হারামজাদা, খানকির ফুয়া, তর তামশার দিন শ্যাষ। খয়দিন আর তুই পলাই থাখবি? আমার চউখের নিশানা অখন তুই… বুঝছচনি। আমার চউখের মণি সাজুরে মারিয়া আমার চউখ নষ্ট করিয়া তুই ভাগি যাইবি? ওয় দেখ আমার কুচা। কুচার ফলা দিয়া তর চউখ তুলিয়া ছাড়মু। খত্ত বড়ো খইলজা তর আমি বালা খরিয়া দেখমু। তরে টানি লইয়া…
ঘুমের মধ্যেও বিড়বিড় করে সোনাফর। এমন বকতে বকতে আকলিমার হাত ধরে টেনে কাটামাছের মতো ধড়ফড়ায়। একবার এপাশ-ওপাশ করেই জেগে উঠে ধড়মড় করে। তারপর ঘুমচোখে বসে থাকে ঠায়।
কিতা করেন সাজুর বাপ? ঘুমের মধ্যে ইতা কিতা মাত মাতইন? ঘুম ভেঙে চমকে ওঠে আকলিমা। সোনাফরের টানাটানিতে হকচকিয়ে যায় অন্য আর সব খোয়াবভাঙা রাতের মতো। বিরক্তি ঝেড়ে বলে, আবারও খোয়াব দেখছইন? মাছ ওটার লাগি এত ফাগল অইলে সাজু কিতা ফিরিয়া আইবনি?
নিশ্চুপ সোনাফর ধাতস্থ হবার আগে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে স্ত্রী আকলিমার দিকে। প্রায়শ ঘটে যাওয়া এ ঘটনার কোনো উত্তর নেই তার কাছে। তারপর শোকজমা মনের ঘরে খিল এঁটে দেয় শক্ত করে।
কিতা করেন সাজুর বাপ? ঘুমের মধ্যে ইতা কিতা মাত মাতইন? ঘুম ভেঙে চমকে ওঠে আকলিমা। সোনাফরের টানাটানিতে হকচকিয়ে যায় অন্য আর সব খোয়াবভাঙা রাতের মতো। বিরক্তি ঝেড়ে বলে, আবারও খোয়াব দেখছইন? মাছ ওটার লাগি এত ফাগল অইলে সাজু কিতা ফিরিয়া আইবনি?
হাওরের শুকনো উদোম প্রান্তরে তখন শুধুই ধূধূ হাওয়া। রাতদুপুরে সে হাওয়ায় ঠকঠক করে কাঁপুনি লাগে হাড্ডিতে। হাওয়ার অমন দপদপানিতে সোনাফরের চোখে ঘুম নামে শেষে। বড়ো বিষণ্ণ ক্লান্তির এক ঘুম। আর ঘুমালেই বা কী! চোখে তো তখন খোয়াবের সওয়ারি নামে ঝুপ করে। আর খোয়াব ভাঙার নেশায় মত্ত হয় হার্মাদটা। অনেকদিন ধরে ওই একটাই খোয়াব দেখছিল সোনাফর। জ্বালাধরা ঝাপসা চোখ অবসন্ন অপেক্ষায় বুজে আসে। তবু একটাই খোয়াব। দু একদিন অন্তর বারবার করে দেখছিল সে। তাড়িয়ে আনা খোয়াবে অপেক্ষারত সোনাফর যন্ত্রণাকাতর হয় প্রতিদিন। তারপরও সে দমে যায় না।
হাইল হাওরের পানিতে এবারও বেজায় টান। টান লেগেছে ভাটির কাছাকাছি বিজনা নদীতেও। উজানে বিলাসছড়া কি মরে গেল? সে সংবাদ আনতে পারে কোন পঙ্খির ছায়া? সেখান থেকে হাওড় দ্বিখণ্ডিত করে বয়ে চলেছে যে গোপলা নদী সেও হয়েছে মহাকৃপণ। কয়েক বছর ধরেই শীতশেষে ফাল্গুনের শুরুতে এমন দশা হয়। আর পঞ্জিকার পাতায় চৈতের শুরু তো ছটফট দহন লাগে ছোটো ছোটো বিলগুলোর শরীরে। মাইমালদের হাহাকার ওঠে তখন। পাত্রডোবা, খাগউরা, চাপড়া, চরাডোবা, কুলিমারা, ধলিডোবা, বল্লাবিল, ডুমা বিল সবজায়গায় পানি শুকিয়ে খটখট— প্রায় ডহরা ডাঙার মতো। জলের এমন খরায় মাইমালদের স্বপ্ন বিলীন হওয়ার উপক্রম। তবু হাওরে চোখ পেতে ঘরে ফিরে যায় তারা। সংবাদ পেলেই ছুটবে সেদিকে। হাতে কোচ, পলো, ডুলা কখনওবা জালের বহর নিয়ে। মাছ মারার ধুম ওটুকুই।
মাইমালরা মাছ ধরে তখন বাইক্কা, বিরাই আর দুধালের বুক ছেনে। সোনাফরের গ্রাম কানুহাটির সীমানা ছাড়িয়ে আরও পুবে। যদিও বাইক্কা বিলে হাত দেওয়া মানা। ওটা হাওরের সমুদ্দর, মাছদের নির্বিঘ্ন চলাফেরার জায়গা— নির্ভয় আবাসস্থলের নমুনা।
মাইমালরা মাছ ধরে তখন বাইক্কা, বিরাই আর দুধালের বুক ছেনে। সোনাফরের গ্রাম কানুহাটির সীমানা ছাড়িয়ে আরও পুবে। যদিও বাইক্কা বিলে হাত দেওয়া মানা। ওটা হাওরের সমুদ্দর, মাছদের নির্বিঘ্ন চলাফেরার জায়গা— নির্ভয় আবাসস্থলের নমুনা। সোনাফরের দাওয়াঘেঁষে যে মায়াজুরি বিল সেখানেও এবার পানি একহাঁটু। শাপলা-কলমির দঙ্গলে প্রাণ আইঢাই। অকস্মাৎ পানির প্রবাহ এমন কমে গেল কেন তা কেউ জানে না।
