দুপুরের ঘুমটা একটু উঁকি দিতেই সানজানার কান্নার শব্দ রুমকীর ঘুমটাকে একেবারে থেঁতলে দিয়েছে। মস্তিষ্কের রাডারে তখন ঘুম-ঘুম, সানজানার মুখ, সানজানার মায়ের মুখ, সানজানাদের বারান্দায় মানিপ্ল্যান্ট আর থোকা থোকা সাদা ফুলের টগর গাছটা, আর তার মধ্যে থেকে ছোট্ট একটা মিষ্টি পুতুলের মুখ যেন ঘুম-তন্দ্রার, চেতন-অবচেতনের মাঝে তখনো ক্রমাগত দোল খাচ্ছে। সানজানার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দটা তিন তলার ব্যালকনির ভেতর দিয়ে এক করুণ বিলাপের মতো কান্নার সুরে খুব তীক্ষ্ণভাবে রুমকীর কানের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কের ভেতরে যেন গেঁথে গেল। ঘুম-জাগরণের মধ্যে সানজানার কান্নার স্বর, খিলখিল হাসি, আধো-আধো কথা, ঘুরিয়ে তাকানো, জড়োসড়ো হয়ে সেজেগুজে থাকা, নতুন জুতার রং, জামার গন্ধ সব—সবকিছুই যেন একবারে ছবির মতো ভাসে। এসবই রুমকীর খুব-খুব প্রিয়। এসব প্রিয় বিষয়ের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় তার প্রিয় আরও কিছু মুখ। স্বপ্নে-জাগরণে সেসব মুখ ডানা ঝাপটায় । সে একটু পাশ ফিরে শোয়—কিন্তু সেইসব পুরানো দিনের মুখগুলো তাকে স্বস্তি দেয় না। সানজানার মুখের সাথে মিলে যায় তার একমাত্র বড়ো ভাইয়ের মেয়ে পাতার মুখ। তিন বছরের পাতা তাকে অনবরত ডাকছে ফুফি-ফুফি-ফুফি। ভাইটা কেমন ভ্রু কুঁচকে দেখছে রুমকীকে! যেন সে কোনো এক আধপোড়া ইতিহাসের গহ্বর থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে রাগত চেহারায়। ভাইটা তাকে ক্রমাগত ডাকছে, সঙ্গে এক সুরে কেঁদে যাচ্ছে পাতা। কিন্তু রুমকী যেন সেসব কান্নার সুরের মধ্যে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে এক অপরিচিত লাল রক্তবর্ণের আকাশ। ওরা দুজনে যেন হাত ধরে পাড়ি দিচ্ছে লাল বর্ণের ভেতর সাদা টগর ফুলের বাগান। রুমকী চেষ্টা করছে তাদেরকে স্পর্শ করতে, কিন্তু বাতাসের ফিসফিস স্বর যেন তার স্পর্শের ব্যাকুলতাকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে অন্য জীবনের দিকে।
ভাইটা তাকে ক্রমাগত ডাকছে, সঙ্গে এক সুরে কেঁদে যাচ্ছে পাতা। কিন্তু রুমকী যেন সেসব কান্নার সুরের মধ্যে দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে এক অপরিচিত লাল রক্তবর্ণের আকাশ। ওরা দুজনে যেন হাত ধরে পাড়ি দিচ্ছে লাল বর্ণের ভেতর সাদা টগর ফুলের বাগান।
সানজানার বয়স তিন বছর। ওর কান্না একেবারেই সহ্য করতে পারে না, রুমকী। সানজানা তার চোখের মণি। খুব স্নেহের, খুব মমতার। কেন যে কিছু কিছু বিষয়ে তার মনের মধ্যে একরাশ মমতা জন্মায়, তা বোধ হয় তার নিজেরও অজানা। তবে এসব বিষয় সে যথাসম্ভব চেপে রাখে। যেমন ঠিক এই মুহূর্তে সানজানার কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙতেই সে ঠিক টের পাচ্ছে, সানজানার খুব অসুখ করেছে। আর পাশাপাশি ওদের ব্যালকনিতে