[এসো, দ্বিধামতী। বৃষ্টিমুখর এই সন্ধ্যায়, এসো, নাঙা নই। প্রশ্নচিহ্নের মতো অপরিহার্য—পরস্পরের সাপ হয়ে উঠি।]
০১.
কী আছে জলপদ্মে! জীবনে দুটো মায়াশালিক কিংবা সবুজ কস্তুরী এক সাথে দেখা হলে কী এমন ক্ষতি!
কোথায় অনিন্দ্য ত্রুটি? কোথায় সে কোমল কোজাগরি? যাপনের এক লহমায় নৈর্ঋতের উদভ্রান্ত যে রোদ উঁকি দিয়ে গেল। গোপনে তার নাম দিয়েছি— শিখা। প্রজ্জলিত ক্রোধের উপর যে শার্দুল নিজের পরিচয় ভুলে যায়, তাকে তুমি অভিমান বলো। বলো প্রেম। কর্পুরের মতো মিলিয়ে যাবার আগে তাকে তুমি শান্ত করো দৃষ্টি সম্মোহনে।
যে আগুনে পথে পথে বিপন্নতার মরি, সে আগুনেই পুড়ে যাচ্ছে ঘর।
আমি আত্মমগ্ন
……………… সয়ম্ভু
…………………….. বর্বর।
০২.
ছুঁড়েছি প্রচণ্ড ধী। এইবার আমাকে ফেরাও দেখি! মনোবল না-হারানো সন্ধ্যাকালে তুমিও কি কোভ-পজেটিভ? নিমীলিত অন্ধের সমস্ত ভূ-ভাগ জুড়ে বিবাগী হাওয়ার কলরব। আমি তোমার দিকে ফিরে তাকাবার ছলে এখনও যে শাসন করে চলেছি নিজেরই আয়ু! শরৎ শেষ হয়ে এলো। মনে করো, তোমাকে মনে রেখে অন্য পথে বয়ে গেছে প্রেমিক-পর্যটক। নদীমাত্রই মিথ্যে, এই কথা ভিত্তিহীন। বিশ্বাস করো, পর্যাপ্ত আলোর নিচে এখনও নীলকে নীল বলেই চিনতে পারি। নিমফুলের মায়াবী সন্ত্রাসে এখনও হাত পেতে দাঁড়াতে পারি নিঃসঙ্কোচে।
বাড়ির সামনে যে পথ, তার ভাঙাচোরা বাঁকে একটি আনমনা ল্যাম্পপোস্ট। কোথাও তার অনন্ত বেদনা আলো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সর্ন্তপণে।
স্বৈরশাসকের মতো নির্বিচারে এইসব টুকে রাখো। মনে রেখো, খুন হয়েছি বলেই ফুলের জগতে অন্ধ হয়ে গেছে দ্রবীভূত লালপদ্ম; চৌকশ লাল টিপের উপাখ্যান।
০৩.
জলের উপর সবুজচূড়া, তার ’পরে কাকনের রিনিঝিনি রব।
নীল শোকের রং হলেও এই দৃশ্যে সম্ভাবনা। বস্তুত স্বপ্নের ভেতর পরিচিত পাহাড়। তার কটিদেশে আগ্নেয় গিরি। আর সমস্ত তটরেখা জুড়ে ডার্ক সাইলেন্স। কেন প্রভূত নিরুত্তরের মাঝে আমি তার প্রতিবিম্ব দেখি, এই প্রশ্নে মহাকাল ভাগ। সনাতনী প্রথার বাইরে গিয়ে তুমুল জোয়ারে নিরুপায় যে শিষ ছুঁড়েছি, তার গন্তব্য কোথায় কোন মেঘফুল হয়ে গেঁথে যাবে মৌনখোঁপায়?
জলের উপর সবুজচূড়া, তার ’পরে কাকনের রিনিঝিনি রব।
০৪.
দেখি, বরফের মতো তোমার অসীম নীরবতা। মনে হয়, জেগেছে দূরন্ত চর। একবার ডাক দাও। অন্তত একবার আলতো করে ডেকে উঠে ত্রিভুজের সতর্ক চূড়ায় ঠাঁই দাও। মুখের উপর ছড়িয়ে দাও চুলের অন্ধকার। উজানের প্রতিটি নিঃশ্বাসে বরফ গলুক। তোমার নাভির চারপাশে আজ চক্রাকারে ঘুরে উঠছে কাঁকচূড়ার জল, পশ্চিমের সূর্য আর কাশফুলের ছদ্মবেশ।
চক্ষু-চাবুকের দিকে একান্তে পেতেছি হাত। যদি পারো, পুনরায় ফুলে ওঠো। আবার ভাসাও তরী, লালটিপ, মনময় শাপলাবিলে।
০৫.
