বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

শূন্যপূরণ : ফয়জুল ইসলাম

0

শেষপর্যন্ত পয়লা বোশেখের ছুটিতে পাবনায় যেতে পারল মনু! সেই ১৯৫০ সনে ঢাকা-পাবনায় যাতায়াত করাটা বেজায় কঠিন ছিল— পয়লাতে সদরঘাট থেকে স্টিমারে উঠতে হবে, সেখান থেকে নামতে হবে গোয়ালন্দে, গোয়ালন্দ থেকে ট্রেন ধরে যেতে হবে দর্শনায়, দর্শনাতে ট্রেন বদল করে ঈশ্বরদি জংশন, সেখান থেকে বাসে চেপে তারপর পাবনা শহর। এই করতেই দিনটা শেষ হয়ে যেত তখন! যাতায়াতের এই ঝক্কির কারণেই ঢাকা থেকে মনুর পাবনাতে যাওয়া পড়ছিল কম। এবারও তাইই হলো— স্টিমার, ট্রেন আর বাসেই খরচ হয়ে গেল চৈত্রসংক্রান্তির পুরো দিনটা, রাতও নেমে এলো! টিনের তোরঙ্গ হাতে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মনু রাত ন’টার দিকে তাদের হেমসাগর লেনের বাসার চৌহদ্দিতে ঢুকতেই দেখতে পেল, বৈঠকখানার বারান্দায় অন্ধকারে বসে গড়গড়া টানছে তার আব্বা আনোয়ার হোসেন। এর অর্থ এই যে সোনাপট্টির রড-সিমেন্টের দোকান বন্ধ করে আনোয়ার হোসেন বাসায় ফিরে এসেছে আগেই। অন্ধকারে মনুকে ঠাওর করে খুব খুশি হয়ে আনোয়ার বলে ওঠে, ‘আরে! একটা খবর দিবি না? যাক! ভালোই হলো যে তুই এসেছিস!’ যাতায়াতের ধকলের কারণে ক্লান্ত মনু ‘কী ভালো হলো’— তা আর জিজ্ঞাসা করবার মতো শক্তি পায় না! কাজেই সে ‘হু-হা’ করে বাসার ভেতরে ঢুকে যায়।

কুয়োতলায় গোসল সেরে রান্নাঘরের পাটিতে খেতে বসলে মনু দেখতে পায়, আগেই সেখানে আসন নিয়েছে আনোয়ার। মনু আর আনোয়ারের পাতে ভাত আর সবজি বেড়ে দিতে দিতে সামনের পিঁড়িতে বসা মনুর মা রাশিদা খাতুন অনুযোগ নিয়ে বলে, ‘গুনে গুনে পাঁচ মাস পরে বাড়িতে এলি তুই! ইউনিভার্সিটিতে যে তোর কী মধু আছে তা বুঝি না বাপু! তা এ যাত্রায় ক’দিন থাকা হবে, শুনি?’

আনোয়ারের পাতে ভাত আর সবজি বেড়ে দিতে দিতে সামনের পিঁড়িতে বসা মনুর মা রাশিদা খাতুন অনুযোগ নিয়ে বলে, ‘গুনে গুনে পাঁচ মাস পরে বাড়িতে এলি তুই! ইউনিভার্সিটিতে যে তোর কী মধু আছে তা বুঝি না বাপু! তা এ যাত্রায় ক’দিন থাকা হবে, শুনি?’

মৃদু হেসে মনু তার মা’কে জানায়, সে এবার চার দিন বাড়িতে থাকবে; তারপর ফিরে যাবে ঢাকায়। বেশি দিন ক্লাস কামাই দেওয়াটা ঠিক হবে না। সামনেই ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের হ্যাপা আছে। এই উত্তরের পরে মনুর মনে হয়, হারিক্যানের আলো-আঁধারিতে ভেসে থাকা তার মা’র মুখটা আরও আঁধার হয়ে গেল, থেমে গেল মা। সেই নিরবতার ভেতর থেকে জেগে উঠল আনোয়ারের জলদ গম্ভীর কন্ঠ, ‘আর ক’টা দিন থেকে যাওয়া যায় না?’

সপ্রশ্নে আনোয়ারের দিকে তাকালে বেশ অস্বস্তি নিয়েই, নিভু নিভু স্বরে আনোয়ার মনুকে বলে, ‘কোলকাতায় যাওয়ার দরকার ছিল একটু! তোকে নিয়ে যেতাম সাথে করে!’

আনোয়ারের উত্তরের পরে মনুর বুঝতে আর বাকি রইল না যে কোলকাতায় আনোয়ারের যে দোকানটা রয়ে গেছে তার কোনো গতি হয়নি এখন পর্যন্ত। তিরিশ সনে শিয়ালদা’র চোরবাজার-এলাকায় একটা দোকান কিনেছিল আনোয়ার। দোকানটা শিয়ালদা রেলস্টেশনের পশ্চিমে— সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে মোটেই দূরে নয়। সেটা ভাড়া নিয়ে এই মুহূর্তে সেখানে যে ব্যক্তি জুতোর কারবার বসিয়েছে তার নাম যতীন প্রামাণিক, বাড়ি আসানসোলে। এই লাইনেই রয়েছে গোটা পঞ্চাশেক জুতোর দোকান। সাতচল্লিশের অগাস্টে দেশবিভাগের পর থেকেই দোকানটা বিক্রি করে দেবে বলে মনস্থির করেছে আনোয়ার। তার যুক্তি পরিষ্কার— এক দেশে বাস করে অন্য দেশে সম্পত্তি রাখাটা দিনকে দিন কষ্টকর একটা কাজ হয়ে উঠবে, সম্পত্তি বারোভূতে লুটেপুটে খাবে শেষপর্যন্ত। কাজেই দোকানটা বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। আটচল্লিশের পয়লা দিকে একবার কোলকাতা গিয়ে সে যতীনকে তার অভিপ্রায় জানিয়ে এসেছিল; বলেছিল, ভালো পার্টি পেলে খবর দিতে; জানিয়েছিল, তিরিশ হাজার রুপির নিচে সে নামবে না। কোলকাতা থেকে পাবনায় ফিরে আসার পর আনোয়ার আর যতীনের ভেতরে চিঠি চালাচালি হয়েছে কমপক্ষে আট বার। যতীনের একই ভাষ্য— দোকানের দাম তো উঠচে না কত্তা! মাইরি বলচি, কুড়ি হাজার সাধচে সকলেই! যতীনের কথায় বিচলিত হয়েছিল আনোয়ার; রেগেও গিয়েছিল বেশ। যতীনকে সে চিঠিতে লিখেছিল— চারশ স্কয়ার ফিটের এত বড়ো একখানা দোকান কি আর কুড়ি হাজারে ছেড়ে দেওয়া যায়? বললেই হলো? শেষ চিঠিতে যতীনকে আনোয়ার এমনটাও বলেছিল, যতীন না হয় নিজেই চোরবাজারের দোকানটা কিনে নিক! সে ক্ষেত্রে দোকানের দাম কিছুটা কমিয়ে রাখা যাবে। উত্তরে যতীন জানিয়েছে, সেটা উত্তম প্রস্তাব। তবে সে দশ হাজারের ওপরে দাম দিতে পারবে না। টাকাপয়সার সঙ্কট চলছে এই মুহূর্তে। নতুবা সে থুতু দিয়ে গুনে গুনে তিরিশ হাজার রুপিই দিত! এসব প্যাঁচের কথায় বিরক্ত হয়ে যতীনকে জানিয়ে দিয়েছে আনোয়ার— এত কমে দোকান ছাড়ব না কিছুতেই! বুয়েচ?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ঠিকানায় মাস তিনেক আগে পাঠানো এক চিঠিতে মনুকে আনোয়ার এসব বৃত্তান্ত জানিয়েছিল। আনোয়ারের কোলকাতায় যাবার পরিকল্পনা শুনে তাই মনুর ধারণা হয়, চোরবাজারের দোকানটা বিক্রি করে দেবার ব্যাপারটা এখনও ঝুলেই আছে। কথায় কথায় মা’র কাছে সে শুনেছিল, দোকানভাড়া বাবদ টাকাটাও পাঠাচ্ছে না যতীন, পাঠালেও তা নিয়মিত নয়। দেশবিভাগের পর থেকে স্থাবর সম্পত্তি তো এভাবে গলার কাঁটা হয়েছে অনেকেরই! হাতি পাঁকে পড়লে যা হয়— চামচিকাও ঠোকায় তাকে! মনু ভাবে, এই মুহূর্তে দোকানটা বিক্রি না হোক, ভাড়ার টাকাটা যতীন হুণ্ডি করে বা লোক মারফত পাঠালে তো কোনো ক্ষতি হয় না! সে কাজটা আদৌ হচ্ছে বলে মনে হয় না। চোরবাজারের দোকানটা যে জলদিই বিক্রি করে দেওয়া প্রয়োজন এ বিষয়ে মনুর আর তাই সংশয় রইল না কোনো। অবশ্য সেই কাজটা যে সহজে হয়ে যাবে— এমনটা তার মনে হয়নি। কোলকাতাতে গিয়ে মাঝ থেকে কমপক্ষে এক সপ্তাহ ক্লাস কামাই হয়ে যাবে! এ নিয়ে মনটায় খচখচ লেগে থাকে তার।

