শুক্রবার, নভেম্বর ২২

সায়েন্স ফিকশন : অমৃতের সন্ধানে : নিলয় নন্দী

0

অক্সিফিল কোম্পানির হেডঅফিস। চেয়ারম্যান আদনান তালুকদারের পার্সোনাল সেক্রেটারি মিস সিনথিয়া খানম তার ডেস্কে বসে অল্প অল্প ঘামছে। গত চার বছরে চেয়ারম্যান স্যার এই প্রথম তাকে ‘সিনথিয়া’ বলে ডেকেছেন। এমনিতেই তিনি খুব ঠান্ডা মাথার মানুষ। সব সময় খুব নরম স্বরে কথা বলেন। সেক্রেটারিকে ডাকেন ‘সিনথি’ বলে। পুরো নাম ধরে ডাকার অর্থ কোথাও কিছু একটা গোলযোগ ঘটেছে। স্যার কারো ওপর ভয়ানক রাগ করেছেন। একটা ফোল্ডারে ফাইলগুলো ছিল। সিনথিয়া চেক করে দেখল— স্যারের ডিজিটাল সাইনের জায়গাগুলোতে বড়ো বড়ো ক্রস দিয়ে রাখা। আগেকার দিনের মতো কাগজের ফাইল হলে হয়তো মুখের ওপর ছুড়ে মারতেন। উনি রাগ করেছেন কী নিয়ে— তা ভেবে পায় না সিনথিয়া।

বাইরে থেকে চারজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এসে দেখা করতে না পেরে ফিরে গেলেন। এদের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত ছিলেন। সিনথিয়া খুব বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ‘স্যার, একটু অসুস্থ ফিল করছেন। উনি খুব দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্যার। আপনার সঙ্গে আমরা নেক্সট মিটিং অ্যারেঞ্জ করব।’ অতিরিক্ত সচিব ড. আহমেদ মতিন রাগ চাপতে না পেরে চায়ের কাপটা সশব্দে প্লেটের ওপরে রেখে চলে গেছেন। তাঁর সময়ের দাম আছে, রাগ তো করবেনই!

পুরো নাম ধরে ডাকার অর্থ কোথাও কিছু একটা গোলযোগ ঘটেছে। স্যার কারো ওপর ভয়ানক রাগ করেছেন। একটা ফোল্ডারে ফাইলগুলো ছিল। সিনথিয়া চেক করে দেখল— স্যারের ডিজিটাল সাইনের জায়গাগুলোতে বড়ো বড়ো ক্রস দিয়ে রাখা।

ফোন বাজতেই সিনথিয়া কল বোর্ডের সুইচে চাপ দিল, ‘স্যার?’

‘সিনথিয়া, বোর্ড মিটিং অ্যারেঞ্জ কর। উইথইন থার্টি মিনিটস।‘

‘স্যার, এত অল্প সময়ে…!’

‘সেটা তোমার কাছে শুনতে চাই না। ডু হোয়াট আই সেইড।’

আধঘণ্টার মধ্যেই মিটিং রুমে কোম্পানির সব বিভাগের প্রধান হাজির হয়ে গেলেন। এমডি আক্তার সালেম ও ডিরেকটর তথাগত বড়ুয়া বেশ বিব্রত মুখে বসে আছেন। পরিস্থিতির গুরুত্ব তাঁরা জানেন। বাকি সবার মাথা নিচু। মুখ অন্ধকার।

চেয়ারম্যান তালুকদার টিস্যুতে মুখ মুছে পেপারটা ছুড়ে দিলেন ওয়েস্ট বাস্কেটে। সেটা জায়গামতো গিয়ে পড়ল না। তিনি শুরু করলেন, ‘কোম্পানির সেলস রিপোর্ট হাতে আছে সবার?’

‘আছে…’ অনেকেই মাথা নাড়লেন।

‘তালেব সাহেব,’ মার্কেটিং হেডের দিকে ফিরলেন চেয়ারম্যান, ‘গত মাসের রিপোর্ট বলছে টেন পারসেন্ট ডাউন। …এবং তার আগের মাসেও তাই। অথচ আমাদের প্রেডিকশন ছিল আগামী ছয় মাসে টোয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট গ্রোথ, তাই তো?’

‘স্যার!’ শুকনো মুখে মাথা নাড়লেন তালেব আহমেদ।

‘আপনাদের ফিল্ড থেকে টিম কী বলছে? এর কারণ কী?’

‘স্যার, ওই লোকটা… আবু নাঈম… আমাদের রেপ্যুটেশনের ওপরে আঘাত করেছে। ফল কিন্তু শুধু আমাদের না, লিডিং সাতাশটা ফার্মাসিউটিক্যালের হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ হয়ে গেছে। ক্রেতাদের মধ্যে এই অ্যাওয়ারনেসটা বেশ অ্যালার্মিং।’

‘কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি আমাদের!’ টেবিলের ওপর একটা কিল দিয়ে সবাইকে চমকে দিলেন চেয়ারম্যান আদনান তালুকদার, ‘একটা চুনোপুঁটি এসে খেয়ে যাচ্ছে। কী করেন আপনারা?’