লাগানো সাদা টগর ফুলের গাছটা জলের অভাবে মরে গেছে। রুমকী জানে, ওই টগর ফুলের গাছটিও এক অপার্থিব মমত্ববোধে তাকে জড়িয়ে রাখে। কী সেই টান! সানজানার অসুখ আর টগর ফুলের গাছটির মৃত্যুর কথা ভেবে রুমকী তাৎক্ষণিকভাবে ঘুমের গভীর আয়োজন ঝেড়ে উঠে বসে। গত তিন বছর ধরেই রুমকী দেখে আসছে, সানজানার হঠাৎ জ্বর, ব্যালকনির টগরগাছের মৃত্যু, আর সানজানার মায়ের ঠিক সেদিনই অফিসের জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকার মধ্যে এক গভীর সত্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই ব্যাপারটি ঘটে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু রুমকীই বিষয়গুলো টের পেয়ে যায় কেন! একটা এলোমেলো বাতাস যেন সমস্ত শরীর জুড়ে নিঃশব্দে কিছু কথা বলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে বুক থেকে।
রুমকী আর দেরি করে না। ঘুম থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, তার পাঁচ তলার বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে নিচে তিন তলার দিকে তাকিয়ে দেখে কিছু শুকিয়ে যাওয়া সাদা ফুল ঝরিয়ে তাজা সবুজগাছটি মরে গ্যাছে। সত্যিই! মরে গ্যাছে! আহা! মরে গ্যাছে! সে কেবলই জেনে যায় এক সূক্ষ্ম অথচ তীব্র নির্দেশ যেন নেপথ্যের কোনো এক ইশারা! টের পায় সে! এক বিকট শূন্যতার ত্রাসের ভেতর ভেঙে পড়া, নুয়ে পড়া ! সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে অতীতের গ্রাস!
রুমকী যেন বৃথাই সময় নষ্ট করছে বসে বসে। কিছুটা উৎকণ্ঠিত হয়ে, সে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে এগিয়ে গিয়ে তিন তলায় সানজানাদের ফ্ল্যাটের কলবেলের দিকে। বৃদ্ধা বুয়া দরজা খুলে এগিয়ে আসে, সানজানাকে কোলে নিয়ে।
রুমকীকে দেখে বৃদ্ধা মহিলা যেন প্রাণে শক্তি পেল, কী যে করবাম! সানজানার গা পুইড়ে গেল জ্বরে!
ওর আম্মুকে বলছ!
ফোনে তো পাইলাম না। ফিল্ডে গেছে বইলা অফিস থাইক্যা কইল!
ওর আব্বু!
হেয় কী কোনো দিন কোন্ডায় থায়ে! বাসায় আইসে রাইত কইর্যা। পরতিদিন স্বামী-স্ত্রীয়ে ঝগড়া-বিবাদ। মনডা কয় সব ফালাইয়া থুইয়্যা বাড়িত জাইগা! এরা বলে শিক্ষিত! এতটুকুন মাইয়াডার কথা ভাবে না! যেমন মাও! তেমন বাপ!
রুমকীর ভেতরটা কেমন করে ওঠে! সে চুপচাপ কোনো কথা না বলে, সানজানাকে কোলে নেয়। তারপর তাকে কোলে নিয়ে একা বারান্দায় গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। টগরগাছটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেখে গাছটি বেশ কদিন জল না পেয়ে শুকিয়ে মরে গেছে। শুকিয়ে মরার আরেকটি কারণ হলো, বেশি বেশি ফুল ফোটানোর জন্য এর গোড়ায় বেশি বেশি সার দেওয়া হয়েছে। জল না পেয়ে গাছভর্তি ফুলসহ গাছটা মরে গেছে।
রুমকী যেন কী এক অভিমানে ফুঁসে উঠল। বুয়াকে বলল, বুয়া মরা গাছটাকে ফেলে দেন। সানজানার অসুখটা বেড়ে যাচ্ছে।
২.