পরদিনে অর্থাৎ পয়লা বোশেখে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল বের করে মনু, তারপর সে রাঘবপুরে তার বন্ধু বদির বাসায় বেড়াতে যায়। জোড় বাংলো-এলাকার পিযুষকান্তি আর মোস্তফাকে ডাকিয়ে নিয়ে আসে বদি। আড্ডার ভেতরে বার বার ঢুকে পড়ে তাদের বাল্যবন্ধু স্বপন সান্যাল, তরু ঘোষ, বিপীন লাহিড়ী, অপর্ণা মজুমদার আর রমা দাসগুপ্তার কথা। সাতচল্লিশে দেশবিভাগের পর অগাস্ট মাসেই সপরিবারে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে স্বপন, তরু, বিপীন আর অপর্ণা। রমা কোলকাতায় গিয়েছিল সবার আগে। ছিচল্লিশের অগাস্টে কোলকাতায় হিন্দু-মুসলিমদের দাঙ্গা ঘটে যাবার পরে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল রমা দাশগুপ্তারা। তাদের আতঙ্কের বাস্তব কারণও ছিল বটে— পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকামী পড়শিদের অনেকেরই সহিংস চেহারাটা নগ্ন হয়ে পড়ছিল তখন। এ কারণে রাতের অন্ধকারে রমাকে কোলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছিল তার বাবা বসন্ত দাশগুপ্ত। ওপারে চলে যাওয়া বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যাওয়াতে পরিতাপে চুক চুক করছিল মনুরা চারজনেই। মনু কোলকাতায় যাচ্ছে শুনে বদি বলেছিল, ‘তোদের দোকানের কোনো গতি হোক বা না হোক, রমা আর স্বপনের সাথে অন্তত দেখা করতে পারবি তুই! সেটাই বা কম কী?’ রমার মতো করে স্বপনও যে এই মুহূর্তে কোলকাতাতেই থাকছে তা জানা গেছে মোস্তফাকে লেখা স্বপনের একটা চিঠি থেকে। তরু, বিপীন আর অপর্ণা পশ্চিমবঙ্গের কোথায় আছে সে খবর তখনও পাবনাতে এসে পৌঁছোয়নি।

বদির খাতা থেকে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে সেখানে স্বপনের ঠিকানাটা লিখে দেয় পিষুষকান্তি। মনুর কানের কাছে ফিসফিস করে পিষুষকান্তি বলেছিল, ‘স্বপনের সাথে দেখা হলে তোরা দু’জনে মিলে অপর্ণাকে খুঁজে বের করিস কিন্তু! অপর্ণাকে বলিস, দুর্গাপুজোর আগেই আমরা ওপারে চলে যাব। ও যেন অপেক্ষা করে!’

কলেজ স্ট্রিটের একটা ছাপাখানায় স্বপন কম্পোজিটারের কাজ করছে তখন। ছাপাখানাটার নাম ‘আদি চিত্রলেখা প্রিন্টিং প্রেস’। বদির খাতা থেকে এক টুকরো কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে সেখানে স্বপনের ঠিকানাটা লিখে দেয় পিষুষকান্তি। মনুর কানের কাছে ফিসফিস করে পিষুষকান্তি বলেছিল, ‘স্বপনের সাথে দেখা হলে তোরা দু’জনে মিলে অপর্ণাকে খুঁজে বের করিস কিন্তু! অপর্ণাকে বলিস, দুর্গাপুজোর আগেই আমরা ওপারে চলে যাব। ও যেন অপেক্ষা করে!’

বিস্ময় নিয়ে পিযুষকান্তির চোখের দিকে সোজা তাকিয়েছিল মনু। তার মনের অজান্তেই তার মুখ থেকে একটা প্রশ্ন বেরিয়ে গেল, ‘শেষে কিনা তুইও?’

অপরাধবোধেই হয়তোবা, নুইয়ে পড়েছিল পিযুষকান্তির মাথাটা। মিনমিন করতে করতে সে নিজের মনে ঘাপটি মেরে থাকা ইচ্ছেটাকে ঢাকতে চায়, ‘আসলে হয়েছে কী জানিস— বারাসাতে আমার যে মামা থাকেন, তিনি খুব করে ধরেছেনরে! মা আর বাবা না করতে পারছেন না কিছুতেই!’

অবাক হয়ে পিযুষকান্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিল মনু, ‘তোর মামারা তো সবাই চাটমোহরে থাকেন বলেই জানি! বারাসাতে তাদের কেউ আছেন— এটা তো জানতাম না!’

এমন প্রশ্নে তাল হারিয়ে পিযুষকান্তি উত্তর দেয়, ‘লতায়-পাতায় আরকি! একই রক্ত তো!’

গম্ভীর হয়ে গিয়ে পিযুষকান্তিকে আর কিছু বলে না মনু।

বদির কথা থেকে জানা যায়, দক্ষিণ কোলকাতা থেকে ভাসতে ভাসতে উত্তর-পশ্চিমের শহরতলী ডানকুনিতে গিয়ে বাড়িভাড়া নিয়েছে স্বপনের বাবা। ওখানে সান্যালদের একটা ঘর রয়েছে আগে থেকেই। তিরিশ সনে ঢাকায় দাঙ্গা লেগে যাবার পরে স্বপনের বাবার কাকাতো ভাই প্রাণভয়ে রাজবাড়ী থেকে পশ্চিমবাংলায় পাড়ি জমিয়েছিল। তাদের ভরসাতেই স্বপনদের ডানকুনি যাওয়া। ছাপাখানাটায় কম্পোজিটারের কাজ করতে ডানকুনি থেকে প্রতিদিন কলেজ স্ট্রিটে যায় স্বপন। কাজেই মনু ডানকুনি পর্যন্ত না গিয়ে বরং কলেজ স্ট্রিটেই খুঁজে নিতে পারে স্বপনকে— এমনটাই পরামর্শ দেয় বদি। মোস্তফা মন্তব্য করে, স্বপনকে খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলেও রমার সাথে দেখা করাটা তো কোনো ঘটনাই হবে না! তার কারণ হলো, রমাদের বউবাজারের বাসাটা মনুর আব্বা আনোয়ার হোসেন চেনে ভালোভাবেই। দেশবিভাগের ঠিক পর দিয়ে আনোয়ার হোসেন একবার কোনো একটা কাজে কোলকাতায় গিয়েছিল, থেকেছিল রমাদের কোলকাতার ভাড়াবাসায়।

বিকেলের দিকে মনু তার ঘরে শুয়ে শুয়ে গড়াচ্ছিল আর আকাশবাণীতে প্রচারিত ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান শুনছিল ট্রানজিস্টারে। তখন তার আম্মা রাশিদা খাতুন তার পাশে এসে বসেছিল। রাশিদা বলেছিল, মনুর আব্বার কোলকাতা যেতে চাওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ আছে বটে। আনোয়ারের বাল্যবন্ধু বসন্ত দাশগুপ্তর ফেলে যাওয়া সাদা রঙের একতলা বাড়িটার ওপরে সাতচল্লিশের অগাস্ট থেকেই নজর পড়েছে পাথরতলার সোহরাব মোল্লার। হেমসাগর লেনে ঢুকতেই পয়লাতে যে সাদা রঙের একতলা পড়বে সেটার কথা হচ্ছে এখানে। তার ঠিক পেছনের বাড়িটাই মনুদের। বসন্ত দাশগুপ্তের পৈতৃক সূত্রে যে বাড়িটা পেয়েছে তার দালানটার জানালা-দরোজাগুলোর রং গাঢ় সবুজ, সামনে সুপারিগাছের সার, সুপারি গাছগুলো থেকে মেইন রোড পর্যন্ত মস্তবড়ো একটা মাঠ, পেছনে রয়েছে একটা উঠোন আর সবজির বাগান। সব মিলিয়ে বসন্ত দাশগুপ্তের বসতবাটির জায়গা হবে বিঘা পনের। বছর আড়াই ধরে এক্কবারে ফাঁকা পড়ে থাকা এমন মস্তবড়ো একটা জমি আর সুন্দর দালানের দিকে কার না চোখ পড়বে? পড়েছেও। কিন্তু এলাকাটায় সোহরাব মোল্লা সবচাইতে প্রভাবশালী মুসলিম লিগার বলে বাড়িটা কম দামে কিনে নিতে অথবা দখল করতে আর কেউ এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সাথে যোগসাজশে শত্রুসম্পত্তির তালিকায় দু’বার বসন্তের বাড়িটার নাম ঢুকিয়েছে সোহরাব মোল্লা। দু’বারই পাবনা কালেক্টরেটে জোর তদ্বির করে শত্রুসম্পত্তির তালিকা থেকে বাড়িটার নাম কাটিয়েছে আনোয়ার। তা না-হলে কবেই তো এই বাড়িটা নিরানব্বই বছরের জন্য সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে ফেলত সোহরাব মোল্লা! আর সব দখলবাজ মানুষের মতো এই ধান্ধাতেই যে সোহরাব মোল্লা বসে আছে সেটা বোঝাই যায়। কিন্তু এভাবে আর কত দিন বসন্ত দাশগুপ্তর বাড়িটা বেদখল হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে আটকে রাখা সম্ভব হবে? এবার কোলকাতায় গিয়ে তাই বসন্তের সাথে বসে একটা পথ বের করতে চায় আনোয়ার। ব্যাপারটাকে কর্তব্য বলেই মনে করে আনোয়ার কেননা ওপারে যাবার সময় তার হাতেই বাড়িটা হাওলা করে দিয়ে গেছে বসন্ত।