‘স্যার, মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের কাজ তো প্রডাক্ট মার্কেটিং করা।’ সাহস করে বললেন তালেব আহমেদ, ‘আমাদের মিডিয়া উইং এটা হ্যান্ডেল করতে পারত।’

আচমকা বল নিজেদের কোর্টে এসে পড়াতে চমকে গেছেন কোম্পানির মিডিয়া-হেড লোটন সিকান্দার। ‘স্যার, বিষয়টা কিন্তু আমরাই সবার আগে অবগত করেছিলাম। কিন্তু মিডিয়ার কাজ বড়োজোর সোশাল অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট করা। কিন্তু সেই অ্যাওয়ারনেস কাজে লাগল না। আসলে লোকটার কথায় একটা সত্যতা আছে। যেটা মাস পিপলের মধ্যে স্ট্রাইক করেছে।’

‘এটা কি নতুন কিছু? জেনেরিক ওষুধের দাম ব্র্যান্ডেড ওষুধের চেয়ে কম হবে। কে না জানে? গত পঞ্চাশ বছর ধরে এটা ওপেন সিক্রেট হয়ে পড়ে আছে কেউ কেয়ার করেনি। এখন হঠাৎ কী হলো যে এই নিয়ে এত হাঙ্গামা লেগে গেল?’

একটু কেশে নিয়ে ডিরেকটর তথাগত বড়ুয়া মুখ খুললেন, ‘মিডিয়ায় এই রিপোর্টটা এসেছে দেড় বছর আগে। কেউ খেয়াল করেনি। এই দু মাস আগে কেউ সোশাল মিডিয়াগুলোতে আবার শেয়ার করেছে। সেই শেয়ার নিয়ে আবার নতুন করে মিডিয়াগুলো রিপোর্ট করেছে। ফলে আজ এই অবস্থা।’

চেয়ারম্যানের হাতের ইশারায় মিটিং টেবিলের মাঝ বরাবর ফুটে উঠল হলোগ্রাম স্ক্রিন। মিডিয়ার ভিডিও রিপোর্ট দেখা যাচ্ছে তাতে।

আবু নাঈম নামের এক আধবুড়ো লোক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। কোন এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। তাঁর স্ত্রী মারা গেছে বহু বছর আগে। প্রতিদিনের ওষুধের টাকা জোগাড় করতে পারেননি আবু নাঈম। স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে ওষুধের ফেলে দেওয়া স্ট্রিপগুলো মিলিয়ে দেখতে থাকেন এবং আচমকা আবিষ্কার করেন এই সব ওষুধ খুব কম দামে ফার্মেসিগুলো থেকে কেনা সম্ভব। নাম আলাদা হলেও ভেতরের উপাদান একই। জেনেরিক ওষুধ আর ব্র্যান্ডেড ওষুধের দামের পার্থক্য চার-পাঁচ গুণও হতে পারে। অর্থাৎ, স্ত্রীকে তিনি বাঁচাতে পারতেন যদি ডাক্তার তাঁর ব্যাবস্থাপত্রে মূল ওষুধটার নাম লিখতেন। এই ব্যাপারে তিনি শহরের বড়ো বড়ো ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়েছেন। পরিচিত কয়েকজন ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সে কথা। সাংবাদিক তার রিপোর্টের শেষে জানাচ্ছেন— এই ব্যাপারে দেশের সবচেয়ে বড়ো ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিফিল কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। রিপোর্ট শেষ হয়েছে রাস্তার ধারে ফুটপাথে পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা আবু নাঈমের একটা ছবি দিয়ে। ব্যাকগ্রাউন্ডে খুব মৃদু সুরে পিয়ানো বাজছে।

স্ত্রীকে তিনি বাঁচাতে পারতেন যদি ডাক্তার তাঁর ব্যাবস্থাপত্রে মূল ওষুধটার নাম লিখতেন। এই ব্যাপারে তিনি শহরের বড়ো বড়ো ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়েছেন। পরিচিত কয়েকজন ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সে কথা। সাংবাদিক তার রিপোর্টের শেষে জানাচ্ছেন— এই ব্যাপারে দেশের সবচেয়ে বড়ো ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিফিল কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁদের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।

হলোগ্রাম স্ক্রিন মুছে গেল। সবাই চুপচাপ, কে আগে কথা বলবে জানে না।

এমডি আক্তার সালেম নীরবতা ভাঙলেন, ‘কবে আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে, সেটাই তো জানি না!’

‘রিপোর্ট একটা করে দিলেই হলো!’ বিরক্ত স্বরে বললেন চেয়ারম্যান আদনান তালুকদার। ‘আর যে কেউ দেখা করতে চাইলেই তো হবে না! সেই শিডিউলই মেলানো যাবে না। কাজের কথায় আসি। শওকত সাহেব, লিগ্যাল কোনো অ্যাকশন নেওয়া যায় কি?’

কোম্পানির লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ব্যারিস্টার শওকত আকরাম নড়েচড়ে বসলেন, ‘স্টেপ তো অবশ্যই নেওয়া যায়। যে মিডিয়া হাউজগুলো এইসব রিপোর্টকে হাইলাইট করেছে, সেগুলোকে নোটিশ পাঠানো যায়। এক্সপার্টাইজদের সাথে কনসাল্ট না করে তারা এরকম রিপোর্ট করতেই পারে না। রিপ্যুটেড কোম্পানি হিসেবে মানহানির ক্লেইম করতে পারি। চাপ দিলে উলটো কিছু রিপোর্ট তারা করে দেবে।’

‘আর কিছু?’