গত কয়েক বছরের হিসাব একইরকম। ওরই মাঝে দম ধরে মাথা উঁচু করে ঝিমিয়ে ছিল নয়নশ্রী-দেবগ্রাম-কানুহাটির মানুষ। বিল-হাওরের পানির স্রোতে তাদের শিরা-ধমনীর রক্তের চাইতেও আপন। চোখে ঠাওর না করেও বোঝা যায়, পানিতে টান ধরায় যেন শুকিয়ে গেছে মানুষগুলোর শরীর, জিইয়ে থাকা সখ-আহ্লাদ। জিয়ল মাছের মতো মুখ তুলে খাবি খেয়ে যাচ্ছে কোনোমতে।
ক বছর আগেও হাইল হাওর ছিল এক গভীর জলাভূমি। বর্ষায় নূহের প্লাবন নামতো সেখানে। প্লাবন দেখে মানুষগুলো ফেটে পড়তো যুগপৎ উল্লাস-শঙ্কায়। ফণা তুলে গ্রাস করতো একটার পর একটা জনপদ। কতশত খাল-বিল, নদী-নালায় তার সংযোগ, মহাসংযোগ— সে হিসাব জনপদের মানুষগুলো ঠিক জানতো। শঙ্কা কাটিয়ে উল্লাস-আনন্দে মেতে ওঠার জন্য তারা থাকতো বিভোর। কিন্তু এবারের হিসাবে বড়ো গণ্ডগোল। পানির এমন টানাটানিতে চিন্তার ছাপ তাদের চোখে-মুখে। সবার জীবিকার দায় যেখানে লেখা শঙ্কা মুছে গেলেও আনন্দেও যে লেগেছে ভাটির টান।
আশ্বিনের সবুজ সর্পিল মাঠ বিছানো চারদিকে। দুচারটি বিল ছাড়া হাইল হাওর এখন বাথান। বিস্তীর্ণ বাথানে চড়ছে গাই-গরু, কালো মোষের দল। পায়ে হাঁটা পথ জেগেছে সুতানটি সাপের খোলসে। বিরান মাঠের কোণে কোণে মাঠচড়ানো রাখালের দল। ওদিকে নতুন রোয়াওঠা কদমের মতো বিচ্ছিন্ন বসতিগুলো অপেক্ষমান দিনের দীঘলজুড়ে।
হাওরের চরিত্র বদলেছে মাইমালদের জীবিকা বদলের মতো। কিংবা এমনও হতে পারে হাওর তার হাত গুটিয়ে নেওয়ায় সোনাফরসহ অন্য মাইমালরা ব্যস্ত হয়েছে জীবিকা বদলের চেষ্টায়। মাছ ধরায় ক্ষান্ত দিয়েছে সোনাফরসহ কেউ কেউ। তবু অন্যেরা নাছোড়বান্দা। তাদের অপেক্ষা শেষ হয় না। কাজ নেই— তবু রাতদিন কেবল অপেক্ষা আর অপেক্ষা।
চরায় পানি শুকিয়ে গিয়ে উঁচু বুক নিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গোহালটগুলো। তেল জবজবে মাথার নিকানো সিঁথির মতো হালটের চেহারা টানটান ও চোখজুড়ানো। ওগুলোই এখন চলাচলের রাস্তা। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় মন্তাজ উঁকি দেয় সোনাফরের দাওয়ায়। নিত্য অভ্যাসের মতো কাঁধে জাল আর হাতে নাওয়ের বৈঠা। রাস্তা থেকেই হাঁক দেয় জোরে।
ও সুনাফর। বাইক্কা বিলোত মাছ মারতাম যাইতাছি। কুছু লাগতো নায়নি।
আউক্কা, বহ মন্তাজ। কুচ্ছু লাগতো নায়। আমার শত্রুর খোঁজ আনিয়া দিও এখবারের লাগি। বালা করি সন্ধান করি মাছ মারবায়। এখবার খালি দেখি ফালাইলে খবর দিওনি। আমি যাইয়াম।
কিতা, তুমি ফারবায় নি মাছ মারতা? চউখ তোমার অখনো দিশ ফায়না বালা করি।
তা অয়। কিন্তু আমি মাছ মারবার যাইমু।
কিতা কইলা? ইতা আজব মাত মাইতো না সুনাফর। তুমি কিতার লাগি যাও আমি জানি। আইচ্ছা দেখমুনে বালা করি। যাইবার সুমায় যা ফাই কিছু দিয়া যামুনে।
তয় আউক্কা।
সোনাফর শান্ত হয়। ওর বাম চোখে জ্যোতি নেই। মাছে-মানুষে ধুন্দুমার লড়াইয়ে দৃষ্টি খোয়া গেছে বহুদিন। ডান চোখের মণিতেও ঝাপসা অন্ধকার। দু চোখের তারায় দৃষ্টির হদিস করতে গেলে ভরসার জায়গা ছিল একটাই। বিলের কাছে প্রাণ যাওয়া ছেলে সাজু। সে-ই ছিল সোনাফরের চোখ। সেই চোখ হারিয়ে নিজের চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া নিয়ে অত চিন্তা করে না সোনাফর। তবু মন্তাজের মুখ থেকে আশ্বাসবাক্য পেয়ে মন যেন কিছুটা শান্তির নাগাল পায়। আকলিমা উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে স্বজাতি মাইমালদের এমন কথোপকথনের ফাঁকে। অবশেষে শান্ত হয় মায়াজুরি বিলের কাছে সোনাফরের উঠোন, দেবগ্রাম-কানুহাটির চরাচর।
