—এক টুকরা জমি কিন্যা দাও, ফুল চাষ করব।
নিতু তার স্বামীকে বলে।
মুচকি হাসে শোভন। স্বামী। কলেজে পড়ায়। গ্রামের ছেলে। ফুল চাষ করার জন্য কেউ জমি কিনতে চায় শুনে অবাকই হইল না খালি, স্মৃতিকাতরও হয়ে পড়ল অনেকখানি! তার মানসপটে ভাইসা উঠল পুরানা কোনো গ্রামের ছবি। সেসব গল্প ও ছবি এখন বেশ ধূসর। বিয়ের পহেলা দিনে খুব রসিয়ে গল্প মারছিল নিজের রঙিন শৈশবের। সে এক চিত্রবিচিত্র গ্রাম। নিতু তো গল্প শুনেই মুগ্ধ হয়ে যায়। শহরের মেয়ে। গ্রাম তার কাছে পাঠ্যবইয়ে পড়া আর সিনেমায় দেখা জগতের বাইরে বেশি কিছু নয়। এখন যোগ হচ্ছে এইসব গল্প!
ফুল চাষ করার জন্য কেউ জমি কিনতে চায় শুনে অবাকই হইল না খালি, স্মৃতিকাতরও হয়ে পড়ল অনেকখানি! তার মানসপটে ভাইসা উঠল পুরানা কোনো গ্রামের ছবি। সেসব গল্প ও ছবি এখন বেশ ধূসর। বিয়ের পহেলা দিনে খুব রসিয়ে গল্প মারছিল নিজের রঙিন শৈশবের। সে এক চিত্রবিচিত্র গ্রাম।
কিন্তু নিতুর স্বপ্নভঙ্গ হইল দ্রুতই আকদের মাস তিনেক পর বউ উঠিয়ে নিলে। সেই থেকে গল্পও মারে না আর শোভন।
—গ্রামের বাড়ি কত না সুশ্রী ভাবছিলাম আমি। এখন দেখতেছি ছোটোখাটো বস্তিঘরের বাইরে কিছু না। ঘরলাগোয়া একটু ফুলের বাগান, সবজি চাষের সামান্য একটু জমি, চুলে তেল চুবায়া রোদ পোহানোর জন্য এক টুকরা উঠান। বাস্তবতা হইল ঘরে ঢোকার রাস্তাটাও চিপা। সূর্যের আলো আটকে থাকে আরেক ঘরের গলিতে। ফুলবাগান ছাই, একটা মরিচ চারা লাগানোর পরিসরও নাই। পুকুর টিইকা আছে ময়লা ভোগের উপযোগী হিসাবে। মাছের খলবল নাই। পাখির কুহুতান দুর্লভ—এ কেমন গাঁ?
নিতু একনাগাড়ে বলে।
শোভন নানা নিদর্শন দেখায়। সেসব মিথ ও গল্পের ভাষ্যে নিতুর পোষায় না।
শোভন এমনভাবে বলে নিজের চোখে যেন সব দেখতে পায়। শোভন দেখতে পায় গোলাপ বাগান, নিতু দেখে কোঠাঘর। শোভন দেখায় ঠেঁকিঘর, নিতু দেখে ল্যাট্রিন। শোভন দেখায় ঘরোয়া নারীদের কলকাকলিত উঠান, নিতু দেখে ঢাউস অট্টালিকা। মূলত তন্দ্রাচ্ছন্ন শোভনের চোখে নিতু এক ঝটকা পানি। তার সম্বিৎ আসতে সময় লাগে। সপ্তা-মাস-বছর।
শোভন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে তার গ্রাম আর তার নাই। যে সব গৌরবের অংশীদার নিজেকে ভাবত, সে শেয়ারটুকু লুট হয়ে গেছে জনচাপে, হিংসায়, অরুচিতে। যারা ছিলেন গ্রামের বাড়ির সৌন্দর্যের কারিগর তারা গেছেন মরে। তাদের স্থলে অভিষিক্ত পুত্রেরা বিত্তে গরীব না হলেও চিত্তে গরীব হয়েছে নিদারুণ। ফলে আশ্চর্যরকমভাবে এখন গোলাপ ফুটতে দেখে না বাগানে। বোগেনভিলিয়া/গেইটফুল না হোক অন্তত জবা আর বেলি চোখে পড়ত পায়ে হাঁটা দূরত্বে। বাড়ির সদর দরজায় অতিথিকে আমন্ত্রণ জানাত বেলির মোলায়েম ঘ্রাণ! এগুলা ছিল সাধারণ ব্যাপার। আর কত ফুল যে জঙ্গলায় ফুটে থাকত সেসবের তো হিসাবই নাই। শোভন কোনোদিন হিসাবই মিলায়নি। মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। কেবল মুগ্ধই হয়ে যায় নাই। আচ্ছন্নের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। না হলে এতো বড়ো পরিবর্তন তার চোখে পড়বে না কেন নিতু আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া পর্যন্ত!
