এক ঝাপটা ঠান্ডা বাতাস জানালার পুরোনো কপাটকে নির্দ্বিধায় খুলে অনুপ্রবেশ করল পুরোনো দো-চালা ঘরটায়। একখানা হারিকেন এক কোনায় নিভুনিভু হয়ে টিমটিম করছে। বোসদের পুকুরের দৈত্যাকার মাগুরের গায়ের মতো কালো অন্ধকার আর বৃষ্টির ঘ্রাণ মেখে আসা হিম বাতাস পুরো ঘরজুড়ে খবরদারি করছে। তার মধ্যে সেই আদ্দিকালের হারিকেনকে মনে হয় কুঁজো হয়ে থাকা এক ভৃত্য।
শুরুতে সোনামুখি সুঁইয়ের মতো চিকন ধারার মিহিন বৃষ্টির ফোঁটা চালের ওপর আদিম এক মোহনীয় সুর তুলছিল নিবিষ্টমনে। মাটির ওপর বিছানো পাটিতে শোয়া হুরমতির তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি তাকে এই প্রাকৃতিক সুর-তাল-লয়ের স্রোতে জাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে হুরমতি কান পাতে; শুনতে থাকে বাড়ির সামনের বড়ো বড়ো গাছগুলো হুটোপুটির শব্দ। সব ক’টা পাখি এই ভরা রোদের কাঠফাটা ভাদ্র মাসের ষোল তারিখের শেষ রাত্তিরে এমনতরো বৃষ্টিতে বিহ্বলিত। সেই সোনামুখি সুঁইয়ের বরণ বৃষ্টি এবার ভট্টাচায্যি পুকুরের মেলায় পাওয়া কুড়মুড়ে গজা-মজার মতো বড়ো বড়ো শব্দে আছড়ে পড়তে থাকে হুরমতির ছোট্ট ঘরের চালের ওপর।
সব ক’টা পাখি এই ভরা রোদের কাঠফাটা ভাদ্র মাসের ষোল তারিখের শেষ রাত্তিরে এমনতরো বৃষ্টিতে বিহ্বলিত। সেই সোনামুখি সুঁইয়ের বরণ বৃষ্টি এবার ভট্টাচায্যি পুকুরের মেলায় পাওয়া কুড়মুড়ে গজা-মজার মতো বড়ো বড়ো শব্দে আছড়ে পড়তে থাকে হুরমতির ছোট্ট ঘরের চালের ওপর।
বাড়ন্ত চালকুমড়োগুলো সবে রং মেলতে শুরু করেছিল। সেগুলোর গা জড়িয়ে সাদা রঙের লাউয়ের কলিতে গতকালও ছিল চালখানা সয়লাব। উঠোনের মাচাটা ভরে উঠেছে কড়ে আঙুলের সমান কচি সবুজ শসায়। এই হঠাৎ বৃষ্টিতে তাদের কী হবে ভাবতে গিয়ে মধ্য ত্রিশের কোঠায় থাকা হুরমতির ভাঁজহীন কপালে রেশমি সুতোর মতো ভাঁজ পড়ে। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সে বাদ দিল ভাবাভাবি। কতকাল সে শান্তিতে ঘুমায় না! ‘শালার কুত্তা-বিলাইয়ের কান লইয়া হইসে মুসিবত!’ রোজ রাতে নানান শব্দে হুরমতির ঘুম ভাঙলে এভাবেই নিজেকে গাল পেড়ে মাটির মেঝেটায় একদলা থুথু ছুড়ে মারে। এই থুথু কি অদৃষ্টের পরিহাস নাকি হুরমতির নিজের প্রতি সেটা সে জানে না।
কিন্তু আজ শেষ রাতে বৃষ্টির শব্দে তার বড়ো ভালো লাগে। এই তালনিদিঘী গ্রামের যুগ যুগান্তরের তৃষ্ণা যেন আজ এক রাতের বৃষ্টিতেই সব মিটিয়ে দেবে প্রকৃতি। হুরমতির মনে হতে থাকে আজলা ভরা সোঁদা জল তুলে দু-কান ঢেকে দিতে। জগতের বাকি সব শব্দ ধীরে ধীরে নিভে যায় তুমুল বরষায়। দরজা খুলে দিয়ে হুরমতি ফের বিছানায় শুয়ে পড়ে। মুখখানা উঠোনের দিকে।
বৃষ্টির পানি জমতে জমতে তখন তার ছোট্ট নিকোনো উঠোন জল থইথই একখানা উদ্ভিন্নযৌবনা নতুন পুকুর যেন! বৃষ্টির ছাঁট দুদ্দাড় বাতাসের সাথে হুরমতির গায়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যায়। বাধ্য হয়ে পায়ের কাছে রাখা গুটানো কাঁথাটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। এই আচমকা বৃষ্টি, হিম বাতাস, কড়কড় করে নেমে আসা বাজ আর আকাশ চিরে উঁকি মারা তীব্র বাঁকা বিজলি হুট করে হুরমতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় বিশ-বাইশ বছর আগের এমনি একটি দিনের কথা। আতঙ্কে হিম হয়ে আসে হুরমতির রক্ত, বোবায় ধরার মতো গোঙাতে থাকে সে। অদৃশ্য কারো কাছে আকুতি জানায় করুণ মিনতিতে, ‘আসিস না তুই! আসিস না!’ কিন্তু ঘরের উঠোনখানা এক টুকরো পুকুর হয়ে উঠে, চারদিকে তীব্র হতে থাকে কচুরিপানা, কলমিশাকের জলজ ঘ্রাণ। একটি শ্যামল হাত হুরমতির ফর্সা হাত আঁকড়ে ধরে চরম শক্তিতে। হুরমতি গোঙায়, ‘আর কত নিবি! সব নিয়া নিলি! সব!’ আর তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে অতীতের এক ভরা শ্রাবণের দিনে।
