বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

ওশো রজনীশের : ভিখারি : ভাষান্তর: কবির বিটু

0
Osho Rajnish 2

ওশো রজনীশ

ভারতের মধ্যপ্রদেশের কুচবারা নামক গ্রামে ১১ ডিসেম্বর ১৯৩১ সালে ওশো জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক সূত্রে জৈন ধর্মের অধিকারী ছিলেন বলে শিশুকালে তার পারিবারিক নাম ছিল রজনীশ চন্দ্রমোহন জৈন।

জীবনের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি ছিলেন যেমন নির্ভীক তেমনি সাহসী। নিজস্ব চিন্তাভাবনাজাত যুক্তিবলে ছোটোবেলা থেকেই প্রথাগত ধর্মের কট্টোর সমালোচক ছিলেন। সমাজের পরজীবী হিসেবে বেড়ে ওঠা মোল্লা, পুরোহিত, পাদ্রি, সন্ত কেউ তাঁর হাত থেকে নিস্তার পায়নি। যুবক বয়সেই তিনি সমাজের এসব প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা করে কথা বলে ওঠেন।

মাস্টার্স-এ দর্শন শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি জবলপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ বছর অধ্যাপনাকালীন সময় থেকে তিনি সারা ভারতবর্ষ ঘুরে হাজার হাজার মানুষের মাঝে এক নতুন চেতনা জাগরণের কাজ করে যান। প্রথাগত চিন্তায় একে আধ্যাত্মিক জাগরণ মনে হতে পারে। আদতে তাঁর কথা ও চিন্তায় তিনি মানুষকে এমন এক নবজাগরণের কথা বলছিলেন যেমনটা মানবাত্মার জন্য মুক্তির পথ‌ই শুধু দেখায় না একাধারে প্রচলিত নীতি নৈতিকতার সারবস্তু ভেঙে মানুষকে তার প্রকৃত স্বরূপটা চোখের সামনে তুলে ধরতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে তাঁর প্রধানতম গুণ ছিল কথা বলার অসাধারণ ক্ষমতা। সামনে বসে থাকা হাজার হাজার শ্রোতাকে তিনি আক্ষরিক অর্থেই সম্মোহন করে ফেলতে পারতেন।

ভারতের বিশাল গণ্ডি পেরিয়ে সুদূর আমেরিকাতেও ছিল তাঁর আশ্রম ও লাখ লাখ শিষ্য অথবা অনুসারী। জীবিত কালেও যেমন তিনি কোটি কোটি মানুষকে নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁর অনুপস্থিতিতে এখনো সারা পৃথিবীর মানুষকে তিনি তাঁর বক্তব্যের সৌন্দর্যে মোহিত করে রেখেছেন।

তিনি কখনো কোনো বই লেখেননি। শ্রোতাদের মাঝে তিনি যেসব কথা বলেছেন আজীবন, সেগুলোই পরবর্তী সময়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। সেই হিসেবে তাঁর বইয়ের সংখ্যা সাত শতাধিক। এখন পর্যন্ত ত্রিশটি ভাষায় তাঁর বই অনুবাদ হয়েছে।

এ লেখাটি তাঁর The book of man বইয়ের The Begger অধ্যায়ের অনুবাদ।


আমরা কেন ভিখারির মতো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করি? এ ব্যাপারে আপনার কাছে কিছু শুনতে চাই।

 

এটি মানুষের এক প্রকার দুর্বলতা, অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করার এক ধরনের গভীর আকুতি। নিজেকে জানে না বলেই মানুষ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। এর একমাত্র কারণই হলো মানুষ অন্যের চোখে তার নিজেকে দেখে, তাদের মতামতের মাঝে সে তার ব্যক্তিত্ব খুঁজতে যায়। তাদের বলা কথা তার কাছে অনেক বড়ো বিষয় বলে মনে হয়। যদি তারা তাকে উপেক্ষা করে, প্রত্যাখ্যান করে, তবে সে নিজেকে অস্ত্বিত্বহীন মনে করে। আপনি যদি পাশ দিয়ে যান আর কারো মনোযোগ আপনার ওপর না পড়ে আপনি হাড়াতে থাকেন নিজের সবটুকু—আপনার ব্যাক্তিত্ব। এটা এমন একটি বিষয় যা আপনি নিজের সাথে একিভূত করে নিয়েছেন। আপনি এটি আবিষ্কার করেননি, এটি সহজাত নয়। এটি খুবই আরোপিত এবং খেয়ালি।