হাওর শুকিয়ে যাওয়ায় পুবের দু চারটি বিলেই ছিল মন্তাজদের জোর ভরসা। মাছ মারার তোড়জোড় এখন কম। বাইক্কা-বিরাই-দুধাল এমন কয়েকটা বিল ঘিরেই শুধু মাইমালদের অবিরাম আনাগোনা। ঝুপঝাপ মাছ ধরা। বাকি সব ডহরা খাল। উজানের আকাশে একসময় সিঁদুর রঙ ধরে। সে রঙের ছোপ আরও গাঢ় হতে হতে পাড়ে উঠে আসে তারা। পশ্চিমের সূর্য ডোবে তখন গোপলা নদীর উজানে। অস্তগোধূলির রঙ মুছে সেখানে সন্ধ্যা নামে রুদ্ধশ্বাসের মতো। তারপর সেখান থেকে অন্ধকারটা ধেয়ে আসে মায়াজুরি বিলের কাছে। যেখানে সোনাফরের বসত। টিনের ছাপরার কাছে এসে ঘোট পাকানো অন্ধকারটা থিতু হয়। সে অন্ধকারে ভাঙাচোরা কথার শব্দ আটকে থাকে রাতের খোয়াবের মতো।
দূর থেকে সোনাফর মাইমালদের সেসব কথা শুনতে পায়। আর শুনতে পায় বিলের উথাল পাথাল শব্দ। শোঁ শোঁ হাওয়ার পিঠে সওয়ার হয়ে সেসব কথা ভাঙে সোনাফরের দাওয়ায়, উঠোনের কাছে। বুকে হেঁটে উজিয়ে গিয়ে বেড়ার ফাঁক গলে আকলিমার কানে।
ওরে মাজু দেখছনি বা, খত্ত বড়ো মাছখান… মনে অয় চিতল না গইন্না; একখোবারো পাখনা তুলি ডুব দিল।
না না মাছ কিতা? ওটা তো বহুত বড়ো পঙ্খি। শামুকখোল নায়নি। ঝুপ করি উঠিল পানি থাকি। ল্যাজখান দেখছনিরে বা?
আরে আরে, দেখছনি, খত্ত বড়ো কালবাউশের ঝাঁক নায়নি। আহ্হা, ফাইস্যার ফাঁক থাকি ফসকি গেল একখোবারো!
সাবধানে টানিয়া আনো জাল, বরুনার হাটে বেচমুনে, বালা দাম ফামু।
টুকরো টুকরো এসব কথার ফাঁদে মন ডুবে থাকে সোনাফরের। খুশির ঝিলিক লেগে উঠতেই ডান চোখের ক্লান্ত তারা অস্থির হয় বড়ো। সে কাতরতা আরও অস্থির হয়ে খোঁজে সাজুকে। তারপর সবকিছু সুনসান, নিথর।
সোনাফরের সদর খিড়কীর কাছে ছন ঘাসের ঝোপ। গাছের আড়ালে ডিম পাড়ে কুড়া পাখি। হিমলাগানো আশ্বিনের হাওয়ায় কুড়া পাখির ডাক আসে কুঁই-কুঁই-কুঁই। সোনাফরের ভয় লাগে। অন্ধকারের আওয়াজ তাকে অকারণে ভীত করে। একসময় ঝিম লেগে আসে সোনাফরের চোখে। আতঙ্কে শরীর কাঁপে থরথর। খোয়াবের যে কোনো মাথামুণ্ডু নেই। নেই ঠিকমতো নাম-নিশানা। কে বলে ওটা বাঘাইড়? ওটা তো মাহি সওয়ার। যার পিঠে চেপেছে সোনাফর, সোনাফরের অঢেল অপূর্ণ স্বপ্ন। হ্যাঁচকা টানে জলে আছড়ে ফেলে দুবার দাপিয়ে ওটার পিঠে উঠেছিল ও। চোখের কাছে মোষের শিঙের মতো ধারালো কাঁটা শক্ত হাতে চেপে ধরেছিল ঘোড়ার লাগামের মতো।
ঘুমঘোরে এমনটাই মনে পড়ে সোনাফরের। কিন্তু, এ কী? কই নিয়ে যাচ্ছে দানবটা? বাইক্কা বিলের অথৈ তলে? সাজুর কাছে? নাকি অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে তার? কোচ মেরেছিল সেদিন ঢুস করে। কিন্তু, বড়ো বাঁচা বেঁচেছিল! ডান চোখে সামান্য লেগেছিল বুঝি মাছটার! একটু রক্তের জখমও দেখা যায়! সেই ক্ষোভে কি সোনাফরকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও গভীর অতলে? সোনাফরের শ্বাসকষ্ট হয়। ধড়মড় করে জেগে ওঠে বিছানায়। শেষ রাতের হিমেও ঘামতে থাকে দরদর করে।
কালিয়ারগাঁও থেকে মতিগঞ্জ— সুবিশাল হাইল হাওরের নিশানা। বিচ্ছিন্ন ডাঙার ফাঁকে ফাঁকে জনবসতি, হাত ইশারায় গ্রামগুলোর সীমানা, চোখে চোখে ঠাওর। কয়েক হাজার মাইমাল পরিবারের পিতৃপুরুষের শেকড়। যুগ যুগ ধরে হাওরঘিরে তাদের জীবনযাত্রা, অপরিসীম নির্ভরতা। হাওরপাড়ের নয়নশ্রী, ভূণবীর, রুস্তমপুর, দিগাপাড়া, মিরনগর, মির্জাপুর, দেবগ্রাম এমন কত না গ্রামের মানুষ চেয়ে আছে গ্রামঘেরা বিল আর বিলআশ্রিত পানির সম্পদের দিকে। করচমহলের ফাঁকে উঁকি দেয় ভাসমান জলজ জংলার বেশুমার দঙ্গল। সেখানে যে মাখনা, ভেট, সিংরাই পাওয়া যায় তাও এখন দেদারসে বিক্রি হয় বরুনা বাজারে।
সোনাফর আজ ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। ওর ঘটনাটা গ্রামের সকলে কমবেশি জানে। সে এখন আর বৈঠা হাতে নামে না। বুকে চাপা জেদ, অভিমান যে যাই বলুক এর পেছনে অন্য কারণও আছে।