ওইদিন অবশ্য সকালের আকাশ ছিল তেঁতুল দিয়ে মাজা নতুন চাঁদির থালার মতো ঝকঝকে। তালনিদিঘীতে সকাল থেকে উৎসবের রং, বোসদের পুকুর, মতি মিয়াদের পুকুর আর লাগোয়া বিলে মাছ ধরা হবে। কদিন আগের ভরা বৃষ্টিতে খাল ছেড়ে কত মাছ এই পুকুর আর বিলে এসে বসত গেড়েছে! পলো, জাল, হাত জাল, বর্শা সব নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা যেভাবে ছুটছিল, মনে হচ্ছিল কোথাও যুদ্ধ লেগেছে। হুরমতিও সেদিন মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে একখানা ভাসা-জাল নিয়ে সেখানে যোগ দিতে গেল। ভাবছিল এক হাতা কুঁচো চিংড়িও যদি পায় বেশ হবে। মাচার ওপর পেলব লাউপাতা, পায়ের কাছে সবুজ মেলে ধরা বিলেতি ধনে পাতার ঘ্রাণ তার জিবে সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। একটুখানি জিরে বাটা, দু-কোয়া রসুনসহ সরষের তেলে লাউপাতা আর কুঁচো চিংড়ির ধোঁয়া ওঠা মাটির হাড়িটার কথা ভাবতেই তার মন আনন্দে ভরে ওঠে।
হুরমতি ছাড়া রয়না বেগমের দুকূলে আর কেউ নেই। বাড়ির চারপাশ গাছগাছালি, লতাপাতা দিয়ে এমনভাবে গড়েছেন যেন সাক্ষাৎ দুর্গ। নিজেই দিনের পর দিন অক্লান্তভাবে একা হাতে পিছনের ডোবার মতো পুকুরটা খুঁড়েছেন যাতে মেয়ের বাকিদের সাথে দীঘিতে না নাইতে যেতে হয়। গাঁয়ের লোকজন ছোঁকছোঁক করলেও তাকে বেশ সমীহ করে। স্বামী মারা যাবার পর কারো কাছে হাত পাতেননি কখনো। নিজের রূপের চার গুণ বেশি নিয়ে জন্মেছে একমাত্র সন্তান হুরমতি। তাই শক্ত করে আগলে আগলে রাখেন। কারণ বেশ জানেন, চারদিকে আঁধার নামতেই হায়েনার দল ঘুরঘুর করে মা-মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। যেখানেই যায় আঁচলের খুঁট ধরে থাকে হুরমতি। মা না বললে মুখ ফুটে কথা বলে না।
পরাণ ভরে মা ডাকও শুনতে পারি না আমি। কী কপাল আমার!’ এ ঘটনা জানে না এরকম কোনো বুড়ো কিংবা বাচ্চা বোধহয় তালনিদিঘীতে নেই। হুরমতির বয়স ৮-৯ হবার আগ পর্যন্ত সে বাকি দশটা বাচ্চার সাথে সাধারণভাবেই খেলাধুলা করত, সারা দিন পাড়াময় হইহই করে মাগরিবের আজান পড়লে ঘরে ঢুকত। ধীরে ধীরে তার গলার স্বর পরিবর্তন হওয়া শুরু করল।
নিজ হাতে ফলানো শাক-সবজি, ফলমূল বাজারে বেচতে বেচতে রয়না বেগম প্রায়ই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। চোখের পানি মুছতে গিয়ে বলেন, ‘একটা মাত্র মাইয়া আমার। সেই মাইয়ার গলা গেল নষ্ট হইয়া। পরাণ ভরে মা ডাকও শুনতে পারি না আমি। কী কপাল আমার!’ এ ঘটনা জানে না এরকম কোনো বুড়ো কিংবা বাচ্চা বোধহয় তালনিদিঘীতে নেই। হুরমতির বয়স ৮-৯ হবার আগ পর্যন্ত সে বাকি দশটা বাচ্চার সাথে সাধারণভাবেই খেলাধুলা করত, সারা দিন পাড়াময় হইহই করে মাগরিবের আজান পড়লে ঘরে ঢুকত। ধীরে ধীরে তার গলার স্বর পরিবর্তন হওয়া শুরু করল। এ কারণে সে আগের মতো ঘর ছেড়ে বেরোত না। একদিন তো কালাম মিয়ার ছোটো ছেলেটা হুরমতির কারণে ভয়ে প্রায় মরতেই বসেছিল। বয়সে সে হুরমতির কাছাকাছিই। হলো কি, মাগরিবের আজান সবে শেষ হয়েছে, চারদিকে ঘরে ফেরা পাখ-পাখালির শব্দে কান পাতা দায়। তখনো ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছায়নি, তাই বাড়িফেরা অন্ধকারে তালনিদিঘীকে মনে হতো চাদরে মুড়ানো এক বৃদ্ধ মানুষ। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো টিন কিংবা ছনে ছাওয়া ঘরগুলো থেকে ভেসে আসছে কেরোসিনের মৃদু ঘ্রাণ। দাওয়ায় কেউ কেউ একটা হারিকেন এনে রাখে। তাতে আঁধার সরে না বরং আরও ঝাঁকিয়ে বসে।
মাগরিবের পর সাধারণত তাই বাচ্চাদের তেমন একটা বের হতে দেখা যায় না। ওইদিন কেন জানি কালাম মিয়ার ছেলে তহিবুলের মাথায় ঝোঁক চাপলো ঘরের সামনে উত্তরের দিঘীতে একটা বড়শি বসিয়ে আসবে। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আগে ওই দিঘীতে হাত-মুখ ধুতে গিয়ে দেখেছে ঠিক জলঘাটের পাশেই ঘাঁই দিচ্ছে বেশ বড়ো ক’টা মাছ। মায়ের বকা আর বাবার মারের ভয়ে ঘরে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও মন পড়ে ছিল ওখানেই। মাছ-ন্যাওটা তহিবুল তাই তক্কেতক্কে ছিল কখন ঘর থেকে বেরুতে পারবে।