মর্মভেদী ফুলের নাম সোনাই। তার মিথ্যে উড়ানে ভেসে গেছে যে সহজমানব, সে-ই আমি। কাকতাল নয় হয়তো, তবু ঈশানের মেঘে আমরা দেখেছিলাম নিজেদের অবয়ব। কাশফুলের বিনম্র ভঙ্গিতে আমরা জেনেছিলাম মানুষ মাত্রই ছলনাময়ী। তবু পৃথিবীতে সহস্র পাখির ঝাঁক যখন নেমে আসে, তখন নিজেকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, অন্য কোনো অধিভৌতিক অন্ধকারে লিখে যাচ্ছি নিজের নাম। বর্ণক্রম মনে নেই, তবু, দাঁড়িয়েছি নিজস্ব ছায়ায়। একে তুমি কী বলবে? মনে করো, সমস্ত গোপন ভেদ করে একদিন আমার সকল সত্য তোমাকে স্পর্শ করল। সেদিনও তুমি নিজের নামের বদলে বলবে—প্রলয়মাধুরী?
ধরো, তোমাকে বললাম মিথ্যে ফুলের সুবাস নিয়ে তুমি কাটিয়ে দিচ্ছো সমস্ত গোধূলি। তুমি তাকে স্বীকার করে নেবে? ধরো, তোমাকে বললাম, তুমি সমর্পিত সমস্ত মৌনতার কাছে। তখন? রাত যত গভীর হবে এই বলাগুলো তোমাকে পোড়াতে থাকবে। তুমি কি তখন ঘুমাতে না পেরে ছেড়ে দেবে বিকল্প জীবনানন্দ? মৃত্যু সুমহান ঠিক; ততধিক জীবন। ধরো, সমস্ত লালপদ্ম বিট্রে করে বসল। ধরো, সমস্ত দুপুর গেয়ে উঠল ব্যক্তিগত উজান। তখন? আকাশচূড়ার কাছাকাছি আমি নেই তা তুমি জানো। তুমি জানো, একটি বিকেল হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি কোনোদিন সন্ধ্যা দেখিনি। পাতাবাহারের বর্ণবিভায় লুকিয়েছি নিজেকে বরং। তবু কি তোমার ধারাপাত শেষ হবে না? নিজের ভেতর থেকে কি এখনও জেগে উঠবে না অকৈতব রব? এই জন্মান্ধের দিকে তাকাও। দেখো, নিজস্ব রং হারিয়ে যে ক্রমাগত কেঁপে কেঁপে উঠছে। আর তোমার দিকে তাকিয়ে আছে নিরুপায়।
যদি পারো, আমাকে ফেরাও, সোনা! একে একে বলে দাও পছন্দের রাংতা নদীর নাম। ছকে ছকে এঁকে রাখো রাঙা মন্দাকিনী। শশীবক্ষে আমি যে কোমল মাধুরী দেখেছি, সেই দৃশ্যে অমরত্ম সই! আমাকে শোনাও আজ দুর্দিনের মৃদুল পাঁচালি। এতোই যদি কলঙ্কের ভয়, তাহলে বলো, কেন ধনুকের ছিলার দিকে তাকিয়েছিলে পুনশ্চ বঙ্কিম চোখে?
পথ আমাকে পথিক করেছে। তুমি বলো, এই সত্য অর্থহীন? তুমি বলো, দিগন্তের ওপারে যে তুমুল বটগাছ তার ছায়ার দিকে ছুটে যাওয়া অনুচিত? যেহেতু স্বৈরশাসনের নিচে বেরিয়েছি দিকভোলা মাঠে!
অনেক ঘুমের পরে তোমাকে দেখেছি আজ। দেখেছি, বিসর্জনের আয়োজন করে তুমি গেয়ে চলেছো পরিযায়ী গান। আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো তোমার সম্পর্কে আমার ধারণা কী? আমি ততধিক মৌনতাসহ হারিয়ে যাব নিজেরই গহনচরে। তোমার অগাধ ঘ্রাণ পাই বলে, ভেবো না কাশফুল মানেই মেঘবালিকা। ছত্রে ছত্রে ছড়িয়েছ আমার নিদাঘে।
ক্রন্দন শুকিয়ে গেলে চিবুকে যে নদী জন্ম নেয়, তার নাম শ্রী।
জন্ম ১৯৮৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়া জেলার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫], এসো বটগাছ [না-কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭], শ্রীদেবী অপেরা [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০১৯], অবিরাম বিস্মরণ [কবিতা, বৈভব, ২০২৩] এবং সম্পাদিত বই শতবর্ষে সত্যজিৎ [শ্রী, ডিসেম্বর ২০২১]। কলকাতা থেকে পেয়েছেন ‘আদম সম্মাননা-২০১৭’। সম্পাদনা করেন ওয়েবম্যাগাজিন ‘শ্রী’।