‘Art is not a pleasure trip, it’s a battle.’ শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সময়ই এই কথাটি বলতেন এবং তাঁর এই কথাটির গভীরতা অনেক ব্যাপক। একজন শিল্পী এবং তাঁর শিল্প দুটোই বেঁচে থাকে পরস্পরকে আলীঙ্গন করে। একজন শিল্পীকে আজীবন তাঁর শিল্প নির্মাণে ধ্যানী কারিগর হতে হয় পাশাপশি সেই শিল্পকে আবিষ্কার করতে গিয়ে শিল্পসত্তাটি অর্জন করতেও নানা রকম যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হয়। তবে কাজটি এত সহজ নয়। আবার এ কথাও সত্য যে একজন শিল্পীর শিল্পসত্তাকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত একটি প্লাটফর্ম বা মাধ্যম। কারণ এই প্লাটফর্ম বা উপযুক্ত কোনো মাধ্যমকে ব্যবহার করেই একজন শিল্পী তাঁর শিল্পসত্তাকে পাঠক এবং দর্শকদের সামনে মেলে ধরতে পারেন। কেউ কেউ এই প্লাটফর্মকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন আবার অনেকেই পারেন না। বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও তাঁর কালজয়ি লেখাগুলোকে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে প্লাটফর্ম হিসেবে বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘এস্কোয়ার’ অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য সে জন্য ‘এস্কোয়ার’ নিজেও উপকৃত হয়েছিল। সবদিক দিক দিয়ে ভাবলে মনে হবে হেমিংওয়ে এবং এস্কোয়ার পরস্পর যেন ছিল একে অপরের মহামূল্যবান সত্তা।
হেমিংওয়ের সঙ্গে ‘এস্কোয়ার’ ম্যাগাজিনের সম্পর্ক এবং সম্পৃক্ততা পরবর্তী সময়ে হেমিংওয়ের জীবনে লেখালেখির জগতে অন্যতম মাইল ফলক হিসেবে ধরা দেয়। এস্কোয়ার ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আরনল্ড গিংরিচ নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এই ম্যাগাজিনের একজন অন্যতম বন্ধু হেমিংওয়ে।’ ১৯৩৩ সালের অক্টোবরের প্রথম সংখ্যা থেকেই হেমিংওয়ের সঙ্গে এই ম্যাগাজিনের একটি আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। তিনি সেখানে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি স্নো অব কিলিমানজারো, সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সী’ সহ অনেক বিখ্যাত গল্পগুলোর প্রাথমিক ভাবনা এই এস্কোয়ার ম্যাগাজিনেই প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে এই ম্যাগাজিনে লেখার কারণে সেটিও রাতারাতি জনপ্রিয় একটি পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়েছিল। পিবিএস এর একটি তথ্যচিত্রের মতে ‘এস্কোয়ার ম্যাগাজিনটির শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ব্যাপক পরিচিতির পেছনে যে মানুষটির সবচেয়ে বেশি অবদান তিনি কথাসাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।’
তারচেয়ে বরং পুরুষদের আধুনিক সাজসজ্জা এবং সেই সঙ্গে মুখরোচক কিছু গল্প যদি ম্যাগাজিনটিতে জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে ক্ষতি কী? সেই ভাবনা থেকে তিনি ম্যাগাজিনের পাতায় বিলাসবহুল পরিধান আর সাজসজ্জার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে কিছু মজাদার গল্পও ছাপতে শুরু করলেন। সেখানে গল্প লিখতে তিনি প্রথমেই হেমিংওয়েকে আহ্বান জানালেন।
