মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩

সুবর্ণা গোস্বামীর কবিতা

0

নিজের প্রতি

০১.
আমরা দুজন অপরিচিত, পরস্পরে প্রবেশ করি। কী আসে যায় পরিচয়ে? এই যে একটা মাধবীলতা, ধর আমি তোমায় দিলাম। কিংবা নিলাম নিজের হাতে। কী আসে যায়? শেষমেস তো দুজন আমরা একই সাথে। একই স্বরে কথা বলি, একই ঠোঁটে যুগল হাসি। যেমন ধর, পাখির ডানা একটি কোথাও মেলবে নাকি?

সেও তেমন, যাকে বলছি অপরিচিত সেও আমার, আমাদেরও। নয় কি এমন? আমরা দারুণ একেকজনকে একই রকম ভালবাসি।

কী আসে যায় তুমি না সে? পাখি নাকি প্রজাপতি?

যখন উড়ি আকাশ কেবল— শূন্যতাকে হয় না শোন ভাগ করতে।
তাতে কেবল ভগ্নাংশের কষ্ট বাড়ে। কষ্ট বাড়ে!

০২.
অনেকদিনের ইচ্ছে নিজের জন্য কিছু লিখি। ডাক্তারও বলেছেন লেখা চালিয়ে যেতে। লিখলে নাকি সাম্রাজ্যবাদ কমে আসে। আমি এখন নিজের সঙ্গে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি। ঘণ্টা দেড়েক দৌড়াচ্ছি রোজ ভাঙ্গা পায়ে ভাঙ্গা মনে। যদিও দেখে মনে হবে শামুক বুঝি হেঁটে যাচ্ছে।

আর শুনছি তাদের কথা যাদের কথা সবাই শোনে। নিজের সঙ্গে গুনগুনাচ্ছি ছন্নছাড়া পঙ্ক্তিগুলো।

ইট ভাঙছি ভাঙছি লোহা পাথর হীরা চকমকিও। ভাঙছি আমার শরীরটুকু নতুন করে গড়ব বলে।

তবু জানো, কোথায় একটা কেউনা যেন হারিয়ে গেছে। সে আমার কেউ ছিল না, চিনিও না ভাল করে। সন্ধ্যাবেলা ছায়াতুরা অনেকখানি ডুবিয়ে দিলে, বুকের মধ্যে গানের মধ্যে প্রাণের মধ্যে, শূন্য এবং সংখ্যাজুড়ে হু হু করে কেউনা কাঁদে।

০৩.
শহর দেখতে বেরিয়েছিলাম। রোজই বের হই নিজেকে নিয়ে। প্রথম লেনটায় মাধবীলতা ছড়িয়েছে ছ’তলা অবধি, পরের লেনে কিছু গাছ গাইছে বৃষ্টির ইমন কল্যাণ। ভাবলাম যদি বৃষ্টি হয় সামনে যে কোন বাড়ির ছাউনিতে দাঁড়াব কিংবা ভিজব। এ শহরে ভেজা অ্যালাউড নিশ্চয়ই? ব্যাল্কনি থেকে উঁকি দেয়া কোনো মুখ দেখলেই আমার বন্দী জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। মানুষ ততক্ষণ অসুখী যতক্ষণ সে পরাধীন। তবু পরাধীনতা আমাদের প্রাকৃতিক। হাজার হোক সঙ্গী চাই, চাই গন্দম ফল। অতঃপর স্বর্গচ্যুত।

বুঝি একমাত্র একা মানুষেরই নিঃসঙ্গতা নেই, যতক্ষণ সে তার জন্য থাকে। একটা মেয়ে টিনের বাক্স বাজিয়ে হিন্দি গান করছিল আর তালে তালে নাচছিল অথচ একজন বৃদ্ধা আপনমনে বকে যাচ্ছিলেন কাউকে। আমি চিনলাম স্বাধীনতা আর পরাধীনতাকে।

আমার মন খারাপ কিছুটা কমে এসেছে। তোমার কথা ডাক্তারকে বলবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং আমাদের গোপন বাক্সটাও খুলব। যে কোনো তালাই খুব কষ্টের।আর তার চাবি অন্য হাতে।