-আসলে প্রেম থাকলে অনেক ত্রুটিই নজরে এড়ায়া যায়।
নিজের অজ্ঞতাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে শোভন। যদিও ভেতরে ভেতরে ভাংচুর হয় তার মধ্যে। তার ট্র্যাকটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করত সে। সেটার প্রতি সন্দেহ ঘনীভূত হয়। নিতুর সামনে ধরা দেয় না। মনে মনে ভাবে। নিজের কন্ট্রাডিকশনের প্রতিও তার চোখ খুলতে শুরু করে।
শোভন প্রকৃতিকে অবলীলায় পেয়েছে। ফলে তার প্রেম স্বভাবজ। আর নিতু শ্রম বিনিয়োগে অর্জন করেছে। তার প্রেম মূল্য দিয়ে কেনা। সে পাঠ থেকে মাঠে নেমেছে। শোভন মাঠ থেকে গিয়েছে পাঠে। ফলে এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে নাই সে।
—তবে কি পাঠাভ্যাস মানুষের চোখে ছানি তৈয়ার করে, যার কারণে স্পষ্ট দেখা যায় না সব? আর এটা প্রকৃতি থেকে তার ভূমিপুত্রকে আলগা কইরা দ্যায়?
শোভন সন্দেহের তীর ছোঁড়ে নিজের দিকে। কিন্তু দুজনের লক্ষ্যই যে মহৎ, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই ভেবে নিজেকে প্রবোধ দেয় শোভন।
একরাতে তুমুল তর্কের পর শোভন নিতুর জয় ঘোষণা করে এবং জমি কেনার সামর্থ্য নাই বলে জানায়। তবে তার সাধ্যের সর্বোচ্চ সীমায় বারান্দা ও ছাদওয়ালা বাসা নিবে বলে ঘোষণা করে। নিতু শান্ত হয়। কারণ চিলেকোঠার ঘুপচি ঘর থেকে অন্তত সে ঢের ভালো। বাগান করার স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনার আভাস পেয়েই নিতুর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যায়।
নিতুর ধারণা নতুন মধ্যবিত্তের বাগান করার শখ জেগেছে। এরা আর গ্রামে ফিরতে চায় না। কিংবা ফেরার উপায়ও নাই। অতীতের সমস্ত লিগ্যাসিকে তারা ধরে রাখতে চায় বাসার চৌহদ্দিতে। ফলে কোথাও বেড়াইতে গেলে নিতুর চোখ শুরুতেই যাবে কারো বারান্দার দিকে। কাপড়ের ফাঁক-ফোঁকরে কী কী গাছ উঁকি মারে সেসবে ঘোরে তার চোখের তারা। এমনকি গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে আলাপের অংশজুড়ে থাকে গাছ-ফুল-লতাপাতা ও এসবের বিবিধ প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি। আশপাশের সমস্ত নার্সারির দোকান তার চেনা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। নিজস্ব সার্কেলের ফুলপ্রেমীদের লগে তৈরি হইছে আলাদা খাতির। অনলাইনের নানা ঘুপচি ছেনে সে বার করে বিচিত্র পেইজের ঠিকানা। কেউ টবের কারবারি, কেউ হাসমাটির৷ কেউ ফুলের, কেউ পাতার। অবসরটুকু বিলীন করে নিতু নিজেকে আবিষ্কার করে অন্য এক দুনিয়ায়। যেখানে ঘ্রাণ ও রং মূল নিবাসী। ধীর শ্বাসে বেড়ে ওঠা কুঁড়ি তার চোখের মণির সমার্থক হয়ে ওঠে যেন। তার মনের মণিকোঠা থেকে ক্রমে ভরে ওঠে বারান্দা। মাসিক খরচের সাথে যোগ হয় নতুন এক খাত। ফলে শোভন বাধ সাধে কর্তাসুলভ ভঙ্গিতে।
ফলে কোথাও বেড়াইতে গেলে নিতুর চোখ শুরুতেই যাবে কারো বারান্দার দিকে। কাপড়ের ফাঁক-ফোঁকরে কী কী গাছ উঁকি মারে সেসবে ঘোরে তার চোখের তারা। এমনকি গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে আলাপের অংশজুড়ে থাকে গাছ-ফুল-লতাপাতা ও এসবের বিবিধ প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি।
—বারান্দার জায়গা তো শেষ, এবার ডাইনিং ব্যবহার করতে পার। ঐ জায়গাটা তো বেশ খালি রইছে।
টিপ্পনী বেশ লাগে নিতুর।
হিট করে শোভনের দুর্বল জায়গায়।
ড্রয়িংয়ের বড়ো অংশটা যে দখল কইরা আছ বই কিন্যা কিন্যা, সেটার হিসাব কে নিব? তোমার প্যাশন খুব দামি, আর আমারটা টিটকারিতুল্য?
