শুক্রবার, নভেম্বর ২২

শামীম কবীরের দশটি কবিতা

0

পৃথক পালঙ্কে

(কবি আবুল হাসানকে নিবেদিত)


তুমি ঠিক পলাতক নও। আমিতো এখনো দগ্ধ তৃণভূমি
থেকে পাই উপবাসী ভেড়াদের বিক্ষুব্ধ শিং-সংঙ্কেত; তুমি
কি উটের মতো জ্বলন্ত ক্যাকটাসের জমাট জল তরঙ্গ
এখনো শুনতে চাও, নাকি ঘুমের ভেতরে শুয়ে—সমকামী
আর হিজড়েদের ত্রুটিহীন ব্রক্ষনৃত্য দেখবে? স্বপ্ন ভঙ্গ—
জানি তুমি অক্লেশে সোয়ে নাও, তবু—রাত্রির মতো নিুগামী
কালো জলে ভেসে যদি যায়—জননীর মতো অসহায়—বঙ্গ
তোমার, তুমিও তো পারবে না ঠিক এড়াতে যন্ত্রণার সঙ্গ।

তোমার মর্মমূলে নিসর্গের শীর্ণ লাশ সর্বদা কল্লোলিত
শ্মশানের প্রেতী গান গায়, অরণ্য-মঞ্চে এক অন্ধ নায়ক
রাতদিন তোমার অনুকরণে করে বৃক্ষপূজা,স্বপ্নাতঙ্কে
নীল কিশোরীর বুকে মোহন তোমার বাঁশি বাজে—উন্মোচিত
সত্য-সম জানি সব, হে-পাতক স্বর্গের বাগান পলাতক
নও তুমি, নির্বাসিত হোয়ে আছো—স্বপ্নহীন পৃথক পালঙ্কে।।


শামীম কবীর


খুব ক্রুর মুখোশের মতো মনে হয় এই নাম। অতিকায়
রূপালী তিমির মতো আমার মর্মমূলে এই খুব নিবিড়
আপন নাম নিদ্রিত রেখেছে মহিমা)—এই প্রিয় সশরীর
নাম খুব দাঁতাল মাছির মতো অস্তিত্বের রৌদ্র কুঁরে খায়
রাত্রিদিন; আষ্টেপৃষ্টে কাঁটাতার হোয়ে আছে—শামীম কবীর
এই তুচ্ছতর নাম : ত্বকের নিচে খুব নিরুপায়
এক আহত শিকারি নামের মোহন ফাঁকে জড়ায় তিমির।

ইতিহাসে অমরতা নেই। পরিবর্তে রাশি রাশি বুলেটের
দক্ষ কারুকাজ করোটিতে, দগ্ধ লাশময় দীর্ঘ উপত্যকা
আর নীলিমার বোঁটা থেকে অনর্গল—নির্ভার নিঃস্বদের
জাতীয় সঙ্গীত ঝ’রে পড়ে; ক্যাবল কুচক্রী এই নাম—পাকা
নিকারীর মতো রোয়েছে অমন য্যান, আমার সকল পথে
অক্ষয় জালের ব্যুহ কোরেছে আরোপ কোন দূর্বার শপথে।


এই ঘরে একজন কবি


এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার মতো—তার নিদ্রামগ্ন ‘ভাসমান চোখে ধীর লয়ে
শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যাল সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম শিলাখণ্ড শিয়রে তার—ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের মতো : ছিন্নভিন্ন—ছেড়াঁ জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী থেকে অপরাহ্নে রূপালী ইলিশ ছেঁকে নেবে; পচা ঘা-য়ে
গোলাপের মধু ঢালা—অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে ভ্যান। ভীষণ অস্থির
হাতে সে ক্যাবল বিষণ্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।

কবির আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে প’ড়ে থাকে সে—ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝে বদ্ধ ঘরময়
গলিত বাতাস কাঁপে—অন্তর্গত সজীব গর্জনে : বাঁধা গৎ
ভুলে গিয়ে—নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে সুরের প্রতিমা, অথচ খোলা না তার অন্ধ চক্ষুদ্বয়।।


একজন রৌদ্র

[উৎসর্গ : নূর হোসেন]