মনোযোগ আকর্ষণ-প্রার্থী শুধু আপনি একাই নন; প্রায় সকলের মধ্যেই এ দূর্বলতা রয়েছে। এবং এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি প্রকৃত নিজেকে আবিষ্কার করছেন—যা কিনা অন্য কারো মতামত, মনোযোগ, সমালোচনা, উদাসীনতার ওপর নির্ভর করে না। যা কারো ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারে না। যেহেতু খুব কম সংখ্যক মানুষই তাদের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করতে অক্ষম, তাই এ পৃথিবী ভিখারিতে পরিপূর্ণ।

মনের গভীরে আপনারা সকলেই মনোযোগ প্রত্যাশী। এটি আপনার ব্যক্তিত্বে পুষ্টির যোগান দেয়। এমনকি লোকজন যদি আপনার নিন্দা করে, সমালোচনা করে, আপনার বিরুদ্ধে যায়, তাও আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য, অন্ততঃপক্ষে তারা তো আপনার দিকে মনোযোগ দেয়; যদি তারা বন্ধুভাবাপণ্য হয়, আপনাকে সম্মান করে, অবশ্যই সেটা অনেক ভালো ব্যাপার। কিন্তু আপনি মনোযোগহীন ব্যক্তিত্ব হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবেন না। এটা নেতিবাচক অথবা ইতিবাচক দুটোই হতে পারে, সেটা কোনো ব্যাপার না। মানুষকে আপনার সম্পর্কে কিছু বলতে হবে, শ্রদ্ধাশীল অথবা অসম্মানজনক, উভয়ই একই উদ্দেশ্য পূর্ণ করে।

আমি আপনাদের (Respect) ‘সম্মান’ শব্দটি নিয়ে ভাবতে বলি। এটা দ্বারা (Honor) শ্রদ্ধা বুঝায় না, প্রত্যেকটি অভিধানে এর অর্থের কোনো ব্যাতিক্রম নেই। Respect শব্দটি Re-spect শব্দটিরই সমন্নিত রূপ। এর অর্থ দাঁড়ায় পুনরায় তাকানো। যখন আপনি রাস্তা দিয়ে যান, কেউ পুনরায় দেখে, আপনি তার চোখে কিছু একজন হয়ে ধরা পড়েন। কারণ সম্মান আপনাকে কিছু একটা হয়ে ওঠার ধারণা দেয়। আপনি মনোযোগ পেতে নির্বুদ্ধিতাপূর্ণ যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারেন।

সকল বয়সের মানুষই অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য হাজার রকমের চেষ্টা করে। সে সকল চেষ্টার কোনোটাই যৌক্তিক নয়— উদাহরণ হিসেবে বলা যায় পাশ্চাত্যের পাঙ্কু জেনারেশনের কথা। অদ্ভুতভাবে চুল কেটে আর তাতে উম্মাদের মতো রং লাগিয়ে মানুষের কাছে সত্যিকার অর্থে তারা কী আশা করত? তারা মর্মমূলে ভিখারি। আপনার তাদের উপর রাগ করা উচিত নয় কারণ তারা আসলে তা-ই চায়। আপনার তাদের নিন্দা করা উচিত নয় কারণ তারা সেভাবেই থাকতে চায়। তাদের বাবা-মার উচিত তাদের সমালোচনা না করা। কারণ তারা তা-ই চায়। তারা মানুষের মনোযোগ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না।