তহুরা বেগম যখন হারিকেনের চিমনি মেজে ঘষে চকচকে করে সলতে ঠিক করছেন, তখন তার ছেলে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ওই অন্ধকারে মিশে এগিয়ে গেল উত্তরের দিঘীর দিকে। ঘাটে পৌঁছে বড়শিটা ঠিক করে বসাতে যাবে, তখন হঠাৎ পানি পড়ার শব্দ শুনে তাকাতেই দেখল, আবছা আঁধারের মধ্যে কে জানি দাঁড়িয়ে। তহিবুল বুঝতে পারল দিঘীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ প্রসাব করছে। বেশ রেগে গিয়ে সে চিৎকার করে উঠল, ‘কী রে বেয়াক্কেল দিঘীর পাড়ে দাঁড়াইয়া এই কাজ করো ‘ এমনটা নয় যে তহিবুল আর তার বয়সী ছেলেমেয়েরা গোসলে নেমে পুকুরে মাঝেমধ্যে প্রসাব করে না। করে। তবে মুরুব্বিরা পইপই করে মানা করেন এই কাজ না করতে। ঘরের যাবতীয় থালাবাটি থেকে শুরু করে গোসল, অযুর কাজ সবই এই দিঘীর পানিতেই হয়। তহিবুলও আজ মুরুব্বিয়ানা দেখিয়ে ওই আবছা কায়ার দিকে রেগে তেড়ে গেল। কাছাকাছি আসতেই সে বেশ বুঝতে পারল এটা হুরমতি! হুরমতি তার পরনের জামা গুটিয়ে উপরে তুলে ছেলেদের মতো দাঁড়িয়ে প্রস্রাব কেন করছে সেটা ভাবতে গিয়ে তহিবুলের ছোটো মাথায় গন্ডগোল লেগে গেল। বড়ো একটা ঘাপলা আছে সেটা বুঝতে পারলেও খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে কাঁপাকাঁপা গলায় সে প্রশ্ন করল, ‘হুরমতি নাকি? কী করস তুই?! পাগল হইলি না কি!’
ছায়াটা স্পষ্ট ছেলের গলায় বলে উঠল, ‘হ, হুরমতি। দেখস না প্রস্রাব করি। এখন ধুর হ!’
তহিবুলের মাথায় বাজ পড়লেও বোধহয় সে অতটা ভয় পেত না, যতটা সে হুরমতির কণ্ঠ আর কাজকারবার দেখে পেয়েছে। হুড়মুড় করে সে ‘মা গো! বাবা গো!’ বলে চিৎকার করে ঘরমুখো যে দৌড়টা দিলো তাতে অনায়াসে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিতে পারত। কোনোভাবে হাঁচড়েপাঁচড়ে সে ঘরের দাওয়ায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ে। চোখ আতঙ্ক, মুখভর্তি ফেনা নিয়ে জ্ঞান হারানোর আগে সে শুধু বলতে পারল, ‘হুরমতি! হুরমতি!’
পরদিন দুপুরে জ্ঞান ফিরলে সে যখন সব খুলে বলল, লোকজন তখন দলবেঁধে গেল রয়না বেগমের ঘরে।
এই রহস্যের তলানিতে পৌঁছার জন্য গ্রামের মুরুব্বিরা সবাই যখন রয়না বেগমের নিকানো উঠানে জমায়েত হচ্ছেন, তখন ঘর থেকে কানফাটা আর্তনাদ শোনা গেল। সবাই হতচকিত হয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখল হুরমতির ফর্সামুখ টকটকে লাল, মুখে পাঁচ আঙুলের গভীর ছাপ। চোখ দুটো আধবোজা তার। পাশে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে রয়না। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে পুঁথি পড়ার সুরে ঝাড়া আধা ঘন্টা টেনে টেনে তিনি কাঁদলেন। তাঁর এলোমেলো কথার ভেতর থেকে মোটামুটি এতটুক বোঝা গেল মেয়েকে জিনে ধরেছে। ঘরে ফিরে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে রয়না বেগম দিগবিদিক খুঁজতে খুঁজতে উত্তরের দিঘীর পশ্চিমের কোনায় বেঁহুশ হয়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন। ঘরে আনার পর দেখেন মেয়ের গালে কড়া চড়ের দাগ। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে হুরমতি ভাঙ্গা গলায় ছেলেদের স্বরে কথা বলা শুরু করে। কাহিনির সারমর্ম হলো এই। লোকজন হুজুর কবিরাজ সব ডেকে জড়ো করল। রাত বাড়তে থাকে। ঝিঁঝির শব্দকে ছাড়িয়ে রয়না বেগমের ছোট্ট কুটির থেকে ভেসে আসতে থাকে হুরমতির অদ্ভুত স্বরে কান্নার সাথে মিশে যাওয়া বিচিত্র সব শব্দ। হুজুরের উচ্চস্বরে দোয়াদরুদ পড়া আর হাতের শক্ত বেত সপাংসপাং শব্দে হুরমতির পিঠের ওপর নেমে আসা ততক্ষণ পর্যন্ত থামল না যতক্ষণ ক্ষীণস্বরে হুরমতি জানাল, ‘যাইতাসি! যাইতাসি! আর আসুম না!’
সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে পুঁথি পড়ার সুরে ঝাড়া আধা ঘন্টা টেনে টেনে তিনি কাঁদলেন। তাঁর এলোমেলো কথার ভেতর থেকে মোটামুটি এতটুক বোঝা গেল মেয়েকে জিনে ধরেছে। ঘরে ফিরে মেয়েকে দেখতে না পেয়ে রয়না বেগম দিগবিদিক খুঁজতে খুঁজতে উত্তরের দিঘীর পশ্চিমের কোনায় বেঁহুশ হয়ে তাকে পড়ে থাকতে দেখেন।
ছোট্ট শরীরটা তখন বেতের আঘাতে জর্জরিত। শরীর পুড়ে যাচ্ছে ভয়াবহ জ্বরে। রয়না বেগম যে সন্তানের গায়ে কখনো ফুলের টোকা দেননি তাকেই অন্যের হাতে তুলে দিলেন মার খেতে। সবাই যখন সন্তুষ্ট চিত্তে জিন তাড়ানো গেল ভেবে বাড়ি ফিরছে, রয়না বেগম তাঁর একমাত্র সম্বল হুরমতিকে তখন বুকে তুলে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন আর বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘মাফ করে দিস মা! আমারে মাফ করে দিস। কিন্তু আর তো উপায় ছিল না!’
আজ ভরা বৃষ্টি আর প্রতিমুহূর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠা ঘন অন্ধকারে হুরমতি ফের ডুবে যেতে থাকে পুরনো দুঃস্বপ্নে।
এই দুঃস্বপ্ন প্রায়ই ভরা বর্ষায় ছটফট করতে থাকা জীয়ন্ত কই মাছের মতো তার কাছে ফিরে ফিরে আসে। হুরমতি বটিতে পড়া মাগুর মাছের মতো মোচড়ায়, আতঙ্কে তার চোখদুটো কোটরের বাইরে বের হয়ে যেতে চায়। আঁকড়ে ধরার মতো কেউ নেই বলে এই ভয়টুকুও নিজেরই কাটাতে হয়। কিন্তু আজ রাতে সেই প্রাচীন ভয় বৃষ্টির লাগাম পেয়ে আরও দানবীয় হয়ে ওঠে। মতির মা চাচির সুঁইয়ের ফোঁড় যেমন অনবদ্য, স্পষ্ট হয়ে ওঠে কাঁথার প্রতিটি নকশা— ঠিক তেমনি।
মাকড়সার মতো চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা পেয়ারা, পেঁপে, আম আর কাঠাঁলের গাছ, বাড়ন্ত সবজির মাচা, কচি সবুজ শাকের ডগা সব ভোজবাজির মতো এক এক করে উধাও হয়ে যেতে থাকে উঠোন আর বাড়ির চারপাশ থেকে। আতঙ্ক যেন কাঁঠালের পাতার গায়ে চেরাগের ধোঁয়া লেগে হয়ে ওঠা নিবিড় কাজলের মতো লেপ্টে যায় হুরমতির চোখে। বিস্ফোরিত চোখে সে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। দেখে চোখের সামনে ফের জীবন্ত হয়ে উঠছে বহু বছর আগের শ্রাবণের দিনটি…
শ্রাবণের ১৭ তারিখ। কাজলপড়া চোখে আকাশ চেয়ে আছে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা ভর্তি তরতাজা জলের দিকে। যেন এখনই সে সব নতুন করে ধুয়ে দেবে। চারদিকে মাটি ফুঁড়ে আসা সোঁদা ঘ্রাণ। পুবের বিলে নাকি এই কদিনের ভারী বৃষ্টিতে মাছ উঠে কিলবিল করছে। বোসদের বাড়ি ছাড়াও মতি মিয়াদের বড়ো পুকুরে জাল পড়ছে আজ। সৈয়দ বাড়ির ছেলেরা সব চাঁই, পোলো, ঝাঁকিজাল, ভাসাজাল নিয়ে নিজেদের বিলে নেমে পড়েছে। পুরো গ্রাম জুড়ে শাপলা, জলজ শাক আর মাছের আঁশটে ঘ্রাণ। মাথার ওপর মেঘ শফিয়া ফুফুদের গাভীর দুধের মতো ঘন হচ্ছিল। বাকি সব ছেলেপুলেদের সাথে চৌদ্দ-পনেরো বছরের হুরমতিও বেরিয়ে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু মা কোনোভাবেই দেবে না, অবশ্য কখনো দেয়নি। পাড়া মাতিয়ে রাখা গোল্লাছুট, বউচি, এক্কা-দোক্কা, কানামাছি কোনোটাতেই কখনো সে ছিল না সেই জিনে ধরার পর। এমনকি হুরমতি কথাই বলত না তেমন। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে এর বাড়ি ওর বাড়ি যেত। সমবয়সী মেয়েদের রান্নাবাটি খেলা দেখত। বিশেষ করে জমিরউদ্দীন চাচার মেয়ে রুনুর সাথে তার খানিকটা কথা-বার্তা হতো। ছয়-সাত বছরের রুনু প্রজাপতির মতো, পলকা রোগা শরীর নিয়ে একটু ছুটেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত। আর একবার ঘুমিয়ে পড়লে ঘরে ডাকাত পড়লেও সে ঘুম ভাঙত না তার। হুরমতির মনে হতো রুনুও তার মতো ঘর-বন্দি এক মানুষ। যদিও হুরমতির চেয়ে তার স্বাধীনতা ঢের বেশি।