‘ওই লোকটা… দ্যাট নাঈম আলী না কী, ওনাকে নানা কিসিমের হ্যাজার্ডের মধ্যে ফেলা সম্ভব। ওর পাশের বাড়ির লোককে আমরা কিনে নিয়ে তাকে দিয়ে জমি দখলের মামলা দিয়ে বিরাট ঝামেলায় ফেলে দিতে পারি। গুম, খুন, চুরি, ছিনতাই যে কোনো কেসে ফেলে কয়েক বছরের জন্য অন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। এর পেছনে যে আমাদের হাত আছে সেটা ফ্ল্যাশই করা যাবে না। ওই লোক আসলে ক্রিমিনাল মাইন্ডেড এমন কিছু আইডিয়া ক্রিয়েট করতে পারলে পরে এটা দেখানো সহজ হবে যে সে অক্সিফিল কোম্পানির কাছ থেকে ইকনমিক্যাল কিছু ফায়দা হাসিলের উদ্দেশেই এইসব নাটক করেছিল।’

মিটিং টেবিলের অনেকেই সমস্বরে শওকত আকরামের বক্তব্যকে সমর্থন জানালেন। মাথা নাড়লেন চেয়ারম্যান আদনান তালুকদার, ‘এই সময়ে লোকটা যদি আইনি জটিলতায় পড়ে, পাবলিক সাপোর্ট তার পক্ষে আর আমাদের বিপক্ষে যাবে। এখন সবার আগে দরকার আমাদের দিকে পাবলিক অপিনিয়ন টানা। লোটন সাহেব, রিসেন্টলি যে টকশোগুলো সবচেয়ে বেশি পপুলার হয়েছে তাদের অ্যাংকরের সাথে কথা বলেন। কয়েকটা টক শো করেন, যেখানে প্রত্যেক প্রোগ্রামে সাইড টপিক হিসেবে আমাদের এই প্রসঙ্গটা আসবে। এমনভাবে উপস্থাপন করবেন যেন প্রসঙ্গক্রমে কথা বলতে গিয়ে এটা চলে এসেছে? ক্লিয়ার?’

‘জি স্যার!’ মাথা নাড়েন লোটন সিকান্দার।

কোম্পানির ভাবমূর্তি বৃদ্ধির প্রকল্প হাতে নেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগামী ছয়মাসের ‘জনস্বার্থে অক্সিফিল’ কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে ফেললেন কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তারা। কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে:

১. মাতৃদুগ্ধ সম্পর্কিত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি।
২. বিনামূল্যে স্যালাইন সরবরাহ।
৩. মশানিধন প্রকল্প।
৪. মাদকসেবীদের পূনর্বাসন।
৫. স্যানিটারি প্যাড বিতরণ।
৬. দরিদ্রদের মধ্যে বস্ত্রবিতরণ।
৭. স্বাস্থ্যবিষয়ক পুস্তিকা প্রকাশ।

ঠিক এক মাস পরে বাজারের অবস্থা পর্যবেক্ষণের রিপোর্টসহ পরবর্তী মিটিং করা হবে। আজকের মতো মিটিংয়ের এখানেই ইতি।

 

 

Motif_Niloy Nandi

‘আমি বুঝতে পারি না, এইসব কথা কেন উঠবে,’ গর্জন করে উঠলেন লোটন সিকান্দার। ‘আরে যে লোকের কথা শুনে সবাই এত বেতালা হয়ে পড়েছেন, উনি ওষুধ সম্পর্কে বিন্দু-বিসর্গ জানেন না। এইসব নিয়ে তারাই কথা বলতে পারেন যাদের ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বিষয়ে কিছু ধারণা আছে। যারা ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রির সাথে জড়িত। উনি কোন হরিদাস পাল…’

‘জনাব সিকান্দার, আপনি কিন্তু লাইভে আছেন।’ সাবধান করে দিলেন নিউজ অ্যান্ড ভিউজ চ্যানেলের উপস্থাপিকা রেহানা করিম। ‘আপনাকে আমরা শুনতে পাচ্ছি!’

‘জি, জি, নিশ্চয়ই।’ উত্তেজনা সামলে জবাব দিলেন লোটন।

শহরের মূল সড়কগুলোর ওপরে বসানো বিশ ফুটের টিভি স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন পথচারীরা। অনেকেই পথ চলতি টিভির দোকানের টিভি দেখছেন। রেস্টুরেন্টের টিভি সেটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন খদ্দেররা। রেল স্টেশন থেকে বাস স্টপ সব জায়গায় বলে দেওয়া হয়েছে রাত নটায় যেন সবগুলো পাবলিক টিভি সেটেই নিউজ অ্যান্ড ভিউজ চ্যানেলটি খুলে রাখা হয়। এমনিতেই বাড়িতে বসে কেউ আর টিভি দেখে না। তবু ব্যাপক প্রচারণার ফলে অনেকেই আজ বিনোদনের অন্যান্য উপকরণ বাদ দিয়ে টিভি দেখতে বসেছেন।

অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল— ‘আমাদের ঔষধশিল্প : এক অর্থনৈতিক অভিযাত্রা’। অভিজ্ঞ উপস্থাপিকা রেহানা করিমের নান্দনিক সঞ্চালনায় স্টুডিওতে উপস্থিত বাণিজ্য উপমন্ত্রী কুদ্দুস হাসেম এবং মুনড্রপ ফার্মা কোম্পানির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক সঞ্জয় রাহা খুব উৎসাহ নিয়ে কথা বলছেন। অনলাইনে যুক্ত হলেন অক্সিফিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মিডিয়া-হেড লোটন সিকান্দার। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়লেন।