প্রতিদিন কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লক্ষ্য স্থির করি। নিজেকে বাহবা দেই কিংবা বলি ‘কোই নেহি, আজ নেহি তো কাল জরুর’। নিজের সঙ্গে দাবা খেলি নিজের বানানো নিয়মে। হারলেও আনন্দ, জিতলেও আনন্দ।

নিজেকে বলি চিন্তা কী? তোমার সঙ্গে আমি তো আছি।

পুনশ্চঃ বৃষ্টি আসেনি।

০৪.
ভালো থাক্ সেই সব স্রোত যার স্পর্শ অসম্ভব। মূলত পুরো পৃথিবীই তাই। অথচ ধরে আছি মাধবীলতা, ছায়াসমগ্র কিংবা বাতুলের ভূগোলক। আমরা ধরে নিয়েছি সমস্তই ধরা যায় হাতের মুঠোতে। প্রাক্তনের বিস্মরিত মুখ বলে গেল, ভুলে যাও সমস্ত সংলাপ, অতীত বা ভাবী— শুধু এই মুহূর্তটি মনে রেখ, যখন বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায় কেঁপে উঠছে অপরাজিতার পাঁপড়ি। তার আগে অসজ্ঞায়িত শূন্যতা আর পরেও— তুমি ধরতে গিয়ে যেদিন সব ছেড়েছুঁড়ে পুড়ে যাবে নিজের ভিতরেই, জন্ম নেবে সেই পাখি যার নাম বর্তমান। তখন আমাকে ডেকো বুকের নিশ্চুপে।

০৫.
বাইশ বছর পর সেই দমকা হাওয়া আর বজ্রসহ বৃষ্টি।

আমি বজ্রাহত। কী হয়েছে জানো? এতদিন ভাবতাম আমিই বোধয় একা পাগল সমস্ত এই ভূ-ভাগে। আজ পরিচয় মিললো এমন একজনের যে কিনা ধরে রেখেছে ছাইভস্ম মূল্য না জেনেই। গায়ে মেখে, মেখে অন্তরে বলছে এ নাকি হীরকচূর্ণ। একবার ভাবো! এমন পাগল কি দুটো মিলবে? মাধবীলতারা আমাদের কথা শুনে হাসছিল। পাশেই ছিল জলের কল্লোল, তার অনুরোধে আমরা গানও গাইলাম অন্তরা পর্যন্ত। তারপর—

আগুনে নিজের দশদিক রেখে বললাম, পোড়াও, যতদূর পারো।

০৬.
কাল থেকে শান্তি নাই। কেন নাই এইজন্য কোনো বেদনাবোধও নাই। যেন শান্তি না থাকাটাই শ্রেয়। যে অতীত বাইশ বছর নীরব থাকার পর এইমাত্র সরবে কাঁদল তার জন্য কী করা উচিত বুঝতে কষ্ট হচ্ছে।

ফেলে দিব নাকি তুলে নেব? ছিঁড়ে ফেলব নাকি ছায়া দেব? জানিনা…

কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে। সঙ্গে তার পাতারাও। ফুটে উঠেছে ষড়জ ঋষভ কোমল গান্ধার, দিকে দিকে ফুটছে ঈষাণ নৈঋত।

পালিয়ে যাবো! এত সুন্দরের ভিতর বিষন্নতা ছাড়া আমার ভীষণ অপ্রস্তুত লাগে। আমি অসুন্দরে অভ্যস্ত সেই পুষ্পকাল থেকে। সদ্যফোটা কৃষ্ণচূড়াটিকে আমার পিষে ফেলতে ইচ্ছে করে। নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে ইচ্ছে করে।

তোমাকে ভালোবাসিনি কখনও। তবু মনে পড়ে। কেন এত বেশি মনে পড়ে!