রুমকীই সব দায়িত্ব নিয়ে সানজানাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল সন্ধ্যায়। যেতে যেতে সানজানাকে সুন্দর করে ফ্রক পরাল, চুল আঁচড়িয়ে দুবেণি বেঁধে দিলো।
সানজানার নতুন স্যান্ডেলটা দিন, বুয়া। আর একটা ডিম, অল্প তেল দিয়ে পোচ করে দিন। দেখি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার সময় একটু খাওয়াতে পারি কি না! আর আপা ফিরলে যেন আমার বাসায় এসে সানজানাকে নিয়ে যায়। না ফিরা পর্যন্ত ওকে আমার কাছেই রাখব।
শ্যামলীতে এই পাঁচ তলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলাটিতেই রুমকীর ছোট্ট পরিবার নিয়ে বসবাস। ছাদটাকে উপযোগী করে রাখা হয়েছে, বারবিকিউ পার্টি আর বাগানের জন্য। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া। সানজানার আম্মু তাহমিনাকে রুমকী অনেক আগে থেকেই চিনত। তাহমিনা আগে একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াত। তখন রুমকীর একমাত্র ছেলে পড়ত ওই স্কুলটাতেই।
সানজানার সাথে এই হলো রুমকীর সম্পর্ক। সানজানার জন্মের পর থেকেই বিষয়টি এমন। রুমকী এই পাঁচ তলা বাড়ির বাড়িওয়ালি। চমৎকার, সুশ্রী, মানবিক বোধসম্পন্ন একজন সাতাশ-আটাশ বছরের মহিলা। শ্যামলীতে এই পাঁচ তলা বাড়ির সবচেয়ে ওপরের তলাটিতেই রুমকীর ছোট্ট পরিবার নিয়ে বসবাস। ছাদটাকে উপযোগী করে রাখা হয়েছে, বারবিকিউ পার্টি আর বাগানের জন্য। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া। সানজানার আম্মু তাহমিনাকে রুমকী অনেক আগে থেকেই চিনত। তাহমিনা আগে একটা কিন্ডারগার্টেনে পড়াত। তখন রুমকীর একমাত্র ছেলে পড়ত ওই স্কুলটাতেই। তাই একটা চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দুজনের। তাহমিনা বিয়ের পরে বাসা নিতে চাইলে রুমকীই নিজের বাসার তিন তলায় একটু কম ভাড়াতে ম্যানেজ করে দিয়েছিল।
বিয়ের চার বছর পর সানজানার জন্ম। ওর জন্মের সময় কিন্ডারগার্টেনের চাকরি ছেড়ে দিতে হলো তাহমিনাকে। ওর বিয়েটা নিয়ে প্রথম থেকেই সমস্যা ছিল। সানজানার জন্মের আগের কঠিন সময়গুলোতেও সানজানার স্বামী তাকে কোনো সময়ই দিত না। অনেক রাত করে বাড়ি ফেরা তার একটি বদভ্যাসের অংশ। অভিমান, আর জেদ করে করে তাহমিনা অনেক সময় কান্নাকাটি করত, তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবাদ করতে শুরু করল। এসব কথা তো আর চাপা থাকে না। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর বনিবনা না হওয়ার কাহিনি ছড়িয়ে গেল সবর্ত্রই। বাচ্চা পেটে নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ল তাহমিনা। রান্নাও করত না। রুমকীই বেশিরভাগ সময় খাবার নিয়ে যেত। তাছাড়া রুমকীর হাজবেন্ডের পারিবারিকভাবে হোটেলের ব্যাবসা। ওর দুটো ফ্রিজ জুড়ে ভরা থাকত নানা রকম খাবার। বলতে গেলে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পুরো দায়িত্বটাই নিয়েছিল রুমকী। তাহমিনার বাবা-মা নেই। তাই রুমকীর ভেতরের সহজাত মমত্ববোধ—নিজ থেকেই তাহমিনাকে যত্ন করে সুখ পেত। এসব নিয়ে প্রতিবেশীদের নানা রকম মুখরোচক আলোচনাও কানে এসেছিল রুমকীর। কিন্তু রুমকীর মমত্ববোধের স্বভাব এইসব আলোচনাকে মোটেও গ্রাহ্য করেনি। এমনকি সানজানার জন্মের পর তাহমিনার হাজবেন্ড মাহমুদ নানা রকম অসন্তোষ প্রকাশ করত রুমকীর সামনেই। যেন রুমকীই আছে তাদের দাম্পত্য জীবনের সমস্যার মূলে! এমনকি সানজানার সামান্য অসুখ হলেও ভেবে নিত, যে অসুখের উৎস হচ্ছে রুমকীর বাসায় বেশিক্ষণ সময় কাটানো।
তাহমিনা পাত্তাই দিত না এইসব!