একজন রৌদ্র থেকে গাঢ় স্বরে শোনালো বিষণ্ন শব্দাবলী—
—আমার মৃত্যুর পর, এ-রকম রৌদ্র জেনো উঠবে না আর,
ফুলে ঝ’রে যাবে, থেমে যাবে পাখিদের গান, প্রগাঢ় ছায়ার
শীতে যাবে বনভূমি মাঠ ছেয়ে, শহরের সবকটা গলি
উপগলি ভ’রে যাবে ব্যাঙের ছাতায় আর অনুর্বর পলি
জ’মে যাবে শস্য ক্ষেতে; মধ্যরাত ভেদ কোরে কোনো সূর্যরঙ
আর পারবে না বানাতে প্রতিমা সুন্দরের, বেবুশ্যার ঢঙ
অবলা-মহলে জনপ্রিয় হবে খুব, হবে স্নিগ্ধতার বলি—

—আমার মৃত্যুর পরে অনেকেই কোরবে বিলাপ; কী নিবিড়
মানবিক বিলাপ ধ্বনিতে যাবে না নাভিমূল ছিঁড়ে স্তব্ধতার,
যে ভাবে বিয়োয় শিশু গর্ভবতী নারী, সে-রকমই তিমির
বিদারী হবে রৌদ্রহীনতার প্রতিবাদ : মুকুটের কিনার
বেয়ে সম্রাটের নিশ্চিত লুটারে ধুলায়, বেজন্মা দেবগণ
ঠিক জানি নির্বাসিত হবে—এই বোলে স’রে গ্যালো আরজন।।


ফুঁ


তোর নাম কী?
নেংটি
তোর নাম কি?
টুপি
যা। শিক্ষা দিয়েছি দুজনাকে। এখন আমার এক কানে একজন আরেক কানে আরেকজন তিনটে ক’রে ফুঁ দিয়ে দূর হ’য়ে যা দুইজনে। তারা দুইজন তাই’হলো : একজন এইদিকে আরেকজন ওইদিকে হাঁট দিলো তারপর পিছনে ফিরে কেউ যখন কাউকে দেখতে পেলো না থামলো তখন। এইভাবে একজন মাঠের ওইপাড় আরেকজন মাঠের ওইপাড় গিয়ে ঠিক হলো।

কিছুক্ষণ পরে সূর্য গ্যালো ডুবে। যে এইপাড় গিয়েছে তার মনে তখন ভাবনা হলো যে এখন কী করতে হবে তা তো জেনে নেই নাই। ওইপাড়ে যে সেও ভাবলো আমি কি বোকারে। এইসব ভাবতে ভাবতে তারা প্রতেম রেগে উঠলো। তারপর রাগ কমিয়ে বসে আবার ভাবতে লাগলো। শেষে ক্লান্ত হ’য়ে ঠিক ক’রলো খাদ্য খাই। কিন্তু একজনের কাছে পরনের টুপি আরেক জনের কাছে পরনের নেংটি ছাড়া দুজনার কারো কিছু নাই। এই নিয়ে আবার ভাবনা হলো তাদের। ভাবতে ভাবতে উত্তেজিত হতভম্ব হ’য়ে গ্যালো। কিন্তু কিছু পেলো না কেউই। একজন তখন ঠিক করলো যে আগে সূর্য পরে গুরু প্রাতে উঠে গুরুর সন্ধানে যাই। তারপর মাটিতে মাথা রেখে লম্ব হ’য়ে তিনটে দীর্ঘ ফুঁ দিলো শিষ তুলে। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে ঘুমোতে লাগলো তারপর।

