শনিবার, নভেম্বর ২৩

শাহেদ কায়েস-এর নির্বাচিত দশ কবিতা

0

প্রতিধ্বনি

গভীরে খুরের আওয়াজ, হ্রেষাধ্বনি, তারপর শুধু গতি
আর গতি… দিগভ্রান্ত পথ, পায়ে পায়ে হাওয়ার রাজ্য
যেভাবে একটি জীবন নিভৃতে শাসিত, কুঠারে সবুজেরা…
‘বৃক্ষ বেজে ওঠে যার আঘাতে আঘাতে, সে কি প্রতিধ্বনি!’

প্রাচ্যের রহস্য নগরী, ইটের লবণ বিলাস― দোল পূর্ণিমার রাত
জোড়বাংলা স্থাপত্যের তীব্র হাস্নাহেনা, সংস্কারে রেখেছ হাত!

দুলে ওঠে তোমার প্রাচীন বন, মন্দিরে কী থাকে তখন?
হ্রেষাধ্বনি, গতি, এক ঝলক হাওয়া― অজন্তা-ইলোরা, আহা
নক্ষত্র-জোনাকপোকা-শস্যঢেউ, ফাল্গুনের মাতোয়ারা চাঁদ!


ভাষা দে, প্রভু

মদ্যপসারিণী যুবতীরা অরণ্য জোড়ায়
‘আয় বাবু, আয় বাবু…’ পাশেই মহুয়া
ছড়ানো-ছিটানো ছোলাসেদ্ধ, হাঁড়িয়ার
জালা… ভাত নেই, ঘর নেই, স্বপ্ন নেই
কোটি মানুষের মুখ আছে, ভাষা নেই;
এরা কথা শিখেছে পাহাড়, প্রকৃতি
নদী-ফুল-পাখি, বসন্তের মাদল, ঝর্নার
জল, প্রাচীন ছিলা ও ধনুকের সংলাপ
ঝর্নার পতন, ডুংরি, টিলা, চষা মাঠ…
স্বপ্নভুক দিগন্ত, জঙ্গল, অন্ধকার থেকে।

কঠিন মাটির তলে ইউরেনিয়াম, তামা
অফুরন্ত অভ্র, সোনা, লোহাপাথর, মাটির―
উপরে অভাব, ক্ষুধা, শালবন, সাঁওতাল
বীরহোড়, মুণ্ডা, হো…অ-মানুষের উপস্থিতি!

হাওয়ায় ফের চড়াই, শালিখ, বনহারা ঘুঘু
ঢেউ-পাহাড়, শাল-মহুয়া, সোনাঝুরি
অলচিকির জীবনভাঙ্গা নীরব ডাহার-ডিহি
ঘাসে রচিত হারানো ভুবনের ইস্তাহার…

ঊনত্রিশটি অদৃশ্য প্রাণ ঘুরে বেড়াচ্ছে
অরণ্য-পাহাড়ে… সিংবোঙ্গা, ভাষা দে প্রভু
ভাষা দে… কাটল ঘুমহীন সহস্র বছর
শেষে শংসাপত্র পাঠাল জঙ্গল, সুবর্ণরেখা!


সন্ধ্যা

সন্ধ্যায় প্রতিটি বৃক্ষ
শৈশবে ফিরে যায়―
তারা নীল ফ্রক পরে
ডাকনামে সাড়া দেয়।

প্রতিটি সন্ধ্যা আমাকে
কল্যাণ-ঠাটে গৃহাকুল করে
সন্ধ্যায় প্রতিটি ঘরই শূন্য

তাঁর ফেলে যাওয়া নিঃশ্বাস
পায়চারি করছে সন্ধ্যায়…
ঘর না বাহির, জন না নির্জন
কোথায় মানুষ বেশি একা!

 

স্মৃতি গ্রহের বর্ষা: উত্তর কৈশোর বিভাগ ২

নানীগঙ্গার পাশেই আমার ঘর
নিত্য পাঁচওয়াক্ত ওজু করে ভাসাই তরী
কবির মাজারে রাখি হাত, ঠোঁটের লজ্জায় নেমে আসে শিল্পের চড়াই
ডাকে পাঠাই খোলা বুকের পালক, আর যত পাথুরে অভিমান…
লাল মাটির স্বপ্নে ভেঙ্গে ফেলি অসহ্য কসম
লাবণ্যজলে গোসল সেরে ছিটিয়ে দিই কবিতার বিষ
আজানের ধ্বনিতে ভরে ওঠে রহস্য পেয়ালা
প্রকৌশল ঘাসতীর্থে সমাজিক ঘৃণা!

নিজের বিরুদ্ধে গড়ে তুলি প্রাচীর, ঘৃণার দেয়াল।

 

স্মৃতি গ্রহের বর্ষা: দশমাস দশদিন

ছিল বসন্ত, ছিল রৌদ্র সুদিন
খরগোশ চাতুরিতে ছিল মাসিদের ঋণ
উড়াল স্বরে আটকে গেল বুকের নিঃশ্বাস!
দূরবন থেকে তুলে আনি হলুদ অবকাশ
যদিবা লতিয়ে ওঠে স্বর্ণলতার স্বাদ
যদিবা আমার মৃত্যু হয়―
মুহূর্ত আদরে ভেঙ্গে ফেলি জরায়ুর ত্রাস
সখির গর্ভে আবারো আমার জন্ম হয়!