প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে সানজানাকে কোলে নিয়ে রুমকীর বাসায় এসেই তাহমিনা বলত, ভাবি কফি খাব।
রুমকীর খুব ভালো লাগত এই সন্ধ্যার সময়টা। কেউ তো আছে! যার জন্য তার সন্ধ্যাটা পূর্ণ হয়ে ওঠে। যেন ওরা দুই বোন! সানজানাকে দুজনের মাঝে বসিয়ে খোশগল্পে কেটে যেত সময়। সানজানাও খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকত।
কী বিয়ে করলাম, কও তো ভাবি! চাকরি, সংসার, বাচ্চা পালা—সব কি আমার একার দায়িত্ব! মাহমুদের কোনো বিবেকবোধই নেই! যা রোজগার করে তার প্রায় সবটাই বন্ধুদের সঙ্গে মদ-গাঁজা খেয়ে ওড়ায়! এটা কী কোনো সংসার! তাহমিনার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে, অভিমানে! আত্মীয়স্বজনের কথায় এই বিয়েটা করাই আমার ঠিক হয়নি।
রুমকী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ঠিক হয়ে যাবে! একটু ধৈর্য ধর!
না ভাবি, ও ঠিক হবার না। আজকাল কথার আগেই গায়ে হাত তোলে! আমি যদি কোথাও চলে যাই, সানজানাকে তুমিই বড়ো করো!
দুর! পাগলের মতো কথা বলো না। একটু স্থির থাকো, দেখো সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে!
আমি আর এই সম্পর্কটা নিতে পারছি না, ভাবি! প্রতিদিন ঘর গুছাই, প্রতিদিন ঘর ভাঙে। প্রতিদিন ঝগড়াঝাঁটি, শ্বশুর-ননদ কাউকে বলা যায় না। মনে হয়, সম্পর্কের ভেতর একটা লুকানো সাপ, সব সময় আমাকে মারার জন্য অপেক্ষা করছে। নিজের ঘরেই পরবাসী মনে হয়।
যা! কত সুন্দর করে ঘর সাজাও তুমি! মানিপ্ল্যান্টগুলো কী সুন্দরভাবে টেবিলে সবুজ হয়ে থাকে! কেন পরবাসী মনে হবে! তোমার সানজানার মতো একটা মিষ্টি মেয়ে আছে! তাকে তো বড়ো করতে হবে!
আমি আর কিছু পারব না ভাবি! আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে! কোনো রকমে অফিস করি! আর অফিসেও এত চাপ! কুলাতে পারছি না!
তুমি বোধ হয় খেয়াল করোনি, আজকাল আমার ফুলের গাছগুলি বিনা কারণেই মরে যায়! কত চেষ্টা করি বাঁচাতে! মানিপ্ল্যান্টগুলো তো একদম হলুদ হয়ে গেছে! দেখো নাই!
দেখেছিলাম! তোমাকে জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম! কেন বলো তো!
কেন জানি না। শুধু মন খারাপ লাগে, এত খরচ করে কিনে আনি! বাসায় আনার একদিন পরেই মারা যায়। তাহমিনার কণ্ঠে তীব্র হতাশার সুর ঝরে পড়ে। বেশ কয়েকটা নতুন টগর কিনেছি, এগুলিও মারা যাবে দেখো!
রুমকী চুপ করে শোনে, কী বলা উচিত বুঝতে পারে না। সে জানে, সম্পর্ক যখন আর টেকানো যায় না, তখন চারপাশে ভরে থাকে সম্পর্কের ছেড়ে যাওয়া তীব্র বমির গন্ধ! আর তার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় ওয়াক থু শব্দে ভরে যায় চারপাশ। সব মরে যায়, সবাই মরে যায়! আবার নতুন করে সবকিছু প্রেম দিয়ে সাজাতে হয়! আহা! ওদের এত মিষ্টি একটা মেয়ে আছে! তবু ওরা কেমন যেন হয়ে গেছে! পাগলা কুকুরের মতো!
নিজেদের একান্ত ভাবনাগুলো নিজেদের মধ্যে রেখেই ওরা দুজনেই তাকিয়ে দেখে সানজানাকে। সানজানা খেলে আপন মনে, রুমকীর বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে, সামনে ছিটানো রুমকীর দেওয়া নতুন নতুন খেলনাগুলো। যেগুলো প্রতিমাসেই রুমকী সানজানার জন্য কিনবেই।
৩.
