টানা তিনদিন এতিমের মতো মনমরা হয়ে বসে থাকার পর হাবিলের মনে হলো— এর একটা বিহিত করা চাই। সে বিছানা থেকে উঠে ঘরের দরজার সামনে কিছুক্ষণ বসে থাকল। বর্ষার জলের ভেতর ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক শুনে তার মনে হলো, বোবা প্রণিটির চেয়েও সে অধম। অথচ ব্যাঙগুলি নতুন জলে বাসা বানিয়ে নিজেদের মতো সংগীত রচনা করে। ওরা একে অপরের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়, কখনও কোরাস গায়। ঝুম বর্ষার পরে পৃথিবী যখন ঝরঝরে আর শীতল হয়ে আসে, আকাশে চাঁদের ক্ষীণ রেখা দেখা যায়, ব্যাঙগুলির সংগীত ধীমালয় থেকে ঊর্ধালয়ের কোরাসে জমে ওঠে। ওদের আনন্দমুখোর বসবাসে অন্য কোনো প্রাণি বাধা দিতে আসে না। অথচ, গত পঞ্চাশ বছর ধরে যে বাড়িটিতে হাবিল বসবাস করছে সেখানে না-কি তার অধিকার নেই!
১৯৯৬ সালের ৪ঠা আষাঢ় রোজ মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিবেশি আবু ছায়েত মোল্লা তার পিতার নামের এসএ খতিয়ানের বারাতে হাবিলকে উচ্ছেদের মৌখিক নোটিশ দিল। গ্রামের কয়েকজন হোমরা-চোমরা নিয়ে হাবিলকে এমনভাবে শাসিয়ে গেল, যেকোনো মুহূর্তে সে বাড়ি-ঘর দখল করবে।
১৯৯৬ সালের ৪ঠা আষাঢ় রোজ মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিবেশি আবু ছায়েত মোল্লা তার পিতার নামের এসএ খতিয়ানের বারাতে হাবিলকে উচ্ছেদের মৌখিক নোটিশ দিল। গ্রামের কয়েকজন হোমরা-চোমরা নিয়ে হাবিলকে এমনভাবে শাসিয়ে গেল, যেকোনো মুহূর্তে সে বাড়ি-ঘর দখল করবে। এ কথা সত্য যে, হাবিলের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই, তার বাবা তার যখন ছয় বছর বয়স তখন মারা যায়। তারপর তার মা লালবরু খাতুন এই ভিটায় তাকে নিয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেছে। অথচ গত পঞ্চাশ বছরে ওদের কেউ কিছু বলেনি।
হাবিলের এমন কোনো আত্মীয় স্বজনও নেই যেখানে গিয়ে সে বিপদে পড়া বিষয়টি নিয়ে আলাপ করতে পারে। তার স্ত্রী আমেনা বেগম তাকে পরামর্শ দেয়, গ্রামের বুড়ো মোক্তার মুছুল্লির কাছে পরামর্শ নিতে। হাবিল খায় না, গোসল করে না, ঘুমায় না এমনকি সারাদিন দরজার সামনে নিশ্চল মানুষের মতো বসে থাকে। তার একবার মনে হয়, আবু ছায়েত মোল্লার ছাড়ানো মেয়ের সঙ্গে তার রাতের যে সম্পর্ক ছিল সেটা চালিয়ে গেলেই ভালো হতো। যেকোনো মুহূর্তে স্বামী ছাড়া মেয়েটির প্যাট হলে আবু ছায়েত মোল্লাকে সমাজের সামনে জব্দ করা যেত। তার ভালো মানুষির জন্য সম্পর্কটা দু’চার রাতে বাঁশ বাগানে সঙ্গমের বাইরে আগায়নি। আবু ছায়েত মোল্লাকে ঘায়েল করার জন্য হাবিল অন্য কোনো পথ খুঁজে পায় না। স্ত্রী আমেনার কথা মতোন মোক্তার মুছুল্লির কাছে গিয়ে হাবিল জানতে পারে, এটা প্রিয়ামশন মামলার জমিন। ১৯৫৬ সালে তার বাবা নীকটাত্মীয়ের সম্পত্তির বিক্রিত অংশ আদালতে টাকা দাখিল করে রায় পেয়েছিল। তখন মাঠে এসএ জরিপ চলছিল কিন্তু হাবিলের বাবা ডিক্রিপ্রাপ্ত সম্পত্তি নিজের নামে খতিয়ানভুক্ত করার আগেই মারা যায়। রায়ের নকল কপি হাবিলের বাবা কোথায় রেখে গেছে জানা নেই। হাবিল দুশ্চিন্তায় পড়ল।