মানুষের অতীতের কথা শুনলে আপনারা বিশ্বাস করবেন না। এখনো মানুষ নগ্ন রয়ে গেছে। মহাবীর অথবা ডায়োজিনিসের নগ্ন থাকার কী প্রয়োজন ছিল? সব ঋতুতে নগ্ন থাকা এখন মানুষের জন্য প্রকৃতিবিরুদ্ধ। বহুকাল আগেই সে তার এ ক্ষমতা হারিয়েছে। সকল প্রাণীই নগ্ন, কিন্তু তাদের সকলেরই রয়েছে প্রাকৃতিক নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। শীতের সময় তাদের শরীরে লোমের আধিক্য দেখা দেয়, গ্রীষ্ম এলে আবার তা ঝরে পড়ে। প্রকৃতি তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

একইরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা মানুষেরও ছিল। কিন্তু মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, সে তার প্রকৃতিকে আরও উন্নত করতে পারে। সে ঋতু অনুযায়ী তার শরীরকে আবৃত করার পন্থা খুঁজে বের করে। প্রাকৃতিকভাবে তাই তার শরীর থেকে পশমের আধিক্য কমে যায়। আর এখন নগ্ন হলে হঠাৎ করেই আপনার শরীর আপনাকে রক্ষা করার প্রক্রিয়া তৈরি করতে পারবে না।

আমি জানি মহাবীর বা ডায়োজেনিস অনন্য ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তাঁরা তাদের নিজেদের স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে একটু অনিশ্চিত ছিল। তাঁরা সংশয়ে পূর্ণ ছিল, এটাই ছিল তাদের নগ্ন হওয়ার পেছনের পূর্বকথা, কারণ এ জগতের সকল পোষাক পরিহিত মানুষের মাঝে একজন নগ্ন থাকা মানুষের প্রতি আপনি আপনার মনোযোগ সরাতে পারবেন না। নগ্ন ব্যক্তি নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি তাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না… এমন একটা দৃশ্য দেখে জিজ্ঞেস করার দূর্নিবার আগ্রহ নিয়ে আপনি জানতে চাইবেন, ‘বিষয়টা কী?’

কিন্তু তাদের নগ্নতা তাদের একপ্রকার আধ্যাত্নিক স্বত্ত্বা বানিয়ে তোলে; জনগণ তাদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল শুধুমাত্র তারা নগ্ন বলে। এখন নগ্নতা কোনো গুণ বা যোগ্যতা বা কোনো সৃজনশীলতা নয়; সকল প্রকার প্রাণী, সব পাখি এবং সব গাছ নগ্ন।

কিন্তু এখন এমন বোকা মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। একজন জৈন সন্নাসী মারা গেলে তার স্থান পূর্ণ করতে দ্বিতীয় জন খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই দিনদিন তাদের সংখ্যা কমতির দিকে। সারা ভারতে মাত্র বিশ জন এখনো নগ্ন—এবং আমি তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্ত্বার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাইনি। কোনো ধ্যানীর দেখা যেমন পাইনি তেমনি পাইনি উৎফুল্ল কোনো ব্যাক্তিত্ব।

ভারতে এখনো জৈন সন্নাসী রয়েছে, সব মিলিয়ে বিশ জনের বেশি হবে না। তারা হাজার হাজার ছিল। কিন্তু এখন এমন বোকা মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু কঠিন। একজন জৈন সন্নাসী মারা গেলে তার স্থান পূর্ণ করতে দ্বিতীয় জন খুঁজে পাওয়া যায় না, তাই দিনদিন তাদের সংখ্যা কমতির দিকে। সারা ভারতে মাত্র বিশ জন এখনো নগ্ন—এবং আমি তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্ত্বার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাইনি। কোনো ধ্যানীর দেখা যেমন পাইনি তেমনি পাইনি উৎফুল্ল কোনো ব্যাক্তিত্ব। তাদের মুখ যেন বিষণ্ন, নিস্তেজ, নিদ্রাহীন। তারা কষ্ট ভোগ করছে, নিজেদের ওপর নির্যাতন করছে, শুধুমাত্র ছোট্ট একটা কারণে, আর তা হলো—মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ।

মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করাতে পারলে যেকোনো ফালতু বিষয়েই তাকে জড়ানো সম্ভব। বিপ্লবের আগে রাশিয়ায় একদল খ্রিষ্টান সম্প্রদায় ছিল যারা একটি নির্দিষ্ট দিনে প্রকাশ্যে তাদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলত—এবং তাদের ছিল হাজার হাজার অনুসারী। তাদের আধ্যাত্মবাদী হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা ছিল তাদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলা। বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে গির্জার প্রাঙ্গনে জড়ো হয়ে তারা যৌনাঙ্গ কেটে স্তুপ বানিয়ে ফেলত। এবং হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হতো সেই বোকামি দেখতে।

নারীরাও পিছিয়ে ছিল না… যদিও তাদের কেটে ফেলার মতো ঝুলন্ত কোনো যৌনাঙ্গ ছিল না; তাদের যৌনাঙ্গ থাকে ভেতরের দিকে। তখন তারা তাদের স্তন কাটতে শুরু করে—নারীরাও পিছিয়ে থাকতে রাজি নয়। একটি অরাজক ও রক্তাক্ত পরিস্থিতি ছিল, কিন্তু লোকেরা তাদের পা স্পর্শ করত, তাদের উপাসনা করত। অথচ তারা যা কিছু করত তা ছিল কেবল একটি কুৎসিত কাজ। প্রকৃতি এবং মানবতা বিরুদ্ধ কাজ।

না খেয়ে থাকা একজন মানুষের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? মহাত্মা গান্ধী তার সমগ্র জীবনে এই কৌশলটি ব্যবহার করে গেছেন। এটি সমগ্র জাতির মনোযোগ আকর্ষণ করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। যখনই তিনি আমরণ অনশনে যেতেন, তৎক্ষণাৎ সারা বিশ্ব তার প্রতি মনযোগী হয়ে পড়ত। এছাড়া উপোস থাকার আলাদা কোনো আধ্যাত্মিকতা নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা যায়। আগামী দশ-বারো বছরে আরও লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাবে। কেউ তাদের প্রতি কোনো প্রকার শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখাবে না। কেন? কারণ অনাহার তাদের জন্য অনিবার্য। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুধার্ত নয়, তারা ক্ষুধার্ত কারণ তাদের খাওয়ার মতো কিছু নেই। তারা কেবলমাত্র দরিদ্র ও অনাহারী মানুষ।

কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর কাছে সবকিছু ছিল, যদিও তিনি একজন দরিদ্র মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে একজন, খুব বুদ্ধিমান মহিলা, সরোজিনী নাইডু—একটি বিবৃতিতে বলেছিলেন, মহাত্মা গান্ধীকে দরিদ্র হয়ে থাকার জন্য প্রচুর ব্যয় করতে হতো। তার দারিদ্রতা কোনো সাধারণ দারিদ্রতা ছিল না, এটি ছিল লোক দেখানো।

তিনি মহিষের দুধ খেতেন না কারণ এটি ছিল ভিটামিন সমৃদ্ধ দামি দুধ। তিনি গরুর দুধ পান করতেন না কারণ এটিও ধনী লোকের খাবার। দরিদ্রদের এ দুধ খাবার সামর্থ নেই। তিনি কেবল ছাগলের দুধ পান করতেন, কারণ এটি ছিল সস্তা প্রাণী এবং দরিদ্র লোকের পক্ষে এর ব্যায় বহন করা সম্ভব। কিন্তু আপনারা শুনলে অবাক হবেন তার ছাগলকে দিনে দু’বার করে লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করানো হতো! তার ছাগলের খাবার ছিল খুবই পুষ্টিগুণসম্পন্ন যা ধনীদেরও ঈর্ষান্বিত করে তোলার মতো। কেমন আজব পৃথিবী এটা! এমনকি ছাগলকে খাওয়ানোর জন্য গরুর দুধ পান করতে দেওয়া হতো। ছাগলকে শুধুই ঘাস খেতে দেওয়া হতো না, তার জন্য বরাদ্দ ছিল কাজু বাদাম, আপেল ও অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার। অতীতে প্রতিদিনের সেই খাবারের দাম ছিল দশ টাকা; প্রতিদিনের সেই দশ টাকা দিয়ে তখন একজন মানুষের পক্ষে একমাস জীবনধারণ করা সম্ভব ছিল।

