‘আমি মনে করি শিল্পকর্ম কেবল গ্যালারি এবং জাদুঘরের দেয়ালে ঝুলে থাকার বিষয় নয়, বরং তা আমাদের প্রতিদিনকার জীবনেরই অংশ। আমাদের জীবনধারায় শিল্পের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। আর এই বিশ্বাসের কারণেই আমি আমার শিল্পী জীবনের অধিকাংশ সময় স্টুডিওর বাইরে শিল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞে নিজেকে যুক্ত রেখেছি।’
—শিল্পী প্যসিতা আভাদ
শিল্পী প্যসিতা আভাদ (Pacita abad, ১৯৪৫-২০০৪) একজন এশিয়-আমেরিকান শিল্পী। যার জন্ম ফিলিপাইনের বাটন্সের রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এক পরিবারে। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে বি.এ ডিগ্রি গ্রহণ করেন। তৎকালীন ফিলিপাইনের ফার্দিনান্দ র্মাকোসের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক সক্রিয়তার কারণে ১৯৭০ সালে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয় এবং আমেরিকায় আশ্রয় নেন। আমেরিকার ইউনির্ভসিটি অব সানফ্রান্সিসকোতে তিনি এশিয়ান হিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই সময় তিনি জীবিকা র্নিবাহের জন্য টাইপিস্ট ও দর্জির কাজ করতেন। তিনি একটি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে আর্ট কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতেন। শিল্পী জর্জ ক্লেমনকে বিয়ে করার পর সানফ্রান্সিসকোর শিল্প জগতের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে যান। বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী জীবনে তিনি জ্যাক গাররিটির সঙ্গে এশিয়া জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন ও পরবর্তীতে জ্যাকের সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এশিয়া ভ্রমণ শেষে আমেরিকায় ফিরে এসে প্রথমে ওয়াশিংটন ডিসির কারকোরান স্কুল অব আর্ট এবং পরে দ্য আর্ট স্টুডেন্টস লীগ, নিউ ইয়র্কে পেইন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করেন।
পড়াশোনা শেষ করে প্যসিতা যাযাবর শিল্পী হিসেবে রং ক্যানভাস নিয়ে ভ্রমণ শুরু করেন। স্বামী জ্যাকসহ ভ্রমণ করার সময় তিনি অবস্থান করেন বাংলাদেশ, ইয়েমেন, সুদান, পাপুয়া নিউগিনি এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে। এই ভ্রমণই তাঁর শিল্প শৈলীতে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষত চিত্রপটের ধারণা, কৌশল ও উপকরণগত ব্যবহারে। শিল্পী প্যসিতা আভেদ-এর পেইন্টিং-এ নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভাইব্রান্ট (vibrant) রঙের ব্যবহার ও পরিবর্তনশীলতা লক্ষ্যনীয়। তাঁর প্রথম দিকের চিত্রর্কমে প্রাথমিকভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, আদিম মুখোশ, পানির তলদেশের দৃশ্যপট ও গ্রীষ্মাঞ্চলীয় ফুলের চিত্র প্রধান্য পায়।
শিল্পী প্যসিতা আভাদ-এর চিত্রকর্মে ব্যপকতা দেখা যায়, তিনি তাঁর ক্যানভাসে বিভিন্ন ধরনের উপাদানের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে তাঁর বিমূর্ত-ধারার চিত্রে ভাইব্রান্ট (vibrant) রং, প্রিন্ট করা মোটা কাপড়, ধাতব টুকরো, সিরামিক্স, রঙিন বোতাম, কাচের টুকরো, সামুদ্রিক নানা প্রাণীর খোলস প্রভৃতি প্রচুর পরিমানে ব্যবহার করেছেন। তাঁর নিজস্ব রীতিতে ছবি, ফর্ম তৈরিতে বুনন ও সেলাইয়ের প্রক্রিয়াকে তিনি ‘Trapunto painting’ নামে নামকরণ করেন। ক্যানভাসের উপরিতলে ঐতিহ্যবাহী কাপড়, বোতাম, মালা, ছোটো আকারের আয়না, কাচ ব্যবহারের কারণে এক জাদুকরি মোহময়তার সৃষ্টি হয়। যা দর্শককে ক্লান্ত করে না।
একজন নিয়মানুবর্তী ও প্রাণবন্ত চিত্রশিল্পী হিসেবে প্যসিতা আভাদ প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি শিল্পকর্ম করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে ২৩৫০টি বিভিন্ন রং-এর রঙিন বৃত্তাকার ফর্ম ব্যবহার করে ৫৫ মিটারের একটি সেতু সাজিয়ে তোলেন। বৈশ্বিকশিল্পী হিসেবে প্যসিতা আভাদ যুক্তরাষ্ট্র , ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন জাদুঘর, গ্যালারিতে ৬০টির বেশি একক ও ৭০ টিরও বেশি গ্রুপ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে প্রায় ৭০টি দেশে তাঁর শিল্পকর্ম রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তিগতভাবে সংগৃহিত রয়েছে।
