পৃথিবীতে যত ধরনের শিল্পের বিচরণ আছে, তার মাঝে সবচেয়ে রাজনৈতিক শিল্প হচ্ছে সিনেমা। কিন্তু ইট সেলফ সিনেমা নিজে রাজনৈতিক শিল্প হলেই যে তার ব্যবহার ও অবস্থান রাজনৈতিক হয়ে উঠবে এমন নিশ্চয়তা আর নাই। মূলত আধুনিক জীবন ব্যবস্থায় সিনেমা শিল্পের চেয়ে বড়ো যে জায়গাটা সেখানে গিয়ে নিজের অবস্থান দখল করে ফেলেছে। তাই সিনেমা হয়ে উঠেছে জীবন যাপনের উপাদান হিসেবে। যাকে আর কোনোভাবেই শতভাগ রাজনৈতিক শিল্পের আখ্যা হিসেবে মূল্যায়িত করা যাচ্ছে না। তাই সিনেমার রাজনীতিকরণ ও রাজনীতিকরণের সিনেমাকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখার ও দেখানোর সময় এসেছে। উত্তর আধুনিক ধরন ও চিন্তায় সিনেমাকে এখন বিবেচনা করতে হচ্ছে ‘লাইফ টুলস’ হিসেবে। তখন সিনেমার রাজনীতিকরণে আইডেন্টিফাই করা এক অর্থে সংকীর্ণ একটা যাত্রা। তবে হ্যাঁ, যেহেতু প্রত্যেক বিভাজনেই ধারা উপধারার মতো একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই বিচ্ছিন্ন ধারাতেও মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়ে ওঠে।
সিনেমা আদতে কীভাবে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রচুর গবেষণার দরকার নাই। এর কারণ হিসেবে মনে করি, যে-সব রাজনৈতিক আদর্শ বা চিন্তাকে অবলম্বন করে সিনেমার এইসব সংজ্ঞা ধারণা করা হয়েছে সবগুলোই ক্লাসিক হলেও প্রয়োজন নতুন ও সরল চিন্তার। বরং আমরা আমাদের অঞ্চল তথা এই সাব কন্টিনেন্টের শিল্পীদের ভাষ্যই যদি ধরি তাহলে দেখতে পাই সিনেমার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক কত বেশি ওতপ্রোত। বাংলা ভাষার অন্যতম সেরা অভিনয় শিল্পী উৎপল দত্তের একটা কথা না বললেই নয় এখানে। এই ভদ্রলোক সিনেমার চেয়ে বেশি মঞ্চকেন্দ্রিক ছিলেন বলেও সিনেমাকে তার আইডেন্টিফাই করতে মোটেও ভুল হয়নি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যেকোনো সেমি-কলোনিয়াল (অর্ধ-ঔপনিবেশিক) বা সদ্য স্বাধীন দেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনার সূত্রপাত হওয়া উচিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে।’ মানে সিনেমার সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ত থাকার কথা হিসেবে তিনি ভেবেছিলেন ‘বৃহত্তর জনগোষ্ঠী’ ‘দারিদ্র্য’, ‘নিরক্ষরতা’ এবং সর্বোপরি ‘সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষ’কে। সাম্প্রতিক সময়ের আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক (বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তান) সিনেমায় এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর উপস্থাপনটা কতটুকু আর কীভাবে হয়েছে এটাই মূলত সিনেমার রাজনীতি।
হ্যাঁ, সিনেমাই সেই শিল্প যাতে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও যাতনার গল্পকে আয়নার মতো দাঁড় করায়। এ জন্যই মানুষ সিনেমার কাছে ছুটে যেতে চায়। একটু আগে যে কথা বলছিলাম, সিনেমার রাজনীতি। এখানেই মূলত বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে সিনেমার রাজনীতি।