এদিকে গুরু তাদেরকে মন্ত্র দিয়ে দুইকানে ফুঁ নিয়েই উবে গিয়েছিলো।


শামুক


সারাদিন ধোঁয়ার খেলা দ্যাখাতে হয়। একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাতে হয়। মুখ গহ্বর ভর্তি ক’রে ধোঁয়া টেনে নিয়ে তাল পাকানো। তারপর ঠোঁট গোল ক’রে জিহ্বা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে একটার পর একটা রিং ছুঁড়ে মারা। অনেকগুলি, যতোগুলি সম্বব। এ ব্যাপারে তার আছে রেকর্ড। একটানে একশো একটা রিং। তবে সে সচরাচর সাতাত্তর কিম্বা ঊনসত্তর বার রিং বের করে ধোঁয়ার। দিনে মোট চব্বিশ ঘণ্টা। এক হাজার চারশো চল্লিশ মিটির জুড়ে এইসব। তো সে সবচেয়ে মাইল্ড সিগারেট ব্যবহার করে। তাবে ওর গালে আর মুখের ভেতর জ্বালা ধরে গ্যাছে। সে ভাবছে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে কক্সবাজার যাবে। স্বাদহীন জিহবাকে লোনা বাতাস আর পানি দিয়ে সারিয়ে তোলা যাবে। আর অভিজ্ঞতা খুব দামি জিনিস। বছরে একবার সে জাফলং কিম্বা কক্সবাজার অথবা খাগড়াছড়ি ভ্রমণে যায়। বিভিন্ন স্ট্রেশনে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়। বিভিন্ন রাস্তার ধারে বিভিন্ন বাস্তব দৃশ্য দ্যাখা যায়। এইসব তার কাজে আসে। বিভিন্নবার ফিরে এসে রমমারি ঢঙে সে তার একই খেলা দ্যাখায় আবার দর্শককে। এই ভাবে চলে যাবে অনন্তর।


আতপ চাঁদ


জ্ঞান হ’লো প্রতারণা প্রিয়
তাই জ্ঞানগুলোকে প্রথমে কাঁচি দিয়ে ছেঁটে
আর ক্ষুর দিয়ে চেঁছে নামালেই
সেই একটা পরিষ্কার সাধুসন্ত মার্কা চোয়াল পাওয়া সম্ভব

অর্থাৎ চোয়াল আসছেই

চোয়ালের হাড় ও আষাঢ়ে
অস্বাসথ্য লাগা টকপাতা ঝোপটির নাম তছনছ
সংশোধিত বস্তুর দূরত্বের গড় কৃপালতা হো
শল্যকেশী ফুল এলো তারপর রংধনু ইস্টিশন তীর এলো

কারণ তুমি হ’লে বাইরের লোক

অথচ একটি মুক্ত লিপ্ত চোখ পাওয়া বাস্তবত অশালীন বটে
অসম্ভব আর যদি না চশমা বা সমুদ্রশালী পিপিলিকা যূথ
আর সূর্যাস্ত আঁকানো এই ছবিগুলি
আÍগন্ধে ভরপুর হ’য়ে ওঠে পূর্ণিমায় অমাবশ্যায়

আমি তাই হত্যাকাণ্ড যতো হয় ততো ততো ফর্সা হ’য়ে উঠি

বহুকাল আগের গোল ঘড়ি প্রাতঃস্মৃতি ভুলবার ব্যথায়
ঢং করে কিংবা নিজের প্রতিভা নিজে ভেজে খেয়ে পবিত্রাকার ভাঁজ
আমি কিন্তু মাথা ভেঙ্গে ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছিটিয়ে রাখলেও
এখনো দ্বিধার কাছেই লাঠি খোঁচাখুচি করে বোকা আর্মস্ট্রং

এইভাবে চাঁদও এসে যায়

চাঁদে পড়ে ঊরুগুলো পুঁতে রাখাই সার অনন্তর
মাটি সুদ্ধো ফাঁপা ধুলো সুপ্ত ধনের সচিত্র সিরিঞ্জ আর তারও নিচে
বীজের মধ্যে কলহপ্রবণ এক বামনের হাত
চোয়াল বিভক্তি রেখা লুকিয়েই রাখে অতি তিলে

হায় তার ভাঁপ জানাবার ভাষা নাই
হায় তার তাপ হারাবার আশা নাই


অথচ আমার চোখ


কেউ কেউ বলে বটে—এ আমার ভুল প্রেম। এ-রকম—খোঁড়া
নর্তকীর সাথে রাস্তায় বেড়ানো, আশে-পাশে লক্ষ মানুষের
খুব ঝাঁঝালো অবস্থিতি অগ্রাহ্য কোরে—খোলা সড়কদ্বীপের
ধারে পা ঝুলিয়ে বোসে তার তেজী নৃত্যকলাময়—সুতো ছেঁড়া
অতীতের নিখাদ মলিন গন্ধ শোঁকা, খুব অন্যায়। তা-ছাড়া
যে সুরের রেশ নেই বর্তমানে, নিহত যে পাখি, এ-তো ঢের
বোকামী—তার দগ্ধ পালকের নিচে প্রচ্ছন্ন অবচেতনের
ঘোরে প্রকৃত উষ্ণতা অন্বেষণ; এ-তো অতি স্বপ্নেরও বাড়া।