সব শুনে ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে রাশিদাকে প্রশ্ন করে মনু— বসন্ত কাকার বাড়ি শত্রুসম্পত্তি হতে যাবে কেন? তিনি পাকিস্তানের শত্রু নাকি? এই পাবনাতেই জন্মেছিলেন তিনি, এখানেই তিনি বড়ো হয়েছেন, পড়াশুনা করেছেন, পড়িয়েছেন গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউটে! তাই নয় কি? সাতচল্লিশে প্রাণের ভয়ে নিজের বাড়ি ফেলে কোলকাতায় চলে গেলেন বলেই কি তিনি পাকিস্তানের শত্রু বলে নামাঙ্কিত হবেন? এ কেমন ধারার কথা? বসন্ত কাকা তো তার জন্মভূমিতে ফিরেও আসতে পারেন কোনো না কোনো দিন! পাকিস্তানপ্রেমীদের চোটপাট তো আর সারা জীবন সহ্য করা হবে না! এ দেশটা সকলেরই— সব বাঙালির! উত্তেজিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা থেকে শেখা এমন আরও কিছু বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিল মনু।

কিন্তু রাশিদা তাকে থামাল এই বলে, ‘কোন ভরসায় বসন্তদা তার জন্মভূমিতে ফিরবেন? কচুকাটা হতে? এপারে বল, আর ওপারে বল সবই তো সম্পত্তি বেদখলেরই রাজনীতি! আমাদের আশপাশের মানুষজন কেমন লোভী আর হিংস্র হয়ে উঠেছে, দেখেছিস? তাদেরকে থামাবে কে, শুনি? এসব বুঝেও বৃথা মুখ খরচ করছিস কেন?’

একটু চুপ থেকে মনু বলেছিল, বসন্ত কাকাদের দেশে ফেরাটাই যদি দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে থাকে তবে আর এসব বাড়িঘরের মায়ায় পড়ে থেকে লাভটা কী? বসন্ত কাকার উচিত হবে হেমসাগর লেনের বাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া।

রাশিদা জানায়, আসলে বসন্ত দাশগুপ্তকে এমনটাই প্রস্তাবই দিয়েছে তার বাল্যবন্ধু আনোয়ার। এ নিয়ে কোলকাতায় দু-দু’বার চিঠিও পাঠিয়েছে সে। কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি এখনও।

‘সেকি? এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা তো জানাবেন বসন্ত কাকা! নাকি?’ বলে ওঠে মনু।

‘চিঠিই তো এলো না! দোনোমনা করছেন হয়তোবা!’

‘পোস্ট অফিস থেকে সোহরাব মোল্লা চিঠি গাপ করে দেয়নি তো?’

‘হতেও পারে! এসব পাকিস্তান-প্রেমিকদেরকে কি আর সহজে বিশ্বেস করা যায়, বল? গায়ের জোর বাদেও তাদের চাতুরির তো কোনো অন্ত দেখি না!’ উত্তর দিয়েছিল রাশিদা।

আনোয়ার হোসেনের কোলকাতা যাবার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যে দু’টো মোক্ষম যুক্তি রয়েছে তা বুঝতে পেরেছিল মনু। সেই সাথে তৃতীয় একটা যুক্তিও থাকতে পারে বলে সে ধারণা করেছিল— বছর সাতেক আগে কোলকাতার উপকন্ঠের পাণ্ডুয়াতে বিয়ে হয়েছে তার বড়ো বোন লতিফার। লতিফার স্বামীর পরিবার বর্ধমানের মানুষ। তবে তিন পুরুষ ধরে তারা পাণ্ডুয়াতেই থাকছে। সাতচল্লিশের সতের অগাস্টে রাতারাতি ভিন্ন দেশের মানুষ হয়ে যাওয়া আত্মজাকে নিশ্চয় এক চোখ দেখতে চাইবে আনোয়ার! মনু ভাবছিল, তার বড়দি লতিফার সাথে অনেক দিন বাদে দেখা হবে এবার! ব্যাপারটা ভাবতেই আনন্দে বুক ভরে উঠল তার! কিন্তু লতিফার কথা তোলার পরে দেখা গেল, তার আম্মা রাশিদার চোখ থেকে নীরবে অশ্রু ঝরছে।

মনু বুঝতে পারে, সত্যিই ভারতবর্ষের গা ফেটে জেগে উঠেছে মস্তবড়ো একটা বিষফোঁড়া আর ফোঁড়াটার পুঁজ এবং পুঁতিগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সারাটা শেয়ালদা-স্টেশন জুড়ে, স্টেশনের বাইরেও। সেই দগদগে বিশাল ফোঁড়াটার গায়ে গুঁতো খেতে খেতে তারা পৌঁছেছিল বসন্ত দাশগুপ্তের বউবাজার স্ট্রিটের ভাড়া করা ফ্লাটটাতে। চাঁদনিচকের ঠিক সাথেই বাড়িটা।

পরদিন সকালে ঈশ্বরদি থেকে আটটার ট্রেনে চেপে দর্শনা দিয়ে সীমান্ত পার হয়েছিল আনোয়ার হোসেন আর মনু; নেমেছিল ওপারের গেদে-তে। তখনও পাকিস্তান এবং ভারতের ভেতরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভিসাপদ্ধতি চালু হয়নি, ইমিগ্রেশনে সিটিজেনশিপ কার্ড দেখানোটাই যথেষ্ট ছিল। গেদে রেলস্টেশনে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে তারা উঠে বসেছিল শেয়ালদা-গেদে লাইনের ইস্ট বেঙ্গল মেইলে। শেয়ালদা-স্টেশনে তারা থেমেছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। মনু আবিষ্কার করল, পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের দখলে চলে গেছে পুরো শেয়ালদা-স্টেশন— সেখানে কুলি সিরাজগঞ্জের টানে কথা বলছে, চা-ওয়ালার কন্ঠে বিক্রমপুরের বুলি স্পষ্ট, ট্যাক্সিচালক যে বৃহত্তর বরিশালের মানুষ তার কথা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সেটাও। মনু বুঝতে পারে, সত্যিই ভারতবর্ষের গা ফেটে জেগে উঠেছে মস্তবড়ো একটা বিষফোঁড়া আর ফোঁড়াটার পুঁজ এবং পুঁতিগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সারাটা শেয়ালদা-স্টেশন জুড়ে, স্টেশনের বাইরেও। সেই দগদগে বিশাল ফোঁড়াটার গায়ে গুঁতো খেতে খেতে তারা পৌঁছেছিল বসন্ত দাশগুপ্তের বউবাজার স্ট্রিটের ভাড়া করা ফ্লাটটাতে। চাঁদনিচকের ঠিক সাথেই বাড়িটা।

বাড়িটার তিনতলার ফ্লাটটাতে ঢুকতেই বয়ে গিয়েছিল সুবাতাস— বসন্ত দাশগুপ্ত ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছিল তার বাল্যবন্ধু আনোয়ারকে; টিনের তোরঙ্গ হাতে মনুকে দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্ময়ে বলেছিল উঠেছিল, ‘ওরে বাপস্! এই দেড় বছরেই কত বড়ো হয়ে গেছিস তুই ছোটোকু! আয়, আয়! ভেতরে আয়!’ তারপর মনু সংকীর্ণ বসবার ঘরে গিয়ে সোফায় নিজের শরীরটাকে ছেড়ে দিয়েছিল ভয়ানক ক্লান্তিতে। কিন্তু দূরযাত্রার কারণে আনোয়ারকে মোটেই ক্লান্ত বলে মনে হলো না। জমিয়ে তখন দুই বন্ধুতে স্মৃতিচারণ করছে। সেই ফাঁকে কাকিমা এসে বলল, ‘আনু ভাই! আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে নেবেন, চলুন!’ বসন্তের সাথে কথা বলতে বলতেই আনোয়ার ঢুকে গেল বসার ঘরের পাশের গেস্টরুমটাতে। অস্বস্তিই হচ্ছিল মনুর! তার মনে হচ্ছিল, বসন্ত কাকাদের ছোট্ট এই ফ্লাটটাতে না উঠলেই ভালো হয়! জিনিসপত্তরের গাদাগাদিতে তো এ বাড়িটাতে পা ফেলবারও জো নেই, তা ঘুমাবার জায়গা হবে কীভাবে? এর চাইতে বৈঠকখানা রোডে গিয়ে সস্তা কোনো হোটেল ঢুঁরে নিলে হতো না কি? এমনটাই তো তার কথা হয়েছিল আব্বার সাথে! সে এসব ভাবছিল বটে কিন্তু সবার উপস্থিতিতে আনোয়ারকে সে আর কিছু বলতে পারছিল না। কাজেই আনোয়ারের অনুগামী হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তরই ছিল না তার।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যেতে থেমেছিল দুই বন্ধুর আড্ডা। বসন্ত আর আনোয়ার বড়োবাজারে গিয়েছিল মাছ কিনে নিয়ে আসতে। তৈরি হবার সময় আনোয়ারের কাছে অনুযোগ তুলছিল বসন্ত, ‘শালা! কী দেশ এটারে— পদ্মার ইলিশ খুঁজে পেতে হাঁপিয়ে যেতে হয়!’ আনোয়াররা বাইরে গেলে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল মনু। মনুর বন্ধু রমা দাশগুপ্তা তার বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে বেড়াতে এসে ঘুম ভাঙিয়েছিল তার। রমা আর তার স্বামী দিবাকর সেনের সাথে গল্পে ঢুকে গিয়েছিল মনু।