সেদিন রয়না বেগম গিয়েছেন সৈয়দ বাড়িতে নিত্যদিনের মাজা-ঘষার কাজ করে দিতে। সৈয়দ বাবর মিয়ার স্ত্রী রোশনারা খাতুন বললেন, ‘হুরমতির মা, একটু দেরি কইরা যাও আজ। ছেলেরা সব মাছ আনতিসে, এত মাছ একা কুটবার পারব না। কুইটে দিয়ে যাও।’ রোশনারা খাতুনের গলার স্বর একদম নির্লিপ্ত কিন্তু রয়না জানে তার আদেশ না শুনলে এই মোলায়েম স্বর মুহূর্তেই বাজারের কর্কশ কণ্ঠে তর্ক করতে থাকা মাছ ব্যাপারীর মতো হয়ে যাবে। দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে রয়না গুটিসুটি মেরে পাকের ঘরে বসে থাকে, মাছের অপেক্ষায়।
ওদিকে চারদিকের হৈ-হুল্লোড়ে হুরমতির মনে হলো বোধহয় মেলা লেগেছে। খানিক আগে সৈয়দ বাড়ি থেকে বুচির মা খবর দিয়ে গেছেন, মায়ের আসতে দেরি হবে। সে যেন খেয়ে নেয়। বহু বছর পর এ রকম মোক্ষম সুযোগ পেয়ে হুরমতি আর দেরি করল না, চট করে ঘরের দাওয়ায় রাখা ভাসা জালটা নিয়ে দৌড় দিলো বাইরে।
থেকে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি নামছে। মাথার ওপর কালো আর ধূসর রঙের মেঘ ছুটোছুটি করছে; যেন আকাশে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলছে। ঠান্ডা বাতাস ছুটতে থাকা হুরমতির মুখে গায়ে পরশ বুলিয়ে দেয়। ওর মনে হতে থাকে জগতটা বোধহয় বহু সময় পর আজ সে ভালোমতন দেখছে। মাটির সোঁদা ঘ্রাণ ছাপিয়ে মাছের আঁশটে ঘ্রাণ ক্রমশ তীব্র হতেই সে বুঝতে পারল মতি মিয়াদের পুকুরপাড়ে পৌঁছে গেছে। বুচিকে সেখানে দেখতেই হঠাৎ মায়ের কথা মনে হওয়ায় ভয়ে সে উল্টো দিকে ছুট দিলো। বুচির মা-ও সৈয়দ বাড়িতে কাজ করে। কোনোভাবে তাকে দেখে ফেললেই শেষ। একটা মারও মাটিতে পড়বে না আর। মায়ের যে রাগ!
ওর মনে হতে থাকে জগতটা বোধহয় বহু সময় পর আজ সে ভালোমতন দেখছে। মাটির সোঁদা ঘ্রাণ ছাপিয়ে মাছের আঁশটে ঘ্রাণ ক্রমশ তীব্র হতেই সে বুঝতে পারল মতি মিয়াদের পুকুরপাড়ে পৌঁছে গেছে। বুচিকে সেখানে দেখতেই হঠাৎ মায়ের কথা মনে হওয়ায় ভয়ে সে উল্টো দিকে ছুট দিলো। বুচির মা-ও সৈয়দ বাড়িতে কাজ করে। কোনোভাবে তাকে দেখে ফেললেই শেষ।
ছুটতে ছুটতে কখন সে তালনিদিঘীর পাড়ে আসলো বুঝতেই পারেনি। এই সেই বিখ্যাত তালনিদিঘী যার হাত ধরে এই গ্রামের নাম এলো। কিন্তু প্রতি বছর নিয়ম করে ছোটো ছোটো বাচ্চা গোসলে নেমে লাশ হয়ে ভেসে উঠতে লাগল যখন, মানুষের কাছে তখন থেকে এটা হয়ে উঠল অভিশপ্ত একটা জায়গা। ভয়ে দিনের বেলাতেও এটার ছায়া মাড়ায় না গ্রামের মানুষ, বাচ্চাদের এদিকে আসা কড়া বারণ।
দিঘীর পাড়জুড়ে কানাইলালা ঘাসের ঘন সবুজ আস্তর ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে শত শত ফুল। লাল শাপলা আর শালুকে জড়াজড়ি করে আছে পুকুরের প্রতি ইঞ্চিজুড়ে। এমন শ্রাবণেও এই পুকুরে বড়োজোড় কোমরখানেক পানি। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও এদিকে আর কারো আসার সম্ভাবনা না থাকায় হুরমতি চোখ বুজে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে দিঘীতে।
ডুব দিতেই মাটির সোঁদা ঘ্রাণ; কলমি, হেলেঞ্চার সবুজ ঘ্রাণ সব ছাপিয়ে বর্ষার মাছের আঁশটে ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে ওর। মাথা তুলতেই দেখে তার ঠিক সামনেই শুশুকের মতো ভুস করে মাথা তুলল আরেক জন। তার পাশে আরেকজন!