বহু বছর যাবত হাইল হাওর ইজারা নিয়েছে দেবগ্রামের হাওলাদারেরা। ইজারাদারের লোকজন সারাদিন বিল আগলে বসে থাকে কড়া নজরে। ওদের কব্জায় থেকে দিন দিন শোষিত হচ্ছিল স্থানীয় মাইমালরা। রাতভর চৌকি বসিয়ে পাহারা দেয় বিল সংরক্ষণ কমিটির লোকজন। সাথে যোগ দিয়েছে শ্যাওলা রঙের পোশাকপরা একদল আনসার সদস্য। কারও হাতে লাঠি কারওবা টর্চ কিংবা হারিকেন। হাওলাদারের ব্যাটা রইসুদ্দি যেদিন তাকে ডেকে শাসিয়েছিল, ‘আইজ থাকি তুমার বিলো নামা নিষেধ’, সেদিনই সে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল। বুঝেছে তার পেছনে লেগেছে প্রহরীদল। মনের খেদ মনে চেপে গোপনে লালন করেছে সব। সিদ্ধান্ত নিয়েছে এর একটা রফা করা চাই। মাছ আর না মারলেও হার্মাদ বাঘাইড়টাকে কোনোভাবেই ছেড়ে দেবে না সে। এভাবে জেদ পুষে দিগ্বিদিক ঘুরে বেড়ায় সোনাফর।
কয়েক বছরে বিল-হাওরে পরিবর্তন এসেছে অনেক। পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমে গেছে অর্ধেকে, শীতে হল্লাও করছে কম। জায়গায় জায়গায় জেগে উঠছে সোঁদা মাটির বুক। বুকের খোঁড়লে শিং, মাগুর আর কৈয়ের গোপন আস্তানা। ওদিকে নিচু জায়গায় জলজ শ্যাওলার বুকে আঁতিপাঁতি করে মুখ ডুবায় পাবদা, গুথুম, চান্দা, তিতপুঁটি, খরসুলা আর বাইমের ঝাঁক। বড়ো না হোক আপাতত ওগুলোর সন্ধান পেলেও মাইমালদের বর্ষাশেষের সান্ত¡না জোটে।
সকলেই জানে মাছের মোকাম খোদ বাইক্কা বিল। জানলেও লাভ কী? ওটা সরকারের কড়া নজরদারিতে। মাছ লুটের ঘটনার পর থেকে ইদানীং আরও সতর্ক প্রহরা সেখানে। তবে বাইক্কা বিলের উদরে মাছেদের কিলবিলানি দেখে অন্য মাইমালদের চোখ টাটায়। সুযোগ বুঝে এক আধবার খেপ মারতে পারলে… ইস… এমন আক্ষেপে খালি ছোঁক ছোঁক করে মন।
সকলেই জানে মাছের মোকাম খোদ বাইক্কা বিল। জানলেও লাভ কী? ওটা সরকারের কড়া নজরদারিতে। মাছ লুটের ঘটনার পর থেকে ইদানীং আরও সতর্ক প্রহরা সেখানে। তবে বাইক্কা বিলের উদরে মাছেদের কিলবিলানি দেখে অন্য মাইমালদের চোখ টাটায়। সুযোগ বুঝে এক আধবার খেপ মারতে পারলে… ইস… এমন আক্ষেপে খালি ছোঁক ছোঁক করে মন। তারা আরও জানে, ফাল্গুন-চৈতের দিকে হাওরে ধরবে টান। নিজেদের শরীরে টান লাগার আগে বড়ো বড়ো অমন কয়েকটা বিলই যে ভরসা।
মাইমালদের ভাবনার মাঝেই শোনা যায় বাইক্কা বিল বাদে আরও কয়েকটা বিলেও অভয়াশ্রম গড়ে তুলবে সরকার। যে মাইমালরা এতকাল বুক পেতে আগলে রেখেছিল গোটা হাওর তারাই নাকি ধ্বংস করছে মাছের বংশ বিস্তার, নষ্ট করছে পানির প্রতিবেশ। হাওয়া ফুঁড়ে এমন আজব কথাও ওঠে। মাইমালরা তবে যাবে কোথায়? তাদের নির্বংশ করে কি হাওর রক্ষা পাবে, না শেষমেশ টেকানো যাবে? এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝে না তারা। সরকারের এমন নিষেধাজ্ঞা, বারণও তারা মানবে না।
কয়েক গ্রামের মাইমালরা তাই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে গড়ে তুলেছে ‘জীবিকা রক্ষণ সমিতি’। তারা শুধু চায় টিকে থাকতে। একটু ভালোভাবে খেয়েপড়ে, কোনোকিছু বিপন্ন করে নয়। একদিকে বিল সংরক্ষণ অন্যদিকে জীবিকা রক্ষণ এমন পাল্টাপাল্টি সমিতির বাইরে পায়ে পায়ে গড়ে উঠেছে আরও কিছু এনজিও। এদের কার কী স্বার্থ, কী তাদের উদ্দেশ্য সেটাই বুঝে ওঠা মুশকিল। গজিয়ে ওঠা সংগঠনগুলো শেষমেশ কারও স্বার্থ না দেখে নিজেদের সুবিধা রক্ষায় তৎপর হয়ে উঠছে আজকাল এমন কথাও ভাসে।
সোনাফর অবশ্য কারও সাতেপাঁচে নেই। ওর মনে ক্ষোভের আগুন, একটাই লক্ষ্য মাত্র। হাইল হাওরের যেখানেই হার্মাদটা বেঁচে থাকুক না কেন ও সরকারের কোনো নিষেধ-বারণ, আইনকানুনের তোয়াক্কা করবে না। ধার ধারবে না নিয়ম নীতির। তা সে বাইক্কা বিল হোক অথবা নতুন কোনো বিলই হোক! ওকে দমায় কার সাধ্য?