শিল্পী তাঁর নিজের শিল্প চর্চা সম্পর্কে বলেন—
‘একজন শিল্পী হিসেবে আমি নিজস্ব উপলব্ধি থেকে ছবি আঁকি, তারপরও চিত্রসমূহের নিজস্ব শক্তিশালী সামাজিক বিবেক রয়েছে। আর তা বিশ্বব্যাপী চলমান সামাজিক সমস্যার মোকাবেলা করে। আমি বিশ্বাস করি, একজন শিল্পী হিসেবে আমার শিল্পকর্মের সামাজিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। ঠিক সেই কারণেই আমি ও আমার শিল্পকর্ম এই বিশ্বকে সামান্যতম হলেও ভালো ও সুন্দর করতে চায়। আর এই প্রচেষ্টাতেই আমি ব্যস্ত থাকি। আমার করা ‘Portrait of CombodiaÓ, ÒImmigrant Experience’, ‘Immigrant Experience’ শিরোনামের সিরিজ চিত্রগুলো মানুষকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছে বলে মনে করি। আবার বিমূর্ত সিরিজ চিত্রগুলো যেমন, ‘Abstract Emotions’ এবং ‘Endless blues’ মানুষকে বেশ ভাবিয়েছে দেখলাম। অপরদিকে পাবলিক আর্ট প্রজেক্টে রংচঙা কাজগুলো মানুষকে বেশ অনন্দই দিল। শিল্প শিক্ষার্থীদের সথে বেশ কিছু কাজ করা হলো। বিশেষত ওয়ার্কশপগুলো তাদের শিল্পর্চচা বিষয়ে শিখতে ও জানতে আগ্রহী করেছে।
একজন শিল্পী হিসেবে ছবি আঁকার জন্য পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ঘুরে বেড়ানোকে আমি সৌভাগ্যই মনে করি। আর এই জার্নিই আমার শিল্পকর্মের প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। এই র্জানির মাধ্যমে আমি সচেতনভাবে জানতে পেরেছি এশিয়া, ল্যাতিন-আমেরিকা ও আফ্রিকার নারীদের সম্পর্কে। যেখানে কৃষ্ণবর্ণের নারী বা মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়ে আমি বিশেষভাবে সচেতন ছিলাম। একজন নারী হিসেবে ফিলিপাইনে বেড়ে ওঠা, আমেরিকায় পড়াশোনা ও সারাবিশ্বে ঘুরে বেড়ানোর করণে অনেকে আমাকে সবসময় বেশ সমীহ করেন।
একজন রাজনীতি সচেতন শিল্পী হিসেবে আমার চিত্রগুলো মানুষের কথাই বলে এবং বিশেষ করে নারীদের কথা তুলে আনে। রাজনীতির নানান মারপ্যাঁচ আমি উপলব্ধি করেছি নিজের মতো করে নানা সমস্যার সম্মুখিন হয়ে। আর নারীদের সাথে থেকে, কথা বলে নিজের মতো করে জেনেছি বাস্তব সংকট। এটি সোজাসুজি বলা যেতে পারে আমি শিল্পকর্মে তুলে আনতে চেয়েছি সেই সমস্ত দেশের নারীদের যেখানে পুরুষেরা আধিপত্য করছে, আর নরীরা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। যেমন: ইরান, আফগানিস্থান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, পাপুয়া নিউগিনি, সুদান ও কম্বোডিয়ায় চলমান সহিংসতা, এশিয়ার মেয়ে শিশু, তরুণী ও নারীদের উপর যৌননির্যাতন, এবং বিদেশে গৃহকর্মী হিসেবে অভিবাসনের সময় নানা ধরনের সমস্যা বেড়েই চলেছে। আমি জানি, আর্ট প্রজেক্ট ও পেইন্টিং-এর মাধ্যমে যে সমস্ত সমস্যার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি তা খুবই ন্যূনতম এবং সমস্যার সমাধানে আরও অনেক কিছু করার প্রয়োজন। তারপরও একজন নারী হিসেবে নিজের দেশের ও সারাবিশ্বের অন্যান্য মহিলা/নারীদের জীবন-মান উন্নত করতে সাহায্য করার দায়বদ্ধতা আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে।’
তথ্যসূত্র:
Brooklyn Museum, New York, n. d, Pacita Abad, Viewed 19th march 2019,
<https://www.brooklynmuseum.org/eascfa/about/feminist_art_base/pacita-abad >
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯২ সালের ১৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরের গোসাইলডাঙ্গায়। স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন চিত্রকলা বিষয়ে চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। নিয়মিত দৃশ্যশিল্পের নানান মাধ্যমে চর্চা করছেন। ‘নির্বাসিতের গল্প’ শিরোনামে তার প্রথম একক শিল্প প্রদর্শনী ২০১৮ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ‘কলাকেন্দ্রে’ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের ১০০ জন যুবার মধ্যে শিল্পী হিসেবে ভারত ভ্রমণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি (কেন্দ্রিয় কার্যলয়), ঢাকাতে চারুকলা ও সৃজনী প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত থাকার পাশাপাশি, ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে ইন্সপায়ারিং বাংলাদেশ প্লাটফর্মে কাজ করছেন। প্রতিনিয়ত প্রচ্ছদ শিল্প ও পুস্তক অলংকণের পাশাপাশি লেখালেখি করেন।