মজার বিষয় হলো এস্কোয়ার ম্যাগাজিনটি কিন্তু শুরুর দিকে শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন ছিল না। শুরুতে এটি ছিল পুরুষদের মনোহরি কাপড়, ফ্যাশন এবং অন্যান্য নিত্য ব্যাবহার্য সামগ্রী বিক্রির একটি ম্যাগাজিন। ম্যাগাজিনটির প্রতিষ্ঠাতা গিংরিচের মনে একটা ভয় ছিল যে শুধুমাত্র শিল্প-সাহিত্য দিয়ে এই ম্যাগাজিনটি চলবে না। তারচেয়ে বরং পুরুষদের আধুনিক সাজসজ্জা এবং সেই সঙ্গে মুখরোচক কিছু গল্প যদি ম্যাগাজিনটিতে জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে ক্ষতি কী? সেই ভাবনা থেকে তিনি ম্যাগাজিনের পাতায় বিলাসবহুল পরিধান আর সাজসজ্জার পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে কিছু মজাদার গল্পও ছাপতে শুরু করলেন। সেখানে গল্প লিখতে তিনি প্রথমেই হেমিংওয়েকে আহ্বান জানালেন। লেখক হিসেবে হেমিংওয়ের তখন মোটামুটি একটি পরিচিতি আছে। তাছাড়া হেমিংওয়ের নামের সঙ্গে সাংবাদিক তকমাটিও যুক্ত আছে। স্টার নামের একটি পত্রিকায় তিনি কিছুদিন সাংবাদিকতার কাজ করেছিলেন। তবে সব কিছু ছাপিয়ে তিনি একজন কথাসাহিত্যিক এবং গল্পকার। গিংরিচের ধারণা হেমিংওয়ে যদি এস্কোয়ারে লেখেন তাহলে ম্যাগাজিনটি জনপ্রিয় হতে বাধ্য।
১৯৩২ সালে হেমিংওয়ে এবং গিংরিচ পরস্পরকে আরও গভীরভাবে জানতে নিউ ইয়র্কে (নিউ বুক স্টোর) একটি দোকানে মিলিত হলেন। দোকানটির মালিক ছিলেন মারগারেট কোন এবং তাঁর স্বামী হেনরি লুইস কোন। দুজনের প্রীতি মিলনে হেমিংওয়ে এস্কোয়ারে নিয়মিত গল্প লিখতে অনানুষ্ঠানিকভাবে রাজি হয়ে গেলেন। গিংরিচ চিঠি লিখলেন হেমিংওয়েকে, ‘আমেরিকার “ভগ” (Vogue) ম্যাগাজিনটি যেখানে নারীদের প্লাটফর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেখানে আমি এস্কোয়ারকে পুরুষদের ম্যাগাজিন হিসেবে জনপ্রিয় করতে চাই। আমি প্রথম সংখ্যা থেকেই আপনার ভাবনাগুলো দিয়ে শুরু করতে চাইছি। যেমন আপনার ফ্লোরিডাতে মাছ ধরার গল্প অথবা কোনো শিকার কাহিনি দিয়ে। অথবা আপনি যা ভাববেন তাই। এবং আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আপনার লেখার শব্দের ওপর কোনো সম্পাদকীয় কাঁচি আমি চালাব না। আপনি লিখবেন আর আমি প্রকাশ করব।’
চিঠিটি হেমিংওয়েকে বেশ টানল। বিশেষ করে ফ্লোরিডায় মাছ ধরার গল্প আর শিকার কাহিনি নিয়ে বেশ জমবে ধারাবাহিক লেখাটি। তবে একটা বিষয় নিয়ে হেমিংওয়ে একটু কপাল কুঁচকালেন। সেটি হলো গিংরিচ প্রতি গল্পের জন্য তাকে ২৫০ ডলার দেবেন বলে ঘোষণা দিলেন। প্রথম প্রথম বিষয়টি হেমিংওয়েকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। কারণ লেখক সম্মানী হিসেবে সেটি খুব একটা বেশি নয় কিন্তু কিছু পরেই তিনি অর্থের চেয়ে সেখানে ব্যাপক অ্যাডভেঞ্চারের ঘ্রাণ খুঁজে পেলেন। তিনি গিংরিচকে সবুজ সংকেত দিলেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন প্রতিটি সংখ্যায় (প্রতি চারমাস পরপর এস্কোয়ার প্রকাশিত হতো) তাঁর জীবনের বাস্তব ঘটনা দিয়ে তিনি লিখতে শুরু করবেন। শুরু হলো হেমিংওয়ের আর এস্কোয়ারের মধ্যে নতুন এক পথচলার গল্প।
১৯৩৩ সালের দিকেই এস্কোয়ার বেশ সফলতার মুখ দেখতে শুরু করে। তখন সময়টা ছিল খারাপ। আমেরিকায় চলছে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। কিন্তু এই অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও ম্যাগাজিনটি ভয়াবহরকম জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। গিংরিচ ম্যাগাজিনটিতে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ছাপতে শুরু করলেন। বিজ্ঞাপনের চমকেও তিনি হেমিংওয়েকে যথাযথভাবেই ব্যবহার করলেন। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। “Bobby Jones on Golf, Gene Tunney on Boxing, Hemingway on Fishing.”
