বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

শিল্পের সংসর্গে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতি

0

মূল : চাদ স্কট
ভাষান্তর : মাইনুল ইসলাম মানিক


অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলন কিংবা পারস্যের মতো সুপ্রাচীন সভ্যতাগুলো অধুনাকালের ইরাক-ইরান অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত ছিল। জাদুঘর ভ্রমণার্থীরা উল্টর আমেরিকার শৈল্পিক প্রদর্শনীগুলো প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে এই সংস্কৃতি সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা পেতে পারেন।

পশ্চিমা দর্শনার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পকর্ম সম্পর্কে ভাবলেই যে বিষয়টা প্রথমেই তাদের মানসপটে উঠে আসে, সেটি হচ্ছে কার্পেট বা গালিচা। টরেন্টো থেকে পনের মিনিট দূরের আগা খান জাদুঘরে এর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনের দেখা মেলে।

পশ্চিমা দর্শনার্থীরা মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পকর্ম সম্পর্কে ভাবলেই যে বিষয়টা প্রথমেই তাদের মানসপটে উঠে আসে, সেটি হচ্ছে কার্পেট বা গালিচা। টরেন্টো থেকে পনের মিনিট দূরের আগা খান জাদুঘরে এর শ্রেষ্ঠতম নিদর্শনের দেখা মেলে।

১৭ জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো কানাডায় দ্য ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটের সন্ধান পাই। যে তিনটি নগরী ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, এটি ছিল তার শেষটি। এর ভেতর অবশ্য মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, হিউস্টন এবং মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্টও ছিল। এটি ইসলামী শিল্পকলার এক দুর্লভ নিদর্শন। এই ১৩X১৬ ফুটের কার্পেটটি সপ্তদশ শতকে ইরানের কিরমানে তৈরি। পার্সিয়ান গার্ডেন কার্পেটের মধ্যে এটি সবচেয়ে পুরনোগুলোর একটি।

এই কার্পেটের আকৃতি, বয়স ও কারুনৈপুণ্য বিবেচনায় প্রায় প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে হাতে তৈরি শতাধিক পশমী গিঁট রয়েছে এবং সেগুলোতে অনেকটা আদিমতার ছাপ রয়েছে যা এই কার্পেটটিকে সত্যিকারের নান্দনিকতা দান করেছে।

এই সঘন সবুজাভ সৃজনোন্মুখ জীবনঘনিষ্ট গার্ডেন কার্পেটটি দ্বারা ভাবতাড়িত হয়ে যে কোনো দর্শনার্থীই ‘স্বর্গ’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি খুঁজে পেতে পারেন।


Manik_Iran_1

টরেন্টোর আগা খান জাদুঘরে ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটের প্রদর্শনী


“প্রাচীন পার্সিয়ান ‘প্যারিদাইজা’ শব্দ থেকে ইংরেজি ‘প্যারাডাইস’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে দেয়ালঘেরা বাগান।” ফোর্বস ডট কমকে এই বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন প্রদর্শনীর কিউরেটর ড. ফিলিজ চাকির ফিলিপ। “জলের প্রবাহসমেত ইরানের ধ্রুপদী বাগানকে ‘চাহার বাগ’ বলা হয়। এই ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটে দুটি দীর্ঘ জলের প্রণালী রাখা হয়েছে যার মাঝখানে একটি প্রণালীর মাধ্যমে দীর্ঘ প্রণালী দুটিকে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে এই দুটি জলাধার আর সংযোগটি একটি এইচ অক্ষরের আকৃতি লাভ করেছে যা ছয়টি আয়তাকার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে এবং কার্পেটিকে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছে।”

একজন জার্মান সংগ্রাহকের নামানুসারে এই ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটের নামকরণ করা হয়। তিনি বিংশ শতকে এই কার্পেটটি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৩৯ সালে এই কার্পেটটি কিনেছিলেন স্কটিশ জাহাজ ব্যবসায়ী স্যার উইলিয়াম ব্যারেল। কার্পেটটির আকৃতি ও প্রদর্শনীকৃত স্থানের সংকীর্ণতার কারণে গত বিশ বছরে এটি মাত্র তিনবার প্রদর্শিত করা হয়।

‘ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটের চিত্রকল্প বাগান ও বনায়নের এক সুবিন্যস্ত মিশ্রণ। এতে উঠে এসেছে জীবন ও কর্মচাঞ্চল্যে ব্যস্ত বিচিত্র বন্যপ্রাণী।’ এই বিষয়গুলো ফিলিপ আমাদেরকে অবগত করে। সে আরও জানায়, ‘কার্পেটের পুস্পশোভিত ও অলংকারময় উপাদানগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক।