‘আমাদের কোম্পানি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কী অবদান রেখে চলেছে সেটা সবাই জানে। ম্যালেরিয়া আর ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা একদম নিধন হয়ে গেছে। আমরা সারা দেশে চারটা মাল্টিপারপাস হাসপাতাল স্থাপন করেছি। ভবিষ্যতে আরও কয়েকটা স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের ঔষধ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, ফলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে অক্সিফিলের ভূমিকার কথা সকলেই অবগত। আমাদের কোম্পানি শিশুদের স্বাস্থ্য…’ হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেললেন লোটন। হাতের কাগজের কিছু হারিয়ে ফেলেছেন যেন।

‘আচ্ছা, আমরা বুঝতে পেরেছি। অবশ্যই অক্সিফিলের অবদানের কথা আমরা কেউ অস্বীকার করছি না।’ রেহানা প্রসঙ্গ পাল্টালেন, ‘এর মধ্যে জেনেরিক ওষুধের সঙ্গে ব্র্যান্ডেড ওষুধের একটা তুলনা চলে এসেছে। জনাব সঞ্জয় রাহা যদি কিছু বলেন।’

‘দেখুন, জেনেরিক ওষুধের মূল উপাদান আর ব্র্যান্ডেড ওষুধের মূল উপাদান আসলে একই হয়,’ বললেন সঞ্জয় রাহা। ‘এখন দামের ব্যাপারে কিছু হেরফের তো হবেই। আপনি একই চালের ভাত সাধারণ রেস্টুরেন্টে আর ফাইভ স্টার হোটেলে খেয়ে কি একই দাম দেন? দেন না তো! এখানেও এটা আমাদের বুঝতে হবে। ব্র্যান্ডেড ওষুধের পেটেন্ট থাকে, সেটা তাদের নিজস্ব গবেষণার ফলে তৈরি ওষুধ। সুতরাং গবেষণার খরচ যুক্ত হয়। দাম তো কিছুটা বাড়বেই।‘

‘কিছুটা বলতে কি চার-পাঁচ গুণ হতে পারে?’

‘আ… হ্যাঁ! বেশিও হতে পারে। এটা কোম্পানির পলিসি মেকাররা বলতে পারবেন।’

‘আপনি আপনার কোম্পানির এমডির পদে আছেন। আপনিও পলিসি মেকার তো।’ রেহানার বললেন।

‘হ্যাঁ, আমিও আছি… অন্যরাও আছেন।’ একটু যেন অস্বস্তিতে পড়লেন সঞ্জয়, ‘সে কারণেই তো মেকাররা বললাম। আচ্ছা, সে যাই হোক, সরকারকে যথাযথ ট্যাক্স দিতে হয়। আমাদের বড়ো একটা রাজস্ব আসে এখান থেকে। আমাদের মাননীয় বাণিজ্য উপমন্ত্রী উপস্থিত আছেন, তিনি জানেন।’

বাণিজ্য উপমন্ত্রী কুদ্দুস হাসেম কথা বললেন না, মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

আমজনতা তাকে সাপোর্ট দিয়ে বসে আছে। আমরা তো সেটা অস্বীকার করি না। চিকিৎসক জানেন, কোন রোগীর জন্য কোন ওষুধ প্রযোজ্য। তিনি প্রেসক্রাইব করেছেন! এখানে আমাদের হাত কোথায়? বরং উনি যা করেছেন সেটা জাতীয় অর্থনীতির বিপক্ষে একটা অবস্থান নেওয়ার সামিল।

‘এখন কেউ যদি এই নিয়ে গোঁ ধরে বসে থাকে তাহলে তো সমস্যা। সেই লোক কী যেন নাম তার… ওনার স্ত্রী মারা গেছেন, এখন উনি ক্লেইম করেছেন এইসব ওষুধ কম দামেও কেনা সম্ভব ছিল। আমজনতা তাকে সাপোর্ট দিয়ে বসে আছে। আমরা তো সেটা অস্বীকার করি না। চিকিৎসক জানেন, কোন রোগীর জন্য কোন ওষুধ প্রযোজ্য। তিনি প্রেসক্রাইব করেছেন! এখানে আমাদের হাত কোথায়? বরং উনি যা করেছেন সেটা জাতীয় অর্থনীতির বিপক্ষে একটা অবস্থান নেওয়ার সামিল। আমরা সেটাকে দেশদ্রোহীতাও বলতে পারি।’

‘লাইভে একজন দর্শক ফোন করেছেন! আমরা বরং ফোনটা নিয়ে নিই?’ রেহানা করিমের মধ্যে কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। এইসব অনুষ্ঠান তেমন কেউ দেখে না, ফলে দর্শকের ফোন আসে না বললেই চলে। আজকে ব্যাপক প্রচারণার প্রভাবে দর্শক সংখ্যা বেড়েছে। রেহানা বেশ খুশি। ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘হ্যালো!’ মৃদু বয়স্ক কণ্ঠ শোনা গেল।

‘হ্যালো, কে বলছেন? আপনার নামটা বলুন।’

‘আমার নাম আবু নাঈম। আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিন্ডারেলা সুজ-এর সাবেক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।’

‘আপনি কি আবু নাঈম… মানে যার কথা আমরা বলছিলাম?’ রেহানার কণ্ঠে বিস্ময়।

‘জি, আমি আবু নাঈম।’

পুরো পাঁচ সেকেণ্ড সবাই নিশ্চুপ বসে রইলেন। অবশেষে রেহানা করিম নীরবতা ভাঙলেন, ‘জি, আপনি কার সাথে কথা বলতে চান?’