অথচ আমার চোখে বিস্ফোরণের মতো লাল-নীল, ঈষৎ
ম্লান জ্বলে ওঠে দীপ্র ঝাড়বাতি, চন্দ্রালোকি জলসাঘর—
তবলায় তুফান, তুমুল নূপুর ধ্বনি, তন্ময় নহবত
কানে বাজে অবশেষে—কুয়াশায় নর্তকীর হিল্লোলিত ঊরু,
পদ্মের পাতার মতো পায়ের কাপন আর বক্ষ তোলে ঝড়
আমি দেখি, আবার—খোঁড়া নর্তকীর পায়ে তীব্র নাচের শুরু।।


জন্মান্ধের ভূমিকা


জন্মাবধি অন্ধ হোয়ে আছি—সশরীর, এড়িয়ে ধুলোর মতো—
গাঢ় রৌদ্রালোক দুইচোখে। বয়েসী বটের মূলে গুপ্ত ক্ষত
দেখিনি তাকিয়ে কোনোদিন, অথবা আড়ালে থেকে নির্নিমেষ—
জ্যোৎস্নালোভী নারীদের পাহাড়ী গ্রীবার ভাঁজে তীব্র অনুদিত
গোলাপ শিশু; পরিবর্তে আমার চৈতন্য স্রোতে কি দগ্ধ শেষ
নিঃশ্বাস ফেলে ছায়া হয় ইতস্তত ছিন্ন মেঘেরা; ঘুমন্ত
ঈশ্বরের মতো, মনে হয়—বহুকাল প’ড়ে আছি জলশেষ
শুকনো কাদায়, ত্বকের নিচেও আছেও খুব গাঢ় ছদ্মবেশ।

আমার গুহার বার্ণিশে সবুজ সতেজ অর্কিড প্রতিদিন
রৌদ্র খায়, বাতাসের উন্মুক্ত গালিচায় নির্ভেজাল প্রাচীন
অশথের মতো ছড়ায় শেকড়; ক্যাবল স্মৃতিনষ্ট আফিমে
আŽছনান রোয়েছি বোলে, গুহার আঁধারে আমি মায়াবী পিদিমে
খুঁজি রৌদ্রের প্রতিমা, আর ক্রটিহীন জন্মান্ধতা হেতু—করি
আরাধনা নর্তকীর : নির্ভুল মুদ্রায় নেচে যদি পাই সিঁড়ি।।


সমুদ্র দণ্ড


বস্তুত কোনোদিন ভুলেও কোনো কটু বাক্য বলিনি কাউকে
আমি, কারো মনে কোরিনি আঘাত, বরং নিজের দীনতাকে
রেখেছি আড়ালে বরাবর, নীরবে হীনগোত্রের— চতুষ্পদের
মতো অন্যদের ছায়ার পিছনে খুব ঘুরেছি খুঁড়িয়ে। যাকে
বলে প্রকৃত প্রণয়, তার পাইনি আস্বাদ; শুধু নারীদের
ছায়া শরীরের ঘ্রাণে কাতর হোয়েছি আর আঁধার রোয়াকে
বোসে দূরাগত কলহাস্য-গম্ভীর গর্জন শুনেছি তাদের—
কোনোদিন পারিনি নিকটে যেতে, শুধু জাল বুনেছি স্বপ্নের!

অথচ সবাই মিলে আমাকে দণ্ড দিলে— সমুদ্রে যাবার
আমিতো ধুলোর মতো ছিলাম পায়ের নিচে, স্তব্ধতার হিমে;
সব ভার সোয়েছ নিরবে : তোমাদের কাণ্ড-কীর্তি অবিকার
দেখে গেছি; এমনকি হদয়ের প্রতিশোধ স্পৃহাটুকু ঘুমে
জাগরণে কখনোই কোরিনি প্রকাশ। শুধু ভুলে একবার
আকাশ দেখেছি বোলে আমাকেই দণ্ড দিলে সমুদ্রে যাবার?

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।