আর গান্ধী সাধারণত তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে ভ্রমণ করতেন। স্বাভাবিকভাবেই, তিনি লোকের মনোযোগ আকর্ষণ করতেন—একজন মহান ব্যক্তি তৃতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করছেন! কিন্তু কেউ সেই তৃতীয় শ্রেণীর বগি দেখেনি। যে বগি কমপক্ষে ৬০ জন মানুষ বহনে সক্ষম, সেটায় তিনি ছিলেন একমাত্র যাত্রী। বরং এটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগির চেয়ে বেশি ব্যায়বহুল। কিন্তু এটি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করত।

মনোযোগ আপনার অহংকারের পুষ্টি যোগায়।

প্রয়োজনে রাজনীতিবিদরা ধার্মিক হওয়ার ভান করতে পারেন। কারণ তাদের প্রয়োজন জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ। আদতে তাদের পুরো ব্যক্তিত্বই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের জনপ্রিয়তা নির্ভর করছে কতজন লোক তাদের অনুসরণ করছে তার উপর; এটি তাদের প্রতি মনযোগী লোকের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। এটি মূলত: সংখ্যার রাজনীতি।

ক্যাথলিক পোপ জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে, গর্ভপাতের বিরুদ্ধে, কারণ এটা নয় যে তিনি এ ব্যপারে সহানুভূতিশীল নন। তিনি এমনও বলেন, ‘এটা পরম নিষ্ঠুরতা ও সহিংসতা’, জীবনকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি এ কথা বলেন না। বরং পুরো ক্যাথলিক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে দেখে নেতিবাচকভাবে, এটি জীবনের বিরুদ্ধে। তাহলে কেন তারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ আর গর্ভপাতের বিরুদ্ধে এতা সোচ্চার? কারণ ক্যাথলিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির এটাই একমাত্র উপায়, এবং এটি জনগণকে দরিদ্র বানিয়ে রাখবে যাতে তারা ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের ছায়াতলে থাকতে পারে।

এখন যেহেতু ভারতে অনেক এতিম রয়েছে, ক্যাথলিকদের জন্য এটি একটি ভালো সুযোগ। এবং একটি আশ্চর্যের ব্যপার হচ্ছে মাদার তেরেসার মতো একজন নারী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ভারতীয় ডক্টরেট, ভারত সরকার কর্তৃক পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন শুধুমাত্র এতিমদের দেখাশোনার জন্য। কিন্তু কেউ চিন্তাই করতে পারবে না এ দেখাশোনার অর্থ শুধুমাত্র এতিমদের ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরিত করা। জন্মনিয়ন্ত্রনের পক্ষে থাকলে মাদার তেরেসা এতো এতিম কোথায় পেতেন?

খ্রীষ্টধর্ম এমন একটি বিশ্বের পক্ষে হতে পারে না যা ধনী। বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছেন ক্রমাগত আমরা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি যে এখন আর কারো ক্ষুধার্ত থাকার কোনো কারণ নেই। অনাহারে অথবা খাবারের অভাবে মারা যাবারও কোনো উপায় নেই। এমন বিশ্ব আগে কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন যে আমরা ৫ বিলিয়ন মানুষকে খাওয়াতে পারি খুব সহজেই, আমরা আরও বেশি খাওয়াতে পারি—কিন্তু সেই কণ্ঠস্বরগুলি আজ নীরব। কোনো রাজনীতিবিদ এখন এ ব্যপারে মনযোগী নয়, কারণ রাজনীতিবিদরা এখন তাদের বিরাট অনুসারীদের মনোযোগ আগ্রহে ব্যস্ত।

সবার প্রয়োজন তাদের নাম এবং তাদের ছবি সংবাদপত্রে ক্রমাগত প্রকাশিত হোক, কারণ সংবাদপত্রগুলি যদি কয়েকমাসের জন্য কারো নাম ভুলে যায়, জনগণও সেই মানুষটাকে ভুলে যায়। আপনারা রিচার্ড নিক্সন সম্পর্কে কি জানেন?

আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের সবার প্রয়োজন মনোযোগ আকর্ষণ, সবার প্রয়োজন তাদের নাম এবং তাদের ছবি সংবাদপত্রে ক্রমাগত প্রকাশিত হোক, কারণ সংবাদপত্রগুলি যদি কয়েকমাসের জন্য কারো নাম ভুলে যায়, জনগণও সেই মানুষটাকে ভুলে যায়। আপনারা রিচার্ড নিক্সন সম্পর্কে কি জানেন? তিনি এখন কোথায়? একদিন তিনি ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি। আর এখন আপনারা তার সম্বন্ধে কেবল সেই দিনই শুনবেন যেদিন সে মারা যাবে, এবং পত্রিকার তৃতীয় বা চতুর্থ পৃষ্ঠায় ছোট্ট কলামে সে খবর ছাপা হবে। কী হয় এই ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের? যখন তারা মানুষের মনোযোগ হারিয়ে ফেলে, তখন তাদের ব্যক্তিত্ব উধাও হতে শুরু করে।

আমি এ দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতাদের চিনি। সম্ভবত এই দেশে যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি প্রক্তন মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, গভর্ণর রয়েছে। একবার তারা ‘প্রাক্তন’ হয়ে গেলেই শেষ। তখন কেউ তাদের দিকে মনোযোগ দেয় না, কেউ তাদের সেতু, রেললাইন, হাসপাতাল, স্কুল উদ্বোধন করতে ডাকে না। কোনো পত্রিকা এমনকি তারা কোথায় আছে, আদৌ তারা আছে কি না—জীবিত অথবা মৃত—তাও চিন্তা করে না। আর একটা সময় ছিল যখন তাদেরকে প্রতিদিনের সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে দেখা যেত, শোনা যেত প্রতিদিনের রেডিওর খবরে।

এটি কেবল আপনার সমস্যা নয়, আপনি মনযোগের কাঙাল; এটাই বাস্তবতা। আর এর পেছনের কারণ হলো আপনি সেই ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করেন—যা মিথ্যা, যা দ্বারা তৈরি হয়েছে সমাজ, এবং সমাজই পারে সেটা আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিতে। এটার উপর নির্ভর করবেন না। এটা কোনোভাবেই আপনার নিজস্ব শক্তি নয়।

একদল ইহুদি মা একসাথে কফি পান করছিলেন এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে গর্ব করছিলেন। একজনের চার বছর বয়সী একটি শিশু ছিল, যে পড়তে পারত। আরেকজনের পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু ছিল, যাকে ইতোমধ্যে টেলিভিশনে দেখা গেছে। তখন বেকি গোল্ডবার্গ নামে একজন কথা বলে উঠলেন, ‘এটাতো কিছুই না। তোমরা তো আমার ছোট্ট হাইমিকে দেখোইনি! তার বয়স মাত্র পাঁচ বছর, সেতো প্রতিনিয়ত নিজেই তার মনোচিকিৎসকের কাছে যায়।’

একজন মধ্যবয়সী মহিলা তার যাজকের কাছে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন যে তিনি দিনদিন গরবিনী হয়ে উঠছেন।

পুরোহিত জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেন এমন ভাবছো?’
মহিলাটি উত্তর দিলেন, ‘কারণ যখনই আমি আয়নায় তাকাই আমি আমার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাই।’

‘চিন্তা কোরো না,’ যাজক বললেন, ‘এটি কোনো পাপ নয়, এটি কেবল তোমার দেখার ভুল।’

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সেবা করে আসার পর একজন অবসর গ্রহণকারী কান বিশেষজ্ঞের সম্মানে মেডিকেল সোসাইটির একটি বড়ো সভা ছিল। উপহার হিসেবে তারা তাকে একটি সোনার কান উপহার দিয়েছিল। তিনি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালেন, এবং সবার হাততালি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি তার উপহারের দিকে তাকালেন এবং বললেন, ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলাম না।’

অন্যেও উপর নির্ভর করবেন না!

