বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ২১

রক্তজবা ও অন্যান্য কবিতা : তাসনুভা মোহনা

0

রক্তজবা


এ বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ লোকের বাস। আমার জায়গা হলো পরিবারের শেষ ঘরটির পশ্চিম দিকের জানালা থেকে পাঁচ ফুট দূরে। অসংখ্য জংলি গাছ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটুর ধার ঘেঁষে। যেখানে স্যাঁতসেঁতে দুপুরের গন্ধই কড়া।

ডুমুর গাছের সাথে লাগোয়া একটা নালা। পাকার আগেই সেগুলো ছেলেপেলেরা ছিঁড়ে নিয়ে যায়। নালা ঘেঁষে কিছু নারকেল গাছও আছে। যে জংলা গাছগুলোর কথা বলছিলাম ওগুলোর বেশিরভাগেরই বৈজ্ঞানিক নাম বেশ খটমটে। লোকমুখে কচুকাটা কথাটা হয়তো শুনে থাকবে, এখানে সত্যিই কচুকাটা করা হয়। এত বেশি কচু গাছ যে কেটে না দিলে মনে হবে এ অঞ্চলে কখনো মানুষের পা পড়েনি।

যাক গে, নিজের কথা বলি। আজ আমার কাঁচা হলুদ গায়ের রঙে পাঁচিল টপকে আসা রোদ পড়বে। ভেজা মাটির সাথে রোদের গন্ধ মিশে খুব একটা তাড়ি তাড়ি ব্যাপার হবে। জানালার ওপাশে যে কিশোরটা গল্পের বই হাতে এদিকে তাকিয়ে থাকে অথচ দ্যাখে না কিছুই তার চোখ আটকে যাবে। আজই প্রথম খুলব নিজেকে। মেলে ধরব বিহঙ্গের মতো। বুকের ভেতর ঢেঁকির দুপদাপ আওয়াজ নিয়ে দেখতে দেবো নিজের টকটকে হৃৎপিণ্ড। সবুজ দিয়ে যাকে ঢেকে রাখি, আড়াল করি দিনরাত।

একদিন না একদিন তো জানাতেই হতো ওর চোখ জুড়ে আমার স্থান চাই। বিস্তৃত সরিষার মাঠের দিকে দেওয়া দিগন্তজুড়ে মুগ্ধতার দৃষ্টি নয়, যে দৃষ্টি একপেশে, একঘেয়ে, একযোগে ধীর-স্থির অথচ চঞ্চল। আজ আমি শুধু তার জন্য ফুটব রাজকীয় আদলে। এই আরাম আরাম আকাশি শরৎ, এই পরজীবী ঢলে পড়া তেলাকুচা রং, এক কাঠঠোকরার সুরের দ্যোতনা, জগডুমুরের হুটোপুটি— সব উপেক্ষা করে সে আজ আমাকেই দেখুক। আমার রোমকূপে রোমাঞ্চ মেখে নিয়ে হয়ে উঠি আরও ঘন, ছোটো পরিসরে বৃহত্তর।


খড়কুটো


আরও নিচে পড়ে যেতে পারতাম,
এর চেয়েও অনেক উঁচু থেকে।
আড়াই তলা অব্দি এসে দেখা গেল
আকাশে ভর দিয়ে ঘাড় কাত করে মাটি দেখছি।
ঝরাপাতা ইশারা করে দেখিয়ে দিলো গন্তব্য,
আমি তারে অস্বীকার করি।
চোখ যায় দোতলার বারান্দায়,
শার্টের সঙ্গে লাগোয়া ভেজা বেগুনি শাড়ি,
হলুদ ঝুমঝুমি আর ছিটানো গম
এক যে কেন দিনের কথা মনে করিয়ে দিলো।
আমি চোখ বুজে ফিরে যাই বালিশে,
আকাশ কিংবা মাটি, কেউ যেখানে নিল না,
না হয় সেই শার্টের গায়ে ভেজা শাড়ির মতো
মুখ ঘষে, বুক ঘষে পাশাপাশি ঝুলে থাকি।


আমার দিকে তাকাও


আমি একটি সাদা বৃষ্টির ফোঁটা,
আমি মূলত বাকবাকুম বাক
উড়ে যাবার আগে জেনে গেলাম
ছিলাম মায়ের দুধ মাখা হাঁক ডাক।

আমার আছে ছোট্ট মৃত সাগর
তারই তীরে লালচে বালির বাঁধ
সেখানে নাকি প্রাথমিক ইশকুলে
কারও কারও মানুষ হবার সাধ।

আমার মতো একটা আমি চা খোর
আরেকজনের হাতে স্লিপিং পিল
একটা আমি নেপচুনেতে বসা,
মিলছে না তার, হিসেবে গড়মিল।


বেকার সময়


একটু পরেই গুঁড়ি বৃষ্টি বৃদ্ধি পাবে,
তারপর কী হতে পারে তা তুমি বলবে।
আমার কাজ তো চায়ের কাপে হাত ঘুরানো,
তোমার চোখে না তাকালেও এই চাহনি দেখতে পাবে।

এই যে রাস্তা এক লহমায় জেব্রা ক্রসিং,
জ্যাম ছাড়িয়ে মিটিং ফেলে ‘ফিলিং মিসিং’,
হাফ রাস্তা হাফ ইমোশান, সেমিকোলন
প্রেমের থেকেও অপ্রেমের এই যন্ত্রণাটা ইন্সপায়ারিং।

নিজের ফোনে নিজেই এবার কল করব
তাড়া আছে ভাব দেখিয়ে ইউটার্ন নেব
ইচ্ছা করেই ভুলে যাব বাম হাতেতে ছাতার কথা,
আমরা দুজন দুই গল্পে আজ ভরপুর প্রেম করব।


এসো একে অন্যকে না বলি


বাম পাশের বন্ধ জানালাটা আসলে হাট করে খোলা।
হাওয়ার পরে যতটুকু চোখ, সেখানে বৃষ্টির শিষ্টাচার।
আমরা হ্যাঁ বলতে না পারার এক মিহি কষ্টে ভুগছি।
ক্ষুদ্র দূরত্বের ভেতর এসে যাচ্ছে ঘটিবাটি,
বহুতল ভবন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, হাইওয়ে।
আসক্ত হতে হলে অ্যালকোহল এক দুর্বল নির্বাচন।
এসো মিস করি দাবার নির্ভেজাল তুখোড় চাল,
অনাহুত বৃষ্টিকে আপ্যায়ন করতে হয় যত্নের সাথে।
ঘোলাটে চোখ বেশি ঘোলা হবার প্রতীক্ষা করতে দাও,
এবার দৃষ্টিসীমার বাইরে বেরিয়ে এসে ছিনাল হও।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মন বলে লিখে রাখতে, তাই লেখেন; নইলে ঘুম হবে না। কথা বলতে ভালোবাসেন বলে পেশায় উপস্থাপক। ভালোবাসেন আবৃতি করতে, রান্না করতে। তিনি একই সঙ্গে ঘরোয়া, ওয়ার্কহলিক এবং অ্যাম্বিশাস।

নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একদিন আমি একটা বাড়ি বানাব। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, কবুতর, কুকুর-বিড়াল আর গাছেদের বাড়ি। ঢেঁকি, খড়কুটো, শাক-সবজি, ফল আর মাছেদের বাড়ি। বুকভর্তি ভালোবাসা নিয়ে উঠে আসা একগুচ্ছ হৃদয়বান মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে সে বাড়ির সদর দরজা।’

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।