হাবিলের স্ত্রী আমেনা দেখতে খুবই সাধারণ। কারণ নিরক্ষর হলেও হাবিল ছিল সুপুরুষ আর তার লম্বা চওড়া শরীরটা মানানসই। সে তুলনায় তার স্ত্রী ছিল বেটে, মোটা তবে চালাক-চতুর। আমেনার মোটা নাক আর চওড়া মুখমণ্ডল। কিন্তু সেই সাধারণ নারীর সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে হাবিলের সুখের সীমা নেই। আমেনা হাবিলকে বুঝিয়ে বলল, ফাউলতা চিন্তা হইরেন না তো, কাইল বেয়ানেই কাগজ উডাইতে যামু।
পরদিন সকাল দশটায় ডিসি কোর্টের মসজিদের দক্ষিণ পাশে দাঁড়িয়ে এক হুজুর কিসিমের লোকের কাছে হাবিল জানতে চায়— ও মেয়া, মফিজখানাডা কোম্মে?
হুজুরমতো লোকটা মফিজখানা চেনে না। আর কোর্ট-কাছারিতে এরকম কোনো খানা আছে বলেও তার জানা নেই। সে উত্তর দিকে তিনতলা দালান ইংগিত করে বলল, উদিক যান।
হাবিল আর আমেনা উত্তর দিকের দালানে গিয়ে এক মহুরির কাছে আবার জানতে চাইল, মফিজখানার কথা। মহুরি একশ টাকার বিনিময়ে কোর্ট বিল্ডিংয়ের পশ্চিম মাথায় নিচু জমিতে একতলা দালান দেখিয়ে দেয়। আমেনা কিছু কিছু পড়তে জানে। সে মুখে আঁচল টানতে টানতে দরজার সামনে টিনের পাতে লেখা ‘মোহাফেজখানা’ শব্দটি নিজের মতো করে মফিজখানাই পড়ল। কিন্তু সেখানে কয়েদখানার মতো এমনভাবে গেট লাগানো, ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল গোঁফে পাকধরা কালো মতোন একজন লোক কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছে। হাবিল আর আমেনার লোকটিকে ডাকার মতো সাহস হয় না। আমেনা মিন্তির মেয়ে। তার বাবা সাহেবদের সাথে বোঝা টানার পয়সা নিয়ে তর্ক করে আর কথায় কথায় বলে— দুননাইডা কি মগের মুল্লুক!
এই কথার অর্থ আমেনা জানে না তবে মিন্তির মেয়ে হওয়ার দরুণ স্বভাবে শান্ত হলেও বাবার মতো সাহস আছে তার। সে মোহাফেজখানার গেটের তালায় কয়েকটা ঝুলন দেয়। তখন ভেতর থেকে নাকের ডগা থেকে চশমাটা উপরে তুলে রেকর্ড কীপার জাহাঙ্গীর গেটের কাছে আসে। কীপার হাবিলের হাতে থাকা সন-তারিখের চিরকুটখানা ভেতরে নিয়ে যায়। মিনিট কুড়ি পরে এসে সে জানায়— মূল বালাম পোড়া খাতায় গ্যাছে। মামলার আদেশ নাই, তয় রেজিস্টার আছে। চাইলে দেতে পারি।
ফেরার পথে হাবিলের বউ আমেনার চোখে পড়ে, কিপার লোকটির বাম হাতের কনিষ্ঠা আঙুলটা নেই। লোকটির কপালের মাঝ বরাবর গভীর একটা কাটাদাগ চন্দ্ররেখার মতো এঁকে আছে। লোকটির চারটা আঙুল সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে আর সে স্বাভাবিক ভাবেই নথিপত্র সামলায়। সে কালো হাতদুটো টেবিলের ওপর রেখে বলে— যদি নথির কোনো ছেঁড়া অংশও পাওয়া যায় তাইলে তোমাগো খবর দেব।