শরতের শেষদিকটায় শিউলি ফোটার সময়টা যখন ফুরিয়ে আসতে চায়, বিলিম্বিগাছের পাতাগুলি তখন অল্প হলুদ হতে থাকে শীতের শুরুতেই ঝরবে বলে। রুমকীর এই পরিবর্তন মোটেই ভালো লাগে না। সব সবুজেরা হলুদ হয়ে যায় কেন! মৃত্যুর আগে তাদের পরিবর্তন দেখাতে চায় বলে!
প্রতিদিন তার সকাল কাটে ছাদবাগানে। সে চায় পুরো ছাদ বাগান ছেয়ে যাক চকচকে সবুজে। এতটুকু ময়লা, রোগা বিবর্ণ পাতা, টবের পাশে বা কোণে পড়ে থাকা পচে যাওয়া ময়লা পাতার ছোট্ট অংশটুকুও সে নিজ হাতে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এক অপরূপ সুখে সবুজ বাগানে বসে সুখ কুড়াতে কুড়াতে। বলতে গেলে, এই অপরূপ সকালটার ঘোর সারা দিন তাকে স্নিগ্ধ করে রাখে। বাগানের পাখিগুলো যখন সকাল জুড়ে প্রচণ্ড কলকাকলি করতে থাকে, রুমকী সম্মোহিতের মতোই জাদুটানে এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপর নিজের ভেতর থেকে নিজেকে তুলে নিয়ে সময় কাটায় বাগানে ফুটে থাকা উজ্জ্বল ফুলদের ভিড়ে ।
ছেলের বাবা ধানমন্ডিতে খাবারের দোকানের ব্যাবসা চালায়। রুমকী এতটাই ঝাড়া হাত-পা যে তাকে বিয়ের পর থেকে কোনো দিন রান্নাই করতে হয়নি। তার স্বামী ইমরান এতটাই ভালো রান্না করত যে, রুমকী সেই রকম রান্না কোনো দিনই করতে পারবে না ভেবে জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে রান্নাঘর থেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
তার ছিমছাম সংসার। একমাত্র ছেলে রুবেল পড়াশোনায় ভালো। সামনেই স্কুলের শেষ পরীক্ষা। ছেলের বাবা ধানমন্ডিতে খাবারের দোকানের ব্যাবসা চালায়। রুমকী এতটাই ঝাড়া হাত-পা যে তাকে বিয়ের পর থেকে কোনো দিন রান্নাই করতে হয়নি। তার স্বামী ইমরান এতটাই ভালো রান্না করত যে, রুমকী সেই রকম রান্না কোনো দিনই করতে পারবে না ভেবে জীবনের শুরু থেকেই নিজেকে রান্নাঘর থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ইমরান খুব সাদাসিধা ছেলে। হোটেল নিয়েই তার যাবতীয় চিন্তা! ছেলেটাও হয়েছে বাপের ন্যাওটা। খুব ছোটো বয়স থেকেই নিজে নিজে ময়দা-ডিম-ঘি-চিনি মিশিয়ে বেকিংয়ের ট্রে সাজাত। তারপর ইলেকট্রিক ওভেনে দিয়ে তৈরি করত চমৎকার নরম ফুলে ওঠা কেক। ফুলে ওঠা কেকের আনন্দে, সে কেকের ওপর নানা রকম নকশা করত। সেরকম দুপিস কেক খাবার পর সারা দিন আর কিছুই খেতে চাইত না। তাছাড়া হোটেলের তন্দুরি রুটি, ঝাল মাংস, নানা রকম সবজি ও ফলের সালাদের পর বাসায় তৈরি রান্নার কোনো ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষাও কোনো দিন দেখায়নি রুবেল। বরং রুমকীরই প্রায়ই মাঝে মাঝে ইচ্ছে হতো পেঁয়াজ আর কাঁচামরিচ কুচিয়ে চমৎকার এক ডিমের মামলেট বানিয়ে সাদা সাদা ভাতের সঙ্গে মেখে খেতে।
আম্মু, ডিম দিয়ে মেখে সাদা ভাত তোমার এত প্রিয় কেন!