আরএমও নামে নতুন এনজিওর লোকেরা সোনাফরদের দুঃখকষ্ট বোঝে। প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ রক্ষা, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে সুসম্পর্ক আর মাইমালদের কথা ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। এতে সরকারের সায় আছে। বিদেশি টাকাও এসেছে বানের জলের মতো। হাওরপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা আর অসহায়ত্বের আশঙ্কায় রীতিমতো গবেষণা করে যাচ্ছে সংগঠনটি। ভেতরে ভেতরে যে দশ-বারোটি বিল এখনও জীবন্ত তাতেও এবার পানি কমে হয়েছে বুকসমান। জায়গায় জায়গায় মরেছে হিজল-করচ-বরুণের গাছ। সে গবেষণা নিয়েই অন্তহীন ব্যস্ততা তাদের।
সোনাফর মাইমালের হাতে তেমন কাজ নেই। একা বসে ভাবনায় যোগান দেয় যতসব পুরানো স্মৃতি। প্রয়োজনমতো সোনাফরকে ডাকে তারা। সেও এগিয়ে যায় সময় হাতে কোনোকিছু না ভেবে। সে তাদের অর্থ সাহায্য পেয়েছে, পেয়েছে ক্রমাগত সহযোগিতার আশ্বাসও। তাই তো ওদের দুটি মুখের দিন চলে যায় কোনোমতে। সেও এখন জলাভূমির সম্পদ ব্যবস্থাপনার সংগঠনে বুক চিতিয়ে অংশীদারীত্ব নিয়েছে। কিন্তু, দিনশেষে তার একার শূন্যতা, আকলিমার কষ্ট কয়জন বোঝে? কই কেউ তো পারেনি তার চোখের মণি সাজুর শোককে ভুলিয়ে দিতে!
সোনাফর বরং ভাবে, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে সহজে মিশে তার পুত্র হন্তারকের প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ বুঝি তৈরি হলো এবার। সে ছুতোয় বিলে নামা যাবে অন্তত। অবশ্য আজও যদি সেই দুরন্ত হার্মাদটা বেঁচে থাকে! আর একটিবারের জন্যে যদি সন্ধান মেলে তার! এদিকে বুক থেকে পেট পর্যন্ত চেরা জায়গায় বড্ড টনটন করে। তার চেয়েও বেশি জ্বলে প্রতিশোধ নিতে না পারার আগুন। সোনাফরের এ জ্বলন দেখা যায় না। খোয়াবের মতোই অদৃশ্য।
সাজুর মায়া নিয়ে একলা কাটে সোনাফরের দিন। অপেক্ষারত থাকে ঘোলাটে একচোখা দৃষ্টি। আর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে কোচ। দিনরাতের সঙ্গী। সূচালো ফলা এখনও চকচক করে। মনে পড়ে বরুনা বাজারে নারায়ণের শানঘর থেকে তিনশ টাকায় কিনে এনেছিল কোচটা। লম্বায় প্রায় তার সমান। নারায়ণ বলেছিল, ও সুনাফর ভাই, অত লম্বা কুচ লাগব কিতার লাগি? কি মাছ মারবায়? সোনাফর বলেছিল, তুমার মনে অত খুতখুতানি কিসের লাগি বেটা? খুব জেদ ছিল চোখে মুখে। অকারণ সে ঝাল ঝাড়ে যেন নারায়ণের ওপর।
সাজুর মৃত্যু আজও বড়ো পোড়ায় তাকে। জুতমতো সেদিন নাগাল পায়নি ঘাতক বাঘাইড়টার। তবে হালও ছাড়েনি। বাইক্কা-বিরাই বা দুধাল বিলের কোথাও শোরগোল শুরু হলে ঝাপসা চোখেই ছুটে যায় সোনাফর। না, সাজুর হন্তারককে দেখা যায় না কোথাও। আগেও কয়েকবার এমন মনে হয়েছিল। সন্দেহ ঘাপটি মেরে বসে ছিল সোনাফরের মনে। আচ্ছা, জানোয়ারটা বেঁচে আছে তো? সে না হয় দু বছর ধরে মাছ ধরায় ক্ষান্ত দিয়েছে, হন্যে হয়ে খুঁজছে জাতশত্রুটাকে কিন্তু বাকিরা তো যায়! ইজারাদারের লোকের সাথে মন্তাজ, মাজু এদের ভালোই হাত আছে। একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে যদি… সোনাফর ভাবে।
চৈত্রের এমন টানাটানিতে ছোটোবড়ো সব বিলেই মাছ মারার ধুম লাগবে কদিন পর। যোগান বেশি হলে পাইকারি দরে বেচে দেবে হাটে। তবু ফাঁকে ফাঁকে মন্তাজ নৌকা ঠেলে এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ঘুরে ঢুকে যায় বাইক্কা বিলের পেটে। কই, সেও তো কোনোদিন এসে বললো না, অত চিন্তা কর কিতার লাগি? তুমার মাছের সন্ধান আমি পাইছি। অখন নিশ্চিন্তে বালা করিয়া ঘুমাও।