বাড়িতে এসে হাবিল তার জীবনের অতীত ভবিষ্যতের কথা ভেবে হাপিত্যেস করে। জীবনের সাধ আহ্লাদ নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই কারণ তার জীবনের যেসব অতীত তাকে সুখি করেছে তা খুবই সামান্য সময়। বরং জীবনে যেকোনো কারণে দুঃখ পাওয়ার দিনগুলি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। সে আমেনাকে বলে— সকাল হলেই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বস্তায় ভরে শহরে যাবে। সেখানে যতদিন লাগুক থাকবে আর মফিজখানায় রায়ের কাগজটা খুঁজে দেখবে। প্রথম প্রথম যদি কোনো ঝামেলা ছাড়া কাগজটা উদ্ধার করা যায় তবে ভালো, না হলে জাহাঙ্গীর কিপারের বাসা খুঁজে দুজন তার কাছে যাবে। আর তাদের জন্য কাগজটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ কিপারকে সেসব বুঝিয়ে বলবে। ওরা শহরের কাঠপট্টি বস্তিতে ওঠে আর সেখানকার মানুষের সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই আমেনার ভাব জমে যায়।
হাবিল এক গ্যারেজের মহাজনের থেকে রিক্সা ভাড়া নিয়ে শহরের এমাথা থেকে ওমাথায় চালায়। ও যখন কোর্ট-কাছারির সামনে দিয়ে বকের মতো গলাটা উঁচু করে রিক্সায় প্যাডেল মারে তখন মফিজখানার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। তার মনে হয়, রায়ের রেজিস্টার যখন পাওয়া গেছে নিশ্চয়ই সেসবের নথি আছে। আর সরকারি বালামে লেখা রায় পুড়ে ফেলার কথা অবিশ্বাস্য।
হাবিল এক গ্যারেজের মহাজনের থেকে রিক্সা ভাড়া নিয়ে শহরের এমাথা থেকে ওমাথায় চালায়। ও যখন কোর্ট-কাছারির সামনে দিয়ে বকের মতো গলাটা উঁচু করে রিক্সায় প্যাডেল মারে তখন মফিজখানার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। তার মনে হয়, রায়ের রেজিস্টার যখন পাওয়া গেছে নিশ্চয়ই সেসবের নথি আছে। আর সরকারি বালামে লেখা রায় পুড়ে ফেলার কথা অবিশ্বাস্য। সপ্তাহের প্রথম অফিসের দিন অর্থাৎ রবিবার হাবিল মফিজখানা গিয়ে জাহাঙ্গীর কিপারের চেয়ারের পাশে মিনতির ভঙ্গিমা করে দাঁড়ায়। সে বলে, যদি আপনের কাছে কুনো পরামস্য থাহে তইলে কইয়া দ্যান। রায়ের নকল লইয়া খুব ঝামেলায় আছি।
জাহাঙ্গীর কিপার একগাল হেসে বলে, বাপু কিছু মানুষের জগতে আসাটাই হইল পাপ। তুমি সেই পাপের মইধ্যে নিমজ্জিত। যদিও এতে তোমার কোনো দোষ নাই। কেননা, ১৯৫৬ সালের খতিয়ান তুমি বা তোমার বাপ, কেউই রেকর্ড করো নাই। আর তোমাদের পাপ হইল গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রের প্রতি উদাসীনতা। এই উদাসীনতা তোমাগোর কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তার ইয়ত্তা নেই। তার চাইয়া বরং হাজার খানেক টাকা দিয়া যাও, আরও খুঁজেটুজে দেখি।
মঙ্গলবার দিনটা বিশেষ মন্দ নয়, হাবিলের মনে হয়— আজ মফিজখানায় গেলে কোনো মঙ্গলময় সংবাদ থাকলেও থাকতে পারে। হাবিল দুপুরের দিকে মফিজখানায় যায় আর তার সাথে নিয়ে যায় তারই একজন সহকর্মী রিক্সাওয়ালা। ওরা মফিজখানার প্রাচীরের সামনে জেলখানার মতো দেওয়া রডের ওপর হাত রেখে জাহাঙ্গীর কিপারের দিকে চোখ ইশারা দেয়। লোকটি ফিরতি ইশারায় জানায়— কিছু পাওয়া যায় নাই।
হাবিল বাসায় ফিরে দেখে ঘরটা জঞ্জালে ভরা। জিনিসপত্র সব এলামেলা, মনে হয় কোনো চোর ঘরের ভেতর ঢুকে এমনর বেহাল দশা করেছে। কিন্তু আমেনা আশা সমিতি থেকে ফিরে এসে হাবিলকে বলে— কুত্তা।
তুমি আমারে কইলা? হাবিল জানতে চাইল।
না। কুত্তায় জিনিসপত্তর এলোমেলো করে খাওন খুঁজছে।
কোম্মে গেছিলা তুমি?