ছেলের প্রশ্নে রূমকী হাসে। বলে আমার বাবার তো, তোমার বাবার মতো হোটেল ছিল না। তাই আমার মা যে সাদা ভাত রাঁধত তাই আমরা দুই ভাইবোন মিলে ডিম ভাজি দিয়ে খেতাম। সে স্বাদ আমার মুখে সব সময় ভালো লাগে।
আম্মু, তোমার ভাইটা কই! কোথায় থাকে! আমাদের বাসায় আসে না কেন!
ছেলের প্রশ্নে রুমকী বিচলিত হয়ে ওঠে! সে কী বলবে ছেলেকে! সে সব অন্ধকার নেমে আসা ঝড়ের দিনের কথা! খুব ভালো ছাত্র ছিল তার একমাত্র ভাই, বুয়েটে পড়ত। একটি চমৎকার মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তারপর!
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রুবেল অস্থির হয়ে ওঠে। আম্মু বলো না, সেই মামাটা কই! তাকে তো আমি মামা ডাকব তাই না! তাহলে নানুর বাসায় তাকে দেখি না কেন!
হঠাৎ কোনো সঠিক উত্তর জোগাতে না পেরে রুমকী বলে ওঠে, সে তো বিদেশে থাকে। তুমি কী করে তাকে দেখতে পাবে!
কেন যে জগতে অনেক কিছু অপ্রিয় কথা হঠাৎ মাটি খুড়ে উঠে আসতে চায় কে যানে! এসব কথা তো অনেক আগেই মাটিচাপা দিয়েছিল সে! তবু সত্যগুলো ফাঁক পেলেই বেরিয়ে আসতে চায়, যখন-তখন। এই যে, কেন সানজানাকে তার এত ভালো লাগে! কেন ভালো লাগে এই সাদা সাদা ভাত! বা সাদা সাদা টগর ফুল!
বিয়ের আগে মধ্যবিত্ত সংসারে রুমকীর জীবন ছিল দারুণ সরল। তখনো রুমকী জানেনি, অন্ধকারের রূপ। চাঁদ, আলো, জ্যোৎস্নায় সম্মোহিত মধ্যবিত্ত জীবনের স্নিগ্ধ দিনকাল। তবু ছুরির ফলারা ঠিক রয়ে যায় লুকিয়ে। একদিন পিঠে এসে লাগে তার তীক্ষ্ন আঘাত। রুমকীর বড়ো ভাই বুয়েটে পড়া অবস্থায় হঠাৎ একদিন রাতে তার সহপাঠীকে বিয়ে করে সোজা বাসায় নিয়ে আসে। মেয়ের বাবা কিছুতেই মানবে না এই বিয়ে। রুমকীর মধ্যবিত্ত বাবা-মা কিছুতেই পেরে উঠল না মেয়েপক্ষের সঙ্গে। অথচ বিয়েটা তখন সামাজিকভাবে মেনে নেওয়া খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। কারণ মেয়েটি হয়ে পড়েছিল সন্তান সম্ভবা। নানা রকম টানাহ্যাঁচড়ায় বিয়েটা মাত্র এক বছর টিকেছিল। একটি মেয়ে সন্তান জন্ম দিয়েই মেয়েটি মারা যায়। ওর এই দুর্ঘটনার পেছনে ছিল ওর বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া প্রচণ্ড মানসিক চাপ। রুমকীদের মধ্যবিত্ত স্নিগ্ধ জীবন যেন অনেকগুলো সম্পর্ক আর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে করতে ছোট্ট নতুন মানুষটিকে ঘিরে জীবনের সকল অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে চাইছিল।