আমার থেকে বেরিয়ে এসে আমি আমাকেই খুঁজি।


দূরে কোথাও বিয়োগ চিহ্ন

কেবলই শূন্য হচ্ছি, সময়টা এমনই
আমার চেয়ে যেদিন লম্বা হবে আমার ছায়া
বুঝতে হবে সূর্য না, অস্ত যাচ্ছি আমি

বিচ্ছেদ থেকে বিচ্ছেদে যেতে-যেতে
দূরের সম্পর্কে বিঁধে রয় অস্তগামী সূর্য
সাতরঙ রোদ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মনে

কিছুই না, দূরে কোথাও বিয়োগ চিহ্ন

উড়ে যাচ্ছ জলকণা, শ্রাবণের―
ভাসমান দৃশ্যমান বিনীত স্ফটিক…
পায়ের তলায় থাকুক আমার ছায়া।


যদি কথা বলে গাছ

এমন যদি হয় কথারা গাছ হয়ে যায়!
শৈশবে শেখানো বুলি, ভাঙ্গাকথা
কৈশোরে দুরন্ত কথা, ডানাভাসা দিনে—
প্রেমকথা, ঝগড়া-অভিমান কথা…

কতো কথাই না বলেছি সারাজীবন
এতো এতো কথা কোথায় যায়!

ভাবতো একবার মানুষের প্রতিটি কথা
পাখির প্রতিটি শিস দুলতে দুলতে—
কথা-বীজ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল
জল-হাওয়া পেয়ে একদিন খুব ভোরে
………………. কথার অঙ্কুর উদ্গম হচ্ছে!


সহজিয়া প্রেমের কবিতা ১

বাতাসের চাদর জড়িয়ে বসে আছি
চাদরে তোমার ঘ্রাণ, উড়ছে নিঃশ্বাস

শূন্য ঘরে পড়ে আছে হাসির পালক
চমকে ওঠে তাকায় জানালার রোদ
কোথাও সে নেই, নেই মানে শূন্যতা!

পাখি হয়ে উড়ে গেল যে মায়াবী সুর
কথাগুলো ট্রেন, ছুটছে গভীর…

স্থিতি অসহ্য, গতিতে নিয়ে চল
ফিরে এসো সখি সুবর্ণ-এক্সপ্রেসে


সহজিয়া প্রেমের কবিতা ৯

নদীর ঠোঁটে একটি কালো তিল
তাকিয়ে আছে তীব্র অহংকারে!
গাঙের বাঁকে ছোট্ট এক চিল
গেল উড়ে, মোহন চিৎকারে…

প্রতিটি সম্পর্ক অভিযোজনের—
ভিতর দিয়ে অসীমের কথা বলে
সম্পর্ক একটি অলৌকিক স্পর্শ
উপরে শান্ত— চোরা স্রোত তলে…


সহজিয়া প্রেমের কবিতা ১২

ভেঙে গেলে সান্নিধ্যের সাঁকো
ডানা ঝাঁপটায় অস্থির জল
ঘুম আর জাগরণের মধ্যে—
স্নান সারে নির্জনতা…

নাকফুলে নেমে এলে সন্ধ্যাতারা
জাহাজ ডাকে দূরের বন্দরে
প্রতি সন্ধ্যায় একটি খরগোশ
ঢুকে পড়ে পাতাল সিঁড়িতে…

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মূলত কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। পৈতৃক নিবাস, সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে। পড়াশুনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই; এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে মাস্টার্স। কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে। থাকেন নিজ গ্রাম সোনারগাঁয়। পেশা ফ্রি-ল্যান্স গবেষক। তিনি একজন মুক্ত-চিন্তক, সংস্কৃতিকর্মী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা’ (দোয়েল প্রকাশনী, ১৯৯৯) ‘চূড়ায় হারানো কণ্ঠ’ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), ‘মায়াদ্বীপ’ (ঐতিহ্য, ২০১৫), ‘কৃষক ও কবির সেমিনার’ (অভিযান, ২০২০), ‘সহজিয়া প্রেমের কবিতা’ (অভিযান, ২০২১), ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’ (চৈতন্য, ২০২৩), ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ (ভাষাচিত্র, ২০২৩)। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘মঙ্গলসন্ধ্যা প্রেমের কবিতা’ (ধ্রুবপদ, ২০১৭)। অন্যান্য গ্রন্থ: ‘এশিয়ার বারটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ (ইংরেজি গ্রন্থ, মে এইটিন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৫), ‘বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ’ (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)। পুরস্কার ও সম্মাননা: ‘চন্দ্রাবতী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (কবিতায়, ২০২১), শালুক সম্মাননা (২০১৯)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।