আশপাশের গ্রামে মাইমালদের কত বংশই আছে। সোনাফর সবাইকে চেনে না। তবে সাজুর ঘটনা কারোর অজানা নয়। তাদের কারও জালে আটকা পড়ে চলে যায়নি তো সদরে? অত বড়ো মাছ ধরা পড়লে দু-চার-দশ গ্রামে নিশ্চয়ই খবর রটে যেতো রাতারাতি। সোনাফর বোঝে। সন্দেহটাকে অযথা আশকারা না দিয়ে সে তাই অপেক্ষা করে।
মাইমালদের মুখ থেকে আজকাল কত কথাই শোনে। কত শোল-গজার, চিতল-বোয়াল এমনকি আইড়-বাঘাইড়ও ধরা পড়ে অথচ তার বেলায় যত ফাঁকি? ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে শাসিয়ে ঝুপ করে লাফিয়ে পালিয়ে চলে গিয়েছিল সেদিন। কী ভয়ঙ্কর চোখ দুটো! সেই চোখ ঘুমের ঘোরেও তাকে টাটায়। লোভী সে চোখগুলোই তার চাই।
মাইমালদের জালে কোথাও কখনও বাঘাইড় ধরা পড়লে সোনাফর বলে, ‘দাঁড়াও তুমরা। একবার দেখিয়া লই। কুনো জখম-টখম আছে কিনা। তারপর তুমরা বাজারে লও তারে’। সোনাফরের পাগলামি দেখে তারা হাসে। সোনাফর অমনই। মনে জেদ আছে, আছে চাপা ক্ষোভও। সারাজীবন যে পানিতে দাপিয়ে বেড়িয়ে ক্লান্ত হলো সেখানেও সে নির্লোভ।
মাইমালরা তাই মাছ ধরতে গেলে তার জন্য আলাদা রেখে দেয়। সাজুর কারণে একটা হিস্যা ধরা থাকে বরাবর। কিন্তু সোনাফরের লোভ অন্যখানে। তার একটাই কথা। ‘আমারে হার্মাদটার চউখ আনিয়া দিও। মাছ কুচ্ছু লাগতো নায়। ওর চউখ দুইখানা পাইলেই মনটা শান্তি হইব। আমার চউখের মণিকে সে ঘায়েল কইরছে। তুমরা আমারে তার চউখ আনিয়া দাও’।
সোনাফর জানে, মাছটার ডান চোখের কাছে ইচ্ছামতো ঘাই দিয়েছিল হাতের কোচ দিয়ে। সে চিহ্ন এত সহজে হারিয়ে যাবার নয়। তার শত্রুকে অবশ্যই সে চিনতে পারবে। ঘায়েল করবে জখমের চিহ্ন ধরে।
সাজু যদি আজ বেঁচে থাকতো— একটা বাসি জেদ উসকে ওঠে নগদ, জাল আর ডোঙা নিয়ে বেরোলে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতো নির্ঘাৎ। পদ্মফুলের বুকের ভেতর যে গোখরো নাচে, তার মণি ছিনিয়ে আনতো সাজু। ধলাবুক ডাহুকের মতো পদ্মপাতায় নেচে দাপিয়ে বেড়াতো তার কচি দুটো ঠ্যাঙ, পলকা শরীর। ফড়িংয়ের লেজে সুতো বেঁধে ছুটতো অবিরাম পানকৌড়ি বা কালেমের পেছনে। সবই কেড়ে নিলো ওই ভয়ানক জানোয়ারটা। আবার দেখো, খোয়াবে কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে চায়। সুযোগ পেলেই রক্তচোখে শাসিয়ে যায় সোনাফরকে। সোনাফরও অত সহজে ছেড়ে দেবে না।
সোনাফরের খোয়াব আজকাল সংক্রামিত হয়েছে আকলিমার মনেও। পানির কোথাও খলবল শুরু হলে বড়ো উৎকর্ণ হয়ে কান পাতে সেদিকে। ওই বুঝি ফিরে এলো হার্মাদটা। এমন জালিম আগে দেখেনি কেউ। সাজু গেল। ওটার পেছনে ঘুরে ঘুরে আরেকটু হলে সোনাফর নিজেও ঘায়েল হয়ে যেতো দারুণ আক্রোশে। আকলিমার দুশ্চিন্তা সেখানেই।
বরুনা বাজারের কদমতলায় হাওরের মাছ ওঠে। বড়ো বড়ো মাছের খোঁজে শহর-জনপদ চষে মানুষ ভিড় করে সেখানে। সোনাফরের মনেও লোভ, আঁশটে গন্ধের বীজ। মন পড়ে থাকে সেদিকে। কেউ কেউ এসে জানায়, মাছ তেমন নাইরে সুনাফর, বিলীন হচ্ছে সব। মনে মনে শাপ দেয় সে। একটু যেন খুশিই হয়। বিলুপ্ত হয়েছে, তা যাক না! বাঘের মতো ডোরাকাটা ওই দানোটা না থাকলে কী আর ক্ষতি? আগে দুচারটা মাছ যাই পেতো সাজুর মুখের দিকে চেয়ে সবই বেচে দিতো ঘাটের বাজারে। খাওয়া নিয়ে অত লোভ নেই তার। নেশাটাই ধরার। আর এখন পুষে রাখা প্রতিশোধের।
একদিন বরুনা হাটে বেলালের চায়ের টঙঘরে সোনাফর বসা। ওকে দেখে এগিয়ে আসে মেম্বার হাতেম আলি। টিনের চুলায় কেরোসিনের আগুন উসকানোর মতো সোনাফর দপদপিয়ে ওঠে। ইচ্ছামতো খেদ ঝাড়ে। পুত্রশোকের খেদ।
ইতা তুমরার কেমন বিচার? বিলোত নামার ব্যাফারে তুমি দেখি একখেবারে চুপ। আমরা তুমারে ভুট দিয়া মেম্বার বানাইছি কিতার লাগি? আমারে তারা বিলোত নামবার দেয় না বালা কথা। আমরার সুবিধা-অসুবিধা দেখার দায়িত্ব কিতা তুমরার নায়নি?’