ওই তো আশা সুমিতিতে এক মাতারি লোন নেছে মোরে জাবিন বানাইয়া।
হাবিল বিরক্তির শ্লেষ নিয়ে বলল, এইসাপ ঝামেলায় তোমার যাওন ঠিক অয় নাই।
পরে হাবিলের কথাই সত্য হয়। দশ হাজার টাকা নিয়ে মহিলা লাপাত্তা হয়। তখন কিস্তির টাকার জন্য চাপ আসে আমেনার ওপর। আসলে এটা সত্য যে, আশা সমিতির ফিল্ড অফিসারের করার কিছু ছিল না। কেননা, নগদে বিতরণ করা টাকার কিস্তি অফিসে জমা করতে না পারলে তার পকেট থেকে গুনতে হবে। ফলে দুপুর থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত অফিসার হাবিলের বাসার সামনে বসে থাকে। কিছুটা মৌন হুমকিও দেয়। টাকা নেওয়া সেই মহিলাকে খুঁজে বের করতে না পারলে আমেনার পুরো টাকা গুনতে হবে। তাই রাত দ্বি-প্রহর হওয়ার পর আমেনা আর হাবিল কাটপট্টি বস্তি ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে আসে। নিজেদের বাড়িতে ওদের উঠতে মানা। সালিশ ব্যবস্থায় সাব্যস্ত হয়েছে রায়ের কাগজ দেখালে বাড়িতে বসবাস করা যেতে পারে। কিন্তু রেজিস্টারের যে কপি কিপার দিয়েছে সেখানে বাদী-বিবাদীর নাম ছাড়া তফসিল বিবরণ নেই। ফলে সালিশ ব্যবস্থার মোড়লরা কাগজটি আমলে নেয় না। ওরা এক মুরব্বি সালিশের কাছে জানতে পারে, ঢাকা শহরের সাতরাস্তায় ট্রাকস্ট্যান্ডের কাছে সকল কাগজের কপি পাওয়া যায়। সেখানে গেলে বাংলাদেশের যে প্রান্তেরই হোক, মানুষ কাগজ সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরে। প্রথম রাত ওরা চুরি করে নিজেদের ঘরে ঘুমায়।
পরদিন সকাল সকাল দুজন ঠিক করে ঢাকার সাতরাস্তায় রায়ের কপি খুঁজতে যাবে। অথচ হাবিল কখনো ঢাকা যায়নি। তার কাছে রাজধানী শহরটা বহু বহু মাইল দূরের কোনো অদেখা শহর। সেখানে যেতে হলে সারারাত লঞ্চের পাটাতনে শুয়ে থাকতে হয়। প্রকৃতিতে ভোরের আভাস ফুটে ওঠলে একটা দুটো দালানের আবছা রেখা চোখে পড়ে। পথে পদ্মা মেঘনার স্রোত ভয়ঙ্কর। কখনও লঞ্চ চড় চড় করে কেঁপে ওঠে। আমেনা বলে মুই পদ্মা, মেঘনা দ্যাকতে চাই। ছুডুকাল হইতে ঢাকার দালানকোডা দেহার বেমালা শখ।
লঞ্চটা সরিসৃপের মতো বুক, পেট জলে ভাসিয়ে উত্তর দিকে সাঁই সাঁই করে চলে যায়। সন্ধ্যায় সামান্য চওড়া নদী দেখে আমেনার মনে স্বপ্নের মতো পদ্মা মেঘনার বিশালদেহী নদীটা চোখে ভাসে। অথচ, ক্লান্তিতে ওরা অন্য মানুষের সাথে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু পদ্মা মেঘনা দেখা হয় না। ভোরে সাইরেন বাজিয়ে লঞ্চটা পণ্টুনে যখন ধাক্কা মারে তখন মানুষ নড়েচড়ে ওঠে। কিছুক্ষণ আগে ভোরের বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাতলা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