‘ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটের চিত্রকল্প বাগান ও বনায়নের এক সুবিন্যস্ত মিশ্রণ। এতে উঠে এসেছে জীবন ও কর্মচাঞ্চল্যে ব্যস্ত বিচিত্র বন্যপ্রাণী।’ এই বিষয়গুলো ফিলিপ আমাদেরকে অবগত করে। সে আরও জানায়, ‘কার্পেটের পুস্পশোভিত ও অলংকারময় উপাদানগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক। যেমন ধরুন, ময়ুরের কথা বলা যেতে পারে। আপনি হয়ত দেখতে পাবেন চিত্রকল্পে এই স্বর্গীয় পাখিটির পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কিন্তু যদি খুব কাছ থেকে দেখেন, তাহলে দেখতে পাবেন, কখনো কখনো এই পাখিটির লেজ ওপরে, কখনো দেখবেন লেজটি নিচে; সর্বোপরি এটি একটি শৈল্পিক সৃজনশীলতা প্রদর্শন করে। ফড়িং, প্রজাপতি কিংবা অন্যান্য পতঙ্গের খোঁজ নিতেও ভুলে যাবেন না।’

এই কার্পেটটিতে রঙ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে প্রাকৃতিক উপাদান। এটিতে নীল রঙের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে ইন্ডিগো বা নীলগাছের অংশ। লাল রঙের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে ম্যাডার জাতীয় লতাবিশেষ। হলুদ রঙের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে পাতা ও ফুল। বাদামী ও কালো রঙের জন্যে ব্যবহার করা হয়েছে লৌহসমৃদ্ধ মাটি এবং গাছের বাকল। এই প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেটকে অনন্যতা দান করেছে।


Manik_Iran_2

ওয়েগনার গার্ডেন কার্পেট


আগা খান জাদুঘরটি শিল্প, বুদ্ধিবৃত্তি ও বিজ্ঞানে মুসলিম সভ্যতার অবদান সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জন্যে জানালা অবারিত করে দেওয়ার জন্যে নিজেকে নিবেদিত রেখেছে। ইসলামের এসব পাঠ সম্পর্কে আমেরিকায় এখনো বিস্তর সন্দেহ বিরাজমান।

ফিলিপ বলেন, ‘সাধারণত বলতে গেলে আমাদের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, ইসলামিক আর্ট নিপাট ধর্ম সমন্ধীয় কিংবা শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্যে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইসলামিক আর্টের ধারণা পশ্চিমা পণ্ডিতদের দ্বারা উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই পণ্ডিতরা তাদের নিজেদের পাশ্চাত্য ধ্যানধারণার প্যারামিটারে এসব আর্টকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন।’
ফিলিপের মতে, ইসলামিক আর্ট খুব বাজেভাবে দুটি শৈলীতে বিভক্ত হয়ে গেছে : একটা শৈলী ধর্মীয় বিষযবস্তুকে ঘিরে, যার মধ্যে রয়েছে স্থাপত্যকলা (মসজিদ, মাদরাসা প্রভৃতি) এবং পাঠরূপ (কোরানের পাণ্ডুলিপি, ধর্মীয় পুস্তক প্রভৃতি)। অপর শৈলীটি হচ্ছে অত্যধিক সেক্যুলার বিষয়বস্তু সম্পৃক্ত, যেটিকে অধিক জীবনঘনিষ্ট বলা যেতে পারে।

ফিলিপ আমাদেরকে বলতে থাকেন, ‘দ্বিতীয় শৈলীটি শিল্পীকে তার জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে পুস্পসংক্রান্ত এবং বিমূর্ততার মধ্য দিয়ে এবং রূপকের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে প্রকাশের সুযোগ পান। ইসলামিক শিল্পকলায় বস্তুগত প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধ নেই। স্বভাবত, যখন কোনো শিল্পী কোরানিক বিষয়কে অবলম্বন করেন, তিনি রূপকের আশ্রয় নেন না।’

হিউস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসে আরও অনেক উদ্ঘাটন যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে একটা সাংস্কৃতিক বিনিময় প্রায় সমাপ্তির পথে।