রাতে ভুড়িভোজের পরে সবাই চা খেতে বসেছিল বসবার ছোট্ট ঘরটায়। তখনই বসন্ত দাশগুপ্তের হেমসাগর লেনের বাড়িটার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল আনোয়ার। তার কথা একটাই— তোমরা বাফু এবার বেচেই দাও বাড়িটা! নতুবা পাথরতলার সোহরাব মোল্লা বাড়িটা বেদখল করে নেবেই নেবে! বুয়েচ তো? আনোয়ার বলেছিল, এ কথাটাই সে পর পর দু’টো চিঠিতে বসন্তকে লিখে পাঠিয়েছিল যার কোনো উত্তরই দেয়নি বসন্ত! কী আশ্চর্য! এমন একটা জরুরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বসন্তের এত বিলম্ব ঘটছে কেন?

‘সেকি রে! আমি তো গেল ছ’মাসে তোর কোনো চিঠিই পাইনি!’ আশ্চর্য হয়ে বলেছিল বসন্ত।

আনোয়ার বলছিল, ‘বলিস কী? যাকগে! চিঠি পাসনি— ভালো কথা! এবার তবে বল, কর্তব্য কী?’

আনোয়ারের এ প্রশ্নের পরে নিরবতা নেমেছিল বসবার ঘরটায়। মনু দেখল, কাকিমা গম্ভীর হয়ে গেছে; পুলকদা, বৌদি, রমা আর রমার স্বামী দিবাকর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে পরস্পরের, হয়তো পথ খুঁজে পাচ্ছে না তারা; তাদের দিকে রাজ্যের উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে আনোয়ার। একটু সময় নিয়ে আনোয়ারকে বসন্ত বলেছিল, ‘ঠিক আছে! তবে বাড়িটা বেচেই দেই! তুই পার্টি দেখ!’

পুলকের শঙ্কা ছিল এমন, ‘দাম যদি না ওঠে, বাবা?

পুলককে আশ্বস্ত করবার জন্য আনোয়ার বলেছিল, ‘আমি জোর চেষ্টা চালাব ভালো এক জন পার্টি খুঁজে বের করতে। পাবনায় তেমন পার্টি না মিললে রাজশাহী, নাটোর, রাজবাড়ী বা কুষ্টিয়ায় দালাল লাগাব আমি। তবু এই বাড়ি আমি সোহরাব মোল্লাকে বেদখল করতে দেব না! তোর মনে পড়ে বসন্ত, ছিচল্লিশের অগাস্টে যখন কোলকাতায় হিন্দু-মুসলিমদের ভেতরে দাঙ্গা হয়ে গেলে তারপরে তোদের হেমসাগর লেনের বাসায় আগুন দিতে এসেছিল ঐ বদমাশ সোহরাব মোল্লা?’

‘হ্যাঁ! শরাফত, নান্নু আর তুই বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলি সোহরাব মোল্লাদের মুখোমুখি। তোরা না থাকলে জানেই মারা পড়তাম সেদিন!’

‘শোন বসন্ত! দাম একটু কম হলেও ছেড়ে দে বাড়িটা। তোরা যদি কখনও পূর্বপাকিস্তানে ফিরে যেতে চাস তখন না হয় আরেকটা বাড়ি কিনে নেওয়া যাবে! তাই বলছি, তুই একটু দেখ না, এপারের কোনো মুসলিম বাড়িটা কিনতে বা এক্সচেঞ্জ করতে আগ্রহী হয় কি না?’

‘দেখব। তবে আমি অন্য কথা ভাবছি।’ একটু থেমেছিল বসন্ত দাশগুপ্ত। তারপর সে আনোয়ারকে প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘তুইই বরংচ বাড়িটা কিনে নে! কম দামেই নে! আস্তে ধীরে টাকা শোধ করে দিস। সেটাও ভালো। সোহরাব মোল্লার হাতে যেন আমার বাপ-দাদার ভিটেটা চলে না যায়!’

‘দেখব। তবে আমি অন্য কথা ভাবছি।’ একটু থেমেছিল বসন্ত দাশগুপ্ত। তারপর সে আনোয়ারকে প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘তুইই বরংচ বাড়িটা কিনে নে! কম দামেই নে! আস্তে ধীরে টাকা শোধ করে দিস। সেটাও ভালো। সোহরাব মোল্লার হাতে যেন আমার বাপ-দাদার ভিটেটা চলে না যায়!’

এ প্রস্তাবে বেঁকে বসেছিল আনোয়ার। সে যুক্তি দিয়েছিল, হেমসাগর লেনের বাড়িটাসহ প্রায় পনের বিঘা জমির দাম পড়বে গিয়ে কমপক্ষে দু’লাখ রুপি। এই মুহূর্তে তার হাতে অত টাকা নেই। আর সে বন্ধুর কাছে অন্তত কোনো আর্থিক ঋণ রাখতে চায় না। এতে করে আখেরে মন কষাকষি হতে পারে দু’বন্ধুর ভেতরে! দরকার কি সেধে সেসব ঝুঁকি নেবার?

গলা খাঁকরি দিয়ে, মানে অস্বস্তি নিয়েই, পুলক কথা শুরু করেছিল, ‘জ্যাঠামশাই! বলছিলাম কি, এক্সচেঞ্জের আইডিয়াটা কিন্তু মন্দ নয়! বাবা আপনাকে হেমসাগর লেনের বাড়িটা লিখে দিলেন, তার বিনিময়ে আপনি তাকে লিখে দিলেন আপনার চোরবাজারের দোকানটা। এমনটা তো দেশবিভাগের পরে হরহামেশাই ঘটছে! এতে করে আপনাদের দু’জনেরই ভিন্ন দেশে রয়ে যাওয়া সম্পত্তির মোটামুটি একটা সমাধান হয়ে যায়! তাই নয় কি?’

পুলকের ভাবনাটা সহজেই ঘুর্ণি তুলেছিল তার বাবা বসন্ত দাশগুপ্তের মাথার ভেতরে। তাই আনোয়ারকে বসন্ত অনুরোধ করেছিল পুলকের প্রস্তাবটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখবার জন্য। এ কথা তো মানতেই হবে, বিক্রি করতে গেলে পূর্বপাকিস্তানে ফেলে আসা স্থাবর সম্পত্তির আজকাল সঠিক দাম উঠছে না, সংঘবদ্ধ চক্রান্তের কারণেই। কাজেই এখানে শ্রেয় কিছু আশা করাটা অর্থহীন! তার চাইতে ডিডের মাধ্যমে দু’জনের মাঝে সোজা সম্পত্তি-বিনিময়টা হয়ে যাক। দু’জনার সম্পত্তির দাম যাই উঠুক না কেন, দামের ফারাক যেটাই হোক না কেন সেদিকে তাকাবার কোনো দরকার নেই।

‘বলিস কী বসন্ত? বসতবাটির বদলে ছোট্ট একটা দোকান বিনিময় করবি তুই? তোর তো ঠকা হবেরে গাধা?’ আঁতকে উঠেছিল আনোয়ার।

‘ঠকা হলে, হোক! আমাদের বাড়িটা শহরের কাউকেই কিনতে দেবে না সোহরাব মোল্লা— বুঝতেই তো পারছিস তুই! প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে বা ঘুষটুষ দিয়ে মোল্লা আমাদের বাড়িটা লিজ নিয়েই ছাড়বে! তাই বলছি, তোর-আমার ভেতরে সম্পত্তি বিনিময় করে নেওয়াটাই ভালো! ভেবে দেখ তুই!’ আত্মপ্রত্যয়ে উত্তর দিয়েছিল বসন্ত।

‘আচ্ছা! ভেবে দেখি!’

এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত একটা আলোচনা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল আনোয়ার। শুকনো একটা হাসি দিয়ে বসন্ত তাকে বলেছিল, ‘এমন তো হতেই পারে, দেশে ফিরে যেতে পারছি আমি! তখন এক্সচেঞ্জের ডিডটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেললেই হলো!’