কিন্তু রুমকীর ভাইটি তখন আক্রান্ত হয়ে পড়ল ক্রনিক ডিপ্রেশনে। ওই মানসিক স্তর থেকে আর ফেরানো গেল না। ছোট্ট মেয়েটির পুরো দায়িত্ব তখন রুমকীর। কোথায় তার নাওয়া-খাওয়া! সারা দিনরাত শুধু ছোট্ট শিশুটাকে নিয়ে চিন্তা। অন্যদিকে ভাইটি মোটেই সুস্থ নয়। একেক দিন তার মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ থাকে যে, সে বাসার সবকিছু ভাঙচুর করে, ছোট্ট মেয়েটাকেও আছাড় মারতে চায়। সুইসাইডের প্রতি তীব্র আসক্তি জন্মাতে থাকে, পরিবারের সবার অগোচরে। আর তারপর, যা হবার তাই ঘটে। একদিন রাতে সবাই যখন ঘুমে, তখনই সিলিং ফ্যানের রশিতে ঝুলেছিল। কেউ টের পেল না। শুধু ছোট্ট শিশুটা রুমকীর বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কী কারণে যেন কেঁদে উঠেছিল। জীবনের সেসব আধপোড়া ইতিহাসের কথা, রুমকী কাউকে বলে না। ছেলে কে নয়, স্বামীকে নয়! কাউকেই না। অতীতের সেই তীক্ষ্ন ছুরির ফলাটি অসহ্য ব্যথা নিয়ে রক্তের মধ্যে স্থির হয়ে থাকে। ভাইয়ের মেয়েটিকে রুমকী কত দিন দেখেনি। অথচ, তাকে বড়ো করেছিল সমস্ত শরীর ও মন দিয়ে। পেটে ধরেনি, তাতে কী! কত চোখের জল, রাত জাগা সময়ের ভার, পাতা-পাতা ডেকে চেঁচিয়ে ওঠার দিনরাত্রি। এখন কোথায় সে! বড়ো হচ্ছে নানা-নানিদের কাছে। এখন রুমকীকে দেখলে সে চিনতে পারবে! মনে হয় না! তিন বছরের কথা কী ওর মনে থাকবে! নিশ্চয়ই এত দিনে সব ভুলে গেছে সে! জীবন বুঝি এমনই! অদৃশ্য জালে প্রত্যেককে আটকে রাখে, নিজ নিজ মোহনায়।
৪.
ক্রমাগত টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে সম্পর্কটা থাকা আর না থাকার মাঝে এসে আটকে রইল। তসলিমা আর মাহমুদের এই সম্পর্কটা ভেঙে গেলেই ভালো হতো। রুমকী এমনটাই ভাবে। মাহমুদ আজকাল প্রায় পনেরো দিন পর কখনো কখনো বাসায় ফিরে। কখনো মধ্যরাতে, কখনো ভোরবেলায়। রুমকী টের পায় তাহমিনার বিষণ্নতা। তসলিমার চোখের নিচে কালি পড়ে থাকে। অনেক দামি মেকাপ দিয়ে সে তাকে ঢাকতে চায়। তসলিমার হাতে, গলায় অনেক কালশিটে দাগ। রুমকী জানে এগুলো দাম্পত্য ঝগড়ার ফল, কিন্তু এসব প্রসঙ্গ টেনে কখনো তাকে বিব্রত করে না। আজকাল সানজানাও স্তব্ধ হয়ে থাকে, চঞ্চলতা করে না। এমনকি রুমকীর বাসায় নতুন খেলনা দিলেও খেলতে চায় না সে। যেন ছোট্ট হলেও সে ঠিক ঠিক টের পেয়ে যায় সম্পর্কের অন্ধকার ।
গত দুদিন ধরে কোনো খোঁজ নেই তসলিমার। রুমকী বেশ কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করে দেখেছে, ফোন কল আনরিচেকল। বুয়া সকাল বেলায় রুমকীর কাছে সানজানাকে রেখে জানান দিয়ে গেছে, তাহমিনা গতরাতে ফেরেনি। খুব ভয় লাগতে থাকে রুমকীর। সে অনেকবার ফোনে ট্রাই করছে, আর ভেতরে ভেতরে খুঁজে বেড়াচ্ছে তসলিমাকে।
কোথায় যেতে পারে! ওর শ্বশুরবাড়িতে! না! তা যাবে না। ননদের বাসায় যেতে পারে! কিন্তু সেখানে গেলে নিশ্চয়ই রুমকীকে বলে যেত! তাহলে কি ফিল্ডে গিয়ে খারাপ কিছু ঘটেছে! তাই হয়তো ফোনটা আনরিচেবল। কাকে জিজ্ঞেস করলে সঠিক তথ্যটা জানবে, ঠিক বুঝতে পারে না। তবে কি ইমরানকে খোঁজখবর নিতে বলবে! এসব ভাবতে ভাবতে প্রায় রাত আটটাই বেজে গেল! সানজানাও একটু পরপর অস্থির হয়ে উঠছে! প্রতিদিন রুমকীর হাতে খায়, আজ খেতে চাচ্ছে না। সাদা ফুল ফুল জামায় তাকে মিষ্টি ফুলপরির মতো দেখতে লাগছে!