নিজের সত্তায় স্বাধীন হোন।

শুধু আপনার ভেতরের কথা শুনুন।

আপনি যে মুহূর্ত হতে স্থির হবেন এবং আপনার মনকে শান্ত হওয়ার সুযোগ দেবেন তখন আপনি আপন সত্তার কথা শুনতে পাবেন—এবং এটা কঠিন নয়।

আর যখন আমি বলি যে এটা কঠিন নয়, আমি এটা খুব জোরের সাথেই বলি: এটা কঠিন নয়! কারণ যদি এটা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে থাকে তবে তা আপনার পক্ষেও সম্ভব। এতে কোনো পার্থক্য নেই। সব মানুষই সম্ভবত নিজেকে চিনতে সক্ষম। এবং যে মুহূর্তে আপনি নিজেকে চিনবেন, তখন কেউ আপনার স্বকীয়তা কেড়ে নিতে পারবে না। এমনকি যদি তারা আপনাকে হত্যাও করে, তারা কেবল আপনার শরীরকে হত্যা করতে পারবে, আপনাকে নয়।

একজন ব্যক্তি একমাত্র নিজে চাইলেই এ ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে পারেন; অন্যথায় আপনি সারাজীবন ভিক্ষুক হয়ে থাকবেন। কিন্তু আপনি যদি এই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে চান আপনাকে আপনার অহম এবং ব্যক্তিত্ব থেকে মুক্তি পেতে হবে। আপনাকে শিখতে হবে সম্মানের মাঝে কিছুই নেই, খ্যাতিতে কিছুই নেই, মান্যগণ্য হওয়ার মাঝে কিছুই নেই। এর সবই ভুয়া শব্দ, অর্থহীন, ফালতু। সকল বাস্তবতা আপনার মাঝে লুকোনো, যদি আপনি এটি আবিষ্কার করতে না পারেন আপনাকে অন্যের উপর নির্ভর করতেই হবে।

আপনি সম্রাট, কিন্তু আপনার নিজেকে তা আবিষ্কার করতে হবে।

এবং এই আবিষ্কারটি কঠিন নয়:

আপনার সম্রাজ্য আপনার মধ্যেই আছে।

আপনাকে কেবল চোখ বন্ধ করতে এবং ভিতরের দিকে তাকাতে শিখতে হবে। একটু সুশৃঙ্খলভাবে বসে খুব বেশি বাইরের দিকে মনোনিবেশ না করে প্রতিদিন কমপক্ষে দু-একবার নিজের ভেতরে ঘুরে আসতে হবে। যখনই আপনি সময় পাবেন…ধীরে ধীরে, ধীরে ধীরে আপনি আপনার অনন্ত সত্তার ব্যপারে সচেতন হতে শুরু করবেন। এরপর আপনাকে আর অন্যের মনোযোগ প্রত্যাশার ব্যপারে ভাবতে হবে না।

বিষ্ময়কর ব্যপারটি হলো: যেদিন আপনার আর কারো মনযোগের প্রয়োজন হবে না, লোকেরা আপনার ক্যারিশমা অনুভব করতে শুরু করবে, কারণ ক্যারিশমা হলো আপনার সত্তার স্বতন্ত্রতার ঔজ্জ্বল্য। তারা অনুভব করতে শুরু করবে আপনি একজন বিশেষ, অনন্য—যদিও তারা আপনার স্বতন্ত্রতা কোথায় তা নির্ধারণ করতে পারবে না, আপনার মধ্যে বিশেষ কি আছে যা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

যারা নিজেকে আবিষ্কার করেছেন তারা লোকজনকে এর প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখেছেন, কিন্তু তারা সেটা নিজে থেকে চাননি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

লেখক, অনুবাদক। প্রকাশিত বই: শহরকে মুছে দেবো স্কুল ডাস্টার দিয়ে (২০১৮)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।