ওরা বিকেলে এমভি কদম রসুল লঞ্চে ওঠে। সন্ধ্যার পর বগা স্টেশনের মানুষের গাঠুরি-বোচকাসহ লঞ্চে ওঠার দৃশ্যটা আনন্দ নিয়ে দেখে। রাতের আঁধার ঠেলে লঞ্চটা সরিসৃপের মতো বুক, পেট জলে ভাসিয়ে উত্তর দিকে সাঁই সাঁই করে চলে যায়। সন্ধ্যায় সামান্য চওড়া নদী দেখে আমেনার মনে স্বপ্নের মতো পদ্মা মেঘনার বিশালদেহী নদীটা চোখে ভাসে। অথচ, ক্লান্তিতে ওরা অন্য মানুষের সাথে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু পদ্মা মেঘনা দেখা হয় না। ভোরে সাইরেন বাজিয়ে লঞ্চটা পণ্টুনে যখন ধাক্কা মারে তখন মানুষ নড়েচড়ে ওঠে। কিছুক্ষণ আগে ভোরের বৃষ্টি হয়ে গেছে। পাতলা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। পণ্টুনের দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো গাছের পাতা ভিজে এক সার। পাতাগুলোয় বিজলির আলোয় বৃষ্টির জল চিকচিক করে আর ওগুলো হালকা বাতাসে দোল খায়। বৃষ্টি থামার পর শুরু হয় বুড়িগঙ্গার গন্ধভরা বাতাসের প্রবাহ। গন্ধটা লঞ্চের পাটাতনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হাবিল আমেনাকে ঠেলা দিয়ে উঠায়— আমু দ্যাক, ঢাকা শহর আইয়া পড়ছি।
ওরা হাঁটাপথে বাহাদুরশাহ পার্ক হয়ে গুলিস্তানের দিকে যায়। পথে যেতে যেতে এত গাড়ির মহরা দেখে তাদের আশ্চর্য লাগে। গাড়িগুলো কী করে পরস্পরের গায়ে না লেগে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ওরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গুলিস্তান গিয়ে রাস্তার পাশ থেকে চিতই পিঠা খেয়ে দুজনে দু’গ্লাস করে পানি খায়। ফুলবাড়িয়া থেকে সাতরাস্তার রিক্সায় ওঠে।
সাতরাস্তা গিয়ে হাবিল আর আমেনা এদিক ওদিক তাকায়। ভলিবলের কোটের মতো সেটেলমেন্ট অফিসের সামনে পাকা মাঠ। কোথাও কোনো লোকজন নেই। শুধু সামান্য দূরে বসে একজন বুটপালিশওয়ালা একা একা বিড়ি টানছে। আরেকটু দূরে ভ্যানের ওপর একজন লোক বনরুটি আর কেক সাজাচ্ছে। ভ্যানের একপাশে চায়ের বড়ো সাইজের ফ্লাস্কের মুখ খোলার পর গরম জলের ধোঁয়া উড়ে যায়। একটু পর সেখানে কতগুলো কাগজ বগলে গুঁজে একজন কালো লোক আসে। সে কোথা থেকে যেন একটা কাঠের টুল জোগাড় করে সেটার ওপর বসে পড়ে। লোকটি হাতের ইশারায় আমেনাকে ডাক দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। আমেনা ইশারা বুঝে কাছে এলে কালো লোকটি বলে, কী দরকার?
