ধ্বনির সিম্ফনি ও অনেকটা আড়াল নির্মিত অনুভূতির শাব্দিক অনুবাদই কবিতা
কবিতা কী— এর ব্যাখ্যা দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। বলা চলে অনেকটা অসম্ভব। কারণ কবিতার কোনো আদর্শ সংজ্ঞা আমি এখনো পর্যন্ত স্থির করতে পারিনি, আর কখনো পারব এমনটা যেন না হয়। কবিতা বলতে আমি বুঝি একটা অবস্থা, একটা চেতনা, একটা অনুভূতি, কিছু বলতে ও করতে পারার আনন্দ—যার পরিধি অসীম। যা শব্দ দিয়ে নির্মিত কিন্তু শুধুই শব্দ না। শব্দ অনুভূতি ছুঁতে পাওয়ার সিঁড়ি মাত্র। কবিতার সংজ্ঞা নিজে নির্ধারণ করতে না পারলেও সংজ্ঞা গ্রহণের ব্যাপারে আমি ভীষণ উদার। অর্থাৎ এমন সব নিতে আপত্তি নাই যে; যতজন যতভাবে কবিতা লিখছে—কবিতা ঠিক ততপ্রকার, আর দাবিকৃত সব বস্তুই কবিতা।
সব ব্যাপারকে কবিতা হিসেবে মানলেও কবিতা বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু ধারণা আছে। যা পরিবর্তনশীল, অস্থির। অর্থাৎ আগের ধারণা পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমানে এসেছি, বর্তমান চিন্তা হয়তো নিকট ভবিষ্যতে বা ভবিষ্যতে পরিবর্তন হয়ে যাবে। কবিতা বলতে মনে হয় একটা বোধকে যার অবকাঠামো নির্মিত শব্দে আর যার ভিত্তি অনুভূতি। ইশারা নির্ভর কিছু টুকরো-টুকরো ছবি, কিছু ব্যক্ত-অব্যক্ত ধ্বনির সিম্ফনি ও অনেকটা আড়াল নির্মিত অনুভূতির শাব্দিক অনুবাদই কবিতা। দেখা, শোনা ও অনুভবের জগতে যার যুগপৎ ভ্রমণ। আর এই বোধ নির্মাণের প্রথম সচেতন চেষ্টায় আছে বাক্যের কাঠামো পরিবর্তন এবং যতটা সম্ভব কবিতা থেকে কাব্যিকতা বিয়োগ করা। পূর্ণাঙ্গ চিত্রকে ভেঙে পিক্সেলে রূপান্তর করে তাদের মধ্যকার সেতুটা ডুবিয়ে পাঠককে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে এনে দাঁড় করানো; যেখানে তারা নিজেদের চোখ ও মনন দিয়ে ঘটনার দিক নিয়ন্ত্রণ করবেন। অর্থাৎ কবিতা ও পাঠকের মধ্যে থেকে কবিকে অপসারণ করা যেন কবি পাঠকের সাথে মাস্টারি করতে না পারে। পাঠককে স্বাবলম্বী করার চেষ্টা থেকেই আমার এই কারসাজি।
প্রকৃতির নিজস্ব একটা ছন্দ আছে, আছে সুর-তাল-লয়ের অভূতপূর্ব অর্কেস্ট্রা। প্রচলিত ছন্দ এই সুর-তাল-লয়ের বাইরে না। কিন্তু আমি চাই এই শিক্ষিত ও স্বীকৃত ছন্দের বাইরে থেকে অন্য এক ছন্দকে আনতে, যা স্বতঃস্ফূর্ত। কবিতায় যে আপনিতে জায়গা করে নেয়, যা পরিমাপের জন্য মিটার-স্কেলের প্রয়োজন হয় না।
দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গে আসা যাক। বোধ্যতা-অবোধ্যতা আপেক্ষিক—ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ভিন্ন। প্রসঙ্গ হলো কবিকে কবিতা লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে হয়। সৎ কবির উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই প্রস্তুতি বিহীন ব্যক্তিগত দিনলিপির রসঘন কাব্যিক বয়ান নয়। কবি যেহেতু প্রস্তুতি নিয়ে আসেন তাই পাঠকেও কবিতা পড়ার জন্য আন্তরিক শ্রমটুকু দিতে হবে। তাহলেই কেবল পাঠক, কবিতা ও কবির মধ্যকার দূরত্ব কমেতে পারে।
কবিতা কেন লেখি এই প্রশ্ন হয়তো পুরোনো কিন্তু উত্তর কেন যেন বারবার নতুন হয়ে যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন মঞ্চ তৈরি করে আসছে। কেউ ছবি এঁকে, কেউ নৃত্যে, কেউ গল্পে-নাটকে কেউবা কবিতায়। এই নিরবিচ্ছিন্ন মানব সার্কেলের একক হিসেবে আমিও নিজেকে—নিজের ভাবনা, নিজের আনন্দ, নিজের বোধ প্রকাশের জন্য কবিতাকে বেছে নিয়েছি। আঁকায় দক্ষ হলে হয়তো আঁকতাম কিন্তু হায়— কবিতা ছাড়া ভিন্ন জবান নাই।
ইভা ব্রাউন ও অন্যান্য কবিতা
মেলোডি অব লোনলিনেস
আর আমি সেইসব মাছেদের শ্রমণ
যারা তাবৎ সময় জলে ডুবে মরো মরো।
না আমি সাঁতারে সক্ষম, না আছে ভেসে থাকার পরম পারঙ্গমতা—
তবুও ডুবটা ঠিক ভরাডুবি হলো না কখনো!
ছেড়ে যাব জলাশ্রম, পাহাড়ের কাছে যাব ফিরে—
একশ বছর ঘুমিয়ে থাকব গুহার নির্জন ভিতর—
শরীর থেকে বের করে দেব যা কিছু দাহ্য, যা কিছু ধোকাতো ধিকধিক।
অবরোধ নামাব তৃষ্ণার সকল জিহ্বার উপর।
দেওয়ালের কান থেকে তুমিও জানবে একদিন—
পাহাড়ের ধ্যান উপাখ্যান।
ঝরনা মাত্রই পাহাড়ের কাম প্রবাহ এই সত্য জেনে—চেপে যাবে ঝরনা-স্নানের তাবৎ সংকল্প।
যখন ফিরব তোমার দেশে—একবুক কাঁচাপাকা রোমে,
সেদিনও স্কিপ করে যেও, শতাব্দীর করুণ নিঃসঙ্গতা।
গোপন গীতিকার বাইনারি
ঘুম খুলতেই বেরিয়ে আসছে রাশিরাশি ধান—
হেমন্তের রোদ—শরীরী নরম—চড়ুইভাতির উষ্ণতা।
ছায়ার আবডাল রটিয়ে যাচ্ছে—আগামী সূত্র।
যারপরনাই ডুবে যাচ্ছে মহাজাগতিক ক্রাফট—সর্পিল আলোর রেখায়।
চিবানো লবঙ্গ ক্লাসে শিখে অধিকফ বিদ্যা
ঠোঁট মেনে নেয় ব্রাকেট শাসন।
রোমাঞ্চিত ছলাতসহ যমুনা এলে করতলে
আঙুল ডগায় ফোটে মোরগ সদৃশ ফুল।
এমন উজানি রাতে কুয়াশারা পেলে গাছেদের কম্বল মহত্ব—
উৎসাহী আলোর তল্লাসিতে লুকায় ক্ষয়িষ্ণু লিপিস্টিক বহর।
যদিও স্মরণিকা থেকে খসে যাবে প্রবচনগুচ্ছ,
দোহায় থাকবে না কোনো গোপন গীতিকা।
তবুও সিল্কের রুমাল জুড়ে থাক তোমার আমার বাইনারি স্বাক্ষর!