হুরমতির ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগে। দু-জোড়া চোখ তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।
‘আমি…আমি ভাবসিলাম এইহানে আর কেউ নাই!’ সেই ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে হুরমতি আমতা আমতা করে বলে ওঠে।
রুনু তার ডুলিতে ছটফট করতে থাকা একটা টাকি মাছ রাখতে রাখতে বলল, ‘আরে হুরমতি বু আমি আর ভাই এই জন্যিই এইখানে মাছ ধরবার আসি। কেউ এখানে ডরে নামে না, তাই মাছে সয়লাব পুরা পুকুর।’ বলেই সে মিষ্টি করে হেসে উঠল। রুনুর ভাই রইসুল তার থেকে আট-নয় বছরের বড়ো। দুজনেরই ডাগর চোখ, শ্যামবরণ রং। তবে রুনুর দৃষ্টি যেমন কোমল আর মিষ্টি, রইসুলের তেমনি প্রখর আর দৃঢ়। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই তো ঘর থেকে বাইর হস না। আজ এইহানে কী?’
হুরমতি নিচু স্বরে জবাব দেয়— ‘মা বাড়িত নাই দেইখা বের হইয়া আসছি….মাছ ধরবার মন চায়।’
রইসুল আরও কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই রুনু হুরমতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় পুকুরের মাঝে। যেখানে পানির গভীরতা একটু বেশি তবে সেটা ছোট্ট রুনুর জন্য। সে একহাতে হুরমতিকে আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতে শাপলা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ‘বু আমারে শক্ত করে ধইরো, এইহানে একটু ভয় লাগে।’ হুরমতি অভয় দেয়। কয়েকটা শাপলা তুলতেই পাড়ের কাছাকাছি জায়গায় তারা শুনতে পায় ঘাঁই দিচ্ছে বড়ো মাছ। তিনজন ধীরেধীরে এগিয়ে যায় কিন্তু সেই রুইমাছ ধরার সৌভাগ্য তাদের আর হয় না। তিনজনের তাড়া আর হুড়োহুড়ির মধ্যে লালরঙা লেজের বিশাল রুই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার মতো ছুটতে থাকে চারদিক। শেষতক হাত পিছলে হারিয়ে যায় জলের অতলরাজ্যে। ক্ষান্ত দিয়ে রইসুল আর হুরমতি দাঁড়িয়ে পড়ে হাঁটুখানেক জলে, আর ক্লান্ত রুনু পুকুর পাড়ে উঠে এলিয়ে পড়ে ঘাসের ওপর।
হুরমতিও দাপাদাপিতে হাঁপিয়ে পড়ে, ‘এত্ত বড়ো মাছটা দেখা দিয়া পালাইয়া গেল! কপাল!’ মুখের ওপর লেপ্টে থাকা ভেজা চুল সরাতে গিয়ে তার মনে হলো কেউ একজন তীব্রভাবে তার দিকে চেয়ে আছে। চোখদুটো না তুলেও সে ঠিক বুঝতে পারল এটা রইসুল। তার বুক কেঁপে উঠল। রইসুলের দিকে তাকাতেই ভয়ে, আতঙ্কে তার রক্ত হিম হয়ে আসলো। যে ভয়টা সে সবসময় পায় সেটাই সত্য হলো আজ। তার কৈশোরের লাবণ্যমাখা দুটো পায়ের মাঝে রইসুল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে, তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। পরক্ষণেই সেটা কঠিন বিরক্তিতে রূপ নিলো। শীতল স্বরে সে বলে উঠল, তহিবুল মিছা কয় নাই তাইলে। ওরে বোকা পাইয়া তোরা মা-ঝিয়ে পুরা গ্রামের মানুষরে বান্দর নাচ নাচাইলি। আমি কিন্তুক বেকুব না। এক্ষুণি সবার সামনে নিয়া যাব তোরে। গ্রামের মধ্যে এসব খারাপ জিনিস রাখন যাইব না।
একহাতে হুরমতি তার লজ্জাস্থান ঢাকার চেষ্টা করে। কিন্তু পাতলা ঘিয়ে রঙের কামিজ তার শরীরে আরও বেশি করে লেপটে থাকে। সবে কৈশোরে পৌঁছানো শরীর তালনিদিঘীর জলে ভিজে সমস্ত লাবণ্য উচ্চস্বরে প্রকাশ করে দেয় রইসুলের সামনে। ভয়ে সে কাঁদতেও ভুলে যায়। রইসুল তীব্র ঘৃণা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কী মনে হতেই ঘৃণা মুছে মুখে ফুটে উঠে তাচ্ছিল্য আর কৌতুহল ভরা হাসি। রইসুলের শ্যামল হাত তার দিকে এগিয়ে আসে৷ হুরমতি বেশ বুঝতে পারে রইসুল কী করতে যাচ্ছে। রইসুল অবশ্য হুরমতির ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে ভাবছিল না, তার মাথায় তখন ঘুরছিল হুরমতির মতো মানুষ তাদের চেয়ে ভিন্ন। এই ভিন্নতা সে কখনো নিজ চোখে দেখেনি, আজ সুযোগ যেহেতু এসেছে সে সরাসরি দেখতে চায়, ছুঁয়ে দেখতে চায়। হুরমতি ফ্যাঁসফ্যাঁসে স্বরে মিনতি করে, মাফ চায়, অবশ্য কেন মাফ চাইছিল তাও সে জানে না।