লোকটির জিজ্ঞাসার ভঙ্গি এমন যেন কোনো মক্কেল খুঁজছে। আমেনা হাবিলকে ডেকে আনে আর হাবিল কিপারের কাছে পাওয়া রেজিস্টারের কপি লোকটির হাতে দিয়ে বলে— মামলার কাগজ চাই।
লোকটি ঠোঁট বাঁকা করে বলে, আছে। দশ হাজার টাকা লাগবে।
দশ হাজার! শুনে আমেনা চোখ কপালে তোলে। সামান্য একটা কাগজের মূল্য যে এত হতে পারে সেটা তার জানা ছিল না। শেষে পাঁচ হাজার টাকায় রফা হয়। একে তো গরিব মানুষ তার ওপর হাবিলের দরাদরি করার মতো অভ্যাস আছে। লোকটি টুল ছেড়ে ছোটো ছোটো পায়ে সেটেলমেন্ট অফিসের ভেতর যায়। এক ঘণ্টা পর ভেতর থেকে এসে হাবিলের হাতে দুটো কাগজ ধরিয়ে দেয়। আর সেই কাগজে ইংরেজিতে কী কী লেখা সেসব আমেনা আর হাবিলের বোঝার ক্ষমতা নেই।
কাগজ হাতে পেয়ে ওরা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মরুভূমির মতো শুষ্ক নীরাবতা তাদের কিছু সময় আচ্ছন্ন করে রাখে। কাগজের সত্যতা সম্পর্কে তাদের ভেতর দোলাচল। তবুও বিশ্বাস করার চেষ্টা করে কিন্তু তাদের কোথায় যেন সন্দেহের একটা চির থেকে যায়। হাবিল বলে, এই যে খোদাতাল্লা দুডা চক্ষু দেছে দেহার লাইগ্যা। মোরা তো চউখ থাকতেও কানা। ল আমু, দ্যাশে যাই।
ওরা রাস্তার একপার ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্মরণ করে কলাপাতার প্রচীর ঘেরা এক বাড়ি। পুকুরের একপাশের চওড়া পাড়, ফাল্গুন-চৈত্রে ফেটে চৌচির হওয়া উঠান, ঘরের পাশে বহুবছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুলগাছ ইত্যাদি। এবার নিশ্চয়ই বুকের পাটা শক্ত করে হাবিল নিজের বাড়িতে উঠবে। উত্তেজনায় লঞ্চের ডেকে সারারাত দুজনের চোখে ঘুম আসে না। দিন রোশনের শুরুতে হাবিল কাগজখানা নিয়ে মোক্তার মুছুল্লিকে দেখায়। সে কাগজখানা হাতে নিয়ে চোখদুটো কপালে তুলে বলে, ঠগাইছে, জম্মের ঠগান ঠগাইছে। এগুলান তো পুরান সরকারি কাগজে সিল ছাপ্পর মারা ভূয়া খতিয়ান। মিস কেসের কোনো কাগজ এহানে নাই।
হাবিলের সরল বিশ্বাসের ওপর এমন এক দাগা, মুহূর্তে ভেঙ্গে পড়ার কথা তার। কিন্তু কালো লোকটির হাসি হাসি মিথ্যা চেহারা মনে পড়ায় নিঃশব্দসঞ্চারি জীবের মতো চুপ করে থাকে সে। স্ত্রীর কাছে সত্য কথাটা আপাতত চেপে যায়।
নদীর স্রোতের মতো খানিকটা জল ময়লার ড্রেন থেকে উঠে এসে সড়কটা ছাপিয়ে যায়। হাবিল আর আমেনা বৃষ্টি চিড়েই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাসে ওঠা ওদের দুজনের জন্য ভয় আর বৃষ্টির কারণে রিকসাগুলো কোথায় লুকিয়েছে কে জানে। কিছুপথ হেঁটে কিছুপথ রিক্সায় চড়ে দুজনে সাতরাস্তা সেটেলমেন্ট অফিসে যায়। ওরা পাকা উঠানটা পেরিয়ে আলোকময় একটা কক্ষের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে না কি কে জানে, কোথাও কোনো মানুষজন নেই।
পরের মঙ্গলবার ওরা আবার এম ভি কদম রসুল লঞ্চে ওঠে। সারারাত শিরশিরে বাতাস আর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। আকাশটা কালি মেঘের মতো দিওয়ানা। জানালা দিয়ে ওরা নদীর দিকে তাকায়— দূরে ঢেউয়ের দুলুনিতে জেলেদের নৌকাগুলো দোলে। সারারাত দুজনের ঘুম হলো না মোটেও। ভোরের আলো ফুটতেই হুড়মুড় করে দুজন পণ্টুনে ওঠে। আকাশ থেকে বড়ো বড়ো ফোটায় ঝুম বৃষ্টি ঝরছে। ওয়াইজঘাটের ভাঙাচোরা সড়কের গর্তগুলো বৃষ্টির জলে ভরে ওঠে। নদীর স্রোতের মতো খানিকটা জল ময়লার ড্রেন থেকে উঠে এসে সড়কটা ছাপিয়ে যায়। হাবিল আর আমেনা বৃষ্টি চিড়েই সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাসে ওঠা ওদের দুজনের জন্য ভয় আর বৃষ্টির কারণে রিকসাগুলো কোথায় লুকিয়েছে কে জানে। কিছুপথ হেঁটে কিছুপথ রিক্সায় চড়ে দুজনে সাতরাস্তা সেটেলমেন্ট অফিসে যায়। ওরা পাকা উঠানটা পেরিয়ে আলোকময় একটা কক্ষের কাছে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বৃষ্টির কারণে না কি কে জানে, কোথাও কোনো মানুষজন নেই। নেই সেই কালো লোকটি যে ওদের ঠকিয়েছিল। রবারের বুট পরিহিত একজন বয়স্ক লোক অফিসের এমাথা থেকে ওমাথায় হেঁটে যেতে থাকে। তার বগলে গোটানো পুরনো একটা ছাতা। সেই লোকটি ওদের ভেজা শরীর দেখেও ভ্রুক্ষেপ করল না। হাবিল লোকটিকে তারস্বরে ডাকল, ম্যাছাপ?