দুই বাংলার সিনেমা নির্মাতা বললে সবার আগে যার নাম আসে, এইবার যাই আমি ঋত্বিক ঘটকের কাছে। ঋত্বিক ঘটক সিনেমায় এসেছিলেন মূলত রাজনৈতিক চিন্তা ও মতবাদ প্রচারের লক্ষ্য নিয়েই। বারবার বলেছেন, সিনেমার চেয়ে ভালো প্রচার মাধ্যম যদি আবিষ্কার হয়, তাহলে সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাবেন। কিন্তু কেন? কারণ, ঋত্বিক ভাবতেন সিনেমাই হচ্ছে সবচেয়ে সেরা মাধ্যম, মানুষের কাছে পৌঁছাবার। মানুষের কাছে তো সবচেয়ে সহজে ও দ্রুত পৌঁছায় তার চাহিদার পণ্য বা বিষয়টাই। তাহলে সিনেমা কি আদতে সেই চাহিদার পণ্য বা বিষয়? হ্যাঁ, সিনেমাই সেই শিল্প যাতে মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও যাতনার গল্পকে আয়নার মতো দাঁড় করায়। এ জন্যই মানুষ সিনেমার কাছে ছুটে যেতে চায়। একটু আগে যে কথা বলছিলাম, সিনেমার রাজনীতি। এখানেই মূলত বিরাট এক প্রতিবন্ধকতা হয়ে ওঠে সিনেমার রাজনীতি। সিনেমার রাজনীতি মানুষকে নিয়ে যায় তার কল্পনার জগতে। দেখায় স্বপ্নের ভেতর তুমিও এক স্বপ্নের মানুষ। আর ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে ওঠে কল্পনাশ্রয়ী এক প্রাণী। তার ভেতর তৈরি হয় কল্পনার যে জগৎ তা রূপায়ণের বাসনা। নিজেকে জীবনের নায়ক ভেবে মুহুর্মুহু কল্পনার উপাদান খুঁজে বেড়ায়। সিনেমার রাজনীতি মূলত মানুষকে তার জীবন থেকে সেই জীবনে আলতো করে সরিয়ে রাখে। মানুষকে মোহগ্রস্ত করার এই পথে সবার আগে এগিয়ে আছে সিনেমা এবং তার রাজনীতি।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের চারপাশের সিনেমার দিকে তাকালে দেখি, সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো সিনেমাগুলো আদতে বাস্তবতা সংশ্লিষ্টতার চেয়ে একটা ঘোর বা ফ্যান্টাসির সিনেমাই বেশি। হলিউডের সফল সিনেমাগুলোর দিকে যদি তাকাই, তাহলে কেউ হয়তো ২০২৩ সালের সফল সিনেমা হিসেবে ‘ওপেনহাইমার’ এর কথা উল্লেখ করবেন। আবার কেউ হয়তো অন্য কোনো সিনেমার কথা বলবে। যেগুলোর বেশিরভাগই সিনেমাটিক ভূমিকায় অর্থ রোজগার ছাড়া তেমন কোনো ভূমিকাই শিল্পে রাখছে না। ‘অস্কার’ হিসেবে পরিচিত একাডেমি পুরস্কারেও বেশিরভাগেই থাকে তেমন ধারার সিনেমারই জয়জয়কার। ফলে আমরা বুঝতে পারি সিনেমার রাজনীতিটা তাই এখন শুধু শিল্পের দিকে ধাবিত হওয়ার দিকে থাকে না, যতটা থাকে অর্থের দিকে। সিনেমায় শিল্পের যে যাত্রা যা উতরাতে পারলে যেকোনো সিনেমাই অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয় না এমন উদাহরণ ভূরিভূরি, তবুও সিনেমার রাজনীতি বারবার অর্থনৈতিক সফলতার দিকেই ঠেলে দেবে। এইটাই মূলত সিনেমার রাজনীতি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমাগুলোকে যদি বিবেচনার জায়গা থেকে বাদও দেওয়া হয়, বলিউড বলে যে ইন্ডাস্ট্রি পৃথিবীব্যাপী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেইসব সিনেমায় কী আছে? ভারতের আপামর জনতার মুখ সেখানে কত ভাগ? এই প্রশ্নের বিকল্প প্রশ্ন হতে পারে, বলিউডের সিনেমায় সফলতা আসলে কীসে বা কোথায়? বছরব্যাপী মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনগণকে সম্পৃক্ত করা সিনেমাগুলোই মূলত ফ্যান্টাসি ঘরানার। কিন্তু ফ্যান্টাসি ঘরানার