‘আমি অক্সিফিলের মিডিয়া হেড লোটন স্যারের সাথে কথা বলব।’

‘বলুন, আমরা শুনছি।’

‘স্যার, আপনি আপনার কোম্পানি দেশের জন্য কিংবা জনস্বার্থে কী কী করেছে সেটা জানিয়েছেন। কিন্তু মূল প্রসঙ্গ ছিল ব্র্যান্ডেড ওষুধের দাম আকাশ ছোঁয়া কেন? ওই ওষুধের দাম আপনারা জনসাধারণের হাতের নাগালে আনতে পারেন কি না— এই নিয়ে তেমন কিছু বলেননি। কেন?’

‘আমি তো বলেছি—’ লোটন সিকান্দারের বসে যাওয়া কণ্ঠ শুনে মনে হলো তিনি এইমাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। ‘আপনি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বুঝবেন না, ফার্মাসিউটিক্যাল কেমিস্ট্রি বুঝবেন না— শুধু দুটো প্রডাক্টের মূল্যের বিচারে আমাদের ব্লেম করে যাবেন তা তো হতে পারে না। ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন চিকিৎসকরা। আপনি তাদেরকে বলেন।’

‘চিকিৎসকদের প্রেসক্রাইব করতে প্রলুব্ধ করেন কারা? তাঁদেরকে ওষুধ লিখিয়ে নিতে মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ নিয়োগ দেন কারা?’

‘এটা হচ্ছে বিজনেসের একটা পার্ট। আমরা তো জনস্বার্থে ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান খুলে… না মানে… জনস্বার্থেই কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু সব কিছু একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এই যে আজকে আপনি বললেন চিকিৎসকরা আমাদের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে আমাদের ওষুধ প্রেসক্রাইব করে। এখন যদি তাদেরকে ছেড়ে দেই যে নিজেদের বিবেচনায় জেনেরিক ওষুধ লিখবেন। তখন কী হবে জানেন? মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা ওষুধের দোকানে গিয়ে ভীড় করবেন। সেখানে ফার্মেসির লোকেরা প্রভাবিত হবে তাদের দ্বারা। তারা আবার ক্রেতাকে যে ওষুধ কিনতে বলবে তারা সেটাই কিনবে। ফলাফল কী হলো? আপনি বলেন?’

‘প্রশ্নটা আগের জায়গায় থেকে গেল। ওই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের নিয়োগ দিচ্ছে কারা?’ জানতে চাইলেন আবু নাঈম।

ঢোঁক গিললেন লোটন সিকান্দার, ‘না, সেটা কোম্পানি দিচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার বুঝতে হলে আপনাকে অর্থনীতি বুঝতে হবে।’

‘আমি কিছুটা হলেও বুঝি জনাব সিকান্দার। আমি একটা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে ছিলাম।’

‘তাহলে বুঝতে চাইছেন না কেন?’

‘আমি যা বুঝেছি তা হলো, যা কিছু আমাদের কাছে সহজলভ্য ছিল তা আপনার কোম্পানি আমাদের কাছে দুর্লভ করে ফেলেছে। আমাদের, মানে কোটি কোটি জনতা, যাদের ভাতও খেতে হয়, ওষুধও খেতে হয়।’

‘ভাই, আপনি কি কোনো বিদেশি এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন? আমাদের একটা ইন্ডাস্ট্রির ওপর আপনি সরাসরি আঘাত হেনেছেন।’ অধৈর্য কণ্ঠে বললেন লোটন সিকান্দার, ‘দেশপ্রেম থাকলে আপনি এই কাজ করতে পারতেন না।’

ভাবতে একটু সময় নিলেন আবু নাঈম, ‘দেশ তো মানুষ দিয়ে গড়ে ওঠে। আপনারা কি মানুষের কথা ভেবেছিলেন?’

নড়েচড়ে বসলেন রেহানা করিম, ‘হ্যালো! আচ্ছা… লাইনটা মনে হয় কেটে গেল, তাই না? হ্যালো…!’

 

 

Motif_Niloy Nandi

২০৪৪ সালের মে মাসের ১৭। গ্রীষ্মের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে দেশ। গ্লোবাল ওয়ার্মিং রোখা যায়নি বলে চারিদিকে আগুনের হলকা। এর মধ্যে দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। অক্সিফিল কোম্পানির নিজস্ব অর্থায়নে লাগানো বিশফুটি চারটি টিভি স্ক্রিণ কারা যেন ঢিল ছুড়ে ভেঙে দিয়েছে। সবগুলো যদিও ভাঙতে পারেনি। কয়েকটা ছোটো ছোটো মিছিল আর মানববন্ধন হলো অক্সিফিল কোম্পানির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে। কারা যেন আবু নাঈমের জন্যে আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবী করে শহর প্রদক্ষিণ করল। মোড়ে মোড়ে বক্স বসিয়ে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। দাঙ্গা পুলিশ কিছু জায়গায় লাঠিচার্জ করল। একটি শিশুসহ ছয়জন আহত হলো এর ফলে। ক্রেতারা ফার্মেসিতে গিয়ে অন্য কোম্পানির ওষুধ চাইতে লাগল। ছোটো-বড়ো কয়েকটি ওষুধের দোকানের মালিক ঘোষণা দিয়ে বসলেন তারা আর অক্সিফিলের ওষুধ বিক্রি করবে না। অক্সিফিলের ওষুধ বিক্রিতে ভাঁটা পড়ে গেল রাতারাতি।

এর মধ্যে খবর বের হলো অক্সিফিলের মিডিয়া-হেড লোটন সিকান্দারকে ওএসডি করা হয়েছে। তিনি আর অফিসে যাচ্ছেন না।