তারপর নিজের মুখমণ্ডল ঢেকে হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল বসন্ত; উচ্চারণ করেছিল, ‘হা ভগবান! আমার পোড়া কপাল! দেশ গেল, বাপ-দাদার ভিটেটাও চলে যাচ্ছে এখন!’

মনু দেখল, চুপ করে আছে আনোয়ার, বসন্তের মতো করে সে কোনো হা-হুতাশ করল না। এ কথা সত্য যে পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডুয়া এবং ভগবানগোলায় আনোয়ারের যেসব ধানী জমি ছিল তার সবই বেহাত হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু পাবনাতে তার বসতভিটা আর চাষের জমিজমা মিলিয়ে যে তেপান্ন বিঘা রয়ে গেছে তা তো চলে যায়নি অন্তত! এমন একটা পরিস্থিতির মাঝে দাঁড়িয়ে বসন্তের তুলনায় নিজেকে তার নিশ্চয় ‘সবহারা’ বলে মনে হয়নি। এ নিয়ে শিয়ালদাগামী ট্রেনে বসে কথা হয়েছিল পিতা-পুত্রের মাঝে। মনুকে আনোয়ার বলেছিল, ‘দেখলি, সম্পত্তি বলতে কিছুই রইল না বসন্তের! চাটমোহর আর পাবনা শহর মিলিয়ে কম করে হলেও তার আশি বিঘা জমি ছিল!’

মনুর হাত ধরে তাকে বারান্দায় নিয়ে গেল রমা, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবার চাটমোহরের ধানী জমি সব বেদখল হয়ে গেছে, জানিস? এবার বসতবাড়িটাও চলে গেল! অন্যায় নয়কি এটা?’

গভীর এক বেদনায় চুপ করে রইল মনু। খানিক পরে রমা তাকে অনুরোধ করেছিল, ‘আমাদের ঠাকুরঘরটাকে আবার তোদের নামাজ পড়ার জায়গা বানাসনি যেন!’

এ কথার কী উত্তর দেওয়া যাবে? কেবল দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে না করল মনু যার অর্থ দাঁড়াল— পাগল হয়েছিস তুই?

বারান্দায় সিগারেট টানতে এসে পুলক স্বস্তির নিঃশ্বাসই ফেলল বরংচ! হয়েছে কি— কোলকাতার সেইন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ার সময় থেকেই সে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে বই-খাতা-কলম-পেন্সিল সাপ্লাইয়ের কাজ শুরু করেছিল। দেশবিভাগের পরে পড়াশোনা শেষে জীবনবীমার এজেন্ট হিসেবে দাঁড়াতে চাইছে সে। কিন্তু আয়-উন্নতি খুব একটা হচ্ছে না! চাটমোহরের জমি থেকে যে টাকাটা আসত সেটা তো পুরোটাই গেছে! তাই ক্লায়েন্ট ধরবার জন্য দৌড়াদৌড়ির পাশাপাশি সে তার সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটার পরিধি বাড়িয়ে নিতে চাইছে এখন। সেক্ষেত্রে আনোয়ার হোসেনের চোরবাজারের দোকানটাকে অফিস-কাম গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে যুক্তি দেয় পুলক। মনুকে পুলক বলে, ‘ভেবে দেখ আমার প্রস্তাবটা। তোদের ঐ যতীন প্রামাণিকের পোঁদে লাথি মেরে দোকান থেকে উচ্ছেদ করতে পারলেই কিন্তু আমার কাজটা হয়ে গেল!’

পরদিন সকালে আনোয়ার, পুলক আর মনু যতীন প্রামাণিকের সাথে ফয়সালা করতে চোরবাজারের দোকানটায় যায়। ভাঙা রেকর্ডই বাজাতে থাকে যতীন— কত্তা! দোকানের দাম তো আট হাজারের ওপরে উঠচে না! এ কথায় ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে যতীনকে নিজের প্রতিক্রিয়া জানায় পুলক, ‘মামদোবাজি পেয়েছ, তাই না? আনু জ্যাঠার দোকানটা নিজেই হাপিস করবার মতলব করেছ তুমি? দাঁড়াও! দেখাচ্ছি তোমাকে!’ পুলকের মেজাজের মাত্রা দেখে বোঝা গেল যে অকুস্থলে আনোয়ার আছে বলেই সে খিস্তি সংবরণ করছে।

মিউমিউ করতে থাকে যতীন, ‘সেকি দাদা! আমি তো আনোয়ার কত্তার ভালোই চাই!’

সময় নষ্ট না করে আনোয়ার ঘোষণা দেয়, বউবাজারের বসন্ত দাশগুপ্তর নামে দোকানটার হাতবদল হবে। কাজেই যতীনকে কষ্ট করে আর দোকান বিক্রি-টিক্রির জন্য পার্টি খুঁজতে হবে না। আনোয়ারের এ সিদ্ধান্তে একেবারেই মিইয়ে যায় যতীন; একটু ভেবে আনোয়ারের চোখে তাকিয়ে, দিশেহারা সুরে সে প্রশ্ন করে, ‘ওরা যদি আমায় উটিয়ে দেন? বছর ছয়েক ধরে এখানে আছি! তা’হলে আমার জুতোর ব্যবসাটা পড়ে যাবে কত্তা!’

‘অতো কথায় কাজ নেই! তুমি এখান থেকে এবার বিদেয় হবার প্রস্তুতি নাও চাঁদু!’ ক্রূর হাসিতে যতীনকে বলে দেয় পুলক।

চোরবাজার থেকে সেদিন দুপুরে পাণ্ডুয়ার স্টেশন রোডে লতিফার শ্বশুরবাড়ি যায় আনোয়ার আর মনু। বছর দেড়েক পরে পরিবারের দু’জন মানুষকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে লতিফা। দেশবিভাগের কাটাকুটিতে কোন যুক্তিতে তার জন্মস্থান পাবনা ভিন্ন একটা দেশের ভেতরে পড়ে গেল তা নিয়েই অভিযোগ করে চলছিল সে। লতিফার স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ি বোঝাতে বসল তাকে— যা হবার তা হয়েছে! নতুন বাস্তবতায় মাইনোরিটি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে তেষ্টানো যাবে সেটাই এখন ভাবনার বিষয়।

এসব আলাপে আনোয়ার ঢুকল না। বোঝাই যায়, গেল দেড়টা বছর ধরে দেশবিভাগের নানান বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে ক্লান্ত! ‘একটু আসছি’— বলে মনুকে সাথে নিয়ে মেইলট্রেনে চেপে সে সোজা মল্লিকপুরে রওয়ানা দিল। মল্লিকপুরেই বেহাত হয়ে গেছে তার নিজের কিছু জমিজাতি। পাণ্ডুয়া থেকে আধা ঘন্টা ট্রেন চলবার পরে তারা নামল গিয়ে মল্লিকপুর রেলস্টেশনে। স্টেশনে নেমে গাঁয়ের দিকে মিনিট দশেক হাঁটতেই পড়ল মস্তবড়ো একটা বটগাছ। বটগাছের ঢাল থেকেই আউশধানের বিশাল একটা মাঠের শুরু। এই মাঠেই রয়েছে বেহাত হয়ে যাওয়া সাতশ পঁয়তাল্লিশ ডেসিমাল জমি। আঙুল তুলে আনোয়ার উত্তর দিকের কোনো একটা জায়গা নির্দেশ করে মনুকে বলল, ‘ঐ যে দূরে টিনের বাড়িগুলো দেখছিস না? পাশে একগাদা কলাগাছ? ওগুলোর ঠিক পশ্চিমের প্লটটার কথা বলছি! তুই তো কখনও আসিসনি এদিকটায়!’

লতিফার স্বামীর সূত্রে মনুরা জেনেছে, মল্লিকপুরের বড়োকৃষক নিধু সামন্ত দেশবিভাগের পরপরই বেদখল করে নিয়েছে সেই জমি। আনোয়ারের হয়ে মহকুমার ভূমি-অফিসে দেনদরবার চালু রেখেছে লতিফার শ্বশুর। তবে মনুর ধারণা, বেহাত হয়ে যাওয়া জমিটা ফেরত পাবার সম্ভাবনা খুব কম! মনু তার মা’র কাছে শুনেছে, এই নিধু সামন্ত কংগ্রেসের অনেক পুরোনো মানুষ

লতিফার স্বামীর সূত্রে মনুরা জেনেছে, মল্লিকপুরের বড়োকৃষক নিধু সামন্ত দেশবিভাগের পরপরই বেদখল করে নিয়েছে সেই জমি। আনোয়ারের হয়ে মহকুমার ভূমি-অফিসে দেনদরবার চালু রেখেছে লতিফার শ্বশুর। তবে মনুর ধারণা, বেহাত হয়ে যাওয়া জমিটা ফেরত পাবার সম্ভাবনা খুব কম! মনু তার মা’র কাছে শুনেছে, এই নিধু সামন্ত কংগ্রেসের অনেক পুরোনো মানুষ, বাংলা ভাগ করে নেবার সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল সে। এ ব্যাপারটা নিশ্চয় ঠিকঠাক বুঝতে পারে আনোয়ার! সেজন্যই হয়তো মাঠের জমিটার দিকে উদাস হয়ে কিছুক্ষণ চেয়েই রইল আনোয়ার।

পাণ্ডুয়া টাউন থেকে কোলকাতায় ফিরে যাবার জন্য যখন মনু আর আনোয়ার রেলস্টেশনের দিকে রওয়ানা দিচ্ছে তখন লতিফা ফের কাঁদতে শুরু করে দেয়। আনোয়ার তার অত্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল; বলল, ‘দেখা তো হবেই মা! ঈদের সময় তোরা পাবনাতে আসিস।’ এতে করে তীব্রতর হলো লতিফার কান্নার বেগ! লতিফা নিশ্চয় বুঝেছিল যে মনে চাইলেই পূর্বপাকিস্তানে যাওয়া পড়বে না, সেটা ভিন্ন একটা দেশ এখন!