এত রাগ কর কিতা সুনাফর ভাই। যা লাগে তুমি আমারে কইবা।
আমার কুচ্ছু লাগতো নায়। তাগোরে কইবা আমি চুরও না, ডাখাইতও না। আমার শরীলে জব্বর মাইমালের রক্ত। আমারে কয় কিতা আমার নাকি মাছ মারিবার ধান্দা। তারা একদিনো দেখছেনি আমারে বিলোত নামি মাছ চুরি করবার লাগি! শালা এখ এখোকটা ইবলিশের বাইচ্চা। আমারে কয়, ‘তুমার বিরুদ্ধে থানা ফুলিশ করমু।’
তুমারে কইছি তুমার চউখের দিশ কম। বিলোত আর নামিয়া কাজ নাই। এইবার বসি বসি খাও। মাসে মাসে ট্যাখা পাইবা। এনজিওর সাহেবদের সাহায্য সহযোগিতা করবা। কুনো সমস্যা আছেনি তুমার?
শুনো হাতেম আলি, আমার বিশ্বাস উই হার্মাদটা বাইক্কা বিলোত ঘাপটি মারিয়া আছে। আমার অনুরোধ তুমরার কাছে, যেদিন তারে পাইবা, অত্ত বড়ো দানব ধরা সে পড়বোই, মাইক বাজাইয়া হগলরে জানাইয়া দিবা। পাঁচ গ্রামের লুক তারে দেখবার লাগি অপেক্ষা করিয়া আছে।
সোনাফরের নতুন অপেক্ষা শুরু হয় সেদিন থেকে। শূন্য বিলের হাওয়া ফুঁড়ে বেজে উঠবে মাইকের বাজখাঁই আওয়াজ। সে বসে আছে সে আওয়াজ শোনার। যে কোনোদিন ঘটবে এমন ঘটনা এমনটাই বিশ্বাস তার।
সোনাফরের নতুন অপেক্ষা শুরু হয় সেদিন থেকে। শূন্য বিলের হাওয়া ফুঁড়ে বেজে উঠবে মাইকের বাজখাঁই আওয়াজ। সে বসে আছে সে আওয়াজ শোনার। যে কোনোদিন ঘটবে এমন ঘটনা এমনটাই বিশ্বাস তার।
আরেকদিন অমন হয়েছিল। তার মনে পড়ে, বাইক্কা বিলে লুটপাট হয়েছিল সে বছর। পুলিশ-প্রহরী কারও নিষেধাজ্ঞাই আমলে নেয়নি গ্রামবাসী। নেবেই বা কেন? কোনটা সত্যি আর কোনটা গুজব সে যাচাই করার সময় কই তাদের? পর পর কয়েকটা ফাঁকা গুলির হুংকার। সে শব্দ উপেক্ষা করে সোনাফর তবু কান খাড়া করে রাখে। ওদিকে মাইমালদের মাছ ধরার মহোৎসব চলছে।
নৌকার কাছে একটু খলবলানি। অমনি সতর্ক হাতে ধাঁই করে কোচ মারে পানিতে। না, বাঘাইড় নয়। আইড়, বোয়াল অন্য কিছু হয়তো! তবু তার চোখ গেঁথে থাকে ছপছপানো ঢেউয়ের দিকে। গভীর মনোযোগে হুঁশ-দিশ ছিল না একদম— যেন এখনই পানি ফুঁড়ে ছুটে আসবে প্রকাণ্ড মাহি সওয়ার। ও তার পিঠে চেপে বসবে। শিঙের মতো কাঁটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে দাপিয়ে বেড়াবে পুরা বাইক্কা বিল। শেষে নিয়ে যাবে তার সাজুর কাছে। কখন যে সব জনশূন্য হয়ে পড়েছিল টের পায়নি সোনাফর।
একটা মাইকের সুতীব্র আওয়াজ বারবার তাকে হাঁক পেড়ে ডাকছিল। ‘থাম মাইমালের বাচ্চা… থাম। আগাবি না একদম। খবরদার’।
তারপরই কোত্থেকে যে কী সব ঘটে গেল কেউ বুঝতে পারেনি। এক লহমায় সব লণ্ডভণ্ড। বাইক্কা বিলের কাছ থেকে সোনাফরের গগনবিদারী চিৎকার শুনেছিল অনেকেই। একটা ফাঁকা গুলির আওয়াজ সেদিন স্পষ্ট শুনেছিল মন্তাজ। সে শব্দ ধরে কিছুটা এগোতে দেখে বিলের পাড়ের কাছে একটা ছৈওয়ালা নৌকা। ছইয়ের ভেতর থেকে ধরাধরি করে তাকে নামাচ্ছিল দুজন পুলিশ। বুক থেকে পেট পর্যন্ত চিরে ফালা ফালা করা শরীর। কাদাজল রক্তে মাখামাখি সমস্তখানি। বাঁ চোখের কাছ থেকে গলগল রক্তের ধারা। গড়িয়ে পড়ছে গলায়-বুকে-পেটের কাছে। সকলেই হতভম্ব। খেঁকিয়ে ওঠে বিলের প্রহরী লুৎফর। ‘মাইমালের বাচ্চাটারে নিষেধ করছিলাম। শোনে নাই আমরার কথা। আউতকা ঝাঁপ দিলো পানিতে। ক্যামনে কী হইলো বুঝতাম পারিয়র নায়’।