আবু নাঈম হাঁটছিলেন নির্জন রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে। দুপুরের এই সময়টায় জায়গাটা একটু কম ব্যাস্ত থাকে। তাঁর ক্ষিদে পেয়েছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। নিজেকে কেন যেন অপরাধী মনে হচ্ছে। তাঁর কারণে শহরজুড়ে আজ এত হইচই। একটা বাচ্চাও নাকি আহত হয়েছে। তিনি এসব কিছুই চাননি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর নিজের খেয়ালে ওষুধের খালি স্ট্রিপগুলো নাড়াচাড়া করতেন। এক সময় ওষুধের উপাদান পড়তে গিয়ে বিষয়টা বুঝে ফেলেন। তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নেকে সেটা বলতেই বড়ো এক পত্রিকার পরিচিত সাংবাদিককে ডেকে নিয়ে আসে সে। তারপর একের পর এক যা হয়ে যায় তার ওপরে আবু নাঈমের হাত ছিল না। লাইভ অনুষ্ঠানে ফোনের ব্যাপারটাও কয়েকজন মেডিসিন অ্যাক্টিভিস্টের জোরাজুরিতে করা।

খাবারের জন্য কোথায় যাওয়া যায় ভাবছেন হঠাৎ তাঁর ডান পাশে একটা বড়ো সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়ির ভেতর থেকে কালো কোট পরা সানগ্লাসধারী তিনজন লোক বের হয়ে এলো। সামনের নেতা গোছের লোকটি যথাসম্ভব বিনয়ী গলায় বলল, ‘আমাদের সাথে আপনাকে একটু আসতে হবে স্যার!’

কোনো কিছুতেই এখন আর আবু নাঈমের কিছু যায় আসে না। তবু জানতে চাইলেন, ‘কে পাঠিয়েছে? আপনারা অক্সিফিল থেকে এসেছেন?’

‘স্যার, আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আপনার সাথে একটু কথা বলতে চান।’

বিনা বাক্যব্যয়ে আবু নাঈম গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ির ভেতরটা বেশ ঠান্ডা, আরাম লাগছে।

 

 

Motif_Niloy Nandi

আবু নাঈম যেখানে কাজ করতেন সেটা বেশ বড়ো কোম্পানি ছিল। বড়ো বড়ো অফিস তিনি দেখেছেন। কিন্তু অক্সিফিলের অফিস দেখে তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইল না। এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন বড়ো একটা মিটিং রুমের টেবিলের এক পাশে। তাঁর পেছনের দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে আলোকিত ঝরনাধারা। ঝরনার পানিতে লাল লাল মাছ খেলা করছে। কোথায় যেন একটা দুটো পাখি ডাকছে। পায়ের নিচে দূর্বা ঘাসের মতো নরম কার্পেট বোধহয় তাঁর নোংরা জুতোর কারণে একটু ময়লা হয়ে গেছে। তিনি ভীষণ সংকোচ বোধ করছেন।

একটু আগে পরির মতো একটা মেয়ে এসে বলেছে, ‘আসসালামু ওয়ালাইকুম স্যার। আমার নাম সিনথিয়া। আপনি কী খাবেন?’

তিনি কিছু বলতে পারেননি। মেয়েটা এক বাটি স্যুপ রেখে গেছে। এমন লেবুগন্ধী স্যূপ তিনি কোনোদিন খাননি। তাঁর মতো একটা ছা-পোষা লোকের কারণে এদের হাজার কোটি টাকার ব্যাবসার লালবাতি জ্বলে গেছে। তাঁকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে অনেক ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো হয়। এটা বোধহয় তেমনই একটা কিছু।

ক্ষিদে পেয়েছিল। তিনি স্যূপের বাটিটা শেষ করে কাচের গ্লাসের পানিতে চুমুক দিলেন। স্পিরুলিনা মেশানো সরবত। সামুদ্রিক শৈবাল, এটা তিনি আগে খেয়েছেন অনেকবার।

বাম দিকের একটা দরজা খুলে রুমে কোটপরা একজন লোক ঢুকলেন। তাঁর বয়সটা আন্দাজ করা যায় না। অনেকেই বয়স বেড়ে গেলেও যৌবন ধরে রাখতে পারেন, তিনি হয়তো তেমনই কেউ। পেছন ঘুরে কাকে যেন বললেন, ‘আসতে হবে না, আমি একাই কথা বলব।’

লোকটা এসে টেবিলের অন্য পাশে বসে চশমা খুলে রেখে আবু নাঈমের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে মৃদু হাসি। তাচ্ছিল্যের হাসি হয়তো বা!

আবু নাঈম নীরবতা ভাঙলেন, ‘আসুসালামু ওয়ালাইকুম। স্যুপটা ভালো ছিল।’

‘ওটা হচ্ছে অ্যাসপ্যারাগাস লেমন ক্রিম। আমারও পছন্দ।’

‘আচ্ছা, আমাকে কী জন্যে ধরে আনা হয়েছে?’ জানতে চাইলেন আবু নাঈম।

‘আরে ছি ছি! ধরে আনা হবে কেন? আপনি আমার গেস্ট! আপনি আমার সাথে খাবেন-দাবেন, গল্প করবেন। এই তো! বাই দ্য ওয়ে,’ সামনে ঝুঁকে এলেন তিনি, ‘আমার নাম আদনান তালুকদার। আমি অক্সিফিল কোম্পানির চেয়ারম্যনের দায়িত্বে আছি।’

‘জি, পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’

‘আপনি তো কী একটা জুতার কোম্পানির অ্যাকাউন্টসে ছিলেন?’