তবে সে বেশ বুঝতে পারে রইসুলকে সে কথায় মানাতে পারবে না, তাই অন্য হাত সন্তপর্ণে চলে যায় খোঁপায় গোঁজা কাঁটায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রইসুলের ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে রক্তের স্রোত। সেই জিনে-ধরা রাতের ঘটনার পর রয়না বেগম এই ছোরার মতো তীক্ষ্ণ খোঁপার কাঁটা তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে। আর শিখিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক কোন জায়গায় একবারের আঘাতেই নিভিয়ে দেওয়া যায় যে কারো জীবন প্রদীপ। ক্লান্ত রুনু বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল দিঘীর পাড়ের ঘাসের বুকে, ওদিকে হুরমতি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রাণপণে রইসুলকে চেপে ধরে পানিতে। রইসুলের ক্লান্ত আঘাতপ্রাপ্ত শরীর পেরে ওঠে না আর। হুরমতির হাতে, বাহুতে শেষবারের মতো আকঁড়ে ধরার ছাপ রয়ে যায় নখের আঁচড়ে।
এর মধ্যে অবশ্য রুনু একবার মাথা না তুলেই জানতে চেয়েছিল, কিসের দাপাদাপি শব্দ শোনা যায়। হুরমতি উত্তরে জানায়, ‘ওই বড়ো রুইডা ফেরত আইছে রে রুনু। রইসুল সেটারে ধরবার চেষ্টা করতেসে। তুই আরাম কর, ধরলে পরে তোরে ডাইকা তুলবোনে।’ আশ্বস্ত হয় রুনু, কিন্তু তারপরও মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করে তার ভাইজান কীভাবে মাছটাকে পাকড়াও করছে দেখতে। ছোটোবেলা থেকে রোগেশোকে ভোগা তার ছোট্ট দেহ তাতে সায় দেয় না, বরং নরোম বাতাস দূর থেকে চাঁপার ঘ্রাণ নিয়ে আসে, কখন তাতে চোখ মুদে এলো তার; রুনু ঠিক ঠাহর করতে পারে না।
কতক্ষণ পর কিংবা কত কাল পর রুনুর ঘুম ভাঙল সে বলতে পারে না। ক্ষিধেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। অনেকগুলো কই, টাকি আর পুঁটি মাছ ধরেছে তারা। মাকে বলবে দুটো পুঁটি চটজলদি ভেজে গরম গরম ভাত দিতে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল সেই বিশাল রুইয়ের কথা। ধড়মড় করে উঠে পড়ে সে হাঁক ছাড়ে, ‘ভাইজান, রুইডা ধরবার পারছ?
কতক্ষণ পর কিংবা কত কাল পর রুনুর ঘুম ভাঙল সে বলতে পারে না। ক্ষিধেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। অনেকগুলো কই, টাকি আর পুঁটি মাছ ধরেছে তারা। মাকে বলবে দুটো পুঁটি চটজলদি ভেজে গরম গরম ভাত দিতে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল সেই বিশাল রুইয়ের কথা। ধড়মড় করে উঠে পড়ে সে হাঁক ছাড়ে, ‘ভাইজান, রুইডা ধরবার পারছ?’ জবাব আসে না তার। রুনু চোখ কচলে সামনের দৃশ্যটা ফের বোঝার চেষ্টা করে। গগনবিদারী চিৎকারে পুরো তালনিদিঘী গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এক অশনিসংকেত। এক কান, দু-কান হয়ে পুরো গ্রাম ভেঙে পড়ে সেই দিঘীর পাড়ে। রুনু তখনো ধাতস্থ হয়নি। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘এইডা স্বপন, খারাপ স্বপন! ও ভাইজান, ও ভাইজান, রুইডা কই গেল?’ কিন্তু দিঘীর অল্পজলের কাদামাটিতে কোমর পর্যন্ত পোঁতা রইসুল তার উত্তর দেয় না। তার পাশে একই কায়দায় হাঁটু পর্যন্ত পোঁতা হুরমতিসহ দুজনকে যখন পাড়ে তোলা হলো ততক্ষণে তাদের মা-বাবারা এসে পৌঁছেছেন। গ্রামের ওঝা, কবিরাজ আর সাথে হাতুড়ে ডাক্তার সবাই হাজির হলেও রইসুলকে আর বাঁচিয়ে তোলা যায়নি সেদিন। প্রচুর রক্তক্ষরণ আর দমবন্ধ হয়ে বহু আগেই সে বিদায় নিয়েছিল। হুরমতির পেটের ডানপাশে রইসুলের ঘাড়ে পাওয়া ক্ষতের মতো একই ক্ষত পাওয়া গেলেও সেটা তেমন গভীর না হওয়ায় তার রক্তপাত ততটা গুরুতর না হলেও তার পুরো শরীর ভয়ংকর রকম ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ঠিক মৃত রইসুলের মতো।