সিনেমার সাথেও তারা প্রায়ই চেষ্টা করেন গণমানুষের অন্তর্গত জগৎকে জুড়ে দিতে। বেশিরভাগ সময়েই তা ব্যর্থ হয়। যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তাদের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমাগুলো এর উদাহরণ হতে পারে। একটু আগে উল্লেখ করা সিনেমা ‘ওপেনহাইমার’ যতই ভালো সিনেমা হোক, তা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সিনেমাই। সিনেমার রাজনীতিতে সে সফল। সিনেমায় যে বাস্তব চরিত্র রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবনকে তুলে ধরা হলো, বিষয়টা তিনি যতই ভালোর জন্য করে থাকেন তার ব্যবহার সবটাই তো মানুষের বিপক্ষে গিয়েছে। আদতে মানুষের বিপক্ষে মানুষই যায়। তবুও সেখানে একজনের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা আদতেই গুরুত্বপূর্ণ যে মানবজাতির জন্য তিনি কতটুকু ভালো করতে চান, তাকে নিয়েই ক্রিস্টোফার নোলানের মতো নির্মাতা সিনেমা বানান। এই চিন্তাটা বারবার মাথায় আসে। উত্তর মেলে না। কারণ, সিনেমার রাজনীতিতে এখন নোলান এক ধ্রুবতারা। যাকে কোনো প্রশ্নই করা যায় না। যে কারণে রাজনৈতিক সিনেমা হিসেবেও ‘ওপেনহাইমার’ সফলই। বেশ কিছু পুরস্কার পাওয়ায়ও সিনেমার পৃথিবীতে সফল হওয়ার গল্প সে লিখেই ফেলেছে বলা যায়। কিন্তু শিল্পের নিগূঢ় ভুবনে কি এমন একটি রাজনৈতিক সিনেমার আদতে কোনো প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরেই মূলত সিনেমার রাজনীতি অভিধারা স্পষ্ট করে।
এই প্রশ্নের বিকল্প প্রশ্ন হতে পারে, বলিউডের সিনেমায় সফলতা আসলে কীসে বা কোথায়? বছরব্যাপী মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনগণকে সম্পৃক্ত করা সিনেমাগুলোই মূলত ফ্যান্টাসি ঘরানার। কিন্তু ফ্যান্টাসি ঘরানার সিনেমার সাথেও তারা প্রায়ই চেষ্টা করেন গণমানুষের অন্তর্গত জগৎকে জুড়ে দিতে। বেশিরভাগ সময়েই তা ব্যর্থ হয়। যেমন সেনাবাহিনী, পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তাদের জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে নির্মিত সিনেমাগুলো এর উদাহরণ হতে পারে।
শেষ করি বাংলাদেশের সিনেমা ‘হাসিনা: এ ডটার্স টেল’ প্রসঙ্গ দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যার শিকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার এবং সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর ছোটো বোন শেখ রেহানার জীবন অবলম্বন করে নির্মিত এই সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে কী ভূমিকা রেখেছে আমরা ভাবতে পারি। এমন ভাবনার প্রসঙ্গে আসতে পারে আরও অনেক সিনেমার নাম। কিন্তু এই সিনেমার যে প্রয়োজন তা ছিল রাজনৈতিক। এই রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার দরুণই নির্মিত হয়েছে এই বাক্যে দ্বিধা নেই কারোরই। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমন ‘রাজনৈতিক সিনেমা’ বেশি প্রয়োজন না ‘সিনেমার রাজনীতিতে’ সফল সিনেমা বেশি প্রয়োজন? নাকি শুধুই সিনেমাই প্রয়োজন, তা ভাবার সময় এখনই।
জন্ম ১৯৮৪; ময়মনসিংহ। শিক্ষা : স্নাতকোত্তর। পেশা : সাংবাদিকতা।