কোয়ারেন্টিন
সঙ্গনিরোধে শুক্রবার—
নৈমিত্তিক দুপুরে রোদ শিশুরা
পালানে খেলতেছে ঢেউ সমুদ্র;
গ্রামত্যাগী মহিলা দেখতে আসছে পুরনো ভিটে।
সেখানেই দেখতেছি—রেফারি বাতাসের ফুঁ নির্দেশে
ধুলো আর ঝরাপাতাদের মিটারহীন ম্যারাথন।
একক দর্শক প্রতিযোগিতায় গুনে নিচ্ছি
ফেলানো বিড়ির পুটকি, পাওয়ার টিলারের
ফাল ঘোরানোর শব্দ আরআর মাকড়ের ফিসফাস।
জুম্মার আজান হচ্ছে—
ভিটের পাশের বারোয়ারী কবর থেকে
মুর্দারা উঠতেছে পূর্ব-পশ্চিম ভেঙে—
আসতেছে ভিটের দিকে; মুখোমুখি বসতেছে সবাই।
আজ জলসাদিন— ভরপুর মদ হবে, নাচ হবে—
এই দুপুরের শেষ নেই এই আজানের শেষ নেই…
তিনশ বছরের পুরনো মুর্দা করোটিতে ঢালতেছে
শরাবান তহুরা; যুবতী মুর্দার কোমরে মেহগনি ছিপ
আজানের মিউজিকে শরীরে দোলাচ্ছে চৌষট্টি দোল!
এখানে জিঘাংসা নাই, মহামারী নাই শোক নাই!
আর্তগন, কাতুরে দুর্গত নিয়ে ডুবে যাও জলসা বাইরে!
ইভা ব্রাউন
মনতন্ত্র নেড়ে পাওয়া যায় একজন ইভা ব্রাউন
অনেক ভ্রমণ পথে যে ছিল ফুয়েল ও সিরাকায়।
এই ডিস্টোপিয়া ছায়াবৃত্তে আর কোনো উজ্জ্বল
নক্ষত্র নাই, আর কোনো নীল দেখিনা অঢেল কালোয়।
ইভা ব্রাউন, আমার মায়ের নাম কুয়াশা
নদী, সাদা মরাল ভাসে যার গায়ে। আমাদের
গায়ে এক বাবা বাস করে লজ্জা যার অনূদিত নাম।
ইভা, আমি আজ একক শরনার্থী এই শিরোনামে—
আমার ভেতরের সাদা–রঙ বাঘেরা গোঙরায়—
গোঙরায় অনার্যকালীন তীরের আঘাত নিয়ে বুকে!
আয়রনির মোয়া খেতে খেতে উল্টাই বাণী চিরন্তন,
ওরা বলে প্রতিটা সুর্যদিন অন্য এক জীবনের মানে।
এই লোমশ পাঠাদের শিং থেকে আমাকে ফেরাও।
একবার যেতে দাও ঋণের কাছে, যেতে দাও নদীর বুকে—
পেয়ে যাই যেন একপক্ষকাল মরালের আয়ু!
এরপর ব্রাউন আমার লাল আর্মি ঢুকে গেলে ঘরে
হয়ে যাও শেষ ম্যাগাজিন, দিয়ে দাও শেষ আলিঙ্গন।
জন্মান্তর
আবার সকাল হয় —পতন হয়ে গড়ে ওঠে নতুন
মাচুপিচু। আবার মরে যেয়ে বেঁচে উঠি আমি।
হাম্বুরাবি অথবা নেবুচাঁদের চায়ের আড্ডা থেকে
আচমকা চুম্বনে জেগে উঠি কোন এক প্রশান্তীয় দ্বীপপুঞ্জে।
মনে করে দেখো সিন্ধুর জল ছুঁয়ে
ভারত সাগর… ইরাবতী যখন তুমি, কাছের কোনো
এক বদ্বীপ জুড়ে সৃষ্টি করে গেছি ম্যানগ্রোভ প্রেম।
কবি