০৭.
অন্ধকার বেড়ে উঠেছে প্রতিটি ঘরের গা বেয়ে আর ঝিঁঝির ডাক গাঢ় করে তুলেছে নৈঃশব্দ্য। তুমি যেন প্রাচীন অশ্বত্থ, ভেঙ্গে পড়েছ ঝড়ে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ঝড় নীরবতা। অতিক্রম করতে পেরেছে কোন শুদ্ধতা কখনও? মানুষের নীরবতা ধ্রুব, তার চেয়ে বড় সত্যি নুয়ে পড়া। আমাকে ভাঙ্গছো ভাঙ্গো। নিজেকে হারিও না।

এখানেও অপরাজিতা ফোটে। তীব্র জলের ধারায় ডুবে থাকে পাথর। মৌন। মীনরাশি আমার প্রিয়, প্রিয় খুব পায়রার দীর্ঘ উড়ান, স্কুলে পড়া মেঘ, দীর্ঘশ্বাস। ভালোলাগে ভালোবাসা পেতে।

ভালোবেসো যদি পারো।

০৮.
পৃথিবী যেন এইমাত্র জাদুকরের হাতে পায়রা থেকে তৈরি সুবর্ণ গোলক। এখনই আবার ফুল হয়ে ফোটে— রক্তগোলাপ।

এত মায়া মন্ত্রজুড়ে! আমি সম্মোহিত পুড়ে যাই তোমার অগ্নিতে।

এই যে লালরঙা আপেল এখনই হবে সাপ। দংশনে আমি উঠবো ক্রমশঃ মৃত্যু হয়ে। বিষ হয়ে রক্তপ্রবাহে। তুমি মরে যাবে তীব্র আনন্দে। চিরঅসমাপ্ত ঘোরে, জুড়ে নেবো তোমাকে নিজের শরীরে। বয়ে যাবো—

যেখানে মায়া নেই, বিচ্ছেদও নেই, নেই চেতনার বাজপাখি।
এখানে দৃশ্যজুড়ে শুধু ঝড়, কোথায় তোমাকে রাখি!

০৯.
কী কাজ আছে মনে পড়ছে না। মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ— ‘চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় পসারি…’ দুঃখকে যতটা বৃহৎ মনে হয় নিজেকে ততটাই তুচ্ছ। যেন সেই অসীমে যাত্রা শুরু।

গাছের ডালে সবচেয়ে নিচের পাতারা হলুদ। লতানো গাছেরা অসুখী হয় খুব। আকাশের রিমঝিম বৃষ্টির কনসার্ট শোনে যাবতীয় আলো। তোমাকে আদর— বেগুনি রংয়ের ফুল আমার প্রিয়। এনো। এখনও রৌদ্রের দিনে তোমাকে হারিয়ে ফেলি আবার বৃষ্টি হলেই ফিরে পাই। যখন হেঁটে আসি রোজ সকালে নিজস্ব বেহালায়, পুনশ্চরা ফিরে আসে, এইভাবে।

১০.
আলো আঁধারিই ভালো। অন্ধকারে আমরা একে অন্যের দিকে এগিয়ে যাই, আলোতে দুরত্ব। ঘ্রাণ পেয়েছ কিসের? শিকার, সৌন্দর্য নাকি দুঃখের? কেন আমি তোমার এত প্রিয়!

আমার পাশে বসো। কাঁধে রাখো হাত। তোমাকে একটা মুছে যাওয়া স্কেচের গল্প বলি। অসমাপ্ত বৃক্ষের নিচে পালকহীন একটা ময়ূর, তারপর—

গল্পটা এখানেই শেষ, নদীও ফুরালো।

এবার এসো খেলি সাদাকালোয় দাবা। ঘরগুলিকে দেখো, রঙিন মনে হচ্ছে না? এমনই হয় সবসময়! যখন আমার গায়ে সাদা ফুল ফোটে পাখিরা রঙিন বলে ছিঁড়ে নিয়ে যায়।

শান্ত হও। এইসব রূপান্তর ঝর্ণার মত। তার জল কোথাও হয়ত থামে। সে থামে না। কখনও কী ভেবেছিলে দেখবে সেই রূপালি ফড়িং, ডানায় দশদিক নিয়ে যে ভুলে গেছে দিকের ঠিকানা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি জন্ম একত্রিশ এ জুলাই নওগাঁর মহাদেবপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতোকত্তর।বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। গ্লোরি কলেজে প্রভাষক পদে কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই দুটি। কীর্তিনাশা (২০১৩) আর জলের জ্যামিতি (২০১৭)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।