শুক্রবার, নভেম্বর ২২

শীতের স্মৃতি ও অন্যান্য কবিতা : সাফায়াত হোসাইন

0

টেলিগ্রাফের থামের মতো প্রার্থনার ভঙ্গিতে


টেলিগ্রাফের থামের মতো প্রার্থনার ভঙ্গিতে
সে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল
লুসাই শিশুদের কবরস্থানের পাশে
মহুয়ার ঘ্রাণ তাকে পথ ভুলিয়ে
নিয়ে এলো কংলাক পাহাড়

হলুদ হয়ে যাওয়া পুরোনো বর্ষপঞ্জির
শেষের কয়েকটা অবাঞ্ছিত দিন
এই দীর্ঘ ভঙ্গুর পথে, ক্লান্তি নয়
সারাটা দিন তাকে নিজের ভেতর
বয়ে বেড়ালাম

নৈঃশব্দ্য ও মৃত্যুর দ্বান্দ্বিক তৎপরতার মাঝে
টিম টিম করে জ্বলতে থাকা গৃহহীন আলো
পেরিয়ে আসা হলো পপিফুলের দীর্ঘ মাঠ
পর্যটন শেষে এই লালজীপ, পাহাড়
কিছুই আর মনে থাকবে না

তীব্র হ্যালুসিনেশনের ভেতর, এখনও
সে চশমাটা মুছে নিচ্ছে যেন মৃদু হাতে
পাশাপাশি গোপন একটা বিমর্ষ চিহ্নের ক্যালিগ্রাফি
কেউ এঁকে দিয়ে, দ্রুত মিলিয়ে গেল সন্ধ্যার বাতাসে


সমর্পণ


মশলার ঘ্রাণের ভেতর
একটা মূর্খ হরিণের কথা ভাবি
শিকারির ফাঁদ এড়াতে গিয়ে
সবসময়, যেমনটা তুমিও
নিজেকে জড়ায়ে নাও
কাঁটাগুল্মের আশ্রয়ে

ইল্যুশন ঘিরে রাখা সেই তামাটে রাত
মুরংপল্লির সবুজ টিলার ফাঁকে
নৈঃশব্দ্য ভেঙে উঁকি দিয়েছিল
আধখাওয়া চাঁদ

চাঁদ নাই হয়ে গেলে
চিরায়ত পোকাগুলো
ফিরে যাবে আগুনের সন্ত্রাসের কাছে
সেই ঝলসানো হরিণের ছায়া ক্রমশ
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এখন
দৌড়াতে থাকবে বনের চারপাশে।


পটভূমি


সব কিছুরই একটা কনটেক্সট অবশ্যই কেন লাগবে?
এই দায় থেকে বের হওয়ার দরকার আছে
নির্ধারিত রোবটের বাইরেও কিছু মানুষ আছে
একলা থাকে, একলা চলে
মাথায় বহন না করে আরোপিত কানুন
কুয়াশার ভেতরেও দৃষ্টি রাখে যোজন দূরে

একা লাগতে পারে মানুষের
কারো অভাববোধ জরুরি উপাদান নয়
এই একাকীত্বকে কী বলা যায়?
পূর্বপুরুষের পায়ের ছায়া, জমে থাকা মিথ
পুরনো সব গল্প মানুষকে একই পটভূমে আটকে রাখে

গ্রাম থেকে শীত, চোরাইপথে ঢুকে পড়ছে নগরে
বেড়িবাঁধ থেকে পানির সীমা আরও কয়েক সেন্টিমিটার নিচে
ওই পথ ধরে কখনো হাঁটি, বাতাসের কাঁটা গায়ে লাগে
তোমাকে মনে পড়তে পারে যখন তখন
তোমার থেকেও তোমার সোয়েটারের রঙ
স্মৃতিতে বেশি প্রকট হয়ে উঠতে পারে


শীতের স্মৃতি


নীল কার্ডিগান গায়ে চাপিয়ে পৃথিবীতে ফেরত আসে শীত। ক্যালেন্ডারে কেমন ঝরাপাতার দিন। মন খারাপের বার্তা নিয়ে, হলুদ বোগেনভ্যালিয়া নেমে আসে পুলিশ কোয়ার্টারের শাদা পাঁচিল ঘেঁষে। শীতফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষের ব্যক্তিগত নৈঃশব্দ্য জমে। সমগ্র সন্ধ্যা ফুরিয়ে যাবার আগেই বরং, নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া যাক। কুয়াশাঘেরা কোনো ভোরে, একদিন সত্যিই পার হয়ে যাব সবুজ টিয়াভর্তি আস্ত কামরাঙা বাগান। লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে ফিচার লিখব— শুষ্ক ত্বক ও অ্যালোভেরার বিপ্রতীপ সম্পর্কের বিষয়ে।


ভেবেছি সমুদ্রে যাব


ভেবেছি সমুদ্রে যাব
ক্লিশে পর্যটন সীমানা পেরিয়ে
প্রাচীন কোনো সূর্যডোবা ভূগোলে
যেখানে কান পাতলেই শোনা যাবে
জলের গোপন অস্তিত্ব থেকে
বিপন্ন জাহাজের ডাক

অকৃত্রিম ঢেউয়ের মুদ্রায়
পৃথিবীর একমাত্র নর্তকী তুমি
(কতকালের চেনা একটা মুখ)
সন্ধ্যার নিমীলিত বক্রছায়া
ও প্রার্থিত ফুলের রেণু ভেদ করে
দ্যুতি ছড়ায়ে নিঃশব্দে হেঁটে আসো

জলের অব্যর্থ ক্যাকোফোনি
সভ্যতাপূর্ব আদিম এই সংগীত
রৌদ্রস্নাত আর্যরঙের যৌনতায়
আমাকে ভেঙে দিয়ে গেছে
নির্জন দ্বীপের হলুদ প্লুমেরিয়া,
হাঙরের দাঁতের ট্যাবু ও টোটেম

চালতাফুলের আলসে ভঙ্গির বিকেলে
অনেক পথ ঘুরে একবার সমুদ্রে যাব
যদি সৈকতে ঘিরে ধরে হাজারো হিংস্র সাইক্লোপস
ফার্ণের পাতার ফাঁকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে
আমরা মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করব।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৭ জুন, গাজীপুর। কবিতা ও গদ্য লিখেন। ভাষা ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ক নিরীক্ষাধর্মী প্রচেষ্টার ব্যাপারে উৎসাহী।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।