আনোয়ার হোসেন এবং বসন্ত দাশগুপ্তের মাঝে স্বেচ্ছায় সম্পত্তি বিনিময়ের ডিডটা পুলকই তৈরি করে এনেছিল। তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দুই বন্ধুতে চা খেতে খেতে ডিডের ধারাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে-টেখে রেখে দিল; সই করল না। তারা বেরিয়ে গেল গড়ের মাঠে হাঁটতে; ফিরল রাত ন’টার দিকে। রাতের খাবারের পরে তারা দু’জনে ডিডে সই করল। চুক্তির সাক্ষী হয়ে রইল পুলক আর মনু। তারপর দুই বন্ধুতে গিয়ে চুপচাপ বসে রইল বারান্দার অন্ধকারে।

কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের লাইনে ‘আদি চিত্রলেখা প্রিন্টিং প্রেস’ খুঁজে বের করতে মনুকে মোটেই বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু দেখা গেল, স্বপন সান্যাল নামের কম্পোজিটারকে ছাঁটাই করা হয়েছে সেখান থেকে। অনেক অনুরোধের পরে দারোয়ানের কাছ থেকে এই তথ্য মিলল যে স্বপন এই মুহূর্তে কাজ করছে কলেজ স্ট্রিটেরই অন্য কোনো ছাপাখানায়। ক’দিন আগে স্বপনের সাথে পথে দেখা হয়েছিল সেই দারোয়ানবাবুর।

ছাপাখানাটার নামটা বলা যাবে দাদা? নাহ্! তা জানি না— জবাব দিল দারোয়ান। কাজেই কলেজ স্ট্রিটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোটা তিরিশেক ছাপাখানায় স্বপনকে খুঁজতে নামা ছাড়া গত্যন্তর রইল না মনুর। বউবাজার স্ট্রিট থেকে বিধান সরণী বরাবর এগুতে এগুতে দীর্ঘ রাস্তাটার দু’পাশের ছাপাখানাগুলো উল্টেপাল্টেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না স্বপনকে। হাঁটতে হাঁটতে বিধান সরণীর মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছানোরা পর একটা ছাপাখানায় জিজ্ঞাসা করে জানা গেল— হ্যাঁ! স্বপন সান্যাল নামে নতুন একজন কম্পোজিটার সেখানে কাজে যোগ দিয়েছে বটে। তবে সে চা খেতে গেছে কোথাও, ফিরতে বিলম্ব হবে না। আধা ঘন্টা মতো ছাপাখানাটার সামনে দাঁড়িয়ে চিটমিটে রোদে ঘামতে ঘামতে তাই স্বপনের জন্য অপেক্ষা করল মনু। স্বপন এলো এবং চমকে উঠল মনুকে দেখে! মনুকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, ‘তোর সাথে যে এই জনমে আর দেখা হবে তা ভাবিইনি ভাই, জানিস?’

দু’বন্ধুর মনেই কথা জমেছিল অনেক। কিন্তু স্বপনের ব্যস্ততার কারণে তখন আর কথা এগোনো গেল না। সাব্যস্ত হলো, সন্ধ্যে ছ’টার পরে স্বপন যখন ছাপাখানার কাজ শেষ করে বেরুবে তখন দেখা হবে। স্বপনের সাথে ডানকুনিতে তাদের ডেরায় যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল মনু। রাজি হলো না স্বপন; কেবল বলল, ‘নোংরা-ময়লা বস্তিটার পরিবেশ সহ্য করতে পারবি না তুই! বাদ দে!’

‘আরে ধ্যাত! ঠিকই পারব! মাসিমা আর মেসোমশাইয়ের সাথে দেখা না করলে চলবে নাকি?’

‘এর পরের বার এলে দেখাটি করে যাস, কেমন?’

শালা! তখন কি হাজার দুয়ারী কোনো দালানে উঠে যাবি তুই— স্বপনকে এমন একটা খোঁচা মারা প্রশ্ন নিজের ভেতরে গিলে খেল মনু, সে আর কথা বাড়াল না। স্বপন বলল, কাজ শেষে সে বরং মনুর সাথে দেখা করতে বউবাজারে বসন্ত কাকার বাসায় চলে যাবে।

ঠিক সময়েই চলে এলো স্বপন। তবে সে বসন্ত দাশগুপ্তের ফ্লাটের ভেতরে ঢুকল না; বাইরে হাওয়া খেতে যাবারই প্রস্তাব দিল। বউবাজার থেকে বালিগঞ্জের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে স্বপনের কাছে তরু, বিপীন আর অপর্ণার খবর জানতে চেয়েছিল মনু। বোঝা গেল, পাবনা থেকে পালিয়ে এসে তারা যে পশ্চিমবঙ্গের কোথায় আছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই স্বপনের!

‘অপর্ণার কথা বলছিল পিযুষকান্তি!’ স্বপনকে নিচু স্বরে বলেছিল মনু।

‘শান্তিপুরে অপর্ণার এক খুড়তুতো দাদা থাকতেন বলে জানি। হয়তোবা তারা ওখানেই উঠেছে! ক্যাম্পে যদি তাদেরকে থাকতে না হয় তবে বুঝবি যে ওরা বেঁচে গেল!’ আনমনে উত্তর দিয়েছিল স্বপন। একটু থেমে বলেছিল সে, অগাস্টের শেষে তারা অনেকগুলো পরিবার একসাথে পাবনা থেকে ট্রেনে-বাসে চেপে দর্শনা পার হয়েছিল, রাতের অন্ধকারে। তারপরে কে যে কোথায় ছিটকে পড়েছে তা কি আর বলতে পারবে কেউ? এ বিষয়ে আলোচনা তাই আর এগুল না।

একটু বাদে স্বপন প্রস্তাব দিল, ‘চল! রমার সাথে দেখা করে আসি। রমার বাসাটা বালিগঞ্জেই। খুব একটা কিন্তু দূরে নয় এখান থেকে।’

স্বপন আর তার মাঝের কথোপথন ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল বলে মনুর মনে হয়েছিল, সেটাই ভালো— সদাহাস্যময় রমার উপস্থিতিতে যদি পর্বতসমান নিরবতার অবসানটুকু হয়! স্বপনও হয়তো তেমনটাই ভাবছিল! কে জানে!

বিক্রমপুরের দিবাকর সেন ও তার স্ত্রী রমা সেনের বসবার ঘরের সোফায় গিয়ে বসল স্বপন আর মনু। চা খেতে খেতে পুরোনো তিন বন্ধুর মাঝে গল্প হলো অনেক। বেশ সহজ হয়ে এলো স্বপন। এক সময়ে স্বপন আর রমার আলাপ কেন্দ্রিভূত হয়ে গেল গুটিকতক বিষয়ে: ভাগিরথি নদীর অনাব্যতা, দিল্লির গা চিলবিলানো গরম, কংগ্রেস-সরকারের নয়া পদঃক্ষেপ, মোহনবাগান বনাম ইস্ট বেঙ্গলের ফুটবল ম্যাচ ইত্যাদিতে। সেসব আলোচনাতে নিজেকে ঠিক বসাতে পারছিল না মনু। তাই সে স্বপনকে তুলে নিয়ে রমাদের ছাদে গেল সিগারেট টানতে। তাদের সাথ ধরল রমা। সেই সময়েই অন্তরতম কথাটা প্রকাশ করেছিল রমা, ‘আমাদের হেমসাগর লেনের বাড়িটা চলে গেলরে স্বপন! বাড়িটার প্রতিটা ইটের সাথে আমার স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বিশ্বাসই করতে পারছি না আমি!’

ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে, গলায় তীব্র শ্লেষ নিয়ে স্বপন বলল, ‘তাও তো তোরা নিজেদের বাসাবাড়িটা এক্সচেঞ্জ করতে পারলি আনোয়ার জ্যাঠার সাথে! আর আমাদের বাড়িটাকে পাড়ার ক্লাবঘর বানিয়েছে মোসাদ্দেক গুণ্ডার দলবল। ওটা ফেরতও পাওয়া যাবে না, বিক্রিও করা যাবে না। মনুকে জিজ্ঞাসা করে দেখ!’