বুঝতে অসুবিধা হয় না গিংরিচ মূলত হেমিংওয়ের লেখাকে বিপণন করতে চেয়েছিলেন। হেমিংওয়ে তখনো পর্যন্ত ‘দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ লিখেননি এবং সাহিত্য পাড়ায় ততটা সরগরম তোলেননি। তিনি তখন মনের সুখে মাছ ধরেন, শিকার করে বেড়ান এবং শিল্প-সাহিত্য নিয়ে ঝুঁকে থাকেন। ২৫০ ডলার প্রতি কিস্তিতে রফাদফা হওয়ার পর গিংরিচ শুধুমাত্র হেমিংওয়েকে জানালেন ‘সর্বোচ্চ সম্মানীটাই আপনাকে দিচ্ছি।’ উল্লেখ্য যে এস্কোয়ারে লেখকদের নানা শ্রেণীতে ভাগ করে সম্মানী দেওয়া হতো। বিষয়টি ছিল পত্রিকার জন্য যে লেখাগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং যেসব লেখার জন্য পত্রিকাটি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত সেসব লেখার লেখকদেরকেই শুধুমাত্র উচ্চমূল্যে লেখক সম্মানী দেওয়া হতো। এই প্রসঙ্গে হেমিংওয়ে লিখেছেন, ‘আমার যদি প্রচুর টাকা থাকে এবং বেঁচে থাকার জন্য অর্থ নিয়ে চিন্তা করতে না হয় তাহলে আমি যেকোনো বিষয় নিয়েই লিখতে আগ্রহী। কিন্তু আপনি যদি বলেন আমি ২৫০ ডলারের জন্য লিখছি তাহলে আমি বলব এর মূল্য ২৫০ নয় বরং ২৫০০।’
হেমিংওয়ে কখনো থাকেন হাভানায়, কখনো প্যারিসে আবার কখনো আফ্রিকার কেনিয়াতে। যেখানেই থাকেন না কেন ঠিক সময় মতো তিনি সম্পাদকের টেবিলে তাঁর লেখা পাঠিয়ে দিতেন। এস্কোয়ারে ছাপা হওয়া হেমিংওয়ের প্রথম লেখাটি ছিল ‘কিউবান লেটার’। মারলিন অফ দ্য মরো (Marlin Off the Morro)।’ এই শিরনামে লেখাটি যখন প্রকাশিত হয় তখন এস্কোয়ার পত্রিকার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি হয়ে ওঠে। পত্রিকার দোকানগুলোর শেলফে এস্কোয়ার পত্রিকাটি নিমিষেই বিক্রি হয়ে যায়। পাঠক এসে শূন্য হাতেই বাড়ি ফিরে যান। গিংরিচের ম্যাগাজিন ব্যাবসা তখন তুঙ্গে। বিষয়টি বুঝতে পেরে গিংরিচ তাৎক্ষণিকভাবে পত্রিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে বাধ্য হলেন। এবার হেমিংওয়ের সম্মানীও আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেল। এভাবে প্রতি সংখ্যাতেই হেমিংওয়ের লেখা বাবদ পারিশ্রমিক বাড়তে শুরু করে।
ততদিনে হেমিংওয়েও এস্কোয়ারের জন্য অপরিহার্য একজন মানুষে পরিনত হন। জানা যায় হেমিংওয়ে গিংরিচকে এক সময় ৩০০০ হাজার ডলার অগ্রিম লেখক সম্মানী দিতে বলেছিলেন। কারণ সেই টাকা দিয়ে তিনি তার ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য বড়ো মাছ ধরার নৌকা পিলার (Pilar)-এর মেরামত কাজে ব্যায় করেছিলেন। হেমিংওয়ের লেখালেখি জীবনে এই পিলার নামের নৌকাটির ভূমিকা ব্যাপক।
ধীরে ধীরে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়াল যে হেমিংওয়ে হয়ে উঠলেন এস্কোয়ার পত্রিকার অন্যতম চালিকাশক্তি। ম্যাগাজিনটিতে তাঁর নিয়মিত লেখার অপেক্ষায় পাঠকেরা অপেক্ষা করতেন। তিনি সেখানে শুধু লিখেই থেমে থাকতেন না, সেখানে লিখতে অন্য জনপ্রিয় লেখকদেরও আহ্বান জানাতে শুরু করলেন। সেই সময় তিনি জন দস পেসস, রিং লার্ডনার, স্কট ফিটজেরাল্ড, এজরা পাউন্ড, থিয়োডর ড্রেইসারসহ অনেক লেখককেই এস্কোয়ারে লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদেরকে এস্কোয়ারের সম্পাদকের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই ধীরে ধীরে এস্কোয়ারের সম্পাদক গিংরিচ হয়ে উঠলেন ‘বিখ্যাত লেখকদের সম্পাদক’। হেমিংওয়ের বিশেষজ্ঞ কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর রবার্ট ট্রকডন এর মতে, ‘হেমিংওয়ে ব্যতীত সম্পূর্ণ আনকোড়া এই ম্যাগাজিনের রাতারাতি বিখ্যাত হওয়া অসম্ভব ছিল।’ ততদিনে হেমিংওয়েও এস্কোয়ারের জন্য অপরিহার্য একজন মানুষে পরিনত হন। জানা যায় হেমিংওয়ে গিংরিচকে এক সময় ৩০০০ হাজার ডলার অগ্রিম লেখক সম্মানী দিতে বলেছিলেন। কারণ সেই টাকা দিয়ে তিনি তার ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য বড়ো মাছ ধরার নৌকা পিলার (Pilar)-এর মেরামত কাজে ব্যায় করেছিলেন। হেমিংওয়ের লেখালেখি জীবনে এই পিলার নামের নৌকাটির ভূমিকা ব্যাপক। কারণ, এই পিলার নামের মাছ ধরার নৌকাটি ছিল বলেই তিনি ‘আইল্যান্ড ইন দ্য স্ট্রিম’ এবং ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’র মতো দুটো কালজয়ী উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন।
হেমিংওয়ের লেখার সম্পাদনা বিষয়ে গিংরিচ কোনোদিনই তাঁর প্রতিশ্রুতি থেকে সরে দাঁড়াননি। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা সবসময় এই বিষয়ে খুব সতর্ক ছিলাম যে হেমিংওয়ের লেখায় সম্পাদনার কাঁচি চালানো যাবে না। যদি একান্ত কিছু করতেই হতো তাহলে সেটি হেমিংওয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে করা হতো।’ সেই সময় গিংরিচ এবং হেমিংওয়ের জুটি রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। একজন আরেকজনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহযোদ্ধা। ১৯৩৭ সালের জুন সংখ্যায় গিংরিচ এই নিয়ে লিখেছেনও সে কথা। ‘প্রথম দু-বছর তিনি ছিলেন অসাধারণ পরিশ্রমী একজন লেখক। তিনি তাঁর লেখাটি বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিতেন এবং তিনি কখনো আমাদের হতাশ করতেন না। পত্রিকায় মুদ্রণের জন্য সময়ের ঠিক আগেই আমরা ওঁর লেখাটি পেয়ে যেতাম। তাঁকে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের প্রয়োজন হতো তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের জন্য অবারিত থাকতেন।’
গিংরিচ আর হেমিংওয়ের সম্পর্কটা এতই মধুর ছিল যে হেমিংওয়ে প্রায় সময়ই তাঁর সম্পাদককে সমুদ্রে মৎস শিকারের আমন্ত্রণ জানাতেন। বিষয়টা গিংরিচের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। কারণ তিনি সমুদ্র ভয় পেতেন। তবে দুই বন্ধুর মাছ শিকার উদযাপনও ছিল দেখার মতো। একবার গিংরিচ আর হেমিংয়ে দুজনই বিয়ারের বোতল গুলি করে কে কয়টা মাটিতে ফেলতে পারবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। উল্লেখ্য যে গিংরিচ গুলির নিশানা তো দূরের কথা তিনি কখনো বন্ধুক হাতে পর্যন্ত নেননি। কিন্তু দেখা গেল প্রতিযোগিতায় তিনিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন। হেমিংওয়ের ভাষায়, ‘আমার মনে হয় সে আমার থেকেও বেশি মাতাল ছিল।’
এদিকে এস্কোয়ার পত্রিকায় স্থান পেতে লাগল হেমিংওয়ের জ্বালাময়ী নানা বিষয়ে প্রবন্ধ, গল্প। গল্পের ছলে তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক নানা রকম অনাচার নিয়ে লিখতে শুরু করলেন। ম্যাগাজিনটিতে ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ, ইউরোপে ফ্যাসিজম, মানবতা, শান্তি এসব রাজনৈতিক বিষয় হেমিংওয়ে তুলে ধরতে শুরু করলেন। এই লেখাগুলো তাঁকে যেমন জনপ্রিয়তার চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিল পাশাপাশি তার অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক খ্যাতি, বিপুল পাঠক সমাজও তৈরি করে দিয়েছিল। এস্কোয়ার ছিল হেমিংওয়ের একটি ভিন্নধারার লেখালেখির অন্যতম একটি পরীক্ষামূলক জায়গা। সেদিক থেকে ভাবলে লেখক হেমিংওয়ে এবং ম্যাগাজিন এস্কোয়ার দুটোই সার্থক।
কিন্তু এই জাগতিক সার্থকতাকে একজন জাত লেখক কতটুকু বয়ে বেড়াতে পারেন? তাও আবার তিনি যদি হন হেমিংওয়ের মতো কোনো বোহেমিয়ান ধাঁচের লেখক? ১৯৩৬ সালের দিকে হেমিংওয়ে এস্কোয়ারের জনপ্রিয় লেখালেখির ধারা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। তিনি তখন তার কথাসহিত্য নির্মাণের দিকে বেশি জোড় দিতে শুরু করেন। এক পত্রে তিনি সম্পাদক গিংরিচকে লিখলেন, ‘এটি আমার জন্য পাপ যদি আমি আমার উপন্যাস লেখায় মনোযোগী না হই। কোনো এক ভূত সম্ভবত আমার কাঁধে চেপে বসেছে। আমি যদি এই রসের পেয়ালায় ঠোঁট না ভেজাই তাহলে এর থেকে আমার নিস্তার নেই। আপনাকে আমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও ভালো বন্ধু হিসেবেই জানি। আমি বেশ ভালো করেই জানি যে ম্যাগাজিন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা মানেই হলো আমার বাণিজ্যিক দুনিয়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কিন্তু এর বিকল্প কোনো পথও আমার কাছে খোলা নেই।’
গিংরিচ বেশ কয়েকবারই হেমিংওয়েকে আবার এস্কোয়ারে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হেমিংওয়ে আর আসেননি। ১৯৫৫ সালে গিংরিচ তাঁর দীর্ঘদিনের বান্ধবী ম্যাসনকে বিয়ে করেন। একসময় গিংরিচ ও হেমিংওয়ের মধ্যে কথা চালাচালিও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেলেও এই দুই বন্ধুর মিলন থেকে বিশ্ব সাহিত্যের বোদ্ধারা নতুন কিছু খুঁজে পায়। গিংরিচের এস্কোয়ার এবং কথাসাহিত্যিক হেমিংওয়ে পরস্পর একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। আর এই দুটি সত্তার অপূর্ব মিলনে বিশ্বের সাহিত্যমোদীরা পেয়ে যায় ‘দি ওল্ডম্যান ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’সহ হেমিংওয়ের অসাধারণ সব লেখালেখি।
উল্লেখ্য হেমিংওয়ের নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘এস্কোয়ার’ ম্যাগাজিনের নাম এখনো সমানভাবে উচ্চারিত হয়। এই দুই সত্তা এখনো যেন সমানভাবেই বহমান ও একে অপরের পরিপূরক।
প্রাবন্ধিক, গল্পকার এবং অনুবাদক। ঢাকায় জন্ম। পড়াশুনা করেছেন বাংলাদেশ এবং উত্তর আমেরিকায়। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্ক অভিবাসী। নিউ ইয়র্ক বাংলা বইমেলা, নিউ ইয়র্ক ফিল্ম সেন্টার, নিউ ইয়র্ক বাউরি পোয়েট্রি ক্লাবসহ নানা রকম শিল্প-সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত। পেশায় আর্থিক বিশ্লেষক এবং পরামর্শক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে উত্তর আমেরিকায় বাঙালির অভিবাসী হওয়ার বিস্ময়কর ইতিহাস আর কৌতূহলোদ্দীপক জীবন নিয়ে তাঁর গবেষনাধর্মী গ্রন্থ ‘শিপ জাম্পার: বাঙালির আমেরিকা যাত্রা’, ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতী নারীদের বিচিত্র জীবন নিয়ে গবেষনা গ্রন্থ ‘ঔপনিবেশিক ভারতে বিলাতি নারীরা’ এবং পলাশী যুদ্ধের অন্যতম খলনায়ক রবার্ট ক্লাইভের অজানা কিছু কাহিনি নিয়ে গবেষণাধর্মী গ্রন্থ ‘জানা অজানা রবার্ট ক্লাইভ’। কবি শহীদ কাদরীর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে গ্রন্থ ‘চেনা অচেনা শহীদ কাদরী’ এবং ‘শহীদ কাদরী বাড়ি নেই’। আমেরিকার বাঙালি অভিবাসীদের মন ও তাঁদের জীবনের চমকপ্রদ গল্প নিয়ে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘অ্যাকুরিয়ামের মাছ ও হলুদ প্রজাপতির গল্প’, এবং ‘আমেরিকানামা’। দুঃসহ করেনাকালের ছাপ নিয়ে লেখা তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘করোনা ও একটি অলকানন্দা ফুল’। ভ্রমণ, বই পড়া এবং সিনেমা দেখা তাঁর নেশা।