‘জি, খুব ছোটো পোস্ট। আমার ডেঙ্গু হয়েছিল একবার। এক মাস অসুস্থ ছিলাম, ফিরে এসে শুনি অন্য লোক নেওয়া হয়েছে, চাকরিটা নেই আর।’

‘ভেরি স্যাড! তারপর আপনার স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে গেলেন।’

‘সেটা অনেক পরে। আমার হাতের জমানো টাকা সব শেষ হয়ে গেছিল। অনেক দিন চিকিৎসা চলল। প্রতিদিন অনেক দামি ওষুধ লাগত! কোথায় পাব এত টাকা? পরে আর বাঁচাতে পারলাম না!’

‘আপনার মানসিক শক্তি কিন্তু অনেক। আমি সেই লাইভ অনুষ্ঠানটা দেখেছি।’ আদনান তালুকদার হাসলেন, ‘আপনি খুব শক্ত অবস্থান থেকে কথা বলছিলেন। আমাদের মিডিয়া হেড সামাল দিতে পারেনি।’

‘সেটা পরিস্থিতির ওপরে নির্ভর করে!’ আবু নাঈমের মুখেও হাসির রেখা, ‘আমি আমার সব হারিয়েছি। এখন কথা ছাড়া আমার আর আছেই বা কী?’

‘আমাদের রেভিন্যু কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে জানেন? কত জনের রুটি-রুজি আপনার কারণে হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের পেছনে এভাবে লাগলেন কেন?’

চোখ তুলে তাকালেন আবু নাঈম, ‘আমি এসব ভাবিনি মোটেই। পুরোটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো ঘটে গেছে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট কখন কার দিকে চলে যাবে সেটা আগে থেকে বলা সম্ভব না।’

‘একটা ডিল হয়ে যাক।’ থুতনি চুলকালেন চেয়ারম্যান, ‘আপনি আবার লাইভ কোনো অনুষ্ঠানে এসে বলবেন, আমাদের ওপরে আপনার কোনো ক্ষোভ নেই। যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই বিষয়টা শুধু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান নয়, দেশের অর্থনীতির ওপরে একটা ধাক্কা ছিল। সবাই যেন নিজেদের আবেগ সামলে চলে… এইসব আর কী! প্রয়োজনে আমাদের মিডিয়া উইংস আপনাকে স্ক্রিপ্ট রেডি করে দেবে।’

আবু নাঈম হাসিমুখে তাকিয়ে আছেন।

‘না! খালি হাতে নয়। বিনিময়ে আপনি যা মনে করেন নিতে পারেন। টাকা, চাকরি, ফরেন ট্যুরের প্যাকেজ… প্রয়োজনে নতুন সংসার গড়ে দিতে আমরা আপনাকে হেল্প করব।’

শব্দ করে হেসে ফেললেন আবু নাঈম, ‘আপনার সব আত্মীয়স্বজন কি আপনার মতো ধনী? আপনার কোনো নিকটজনের মৃত্যু কি আপনি দেখেননি কখনো?’

‘হ্যাঁ, আমার নানা স্কুলের হেড স্যার ছিলেন। আমি তখন ছোটো ছিলাম, বোধহয় ক্লাস থ্রিতে। হার্টের ব্লক থেকে মারা গেলেন।’

‘ওই সময়ও তো হার্টের ব্লকের ভালো চিকিৎসা ছিল। রিং পরিয়ে দিলে রোগি বাঁচতেন অনেক দিন।’

‘এসব করা হয়েছিল, বাঁচেননি। আরও ভালো চিকিৎসার জন্যে আব্বা টাকা জোগাড় করছিলেন। সেই সময়টা আর পাওয়া গেল না!’

‘তার মানে আপনাদেরও টাকার সমস্যা ছিল?’ আবু নাঈমের প্রশ্ন।

‘বড়ো চিকিৎসার জন্যে তো বটেই।‘ আদনান তালুকদারের কণ্ঠ একটু ভারী শোনাল, ‘নানা মৃত্যুর আগের দিন সন্ধ্যায় আমাকে ডেকে অনেক কথা বলেছিলেন। আমি যেন মানুষের জন্য কাজ করি, বড়ো মানুষ হই, এইসব আর কী! মানুষ মারা যাওয়ার আগে বোধহয় এগুলো বলে!’

‘তারপর?’

এমন কিছু আবিষ্কার করব, মানে এমন একটা ওষুধ যেটা খেলে মানুষ আর মরবে না! ছোটোবেলায় বাচ্চারা অনেক রকমের প্রতিজ্ঞা করে সে রকম কিছু। তারপর ফার্মেসিতে পড়ালেখা করলাম। কিছুদিন একটা বড়ো প্রতিষ্ঠানে জব করলাম। ব্যাবসার আঁটঘাঁট শিখলাম।

‘আমি একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আপনাকে বলতে গিয়ে এখন মনে পড়ল আবার। আমি বলেছিলাম, এমন কিছু আবিষ্কার করব, মানে এমন একটা ওষুধ যেটা খেলে মানুষ আর মরবে না! ছোটোবেলায় বাচ্চারা অনেক রকমের প্রতিজ্ঞা করে সে রকম কিছু। তারপর ফার্মেসিতে পড়ালেখা করলাম। কিছুদিন একটা বড়ো প্রতিষ্ঠানে জব করলাম। ব্যাবসার আঁটঘাঁট শিখলাম। তারপর শেষ পর্যন্ত নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললাম। মহাখালীতে সেদিনের দোতলা বিল্ডিংয়ের একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি আজকে দেশের সবচেয়ে বড়ো কোম্পানি হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

‘তারপর আপনি আপনার প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলেন!’