রমা তার চোখে তাকালে স্বপনের কথায় সায় দেয় মনু। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রমা বলে, ‘সব যেন কেমন হয়ে গেল রে!’

ছিচল্লিশ সনের অগাস্টের শেষের এক রাতে রমা যখন সাধুপাড়ার খেয়াঘাট থেকে নৌকোয় উঠবে তখন সর্বশক্তি দিয়ে সে মনুর হাত ধরে রেখেছিল। রমাকে বার বার তাড়া দিচ্ছিল মনুর বড়ো ভাই নান্নূ, ‘জলদি ওঠ তো নৌকায়! এই জায়গাটাও কিন্তু সেইফ না!’

নান্নূর তাড়ার মুখেও রমা নড়ছিল না; নদীর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলেছিল— কোলকাতায় যাব না আমি! কথাটা কাকে যে বলেছে রমা সেটা আর বোঝা যাচ্ছিল না। হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে রমাকে নৌকায় তুলতে তুলতে নান্নূ ভৎর্সনা করেছিল রমাকে, ‘কোলকাতায় যাবি না— মানে? পাগল হয়েছিস তুই? কে কখন তুলে নিয়ে যাবে তোকে!’ তারপর কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছিল নৌকোটা।

নান্নূর তাড়ার মুখেও রমা নড়ছিল না; নদীর দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলেছিল— কোলকাতায় যাব না আমি! কথাটা কাকে যে বলেছে রমা সেটা আর বোঝা যাচ্ছিল না। হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে রমাকে নৌকায় তুলতে তুলতে নান্নূ ভৎর্সনা করেছিল রমাকে, ‘কোলকাতায় যাবি না— মানে? পাগল হয়েছিস তুই? কে কখন তুলে নিয়ে যাবে তোকে!’ তারপর কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিয়েছিল নৌকোটা। কুষ্টিয়া থেকে গেদে রেলস্টেশন পর্যন্ত রমাকে এগিয়ে দিয়ে এসেছিল নান্নূ। ট্রেনে খুনোখুনি, রাহাজানি এবং ধর্ষণের সম্ভাবনার বিবেচনায় কুষ্টিয়া শহর থেকে ভাঙা বাসে চুয়াডাঙ্গা পার হয়ে গেদে জংশনে থেমেছিল তারা। গেদেতে রমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল তার দাদা পুলক। এভাবে পাবনা শহর থেকে পালিয়ে রমাকে কোলকাতায় চলে যেতে হয়েছিল।

ছিচল্লিশের অগাস্টের ষোল থেকে আঠারো— এই তিন দিনে কোলকাতায় নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল হিন্দু ও মুসলিম— দু’দলই, হিন্দুদের সাথে সামিল হয়েছিল পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে মার খেয়ে কোলকাতায় ভেসে আসা শিখ জনগোষ্ঠী। এ সময়ে কোলকাতার মানুষজন পরস্পরকে ছুরি মেরেছে, জবাই করেছে একে অপরকে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে চুরমার করে দিয়েছে অন্যের মাথা, গুলি করেছে নিরাপরাধের বুকে, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে একে অপরের গায়ে। মনুরা পরে জেনেছিল কোলকাতায় তিন দিনের দাঙ্গাতে হিন্দু আর মুসলিম মিলিয়ে খুন হয়েছিল প্রায় ছ’হাজার মানুষ, বিকলাঙ্গ হয়েছিল প্রায় হাজার বিশেক এবং ধর্ষিত হয়েছিল অসংখ্য নারী। অগাস্টের একুশ তারিখের দিকে পাবনাতে অবশ্য মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছিল পাবনার শহরের মুসলিম লিগের নেতা সোহরাব মোল্লার দল— কোলকাতার হাজার হাজার মুসলিমকে নাকি কচুকাটা করে গঙ্গায় ফেলে দিয়েছে হিন্দুরা! কিন্তু কাফের মারা পড়েছে দু’দশজন মাত্র! ঐ গুজব রটিয়েই সোহরাব মোল্লা খুব সহজেই পাবনার শহরের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে উত্তেজিত করে ফেলতে পেরেছিল। অগাস্টের একুশে সহিংস মিছিল বের করেছিল তারা।

কিন্তু সেই উস্কানির পরেও পাবনা শহর আর শহরের উপকন্ঠের সংখ্যালঘিষ্ঠ হিন্দুরা মুসলিমদের সাথে বিবাদে জড়াল না। জঙ্গি মুসলিমদের সম্ভাব্য হামলা প্রতিহত করবার জন্য কেবল হিন্দু তরুণ ও যুবকেরা পাহারা বসাল যার যার পাড়ায়, তাদের সাথে হাত লাগাল তাদের সমবয়সী গুটিকতক অসাম্প্রদায়িক মুসলিমরা। গুজবেও দাঙ্গা লাগছে না দেখে পাড়ায় পাড়ায় অবস্থাপন্ন হিন্দুদের বাড়িতে হামলা দিতে শুরু করল সোহরাব মোল্লার দল। এসব দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল শহরের আপামর হিন্দু জনগোষ্ঠী, অসাম্প্রদায়িক মুসলিমরা দিশে হারিয়ে ফেলেছিল। এমনই একটা হামলা সংগঠিত হয়েছিল হেমসাগর লেনের বসন্ত দাশগুপ্তের বাসায়।

পয়লাতে জঙ্গি মুসলিমদের পঞ্চাশ-ষাট জনের একটা দল পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউটের সামনের মেইন রোড থেকে বসন্ত দাশগুপ্তের বাসার সামনের মাঠে নেমে এসেছিল। একশ গজ মতো দূর থেকে বাসাটায় ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করেছিল তারা। তারা নারা দিচ্ছিল বার বার— নারায়ে তকবির! আল্লাহু আকবার! লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান! সেই নারার বিপরীতে ‘বন্দে মাতারাম’ বা ‘জয় হিন্দ’ বা ‘হর হর মহাদেব’ আওয়াজ তুলবার মতো কেউই ছিল না। ইট-পাটকেলের বৃষ্টির পরে বসন্ত দাশগুপ্তের বাসার সামনে সোহরাব মোল্লার নেতৃত্বে জড়ো হলো আক্রমণকারীরা। তাদের হাতে চকচক করছে রামদা-তরোয়াল; নাচছে লোহার রড; আগুন দেবার জন্য তৈরি হয়ে আছে মশাল, কেরোসিন বা পেট্রোলের জার— এসব। তাদের দাবি: কংগ্রেসের দালাল বসন্তের রক্ত চাই, রক্ত চাই!

ঘরের ভেতরে তখন মৃত্যুভয়ে কাঁপছে বসন্ত দাশগুপ্ত, তার স্ত্রী এবং তাদের মেয়ে রমা। বসন্ত দাশগুপ্তের বাসাটার পেছনের দরোজা দিয়ে মনুর আম্মা রাশিদা দাশগুপ্তদেরকে নিয়ে গেল নিজেদের বাসায়। জঙ্গি মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে বন্দুক আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে বেরিয়েছিল আনোয়ার হোসেন, তার ছোটো ভাই শরাফত এবং আনোয়ার হোসেনের বড়ো ছেলে নান্নূ। তাদের অনুগামী হয়েছিল হেমসাগর লেনের জনা তিরিশেক মুসলিম এবং হিন্দু তরুণ। তাদের হাতেও লাঠিসোটা, রামদা আর লোহার রড চমকাচ্ছে। আনোয়ারের নেতৃত্বে দলটা দাঁড়িয়ে গেল বসন্ত দাশগুপ্তের বাসাটার সামনের মাঠে এবং বারান্দায়। বসন্ত দাশগুপ্তের বাসাটার ছাদে থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে পজিশন নিল নান্নূ।

সোহরাব মোল্লাকে আনোয়ার তখন ভৎর্সনা করেছিল, ‘লজ্জা করছে না তোমার? পলিটেকনিকের মাঠে বসন্ত আর আমার সাথে তুমি কৈশোরে ফুটবল খেলনি? হিন্দুরা এই শহরে সংখ্যায় কম বলে তুমি জোর দেখাতে এসেছ? এতগুলো সাধারণ মানুষকে ক্ষেপালে কেন, শুনি? চলে যাও এখান থেকে।’

ক্রূর হাসিতে উত্তর দিয়েছিল সোহরাব মোল্লা, ‘আপনি দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের সাক্ষ্যাৎ দালাল! পাকিস্তানের শত্রুদেরকে বাঁচাতে এসেছেন আপনি? কোলকাতায় আমাদেরকে খুন করল কারা?’

‘কোলকাতায় খুনোখুনি করেছে দু’পক্ষই, কেউ কম যায়নি কারও চাইতে! আর বলি, বসন্তরা কেউই কিন্তু কোলকাতার দাঙ্গায় অংশ নেয়নি, তারা কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িতও নয়! কাজেই প্রতিশোধের নামে নিরাপরাধ মানুষের রক্ত নিতে চাওয়ার কোনো মানে নেই। চলে যাও তোমরা।’ দৃঢ় কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল আনোয়ার। তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে শরাফত সোহরাব মোল্লাকে শাঁসিয়েছিল এই বলে— ‘এখনই ভাগেন আপনারা। নইলে এখানে খুনখারাবি হয়ে যাবে কিন্তু!’