নিতু খোঁচা না নিতে পেরে কষ্ট পেয়েছে বোঝা যায়। ফলে সংবরণ করে নিজেকে শোভন।
চমকে ওঠার সুযোগ ঘটে তার। এতোকাল শোভন ভেবে এসেছে, তার ঘর হয়ে উঠবে ব্যক্তিগত বইয়ের আকর। নিতু অবাক বিস্ময়ে সেসব দেখবে, ঝাড়পোঁচ করবে। মাঝেমধ্যে পড়বে। পড়তে পড়তে মনে হবে, স্বামী তার কতই না সংবেদনশীল, কতই না জ্ঞানী। শ্রদ্ধাবোধে নুয়ে পড়বে সে। পরম বিস্ময় ভরা চোখ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকাতে তাকাতে সে গর্বিত হবে। কত বই সে পড়তে না পেরে উৎসুক হয়ে জানতে চাইবে বইয়ের ভাব।
কিন্তু এসব তো ঘটেই নাই। উল্টা নিতু নতুন এক হাট খুলে বসেছে। তার প্রতিটা পসরা মোহময়, হৃদয়জ বাসনায় রঙিন। পহেলা পহেলা ভাবছিল, নিতু সাধারণ এক ঘরকন্যা। টিপিক্যাল নারীদের মতো ঘর, পোশাক, আসবাব ও পতি এই চার খুঁটিতে বান্ধা থাকবে নিতুর মনোজগৎ।
কিন্তু শোভন ধীরে বুঝতে শুরু করে নিতু অন্য ধাতুতে গড়া। তার নিজস্ব একটা মনোভঙ্গি আছে। সেই পথ ধরে ইদানিং তার প্যাশন হয়ে উঠেছে ফুলচর্চা। ফলে তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। কেউ কারো ফিল্ড নিয়ে ঝামেলা পাকাবে না। পারলে সহযোগিতা করবে, নেহায়েত অন্যায় হস্তক্ষেপ করবে না। বেশ কিছুদিন চলে এই তরিকায়।
রাত গভীর হইলেই দুজনে ঘুরে বেড়ায় বাহারি পেইজে। শোভন সন্ধানে নামে নতুন কী বই বার হইল, কোন বই পাবলিকের আলাপে উঠল! কোনো বই ভালো লেগে গেলে রিভিউ দেয়, তাতে পাবলিকের রেসপন্স কেমন, লাইক-কমেন্ট কত পড়ল এসব! অন্যদের লেখায়ও আবার সে শামিল হয়। তর্কে মাতে। নতুন চিন্তার দিশা পায়। তার পোস্টেও অন্যরা আসে। বাতচিত জমে। এসব নিয়েই তার জগৎ! তার আনন্দ এতেই ভরা!
নিতু ঘোরে ফুলের আড়তে। গাছের গহনে। যেন জগতের সমস্ত গাছের ওয়েব পেইজে তার লাইক দেয়া। তার নিউজফিডজুড়ে বাহারি ফুল ফুটে থাকে! সেসব সে মুগ্ধ হয়ে দেখে। কোনোটা অর্ডার দেয়। দাম যাচাই করে। চাষ পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে। পরামর্শ নেয় নানা জনের। এই তার দুনিয়া। নির্মল-মায়াময়!