কুয়েতভিত্তিক আল-সাবাহ সংগ্রহশালা এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা দার আল-আতহার আল-ইসলামিয়াহর সাথে এই জাদুঘরটির অংশীদারভিত্তিক পথচলা শুরু হয় গত ২৭ ডিসেম্বরে। এর আগে ‘আর্ট অফ ইসলামিক ল্যান্ডস : সিলেকশানস ফ্রম দ্য আল-সাবাহ কালেকশন, কুয়েত’-এর পক্ষ থেকে এই শিল্পকর্মগুলো দর্শনার্থীদের জন্যে প্রদর্শন করা হতো।

বেসরকারিভাবে পরিচালিত সংগ্রহশালার মধ্যে আল-সাবাহ সংগ্রহশালা বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরের। এই জাদুঘরের সাথে ২০১২ সালে সমঝোতা বিষয়ক আলোচনা শুরু হয় এবং ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলমান থাকে। এসময় ৬৭টি উপকরণের বিষয়ে হিউস্টনের এই জাদুঘরের সাথে মতৈক্য হয়। এই ৬৭টি উপকরণের মধ্যে রয়েছে গালিচা, স্থাপত্যবিষয়ক ভগ্নাংশ থেকে শুরু করে সুক্ষ্ম সিরামিক, ধাতব কারূকাজ, গহনা, বৈজ্ঞানিক উপকরণ এবং পাণ্ডুলিপি।

সম্প্রসারিত প্রদর্শনীতে প্রায় তিনগুণ উপকরণ সন্নিবেশিত করা হয়। এতে শিল্পকর্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৫০টিতে দাঁড়ায়। অষ্টম শতক থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, তুর্কি, ভারতীয় উপমহাদেশ, আইবেরিয়ান পেনিনসুলা এবং সেন্ট্রাল এশিয়ার ইসলামিক দৃশ্যমান সংস্কৃতির কারিগরি উন্নয়ন, কারূনৈপূণ্য ও নান্দনিকতা এতে স্থান পায়।

আটলান্টার হাই মিউজয়াম অফ আর্ট তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে Bestowing Beauty: Masterpieces from Persian Lands প্রদর্শনীর জন্যে আরেকটি সংগ্রহশালার আয়োজন করে।

হিউস্টনের মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টসের আয়োজনে উক্ত প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শনী থেকে আগত উপকরণসহ ১২ ডিসেম্বরে প্রদর্শনী শুরু করে যা ২০২১ সালের বসন্ত পর্যন্ত চলমান থাকে। এই প্রদর্শনীতে ষষ্ঠ থেকে ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত ইরানি সভ্যতার সমৃদ্ধ ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের প্রায় শতাধিক শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল গালিচা, বস্ত্র, পাণ্ডুলিপি, চিত্রকর্ম, সিরামিক, বার্ণিশ, ধাতবকর্ম, বৈজ্ঞানিক উপকরণ ও গহনা সামগ্রী। যে বিষয়গুলোকে এই প্রদর্শনীতে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে শাহানামা ও ইরানি জাতীয় মহাকাব্য থেকে নেয়া সুক্ষ্ম ক্ষুদ্র চিত্রকর্ম।

প্রাচীন ইরানি শিল্পকলা থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমির এইচ. ফালাহর (জন্ম ১৯৭৯, তেহরান) ম্যুরাল ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসেতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ কন্টেম্পোরারি আর্ট-এ সর্বাধিক স্থান দখল করে আছে।

প্রাচীন ইরানি শিল্পকলা থেকে বর্তমান পর্যন্ত আমির এইচ. ফালাহর (জন্ম ১৯৭৯, তেহরান) ম্যুরাল ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসেতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ কন্টেম্পোরারি আর্ট-এ সর্বাধিক স্থান দখল করে আছে। এটিতে The Facade Project নামে একটি পাবলিক আর্ট প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম শৈল্পিক বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করা। “Amir H. Fallah: The Facade Project নামের প্রকল্পটিতে ৫০ ফুট দীর্ঘ একটি ভাস্কর্য রয়েছে যা ভবনটির সামনে শোভা পাচ্ছে।

ফালাহ বিক্ষিপ্ত ছড়ানো ছিটানো শিশুতোষ বইয়ের পাঠ ও চিত্রকলা থেকে শুরু করে পার্সিয়ান ক্ষুদ্র উল্লেখযোগ্য পাণ্ডুলিপি ও আমেরিকান প্রদর্শিত চিত্রকলা এবং ব্যাপক বিকীর্ণ পুস্পচিত্র থেকে বিভিন্ন বিষয়আশয় তার শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন।


