম, কষ্ট পেলাম, মনখারাপ হলো, মনখারাপ ততোটা হলো না-ও হয়তো।

এটাই সত্যি।

মা থাকলে, মা-কে দেখাতাম, বলতাম, ‘দেখো এই সেই কবি, যিনি আমেরিকা ফ্রান্স জার্মানি যাননি কবিতা পড়তে, কিন্তু তিনি এখন যাচ্ছেন বাঁশের মাচায়, এক দীর্ঘ আড়ালের কবিতাকাশের দিকে, যে দিকে সূর্যের কবিতা-সংসার সেই দিকে…


এই ধারাবাহিকের অন্য পর্বগুলো পাঠ করুন

শববাহকের ছেলেবেলা : প্রথম পর্ব


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনায়। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের স্নাতক রাণা পেশায় ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সম্প্রতি অবসরে। তিনি লেখক এবং মূলত লেখকই। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পনেরোটি। কবিতা, গদ্য ও গল্পের পাশাপাশি তিনি লিখেছেন একটি উপন্যাসও। তাঁর প্রকাশিত বইসমূহ মধ্যে গদ্যবই : ‘রং ও দাগের কাটাকুটি’, ‘পাগলদের বাড়ি’, ‘রাণার কথা’। উপন্যাস : ‘কিতকিত খেলা’। গল্প : ‘দ্রাবিড়ের ভাঙা উইকেট’। কবিতা : ‘একটি অল্পবয়সী ঘুম’, ‘শরীরে সন্দীপন নেই’, ‘লাল পিঁপড়ের বাসা’, ‘বুনো গাধার ডাক’, ‘বাংলা ভাষার মাদুর’, ‘অগাস্ট মাসের রাস্তা’, ‘রোদ ওঠার খাতা’, ‘আমাদের প্যাথোজ একাদশ’, ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ ও ‘কবিতা সংগ্রহ’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।