‘নারায়ে তকবির’ ধ্বনির সাথে নেচে উঠল সোহরাব মোল্লার দলের তরুণদের লাঠি, তরোয়াল আর রামদা। কেউ একজন ভিড়ের ভেতর থেকে চিৎকার করে দাবি জানাল, ‘বসন্ত দাশগুপ্তকে যদি না দেন তবে তার মেয়ে রমাকে আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে!’

তখন ছাদের ওপর থেকে রাইফেলের দু’রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছিল ক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া নান্নূ। গুলির আওয়াজে হতচকিত হয়ে পড়েছিল সোহরাব মোল্লার অনুসারী সাম্প্রদায়িক মুসলিমরা। তবে সাথে সাথে তারাও তাদের পিস্তল-বন্দুক বের করল। এবার আনোয়ার আর শরাফতের হাতের একনলা বন্দুক উদ্যত হলো হামলাকারীদের দিকে। আনোয়ারদের দৃঢ় প্রত্যয় দেখে সোহরাব মোল্লা পিছু হটে গেল তখন; যাবার সময় তীর্যক হাসিতে বলে গেল, ‘আমরা আবারও আসব। হিন্দুদেরকে আপনারা কত দিন পাহারা দেবেন? পাকিস্তানে একটাও হিন্দু থাকতে পারবে না!’
উত্তর দিয়েছিল আনোয়ারের ছোটো ভাই শরাফত— ‘পাকিস্তান হয়ে গেলেই বা কী? বসন্তদা, নিতাইদা, হারু কাকা, অসীত, জীবন— এরাও এখানেই থাকবে। এটা তাদেরও দেশ!’

‘পাকিস্তান আগে হয়ে নিক না! তারপর ফাঁসিতে ঝোলানো হবে আপনাদের মতো গাদ্দারদেরকে! রেডি থাকবেন আপনারা।’ এই বলে পেছন ফিরে মাঠ ত্যাগ করেছিল সোহরাব মোল্লা। পিছু পিছু ‘নারায়ে তকবির’ আওয়াজ তুলতে তুলতে চলে গিয়েছিল সাম্প্রদায়িক মুসলিমদের জঙ্গি দলটা।

বসন্ত দাশগুপ্তের বাসায় হামলার তিন-চার দিন পরেই দেখা গেল, সোহরাব মোল্লাদের মুসলিম লিগ ফুলে-ফেঁপে উঠছে, পাকিস্তানের দাবিতে জঙ্গি মুসলিমদের মিছিলগুলোর আকার বেড়ে উঠছে ক্রমশ। তখন রাতারাতি তালা ঝুলল হেমসাগর লেনের হারু সাহা এবং নিতাই ঘোষের বাড়িতে; গোপালপুরের অসীতবরণ মজুমদার, লাহিড়ীপাড়ার জীবন সান্যালের বাড়িতে আর বাতি জ্বলল না। হারু সাহারা পালিয়ে গিয়েছিল শিলিগুঁড়িতে, নিতাই ঘোষরা কোলকাতায়, অসীতবরণ মজুমদাররা কৃষ্ণনগরে, জীবন সান্যালরা নৈহাটিতে। তখনই রমা দাশগুপ্তাকে কোলকাতায় তার দাদা পুলকের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ছিচল্লিশের সেসব দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়াতে রমাদের ছাদে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনু। তারপর কী ঘটে যায় তার ভেতরে, সে স্বপনের কাঁধে হাত রেখে বলে ফেলে, ‘দেশে ফিরে চল তোরা। তোরা নেই বলে সব কিছু কেমন ফাঁকা হয়ে গেল! শোন, তোকে বলি, আমার শরীরে এক বিন্দু রক্ত থাকতে আমি তোদের কোনো অনিষ্ট হতে দেব না!’

নিজের কাঁধ থেকে এক ঝটকায় মনুর হাতটা সরিয়ে দেয় স্বপন। তারপর সে ক্রুদ্ধ কন্ঠে ভর্ৎসনা করে মনুকে, ‘তুই কি চাস, পাবনাতে ফিরে গিয়ে, আমি এক জন হিন্দু বলেই, খুন হয়ে যাই সোহরাব মোল্লাদের হাতে? ওটা তো এখন পাকিস্তান! তুই কি উটপাখি হয়ে গেলি নাকি? এখনও বালির ভেতরে মুখ-চোখ-নাক খুসে দিয়ে বসে আছিস যে?’

স্বপনের প্রতিক্রিয়াতে হতচকিত হয়ে পড়ে মনু। কী বলবে তা আর সে ভেবে পায় না। খুব নিচু স্বরে তাকে রমা বলে, ‘সেই ছিচল্লিশেই, যখন ভারত ভাগই হয়নি, তখন তুই আমাকে জঙ্গি মুসলিমদের আক্রোশ থেকে আড়াল করতে পারিসনি, রাতের অন্ধকারে পাবনা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে! এখন তো পাকিস্তান হয়ে গেছে আমার দেশটা, সোহরাব মোল্লাদের শক্তি বেড়েছে লক্ষ গুণে! তোরা যারা সম্প্রীতির কথা বলিস, তারা আর সংখ্যায় ক’জন, বল? তাই বলছি, এসব কথা বাদ দে মনু!’

রমার কথাতে সম্বিত ফিরে আসে মনুর। সে আর কোনো রা করে না। ছাদ থেকে নেমে রমাদের বসবার ঘরে নির্বাক হয়ে বসে থাকে মনু, গম্ভীর হয়ে পড়া স্বপনের পাশে।

‘একটু আসছি’— বলে ভেতরে যায় রমা; ফিরে আসে মিনিট দুয়েক পরেই। মনুর হাতে সে পানপাতার আকারের রূপালি রঙের ছোটো একটা কৌটো তুলে দিয়ে বলে, ‘দেখ তো, কৌটোটা চিনতে পারিস কিনা?’

লাল আবীরের মিহি গুঁড়ো, নাকের ভেতরে সেই গুঁড়ো ঢুকে পড়ে সুরসুরি দিচ্ছে বার বার, বেজায় হাঁচি হচ্ছে মনুর; বালতিতে লাল-সবুজ-নীল-কালো-হলুদ রং গুলছে স্বপন, মনু আর রমা; পিচকিরিতে রং গোলা পানি ভরে তারা মারছে বিপীন, আখতার, অপর্ণা, ইসমাইল আর মাহফুজার গায়ে; বিপীনদের দলও হার মানবার নয়— এক্ষুনি তীব্র বেগে মনুর গায়ে এসে হামলে পড়বে রং গোলা পানি আর দু’হাতের পাঞ্জা দিয়ে তা আড়াল করবার চেষ্টা করবে সে!

কৌটোটা চিনতে মোটেই কষ্ট হয় না মনুর। তাদের কৈশোরে, কোনো এক দোলযাত্রার দিনে, এই ছোট্ট কৌটোটা সে রমাকে উপহার দিয়েছিল। কৌটোটা সে ভরে দিয়েছিল লাল আবীর দিয়ে। জব্বর রং খেলা হয়েছিল সেদিন! এখন বাতাসে উড়ছে লাল লাল আবীরের মিহি গুঁড়ো, নাকের ভেতরে সেই গুঁড়ো ঢুকে পড়ে সুরসুরি দিচ্ছে বার বার, বেজায় হাঁচি হচ্ছে মনুর; বালতিতে লাল-সবুজ-নীল-কালো-হলুদ রং গুলছে স্বপন, মনু আর রমা; পিচকিরিতে রং গোলা পানি ভরে তারা মারছে বিপীন, আখতার, অপর্ণা, ইসমাইল আর মাহফুজার গায়ে; বিপীনদের দলও হার মানবার নয়— এক্ষুনি তীব্র বেগে মনুর গায়ে এসে হামলে পড়বে রং গোলা পানি আর দু’হাতের পাঞ্জা দিয়ে তা আড়াল করবার চেষ্টা করবে সে!

‘আরে! এত দিনেও তবে বাক্সটা হারিয়ে যায়নি? এত গোলমাল হলো, এত বদল হলো!’ অবাক হয়েই রমাকে প্রশ্ন করে মনু।

‘খুলেই দেখ না!’ গম্ভীর কন্ঠে বলে রমা।

আবীরের কৌটোটার ঢাকনা খুলে মনু দেখতে পায়, সেখানে ধুলো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাশিল্পী, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গবেষক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম ২৪ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে, ঢাকা শহরের সিদ্ধেশ্বরীতে। তার প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের ভেতরে রয়েছে: ‘নক্ষত্রের ঘোড়া’, ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’, ‘আয়না’, ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’,  ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’ এবং ‘ঘুমতৃষ্ণা’। উপন্যাসটির নাম–‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২২-এর সৃজনশীল শাখায় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামস কলেজ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে তিনি স্নাতোকোত্তর।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।