‘কোন প্রতিজ্ঞা?’

‘অমৃত তৈরির প্রতিজ্ঞা! মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সেই ওষুধ?’

হাহা করে হেসে উঠলেন আদনান তালুকদার, ‘বাচ্চাকালের ফ্যান্টাসি নিয়ে আর কী বলব?’

‘আপনি চাইলে আমার স্ত্রী বাঁচতে পারত। আরও অনেকের নিকটস্বজন বাঁচতে পারত। আপনি সেটা চাননি! আপনার নানার শেষ ইচ্ছা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে।’

‘ওয়েল, আপনাকে অনেক সময় দিয়েছি…’ আলাপের ইতি টানতে চাইলেন আদনান তালুকদার।

‘বলুন তো, পরোপকারের প্রতিজ্ঞা করা উদার একজন মানুষ কীসের নেশায় পুঁজিপতি হয়ে যায়?’ আবু নাইমের প্রশ্ন।

‘আপনার ধারণা, বলতে গেলে আপনাদের ধারণা ধনী লোক হওয়াটা খারাপ ব্যাপার। অথচ সারাটা জীবন খরচ করে ফেলেন ধনী হওয়ার চেষ্টায়। আমার কোম্পানিতে কত মানুষ কাজ করে আপনার কোনো ধারণা নেই। এতজন কর্মী আর তাদের পরিবার আমার কাজের ওপর নির্ভরশীল। মানুষকে অমর করে রাখার ওষুধ আমি তৈরি করতে পারিনি, কিন্তু তাদের বেঁচে থাকার জন্য টাকার যোগান তো দিতে পেরেছি। আপনি কী পেরেছেন বলেন? এদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছেন কিছুই না বুঝে!’ আদনান তালুকদার হাঁপাচ্ছেন খানিকটা।

কেশে গলা পরিষ্কার করলেন আবু নাঈম, ‘আপনার এই সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন কার টাকায়, সেটা বলুন? যে লোকটা ইট ভাঙে, যে লোকটা মাল টানে, যে লোকটা রাস্তার ধারে জুতো পরিষ্কার করে। অসুস্থ হলে দু’শ টাকায় ওষুধ পাওয়ার তার অধিকার ছিল, আপনি এমন অবস্থা করেছেন যে তাকে হাজার টাকায় সেটা কিনে খেতে হয়। আপনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন অমৃত, হয়ে গেছে বিষ।’

আদনান তালুকদার কপালে হাত রেখে টেবিলের ওপরে ভর দিয়ে বসে আছেন। দরজা খুলে দ্রুত দু’জন লোক ঢুকল রুমে। একজন এগিয়ে এসে বলল, ‘স্যার স্ট্রেস নেবেন না। উনি আসলে এভাবে সাইকোলজিক্যাল প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারেন সবার মধ্যে। ওনার সাথে কথা বলা আপনার ঠিক হয়নি।’

আদনান তালুকদার মাথা তুললেন না। রুমের ভেতরে বয়ে চলে মৃদু ঝরনার শব্দ। পানিতে লাল মাছের ঝাঁক লেজ ঝাপটায়। কোথায় যেন ডেকে ওঠে দু একটা পাখি।

 

 

Motif_Niloy Nandi

হঠাৎ করেই অক্সিফিল কোম্পানির শেয়ার বাজারের সূচক উর্ধ্বমূখী হয়ে গেল। মূল্যের ওপরে পঞ্চাশ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে অক্সিফিল। ওষুধের বাজার আবার গতিশীল হয়ে উঠেছে। ক্রেতারা খুশি মনে ওষুধ কিনছে। কোম্পানি নিজেদের হাসপাতালে ওষুধ-আন্দোলনে আহত কর্মীদের চিকিৎসার জন্যে ভর্তি করে নিয়েছে। শহরে কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই।

এক বিকেলে পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকা বুড়ো মতো লোকটাকে দেখে চিনতে পেরে এক সাংবাদিক ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে যান, ‘জনাব আবু নাঈম, অক্সিফিলের চেয়ারম্যান স্যার এত বড়ো একটা পদক্ষেপ নিলেন। আপনি এ বিষয়ে কী বলবেন?’

তিনি মৃদু হেসে পার্কে খেলতে থাকা শিশুদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ‘সব মানুষের ভেতরেই অমৃত থাকে। কেউ সেটা খুঁজে পায়, কেউ বা সারাজীবনেও পায় না।’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকায় ও রংপুরে। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্য, বিপণন বাণিজ্য ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায়। কিশোর পাঠকদের জন্য তিনি নিজস্ব ধারার গল্প লিখছেন। বাংলাদেশের শিশু-কিশোর সাহিত্যকে বিশ্বমানে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন লালন করছেন দীর্ঘ দিন ধরে। অবসরে তিনি বই সংগ্রহ করেন। বিশ্বচলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তাঁর উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত হতে যাচ্ছে চলচ্চিত্র। নিলয় দীর্ঘ দিন ধরে একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা সংস্থার শিশু-কিশোর শাখার প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। গল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, পুনর্লিখন মিলিয়ে তাঁর এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা এক ডজন। প্রাপ্ত পুরস্কারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: কিশোর উপন্যাসে অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার,  প্রিন্ট মিডিয়ায় মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস এবং রণজিৎ-অভিষেক স্মৃতি সম্মাননা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।