সোনাফরের জেদ সেই থেকে শুরু। খোয়াব না বাস্তব, তবু ঘটনাটা এমনিভাবে তার চোখে-মনে খোদাই হয়ে আছে পরিষ্কার। ওই তো স্পষ্ট কানে ভাসছে সেই মাইকের আওয়াজ। আশ্চর্য, জেগে জেগেই আজ খোয়াব দেখছে সে? এত স্পষ্ট করে আওয়াজ শুনছে? না তো, খোয়াব নয়। সত্যি সত্যিই মাইকের আওয়াজ ভাসছে। দফাদার নুরুর গলা। হুম, নুরুই তো! নিথর সোনাফর কান পাতে ওদিকে।
চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে। আচমকা শোনা যায় হৈহৈ রৈরৈ ব্যাপার। কী কাণ্ড! সেই দানোটা ধরা পড়েছে। সে খবরই জানান দিচ্ছে নুরু। বিলের কাছে মাইক লাগিয়েছে হাতেম মেম্বার। ঘোষণা আসছে বারংবার। সেই বাঘাইড় ধরা পড়েছে। সোনাফরের চিরশত্রু আজ ধরা পড়েছে। গ্রামকে গ্রাম মানুষ ছুটছে সেখানে। একবার চোখের দেখা দেখবে বলে। পাকা ডাকুর মতো চেহারা। কমসে কম চার মণ ওজন। মোটা বাঁশে শক্ত দড়ি লটকেছে। দড়িতে বেঁধে সন্ধ্যার আগে বরুনার বাজারে নিয়ে যাওয়া হবে।
শেষমেশ নিশ্চিত খবরটা এনে দেয় একই গ্রামের মেন্দু মিয়া। ইবার চল, সুনাফর। তুর সাজুর হন্তারক ধরা পড়িছে। একবার দেখবি চল।
সোনাফর বসে থাকে চুপচাপ। পাথরের মতো।
বরুনা বাজার লোকে গমগম। অনেক বছর হলো অন্তত এমন বড়ো বাঘাইড় ওঠেনি মাইমালদের ফাইসা জালে। একা খাবে এমন সাধ্য আছে কার? তাছাড়া খুনী বলে কথা!
বরুনা বাজার লোকে গমগম। অনেক বছর হলো অন্তত এমন বড়ো বাঘাইড় ওঠেনি মাইমালদের ফাইসা জালে। একা খাবে এমন সাধ্য আছে কার? তাছাড়া খুনী বলে কথা! কেউ একা নিতে সাহসও করে না। কেজি দর হাঁকানো হলেও এগোয় না কেউ। মাছ খাওয়ার লোভের চাইতেও একটা চাপা আক্রোশ কাজ করে কারও কারও ভেতর। পরে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ করে দেয় বিল কমিটি। খাতা খুলে নাম লেখায় কেউ কেউ। মেন্দু মিয়া বলে, সুনাফরের নামটাও লেখাও। ওর তো মাছ ধরবার নেশা টেশা কুচ্ছু ছিল নায়। মাছটারে খুঁজবার লাগি খালি বিলোত নামতো। আমার কাছে মাথাটা দিয়া দাও। সুনাফরের লাগি লইয়া যাই।
মেন্দু মিয়ার সাথে মন্তাজ, মাজু সকলে মিলে সোনাফরের বাড়ির দিকে ছোটে। এক চোখ নিয়ে বসে থাকে সোনাফর। দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়ানো আকলিমা। দুজনেই যেন একচোখা দৈত্যের অপেক্ষায়। মেন্দু মিয়ার হাতে সেই দুরন্ত বাঘাইড়টার বিশাল কাঁটাওয়ালা মাথা। রক্ত ঝরছে টপটপ। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে মায়াজুড়ি বিলের কাছে। মেন্দুর হাত থেকে দড়িতে ঝোলানো মাছের মাথাটা চেয়ে নেয় সোনাফর। নিথর চোখেও হার্মাদটার কী তেজ! ছনগাছের ঝোপ সরিয়ে এবার সে এগিয়ে যায় বড়ো রাস্তার ধারে। যেখানে তার সাজুর কবর।
কথাসাহিত্যিক। ১৯৭৮ সালের ৪ঠা আগস্ট (বাংলা ২০ শ্রাবণ, ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ), ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ে জন্ম ও শৈশব কাটলেও পৈতৃক নিবাস ফেনী জেলায়। প্রকাশনা : ‘ফুলকুড়ানি মেয়ে’ (ছোটোদের কবিতার বই), ‘বাস্তুসাপ’ (গল্পগ্রন্থ), ‘সন্ধ্যা নামার আগে’ (গল্পগ্রন্থ), ‘জলসংসার’ (গল্পগ্রন্থ), ‘কল্পে গল্পে ইলিশ’ (সম্পাদিত গল্প সংকলন), ‘শরফুন ও এক শহরের বৃত্তান্ত’ (গল্পগ্রন্থ), ‘রাঙা শালুক’ (ছোটোদের ছড়ার বই), ‘শিল্পী সাহিত্যিকের স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু’ (সম্পাদিত স্মৃতিকথা সংকলন)।