ভাত আর মুরগির ঝোল মুখের সামনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বলছে, আমার আম্মু কই! কই আম্মু!
আম্মু একটু পর আসবে! তুমি খেয়ে নাও!
না, আম্মু আসবে না! আম্মু বলেছে।
আসবে!
রুমকী ফোনের গ্যালারিতে খুঁজে খুঁজে তসলিমার ছবিগুলো দেখায়। সানজানা চেয়ে থাকে তার মায়ের ছবি আর ভিডিয়োতে। এই ফাঁকে ধীরে ধীরে খেয়ে নেয় খাবার। হঠাৎ একটি কল আসার শব্দে রুমকী ফিরে তাকায়। একটা মিসড কল—সঙ্গে একটা এসএমএস।
প্লিজ, ওয়াচ হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিয়ো।
রুমকী সঙ্গে সঙ্গেই হোয়াটসঅ্যাপের ভিডিয়োতে যায়।
ভিডিয়োটা পাঠানো হয়েছে তসলিমার ফোন থেকেই। আশ্চর্য! তবে কল যাচ্ছে না কেন!
সমুদ্রের তীরে দাঁড়ানো তসলিমা। সঙ্গে একজন চমৎকার দেখতে যুবক। দুজনেই তাকিয়ে আছে সমুদ্রের বিশাল জলরাশির দিকে। তারপর তসলিমা এগিয়ে যাচ্ছে জলের দিকে ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে। একটা বড়ো ঢেউ এগিয়ে আসছে—আরও আসছে একটার পর একটা—এবার ওর কালো চুলের ওপর ভিডিয়োটা এখানেই শেষ।
পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন এসএমএস এলো ওই অচেনা নাম্বার থেকে। আমি আবীর। তসলিমার বন্ধু । একসাথে ফিল্ডে এসেছিলাম। সমুদ্রের কাছে।
পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন এসএমএস এলো ওই অচেনা নাম্বার থেকে। আমি আবীর। তসলিমার বন্ধু । একসাথে ফিল্ডে এসেছিলাম। সমুদ্রের কাছে। বুঝতে পারিনি, এমনভাবে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আর এক সেকেন্ড দেরি হলেই স্রোতে ভেসে যেত। এখন হাসপাতালে আছে। আশা করছি, আগামীকাল দুপরের ভেতর সুস্থ হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। ওর ফোনটা মিসিং। প্রয়োজনে এই নাম্বারে কল দেবেন।
রুমকী ভাবল, স্রেফ দুর্ঘটনা না আত্মহত্যার চেষ্টা! যাই হোক! ভয় কেটে গেছে। বেডরুমের বিছানায় ঘুমস্ত সানজানার মুখের দিকে তাকিয়ে তার নির্ভার লাগে। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় সে! দেখে সাদা-সাদা টগর ফুটেছে সারা ব্যালকনি জুড়ে।
মণিকা চক্রবর্তীর জন্ম কুমিল্লায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। লেখালেখি করছেন দীর্ঘকাল ধরে। মূলত গল্প ও উপন্যাস লিখে থাকেন। প্রথম উপন্যাস ‘অতঃপর নিজের কাছে’ প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে, একুশে বইমেলায়। দ্বিতীয় উপন্যাস,‘দিগন্ত ঢেউয়ের ওপারে’,২০১১ সালে, প্রকাশিত হয়। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘বর্ণান্ধ রাত ও ডায়েরি’। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নভেলা ‘মন্দ্রসপ্তক’, এবং পরবতীতে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘হাওয়ার সংকেত ও অন্যান্য’। ২০১৯ এ প্রকাশিত নভেলা ‘অ্যাম্ফিখিয়েটার’ এবং ২০২১ বইমেলায় প্রকাশিত দ্বিভাষিক কাব্যগ্রন্থ ‘অপার্থিব গান’।২০২২ বইমেলায় প্রকাশিত নভেলা ‘যখন ভেসে এসেছিল সমুদ্র ঝিনুক’। তিনি সংগীতের অনুরাগী, বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনের একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী।