বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’ : এক মহাজাগতিক আলোড়ন ।। গৌতম মণ্ডল

0

ভবিষ্যতের বাংলা কবিতা কেমন হতে পারে সে প্রসঙ্গে জীবনানন্দ দাশ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ‘কবিতা : বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’।

প্রবন্ধটির শেষদিকে তিনি বলছেন, ‘….ভবিষ্যৎ কালে (খুব দেরি না করেও) দীর্ঘ কবিতা ও শ্লেষে-লিখিত মহাকবিতা আসতে পারে; এবং কবিতায় নাট্য। ইতিপূর্বে গিরিশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ যা দিয়েছেন তার চেয়ে বেশি দেশি ও গ্রীক (কারও হাতে) ও বেশি শেকসপীয়রীয় (অপরদের হাতে— কিন্তু নতুন, জটিল সময়ের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শ্রী ধারণ করে) বাঙলা দেশে খুব শিগগির না হলেও সৃষ্টি হবে এক-দিন; কেবলই খণ্ড কবিতার সিদ্ধি নিয়ে দূরতর ভবিষ্যৎ তৃপ্ত হয়ে থাকবে বলে মনে হয় না।’

মহাকবিতা কী? কোন ধরনের কবিতাকে জীবনানন্দ মহাকবিতা বলতে চেয়েছেন? দীর্ঘ কবিতা মানেই কি তা মহাকবিতা? মহাকবিতা আর মহাকাব্য কি এক?

কবিতা বিষয়ে জীবনানন্দ দাশের সমস্ত চিন্তা অব্যর্থ ও অমোঘ হলেও এই ভাবনা, বলাই বাহুল্য, বাস্তবে সম্পূর্ণ রূপ পায়নি। অন্তত এখনো পর্যন্ত। এখনো পর্যন্ত বাংলা ভাষায় দীর্ঘ কবিতা বা মহাকবিতা খুব বেশি লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না। জীবনানন্দ দাশ নিজেও কি খুব বেশি মহাকবিতা লিখেছেন? এর উত্তরে যাওয়ার আগে জেনে নেব, মহাকবিতা কী? কোন ধরনের কবিতাকে জীবনানন্দ মহাকবিতা বলতে চেয়েছেন? দীর্ঘ কবিতা মানেই কি তা মহাকবিতা? মহাকবিতা আর মহাকাব্য কি এক? মহাকাব্য আর মহাকবিতা, বলাইবাহুল্য, এক নয়। মহাকাব্যগুলিতে একটা বিশাল নাটকীয় আখ্যান থাকে আর আখ্যান থাকে বলেই তা মোটামুটি পাঠকের সঙ্গে খুব সহজেই কমিউনিকেট করে। কিন্তু মহাকবিতায় সুনির্দিষ্ট যে আখ্যান থাকে, তা নয়, তারও বিরাট প্রেক্ষিত থাকে, মহাকাব্যিক প্রেক্ষিত, থাকে মহাকালচেতনা, বিশ্ববীক্ষা কিন্তু সরাসরি আখ্যান থাকে না। আখ্যানের অনুষঙ্গ থাকতে পারে। থাকেও। মহাকাব্যের সঙ্গে মহাকবিতার আরও একটা ফারাক দৈর্ঘ্যে। মহাকবিতা দীর্ঘ হলেও তার আকার মহাকাব্যের তুলনায় অনেক ছোটো। তবে দীর্ঘ কবিতা আর মহাকবিতা এক নয়। দীর্ঘ কবিতার সঙ্গেও মহাকবিতার বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। মহাকবিতা মানেই তা দীর্ঘ কবিতা কিন্তু সব দীর্ঘ কবিতা মহাকবিতা নয়। মহাকবিতার মতো দীর্ঘ কবিতায় মহাকাব্যিক প্রেক্ষিত থাকে না, নাও থাকতে পারে বিশ্ববীক্ষা।

সাতের দশক থেকে সুধীর দত্ত কবিতা লিখতে শুরু করেন। তাঁর কবিতায় দেশ-বিদেশের পুরাণ, উপনিষদ ও ভারতীয় ঐতিহ্যের নানান অনুষঙ্গ লক্ষ করা যায়। ছোটো কবিতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু দীর্ঘ কবিতাও লিখেছেন। সেসবের মধ্যে বিরাট প্রেক্ষিত যে নেই, তা নয়। বিশেষ করে’প্রাকপুরাণ’-এ। ‘প্রাকপুরাণ’ একটি উৎকৃষ্ট কবিতার বই কিন্তু মহাকবিতা কি?

 

২.
২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় সুধীর দত্তের একক কবিতার একটি কাব্যগ্রন্থ।’হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’। এই কবিতাটি, কোনো সন্দেহ নেই, একটি মহাকবিতা। মহাকবিতাই। কিন্তু কেন একে নিঃসংশয়ে মহাকবিতা বলছি?

সুধীর দত্ত বইটির ভূমিকায় বলছেন : “অর্বাচীনের স্পর্ধায় লেখালেখির সূচনাপর্বে’মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতা দিয়ে শব্দ সভ্যতা ও আত্মার পুনর্জীবনের জন্য শুরু হয়েছিল যে-উড়ান ও আত্মখনন ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’-তে পূর্ণ হল সেই বৃত্ত।”

কী আছে এর মধ্যে? মহাকাব্যিক প্রেক্ষিত? মহাজাগতিক ছায়া? সময়ের বিষ ও অমৃত? সাধারণ মানুষের স্খলন ও পতন? প্রতিবাদ? যুদ্ধ? আছে লেখকের অবচেতন? অবচেতন থেকে উঠে আসা আত্মার নীরব ক্রন্দন? হাহাকার? সুধীর দত্ত বইটির ভূমিকায় বলছেন : “অর্বাচীনের স্পর্ধায় লেখালেখির সূচনাপর্বে’মহেঞ্জোদাড়ো’ কবিতা দিয়ে শব্দ সভ্যতা ও আত্মার পুনর্জীবনের জন্য শুরু হয়েছিল যে-উড়ান ও আত্মখনন ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’-তে পূর্ণ হল সেই বৃত্ত।”

 

৩.
একটা ঘোরের মধ্যে লিখিত হয়েছে’হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’। কিন্তু কোথাও এর ভারসাম্য নষ্ট হয়নি। গতিও কোথাও শ্লথ হয়ে যায়নি। তিনি এই কবিতা, যাকে আমরা মহাকবিতা বলতে চাইছি, লিখেছেন সজ্ঞানে, তা হয়ত নয়। তিনি নিজেই বলছেন’আমি এখানে এক ধারকমাত্র’। অর্থাৎ লিপিকার। কবিতা তাঁর মাথায় ভর করেছিল আর তিনি ভূতগ্রস্তের মতো একের পর এক পঙক্তি রচনা করে গেছেন। প্রায় ৮০০ পঙক্তি রচিত হয়েছে এভাবে। কবিতাটি শুরু হচ্ছে একটা invocation দিয়ে। হংসারূঢ়া দেবী অর্থাৎ, সরস্বতীকে নিবেদন করে লেখা এই invocation। invocation টি শুরু হচ্ছে এইভাবে :

‘দু-এক কণা চিনিমুখে পিঁপড়েসম যে আছিল সুখে
যার ল্যাঙট অর্ধভুক্ত, দণ্ড যার জলে
ঘাই মারছে রাঙা-চক্ষু মহামৎসটি
তাহার তোলপাড় লিখি, তোমার আদেশে
পঙ্গুও ডিঙোয় গিরি;’

invocation-এর শুরুতেই দুটো জিনিস আমরা লক্ষ করি। রাঙা-চক্ষু যে মহামৎসটি আসলে যা মহাকাল তাকে তিনি লিখছেন না, লিখছেন তার আলোড়ন। উত্থান ও পতন। আবেশ। আর কী কী লিখতে চাইছেন, লিখছেনও, সেটাও বলেছেন invocation, এর শেষে।

গাহি জন্ম, বীর্য, কাম গাহি ক্রোধ, স্বাভিমান
গাহি রণ, রক্ত, ক্ষত ও ধাবন’

বোঝাই যায়, সুধীর দত্তের কাছে কবিতা ম্যাজিক বা মাদকতা নয়, পাঠকের চৈতন্যে তা এক
অভিঘাত ও আলোড়ন।

 

৪.
invocation এর পর ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’-তে রয়েছে এগারোটি বল্লী। বল্লী ঔপনিষদিক শব্দ, যার অর্থ লতা। অর্থাৎ এগারোটা লতা। এইসব লতা নিয়ে তৈরি হয়েছে একটা বৃক্ষ। মহাকাল। এখন পুরো কবিতাটির যেমন একটা সামগ্রিক অভিঘাত রয়েছে তেমনি প্রত্যেকটা বল্লীও স্বতন্ত্র, তারও একটা আলাদা মৌলিক আবেদন রয়েছে।

invocation এর পর ‘হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’-তে রয়েছে এগারোটি বল্লী। বল্লী ঔপনিষদিক শব্দ, যার অর্থ লতা। অর্থাৎ এগারোটা লতা। এইসব লতা নিয়ে তৈরি হয়েছে একটা বৃক্ষ। মহাকাল।

প্রথম বল্লীর নাম ‘এই কি সময় নয়, তথাগত’।

এই বল্লী শুরু হচ্ছে এভাবে :

‘কীভাবে আরম্ভ করি? স্থিতাবস্থাপ্রিয় শব্দগণ
বড় বেশি ঠান্ডা
পথ আগলে শুয়ে আছে।’

সত্যিই তো যে বিস্তারকে তিনি ধারণ করতে চাইছেন, যে হিরণ্যক্রোধকে তিনি প্রকাশ করতে চাইছেন তা কি প্রকাশ করা সম্ভব? কেননা যা দিয়ে তিনি প্রকাশ করবেন, সেইসব শব্দগুলো তো আসলে দীর্ঘদিনের অব্যবহারের কারণে’বড় বেশি ঠান্ডা এবং ভারী’– তারা’পথ আগলে শুয়ে আছে’। তবে শব্দগুলো যতই ঠান্ডা হোক তিনি তাঁর ভিতর প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন, করেছেনও। সুধীর দত্ত একজন প্রকৃত কবি তাই হৃদয় ও মননের উত্তাপে

‘আকাশ ছাড়িয়ে যায় তার মাথা/অক্ষর শাসন করে; অপ্রাতিষ্ঠানিক—’। শুধু অক্ষর শাসন নয়, নিজেকে অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসেবে ভাবতেও তিনি পছন্দ করেন। তিনি চান, সমস্ত ঘটনার ভিতর সমস্ত অবলোকনের ভিতর খুঁড়ে খুঁড়ে দেখতে। তাই তিনি প্রথম বল্লীর শেষে লেখেন:

‘এই কি সময় নয়,
খুঁড়ে খুঁড়ে ভিতর দেখবার?
এই কি সময় নয়, তথাগত।

এই কি সময় নয় প্রস্তুত হবার।’

তিনি প্রস্তুত। তাই প্রথম বল্লীর পর দ্রুত প্রবেশ করেন দ্বিতীয় বল্লীতে। সেখানে তিনি কী বলছেন?

‘যা নেই তা থেকে শুরু, যা নেই তা পায়ের তলায়
আধবোজা নয়নে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি একা।
একা কার ভালো লাগে?বাঁশঝাড়ের উপরে মরা চাঁদ
তার নীচে পাঠ করছি— মা যা হয়েছেন আর মা যা হবেন। /
যা নেই তা-ই আছে। আছে ও নাইয়ের মাঝখানে
পাক খাচ্ছে সাত পাতাল, সাত সাতটি লোক।’

বাঁশঝাড়ের উপরে চাঁদ নিচে তিনি আধবোজা নয়নে শুয়ে আছেন একা। একা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একা নন, তার কারণ তিনি টের পান, আছে ও নাইয়ের ভিতর রয়েছে সাত সাতটি লোক। তার আলো। অন্ধকার। এই আলো ও অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তিনি যা লিখছেন তা কি কবিতা? কেমন কবিতা? স্যুররিয়াল? তিনি লিখছেন :

‘এ তো কবিতা দেখছি—স্যুররিয়াল
যা আছে তা নেই
যা নেই তা থেকে শুরু, …’

তাই তো। এই মহাকবিতায় চেতন ও অবচেতন একাকার, একাকার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ— ইহকাল ও পরকাল। এই কবিতাটির সুনির্দিষ্ট কোনো গতিপথ নেই। যেন এবড়োখেবড়ো একটা ভাষাপথ। এই বল্লীতেই তিনি স্বীকার করছেন ’এ গল্পের অর্থ নেই। বস্তুত এ গল্প নয়। কবিতায় গল্প থাকতে নেই’। তাহলে? কেমন এই কাব্য, যাকে আমরা মহাকবিতা বলছি। এই বল্লীতেই সুধীর দত্ত ’হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি’ সম্পর্কে বলছেন’সবকিছুই এলোমেলো— খণ্ডহর— জেমস জয়েসের/যেন পারম্পর্যহীন আগাপাশতলা।’ আসলে তাঁর বুকের ভিতর অবলোকনের ভিতর কাজ করছে’ গোপন কান্নার মতো মায়া ক্রীট ব্যাবিলন মেসোপোটেমিয়া /দোয়াবের শস্যগান, হরপ্পানগর।’

সুধীর দত্তের এই কাব্যগ্রন্থ যা আসলে একটি মহাকবিতা— এর ভিতর রয়েছে নানান শাস্ত্রীয় অনুষঙ্গ। এর এক একটি বাক্য যেন মন্ত্র। কেমন মন্ত্র? তিনি নিজেই তৃতীয় বল্লীতে এসে বলছেন’মন্ত্র তো কার্তুজ, দিব্য বেয়নেট, ফলা।’ হ্যাঁ এ বইয়ে সুধীর দত্তের পঙক্তিগুলো এক একটা ফলা। ফলা-ই। হিরণ্যকশিপুর প্রসঙ্গ টেনে বলছেন’থাম ভেঙে বেরিয়ে এসো/হাঁটুর উপর… /এই তো সময় ভয় জড়তাকে হত্যা করবার।’

শুধু পুরাণ নয়, এই বল্লীতে এসেছে সমসময়। এসেছে সাত্তোরের বধূটির প্রসঙ্গ। এসেছে যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা।

’এই তো সময় ভয় জড়তাকে হত্যা করবার। / এই তো সময়-সন্ধি বিনির্মাণের/যখন সময় হিংস্র, হিরণ্য রাক্ষস; চলো, দেখে আসি—/

আমাদের ছোটো বোন বাড়ি ফিরল কিনা!/ভাইটি বাঁচল কিনা দিদিকে যে বাঁচাতে গিয়েছিল। /এখনো শুকোল কিনা, খোঁজ নাও, সিগ্রেটের ছায়া!’

বোঝাই যায় এ বইয়ের নির্দিষ্ট কোনো সেন্ট্রাল পয়েন্ট নেই, নেই সেন্ট্রাল থিম। তার পরিবর্তে রয়েছে টুকরো টুকরো স্তব। উল্লম্ফন। বিশ্ববীক্ষা।

এর পর আমরা প্রবেশ করব চতুর্থ বল্লীতে। ’বিরাট পুরুষ’ যার শিরোনাম। এই বল্লীতে দেখতে পাই বিরাটকে। তার গর্জন ও নৈঃশব্দ্য। কবি দেখেন’আয়ুধ নিয়ে দেবতারা প্রবেশ করছেন।’ আর সেসময়’হাড় থেকে উদ্যত বজ্র, নেঘে মেঘে ঝলকায় বিদ্যুৎ’। এই প্রসঙ্গে তিনি বলছেন:’হত্যাও একটি শিল্প, দয়া দুর্বলতা, পাপ;’ এই বল্লীটি শেষও হচ্ছে যুদ্ধের অনুষঙ্গে;

‘পাপী তাপী হে সমষ্টি লুচ্চা-নারায়ণ

আর জলশয্যা নয়, ঘুম নয়, যুদ্ধ করো, বাঁচো
চোখে চোখ ; তুমি পুরন্দর নও, বিরাট পুরুষ, ঐ দ্যাখো /
আকাশ থেকে কালপুরুষ কাঁড়বাঁশ ও কুকুরসমেত
নামছেন জঙ্গলপথে
মুণ্ডা, হো, বিরহড়, লোধারা
তোমার সহস্র বাহু, শীর্ষ, রণ-পা…’

পরবর্তী বল্লীর নাম’তিলক উৎসব’। এই বল্লীটি আয়তনে ছোটো কিন্তু এর বিস্তার ব্রম্ভাণ্ডজুড়ে। বল্লীর শুরুতেই দেখি এক দার্শনিকের অমোঘ উচ্চারণ।

‘যখন অগ্নি ও বায়ু
পরস্পরকে উসকে দেয়, উড়ে যেতে চায় উৎকেন্দ্রিক
মূঢ় মাটি আর জল
তাকে টেনে হিঁচড়ে ধরে রাখে।’

সত্যিই তো পৃথিবীর নানা ঘাত প্রতিঘাতে আমরা যেখানেই অবস্থান করি না কেন, আমাদের অন্তিম আশ্রয় কিন্তু মাটি আর জল। এই মাটি আর জল কি মা? নাকি ঈশ্বর? নাকি মৃত্যু? কবি বিশ্বাস করেন মৃত্যুতেই সব শেষ নয়। মৃতেরাও জেগে ওঠে, কথা বলে। এইকারণেই কি তিনি বলছেন

‘মৃতদের দেশ থেকে জাগো।

মৃত্যুকে প্রণাম করো
তুমিই পুরাণ। শেষ নয়, নেই—
এ তো আরেক শুরু। রণদেবতার
তিলক উৎসব, ল্যাজারাস’

এবার আমরা প্রবেশ করব ষষ্ঠ বল্লীতে। এই বল্লীর শিরোনাম’জয় হোক ধুলো-পা ও সম্ভাবনার’। এই বল্লীতে দেখি অনেক কিছু প্রায় পুরো মহাজগৎ। গ্রামশিলা, বালির পাহাড়, কান্দাহার, বিন্ধ্য, সাতপুরা, লুনী নদী, আরাবল্লী, ছোটোনাগপুর, বুন্দেলখণ্ড, তাপ্তী এমনকি দেশ ছাড়িয়ে’নীলনদ’। সর্বত্রই কাজ করছে একটা ভয়। আতঙ্ক। কিন্তু সুধীর দত্ত জানেন জয় হবে মানুষের। জয় হবে ধুলো পা-র। তাই তিনি বিশ্ব, চরাচর ঘুরে অন্তিম পঙক্তিতে এসে বলেন’জয় হোক মানুষের, ধুলো-পা ও সম্ভাবনার…’

ধুলো পা নিয়ে এবার আমরা ঢুকব সপ্তম বল্লীতে। ‘বরণীয় ভর্গ, সূর্যদেব’। আমরা জানি বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের কারণে। শুরুতে পৃথিবী ছিল জলমগ্ন। চারধারে ছিল জল আর জল। সুধীর দত্ত নিজে যেহেতু ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাস করেন সেহেতু তিনি মনে করেন ঈশ্বরের ইচ্ছেতেই সৃষ্টি হয়েছিল সবকিছু এমনকি জলও। আর জলের ভিতর আকাশ, তাও সৃষ্টি হয়েছে তাঁরই নির্দেশে। তিনি বল্লীর শুরুতেই লিখেছেন :

‘ঈশ্বর বললেন, এই জলের ভিতর আকাশ হোক।
আকাশ সৃষ্টি হল।’

ঈশ্বরের কথায় আকাশ তো হল ঠিকই কিন্তু তিনি?তিনি নিজেও তো একজন কবি। কবিও তো একজন ঈশ্বর। ঈশ্বর বাস করেন তাঁর দেহে। তিনি একমেব অদ্বিতীয় । কিন্তু শুধু যে কবির দেহেই ঈশ্বর রয়েছেন, তা নয়। তিনি ছড়িয়ে আছেন সর্বত্র। আর তাই তিনি, সুধীর দত্ত, লিখছেন :

‘তিনি শস্য— অন্ন ও জল।

এই যে তূণীর পিঠে জন্মাবধি, জ্যা রোপণ, কুমড়োফুল, দুর্গাটুনটুনি/
রূপে রূপে অপরূপ যিনি
তাঁর কোনো প্রতিমা নেই।’

সত্যিই তো তিনি রয়েছেন সবার মধ্যে কিন্তু তাঁর নিজস্ব কোনো প্রতিমা নেই। তাই তো কবি বলতে পারেন’এই যে প্রথম গ্রাস ভাতের থালায়/ তা তোমার নয়, সকলের’। সকলের ভিতর তিনি যেহেতু রয়েছেন তাই তিনি বলেছেন : উচ্চারণই স্তব।

উচ্চারণ যে স্তব, তা আমরা দেখতে পাই শুধুমাত্র এই বল্লীতে নয়, সমগ্র বইজুড়ে।

বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়, প্রতিটি বল্লীতে ছড়িয়ে আছে পৌরাণিক অনুষঙ্গ। ক্লাসিক রেফারেন্স। অধ্যাত্মচেতনা। সেইসঙ্গে মানুষের রোষ ও কামনা। হিরণ্যক্রোধ। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা। এসবই পাওয়া যায় অষ্টম বল্লীতে। সুধীর দত্ত এই বল্লীর নামকরণ করেছেন’মা গৃধঃ’। কয়েক লক্ষ বছর এগিয়েও কবি, দেখতে পাই, ক্ষান্ত নন। তিনি এবার ফিরে যেতে চান উৎসে। কিন্তু তিনি কে? আর কীই-বা তিনি চাইছেন? এর উত্তর পেতে পড়তে হবে কয়েক পঙক্তি।

‘আমি গ্রন্থি বা নিরগ্রন্থ নই
আমি মৈত্রী, শূন্য ও করুণা।
ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দাও, সলতে-জ্বলা অভিমান, কুপি।’

থৈ থৈ আকাশ ভাঙা জ্যোৎস্না ঢুকবে হুড়মুড়িয়ে ঘরে শুধু জ্যোৎস্নার কথা নয়, এসেছে কবিতা কেমন হবে, তারও কথা। কীরকম কথা? আসুন, দেখি।

‘এবং সে বর্জন করুক
চিত্রকল্প,
যা কবিতা নয়, কল্প, ভাঙা আরশি, কবিতার প্রায়।’

অর্থাৎ যা কবিতা নয় বা যা কবিতার মতো তাকে তিনি বর্জন করতে চাইছেন। সুধীর দত্তের কবিতার যাঁরা পাঠক তাঁরা জানেন, সুধীর দত্তের কবিতা মানে সলিড কিছু, তা ফাঁপা নয়। সুধীর দত্তের কবিতার আরো একটা বৈশিষ্ট্য তা চিত্রকল্পময় নয়।

এর পরের বল্লী নবম বল্লী। যে দ্রুতিতে কবিতা শুরু হয়েছিল সেই একই দ্রুতি দেখি এখানেও। কবি ভূতগ্রস্তের মতো একের পরে এক পঙ্‌ক্তি রচনা করে চলেছেন। অনেক ক্ষেত্রে মনে হতে পারে এরা পারম্পর্যহীন এবং বিচ্ছিন্ন। কিন্তু কবিতার গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যাবে কবি আসলে পুরোটা মিলিয়ে একটা প্রতিমা নির্মাণ করতে চাইছেন। হোক না সে প্রতিমা অস্পষ্ট। আর একটা ব্যাপার যেভাবে এতদিন কবিতা লিখিত হয়েছে তাকে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন, ভেঙেছেনও। শুরুতেই রয়েছে সেই অভিপ্রায়।

‘এই যে নাভিতন্তু— উর্ণাজাল আমরাই কি রচনা করেছি? /
যা যা ছিল পূর্ব কল্পে
তারই পুনরাবৃত্তি? আমিই তো শৃঙ্খলটিকে
যা বিতত দেবলোক অবধি
ভাঙতে চেয়েছি।’

শুধু শৃঙ্খল ভাঙা নয়, এই বল্লীতে এসেছে উদবাস্তু মানুষের প্রসঙ্গের কথাও। দণ্ডক অরণ্য থেকে বুদাপেস্ট মিউনিখ ভিয়েনার পথে, কবি বলছেন,’উদবাস্তু আমরা সকলেই’। এসেছে কুর্দ-শিশু ইজিয়নের প্রসঙ্গও।’কোন, কর্মফলে ভুগে ইজিয়ন সৈকতে তুমি/শুয়ে আছো এমন নিথর, প্রিয় কুর্দ।’

অতীত থেকে যেহেতু চলছে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, নিপীড়ন, রক্তপাত, তাই, তিনি মনে করছেন যুদ্ধ অনিবার্য। লিখছেনও

‘তবু যুদ্ধ অনিবার্য
আমি যুদ্ধ করি ও করি না। রাত্রির গর্ভ থেকে
জন্মায় যে অসুরেরা প্রতি যামে ক্ষীণ হয়
সংঘর্ষ ব্যতীত /
মুক্তি নেই— রূপান্তর নেই।’

দশম বল্লী, ‘অমৃতের পুত্রগণ’, সেখানেও দেখি সেই তুমুল ঘোর। আঁকাবাঁকা গতি। ‘একটিমাত্র নৌকা। ধ্বস্ত নাবিকদের নিয়ে নতুন উদ্যমে আমরা বেরিয়ে পড়ি উত্তাল সমুদ্রে।’ এরপর? ‘দাঁড়গুলি হয়ে ওঠে পাখা, পবিত্র ক্রোধ ও বিধূনন, পক্ষী পিঞ্জরে, সে পিঞ্জর-ছাড়া, উড্ডীন, বিদেহ, আক্রান্ত ও আক্রমণকারী। রাত্রি নামে তার সব নক্ষত্র উড়িয়ে, অযুত সূর্যাস্ত আমরা অতিক্রম করি, নিরবধি, সঙ্কুল হে অবিনশ্বরতা।’ যে কবি অযুত সূর্যাস্ত অতিক্রম করতে চান, করেনও, তাঁর কবিতা যে অর্থময়তায় বন্দী থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।

রাত্রি নামে তার সব নক্ষত্র উড়িয়ে, অযুত সূর্যাস্ত আমরা অতিক্রম করি, নিরবধি, সঙ্কুল হে অবিনশ্বরতা।’ যে কবি অযুত সূর্যাস্ত অতিক্রম করতে চান, করেনও, তাঁর কবিতা যে অর্থময়তায় বন্দী থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।

এগারোটা বল্লীর মধ্যে শুধু এই বল্লীটি টানা গদ্যে রচিত।

এর পরবর্তী বল্লী একাদশ বল্লী। ‘বজ্রগর্ভ ভাষার সন্ত্রাস’। বইয়ের এটিই শেষ বল্লী। এই বল্লী ‘কোনো বাঁধা সড়ক নয়’। শুধু তাই নয়, কবি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘শত পুষ্প বিকশিত হোক।’

আরও একটা কথা না বললে, এই বইটি যা আসলে একটি মহাকবিতা, অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তা হল, শুরু থেকেই কবি স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। যে ধরনের মহাকবিতা এতদিন লেখা হয়নি, তিনি তাই লিখতে চেয়েছেন, লিখেছেনও। কী লিখেছেন, আসুন, দেখি:

‘আমি তো নৈরাজ্য থেকে সমুদ্রবাতাস, হঠকারী

তুমুল গা ঝাড়া দিই–
উল্টে দিই স্থিতাবস্থা, তুলা ও ডেটল, মোমবাতি।
আমি বিজৃম্ভন করি—
ভাঙি জোড় শব্দদের, গজ ও ব্যান্ডেজ-বাঁধা নিপুণ গঠন, /
ভাঙি থাম, অসম বিবাহ
সংস্কার ও বিপ্লবের, তড়িত-আহত

লিখি হ্রেষা মেধ্যজলে, লিখি ক্ষুরধ্বনি, হা হা রবে…’

একাদশ বল্লীর শেষ এই কয়েক পঙ্ক্তির ভিতর এই মহাকবিতার দার্শনিক প্রস্থানবিন্দুটির ছায়া অবস্থান করছে বলে মনে হয়। কেননা এর মধ্যে ব্যক্ত করেছেন তাঁর নিজস্ব স্থানাঙ্ক। বিশ্ববীক্ষা।

 


সবমিলিয়ে প্রায় ৮০০ পঙ্‌ক্তি। কিন্তু এই দীর্ঘ কবিতাটির প্রেক্ষিত ও বিস্তার ৮০০ পঙ্‌ক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যদিও এখানে নির্দিষ্ট কাহিনি বা আখ্যান নেই তার পরিবর্তে রয়েছে টুকরো টুকরো ভাবনা। ভাবের অনুষঙ্গ। কালের দিক কবিতাটি শুরু হয়েছে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে তেমনি শেষ হয়েছে সুদূর ভবিষ্যতে। অতীত ও ভবিষ্যৎ থাকলেও বর্তমান যে নেই, তা নয়। আছে বর্তমানের বিষ ও অমৃত। টাইমের পাশাপাশি দুমড়ে মুচড়ে আছে স্পেস। এক মহাগাগতিক আলোড়ন। বজ্রগর্ভ ভাষার সন্ত্রাস। তাই এই কবিতা শুধুমাত্র দীর্ঘ কবিতা নয়, এটি নিঃসন্দেহে একটি মহাকবিতা। এই উচ্চতার মহাকবিতা বাংলা ভাষায় খুব বেশি লেখা হয়েছে বলে মনে হয় না।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম  ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। পেশা শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ‘উজাগর আঁখি’ (১৯৯৪), ‘রাত ও রাতের বিভা’ (১৯৯৫), ‘কন্দমূলের আকাশ’ (১৯৯৯), ‘কালপুরুষ’ (২০০০), ‘ভূপাখি ভস্মপাখি’ (২০০৫), ‘দুর্লভ শিখরদেশ’ (২০০৯), ‘অলসরঙের টিলা’ (২০১২), ‘বিবাহের মন্থর আয়োজন’ (২০১৬), ‘অরচিত অন্ধকার’ ( ২০১৯)। সম্পাদিত পত্রিকা : ‘আদম’। সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘কমলকুমার মজুমদারের চিঠি’, ‘আমার স্বামী কমলকুমার : দয়াময়ী মজুমদার’, ‘গদ্যসংগ্রহ : গীতা চট্টোপাধ্যায়’, ‘কবিতাসংগ্রহ : সুধীর দত্ত’, ‘কবিতাসংগ্রহ : সমীরণ ঘোষ’। প্রাপ্ত পুরস্কার : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, অহর্নিশ সম্মাননা, ঐহিক সম্মাননা প্রভৃতি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।