Manik_Iran_3

মিখাইল রাকোইৎজ, নিউইয়র্ক


সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং প্রদর্শনীর দেখা মেলে নিউইয়র্কের হ্যামিল্টন কলেজের Michael Rakowitz: Nimrud প্রদর্শনীতে। রাকোইৎজ ইরাকি বংশোদ্ভুত ইহুদি পরিবারের সন্তান। পশ্চিমা দেশগুলোর নিদর্শন সংগ্রাহক ও মুসলিম চরমপন্থীদের দ্বারা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অবমাননার ইতিহাসকে তিনি তুলে এনেছেন।

‘আসিরীয় রাজা দ্বিতীয় আশুরনাজিরপাল কর্তৃক খ্রিস্টপূর্ব ৮৮৩-৮৫৯ সালে নর্থওয়েস্ট প্যালেসটি নির্মিত হয়। প্রাচীন কালহু নগরীতে নির্মিত এই প্যালেসটি প্রাশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রাজা দ্বিতীয় আশুরনাজিরপাল এটিকে তার সা¤্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন।’ প্রদর্শনীর কিউরেটর ক্যাথেরিন অ্যালকসকাস ফোর্বস ডট কমকে এ বিষয়টি অবগত করেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্যালেসের দেয়ালগুলো পাথরের নির্মিত। এগুলোতে অসংখ্য চিত্রকল্প খোদাই করা আছে। এই খোদাইকৃত চিত্রকর্মগুলো রাজার মাহাত্ম্য ও অসংখ্য ভালো কাজের সাক্ষ্য বহন করে।’

এই প্রদর্শনীর জন্যে রাকোইৎজ শুধুমাত্র সেই পাথরের প্যানেলগুলো পুনর্নির্মাণ করেছেন। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন আরবি ভাষার সংবাদপত্র এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে সব খাদ্যসামগ্রী শিকাগো শহরে আমদানি করা হতো এবং বিভিন্ন মুদি দোকানে বিক্রি করা হতো, সেসব খাদ্যসামগ্রীর মোড়ক। এসব উপকরণ দিয়ে তিনি সাত ফুট দৈর্ঘ্যরে পাথরের প্যানেল নির্মান করেছিলেন। কিউরেটর ক্যাথেরিন জানান, ‘ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি বিট্রিশ স্থাপত্যবিদগণ এবং আমেরিকান মিশনারিজ এবং অপরাপর বিশেষজ্ঞগণ এই শিল্পকর্মগুলো উদ্ঘাটন করেন এবং সেগুলোকে ভাগ করে বেশিরভাগ অংশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠান। এই প্যালেসের কারুশিল্পগুলোর পাশাপাশি আসিরীয় সা¤্রাজ্যের আরও দুটি পুরতত্ত্বের বিষয়ে কলেজ পর্যায়ের সার্ভে কোর্সগুলোতে মাঠপর্যায়ের ইতিহাসের ফাউন্ডেশনাল আর্টওয়ার্ক হিসেবে পাঠ করানো হয়।’

বর্তমান ইরাক অঞ্চল থেকে প্যালেস ভেঙে ৬০০টির মধ্যে অন্তত ৪০০টি কারূকর্ম সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এগুলো পশ্চিমা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগ্রহশালায় জমা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়াম, প্যারিসের লুভ্যর মিউজিয়াম, বোস্টনের মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস, ব্রুকলিন মিউজিয়াম, ইয়েল ইউনিভার্সিটি আর্ট গ্যালারি প্রভৃতি। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন লিবারেল আর্টস কলেজেও এসব কারুকর্ম স্থান পেয়েছে যার মধ্যে হ্যামিল্টন কলেজও রয়েছে।

‘রাকোইৎজের শিল্পকর্ম এই জাদুঘরটিকে সাম্রাজ্যবাদী সত্তা হিসেবে সূচিত করে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ উপকরণসমূহকে সংরক্ষণ করাটা আপাতবিরোধী হিসেবে দৃষ্টি আর্কষণে সহায়তা করে, এদের কার্যকারিতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে নিশ্চল করার বিষয়টি তুলে আনে।’