ওরা পূর্বাপর ঘটনা লোকটির কাছে খুলে বলল। কালো লোকটির অবয়ব বর্ণনায় বয়স্ক লোকটি তাকে চিনেছে এমনটা মনে হয় না। এক দুজন করে লোক অফিসে আসতে শুরু করল। আলোকময় কক্ষটা লোকজনে সরগরম হয়ে ওঠল। গতকাল থেকে ঘটে যাওয়া অফিস কর্মচারিদের দৈনন্দিন গালগল্পে আলোকময় কক্ষটা ভরে যায়।
হাবিল আর আমেনা অফিসের লোকগুলোর সামনে মিনতির ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। ওরা কালো লোকটির বিশদ বর্ণনা দেয় কিন্তু উপস্থিত কেউ তাকে ঠাহর করতে পারে না। মধ্যবয়স্ক লোকটি হাবিল আর আমেনার ভেজা শরীরের দিকে তাকিয়ে বলে, সাইনবোর্ডে পষ্ট লেখা আছে, ইয়ানে অন্য কোনো জেলার কাগজ পাওয়া যায় না। তাছাড়া এটা সেটেলমেন্ট অফিস, খতিয়ান বিষয়ক ঢাকা জেলার কাগজ আছে, সেইসঙ্গে পুরো দেশের ম্যাপ। মামলা মোকদ্দমার কাগজের তো প্রশ্নই ওঠে না।
হাবিল বলল, ওই যে মুরব্বি কইল— সাতরাস্তায় গ্যালে দ্যাশের বেবাক এলাকার কাগজ পাওয়া যায়!
মুরব্বি লোকটি বলল— ভুল, ভুল জানে মুরব্বি। শোনো, এই অফিস ছিল কোলকাতায়, তারপর আসে রংপুর, তারপর যায় বরিশালের ব্রাউন কম্পাউন্ড রোড, এই তো প্রায় সেদিনের কথা, এই অফিস আসলো ঢাকায়।
হাবিল বিচলিত মনে আমেনাকে বলে, আমু তইলে ল, দ্যাশে যাই।
আমেনা বলে দ্যাশে যাইয়া আর কাম নাই। ভিটায় তো আর ওডন যাইবে না। ঢাকায় বইয়া মাডিউডি কাডি আর কালা লোকটারে বিচরাই।
ওরা সেটেলমেন্ট অফিস ছেড়ে বের হয়ে আসে। আকাশ থেকে বড়ো বড়ো ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে, ওদের সামনে একটি ভেজাকাক তারখাম্বার ওপর কা কা করে ওঠে। একটি লোকাল বাস উত্তর দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। বাসের হেল্পার গলার সার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করে, এই মহাখালী, বাসতোরা, গাজীপুর…
হাবিল আর আমেনা সেই বাসের শ্লথ গতির দিকে তাকিয়ে থাকে।
মোস্তফা অভি মূলত তরুণ গল্পকার। জন্ম বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার বিঘাই গ্রামে ১৯৮৪ সালে। পড়াশোনা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতোকত্তোর। পেশায় ব্যাংকার। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকে বেশ কিছু গল্প ছাপা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ, ভারত উভয় দেশের বিভিন্ন সাহিত্যপত্রে ছাপা হয়েছে বেশ কিছু লেখা। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ দুটি। ‘বাজপাখির পুনর্জন্ম’ এবং ‘সিএস খতিয়ান ও একটি মামলার ইতিবৃত্ত’।