যেন দুইটা নদী— স্বচ্ছতোয়া। পাশাপাশি বয়ে যায় স্নিগ্ধ পদসঞ্চারে। বুকভরা জোছনা নিয়ে ঘুমায়। তাদের শিশুটি যেন নিরুপম খাল। দুয়ের মাঝে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।
বন্যার উচ্ছ্বাসেই কেবল তারা মুছে ফেলে নিজেদের স্বতন্ত্র চিহ্নসকল। সে ক্ষণ জৈবিকতার ঘের দিয়ে বাঁধা।
আর সকল মৌসুমে তারা নিজ বলয়ে ঘোরে গ্রহ-নক্ষত্রের মতো।
‘নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়!’ নিজের এস্থেটিক্সের মধ্যে ঘুরপাক খাইতে খাইতে একটা সময় কেউ কাউরে নিয়া ভাবার ফুসরত পায় না। শোভন সমস্ত দুনিয়াকে আবিষ্কার করতে থাকে বইয়ের পাতায়। নিতু ফুলের ঘ্রাণে। এরইমধ্যে মনে থাকে না শিশুটাকে ডাক্তার দেখাইতে হবে, গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানো দরকার। বাজার করার ব্যাপারটাই বা দেখবে কে, রান্নাবান্নাই বা করবে কে?
শিশুটাও হয়ে পড়তেছে, একা। তার বিকাশে বিঘ্ন ঘটতেছে বোঝা যায়। এইটা আগে উপলব্ধি করে নিতু। মায়ের মন বলে কথা! —ভাবে শোভন।
—আমাদের কিছুকাল শিশু হওয়া দরকার।
নিতু প্রস্তাব দেয়।
বই বা ফুল এসব তো ওর বিকাশের লগে সাংঘর্ষিক নয়।
শোভন বলে।
হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ওর দরকার এখন খেলার পুতুল। আর বাবা-মা-ই হইতে পারে সবচেয়ে সেরা খেলনা।
নিতুর ধারাল যুক্তিতে শোভন চুপ হয়ে যায়।
সমঝে বলে খানিকপর,খালি পুতুল হইলে হবে? বাকি সমস্ত কাজ সংসারের—কে দেখবে?
দুজনেই মিলাই দেখব।
নিতু সমাধান বার করে নিজের মতো করে।
দুইজনে বুঝতে চেষ্টা করে, মানুষের জগতে আরও কাজ আছে। এস্থেটিকসের বাইরে বাস্তব দুনিয়ার ব্যাপারে সমঝোতা জরুরি।
বাইরের সকল কাজ দেখবে শোভন। নিতু ঘরের।
শোভন ভাগ করে দেয়।
এসব তো আদিকাল থেকেই চইলা আসছে। সুযোগ পেয়ে খোঁচায় নিতু।
তাইলে একটা উপায় আছে। যে যেইখানে শ্রেষ্ঠ, সে ঐটা করবে।
রক্ষণভাগ সামলায় শোভন।
তার আর লাগবে না। রান্নার যে ছিরি!
মুখ ভ্যাংচায় নিতু। ছোটোবেলা থেকেই তো শিখাইছ রান্না আমগো কাম। নতুন করে আর ভনিতা করে লাভ কী!
তা তোমার মাতা-পিতার অবদান।
রসায় শোভন।
নিজের শিশুরে স্বাধীন বানাইও তবে।
নিতু সুধায়।
সে জন্যই তো এতো কারবার। এ বই ও ফুললতাপাতার ভুবন রচনা।
দুজনেই একটা লক্ষ্য খুঁজে পায়।
নিতু পায় যেন মরম তলার জমিটি। যেখানে সে আন্তর্ধ্যানে চাষ করে যাবে দুনিয়ার সমস্ত রং ও কারুবাসনা। শোভন ধীরে পাঠ করতে থাকবে সৃষ্টির সেরা পাঠ্যখানি।
জন্ম ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি. চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে নোয়াখালীর সরকারি মুজিব কলেজে বাংলা বিভাগেই প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন পার করছেন। প্রকাশিত বইসমূহ: মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ [কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫], তামার তোরঙ্গ [কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮], জড়োয়া [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯], শেমিজের ফুলগুলি [কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০]