ওয়েলিনে প্রদর্শনীর জন্যে গত ১৯ অক্টোবর উন্মুক্ত দেওয়া হয় যা এই বছরের ১৩ জুন পর্যন্ত চলমান থাকে। এটি উন্মুক্ত করার সময় ক্যাথেরিন অ্যালকসকাস বলেন, ‘রাকোইৎজের শিল্পকর্ম এই জাদুঘরটিকে সাম্রাজ্যবাদী সত্তা হিসেবে সূচিত করে এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ও অপূর্ণাঙ্গ উপকরণসমূহকে সংরক্ষণ করাটা আপাতবিরোধী হিসেবে দৃষ্টি আর্কষণে সহায়তা করে, এদের কার্যকারিতা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে নিশ্চল করার বিষয়টি তুলে আনে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি আরেকটি বিষয় স্পষ্ট করে। শরনার্থী এবং তাদের শিল্পসম্পদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। আমেরিকার প্রায় প্রতিটি জাদুঘরই তাদের সংগ্রহশালায় শরনার্থীদের শিল্পকর্মগুলো রাখার ব্যাপারে উদগ্রীব হলেও শরনার্থীদেরকে দেশে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে মোটেও প্রস্তুত নয়। এটি তাদের আপাতবিরোধী আচরণ।’


Manik_Iran_4

মিখাইল রাকোইৎজ (ডিটেইল অফ নিউইয়র্ক, প্রথম প্রদর্শনী, রুথ ও এলমার কর্তৃক অনুমোদিত)


পশ্চিমা পণ্ডিতগণ চলে যাওয়ার পর নর্থওয়েস্ট প্যালেসের ভাঙন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়নি।

আসিরীয় সা¤্রাজ্যের অবশিষ্ট ২০০ কারুকর্ম ২০১৫ সালে আইএস ধ্বংস করে দেয়। তাদের দাবি মতে, এই কারুশিল্পগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিশুদ্ধতার জন্যে নির্মিত হয়েছিল। এগুলো সংরক্ষণ করা অপ্রাসঙ্গিক এবং এসব সংক্রান্ত উদযাপনও এক প্রকারের শিরক। তারা মনে করেন, আসিরীয়রা এসবের মধ্য দিয়ে শিরক করেছিল। এসবকে তারা বৈদেশিক সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত করে যা তাদের মতবিরুদ্ধ ইরাকি জাতিয়তাবাদকে সমর্থন করে। মুসলিম শাসকের অধীনস্ত ইসলামি স্টেট গঠনে এটিও একটি বাধা হিসেবে তারা অনুধাবন করে।

এই প্রদর্শনীর জন্যে রাকোইৎজ শুধুমাত্র সেই পাথরের প্যানেলগুলো পুনর্নির্মাণ করেন যেগুলো আইএস কর্তৃক ২০১৫ সালে ভাঙার আগে নর্থওয়েস্ট প্যালেসে বিরাজমান ছিল। যে অংশের কারুকর্মগুলো ভূতাত্ত্বিকগণ সরিয়ে নিয়েছেন, সে অংশটি তার শিল্পকর্মে শূন্য রাখা হয়েছে।

রাকোইৎজের প্রশ্নগুলো দর্শনার্থীদের মনেও উত্থিত হবে যখন আবার তাদেরকে লস এঞ্জেলসের গেটি ভিলার এই প্রদর্শনীতে পুনর্প্রবেশ করতে দেয়া হবে। এই প্রদর্শনীটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এটি আবার সামার ২০২১-এ Mesopotamia: Civilization Begins ও সামার ২০২২-এ “Assyria: Palace Art of Ancient Iraq প্রদর্শনীর জন্যে পুনরায় খুলে দেয়া হবে।

এই ‘আসিরীয়’ প্রদর্শনীতে বিট্রিশ মিউজিয়াম থেকে ধার করে আনা প্যালেসের কারূকর্মের ভাস্কর্যগুলো অনন্যতা দান করে।

[এই লেখাটি ৬ অক্টোবর ২০২০ সালে ফোর্বস.কম-এ প্রকাশিত হয়]

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮৪ সালের ১১ মার্চ, চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলাধীন বলশীদ গ্রামে। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে বর্তমানে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। নিয়মিত লিখছেন জাতীয় দৈনিক ও বিভিন্ন সাময়িকীতে। ওয়েবম্যাগ তীরন্দাজ-এর সহযোগী সম্পাদক। লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন নাগরিক বার্তা লেখক সম্মাননা, নতুন কুঁড়ি লেখক সম্মাননা, ফরিদগঞ্জ লেখক ফোরাম পদক (প্রবন্ধে), ছায়াবানী মিডিয়া কমিউনিকেশন লেখক সম্মাননাসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। প্রকাশিত অনুবাদগ্রন্থ মধ্যপ্রাচ্যের সমকালীন গল্প (মাওলা ব্রাদার্স, বইমেলা ২০১৯), দশ নোবেলজয়ী লেখকের সাক্ষাৎকার (পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি., বইমেলা-২০১৮) ও কাব্যগ্রন্থ স্বপ্নের শঙ্খচিল (২০১৪)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।