ওই ঘটনার পর থেকে এখনো পর্যন্ত রুনু স্বাভাবিক হয়নি। পাগলের মতো বিড়বিড় করে, কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করে জানতে চায়, ‘ভাইজান, রুইডা কই? ধরবার পারসো? লাল রুইডা?’ গ্রামে ছোটো বাচ্চারা প্রায়ই তাকে রুই-পাগলী বলে খেপায়, ঢিল ছোড়ে।
এত বছরেও সেই অদ্ভুত ঘটনার কেউ কুল-কিনারা করতে না পারলেও, হুরমতির এক আশিক আছে সেইটা বেশ ভালোভাবেই সবাই বিশ্বাস করে। তবে এই আশিক মানুষ নয় বলেই তাদের বিশ্বাস। এই কারণে কেউ তার ছায়াও মাড়াতে চায় না।
পুলিশ চেষ্টা করলেও ময়নাতদন্ত পর্যন্ত রইসুলের দেহকে নিতে পারেনি৷ তার মা-বাবা হাত-পা ধরে, একে ওকে বলে ব্যাপারটা কীভাবে জানি মিটিয়ে ফেলে পুবের গোরস্থানে তাকে দাফন করে। সারা বছর রইসুলের কবর ফুলে ফুলে সুশোভিত থাকে। হেন কোনো ফুল গাছ নেই যা তার মা-বাবা কবরের চারপাশে লাগায়নি। মাঝেমধ্যে হুরমতি সন্তপর্ণে ওদিকে যায়, আড়চোখে দূর থেকে কবরটার দিকে তাকায়। তার মনে হয় রইসুল ওই মাটির ঘরের দেওয়ালের ভেতর নেই, বরং হুরমতির চারপাশে সে এখনো ঘুরঘুর করে৷ প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্ন হয়ে রইসুল ফিরে আসে। ক্রমাগত প্রশ্ন করে যায়, ‘হুরমতি তুই আসলে কিডা?’ মাঝেমাঝে রুনুও আসে তার সাথে, ছটফটিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রুইডা কনে গেল হুরমতি বু?’
হুরমতির তখন মাথা দপদপ করে, অজান্তেই হাত চলে যায় খোঁপার কাঁটার। অদৃশ্য স্বত্তাগুলোকেও যদি একইভাবে মেরে ফেলা যেত! কিন্তু সেই খোঁপার কাঁটা বহু আগেই সে উঠোনের উত্তর পাশে, ভুঁইচাপা ঝাড়ের তলে পুঁতে রেখেছে।
কিন্তু আজকের দুঃস্বপ্ন ভয়াবহ তীব্র হয়ে ওঠে। বরং একটা সময় পর হুরমতি আর স্বপ্ন ও বাস্তবের তফাৎ করতে পারে না। চারদিক থেকে শত শত রইসুল উজানি কই মাছের মতো হুড়হুড় করে তার চারপাশে উপচে পড়তে থাকে। এক রইসুল তার হাত আঁকড়ে ধরে, অন্য রইসুল পা। এভাবে পুরো শরীর তার শক্তভাবে মাটিতে চেপে রাখে তারা। প্রতিবারের মতো হুরমতি নিজেকে বারবার বলতে থাকে, এইসব মিথ্যা বুজরুকি, বানোয়াট স্বপ্ন! রইসুল মইরা গেছে!
কিন্তু এবার সব রইসুল একসাথে বাজখাঁই গলায় গুঙিয়ে উঠে, ‘মরি নাই! মরি নাই’ আতঙ্কে হুরমতির নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, নিজের হৃৎপিণ্ডের শব্দ নিজেরই কানে তালা লাগানোর জোগাড় হয় তার। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ছোটানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে রইসুলরা নেই, তার বদলে বিশাল এক রুই মাছ তার শরীরের ওপর চেপে বসেছে, শরীর তলিয়ে যাচ্ছে জলে। একটু শ্বাস নেবার আশায় ছটফট করতে করতে সে প্রাণপণে মাথা তুলে ধরে জলের ওপর। ততক্ষণে তার সমস্ত শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে শাপলা-শালুকের শেকড়। সাপের মতো পুরো শরীর জুড়ে তারা কিলবিল করতে থাকে। হুরমতি বাঁচার চেষ্টায় আশপাশে হাতড়াতে থাকে কিছু পাবার আশায়, যা তাকে সাহায্য করতে পারে৷ হঠাৎ হাতের নাগালে পায় তার পুরনো খোঁপার কাঁটা। প্রতিটা সেকেন্ডে তখন শেকড়গুলোর আকার বাড়তে থাকে সাথে বাড়তে থাকে তাদের চাপ। হুরমতি ত্রস্তভাবে এক হাত ছাড়িয়ে ধারাল খোঁপার কাঁটা দিয়ে কাটতে থাকে একের পর এক শেকড়।
ঠিক কতক্ষণ বা কতযুগ লাগে তার শেকড় ছাড়াতে সে জানে না। শ্রান্ত শরীর এলিয়ে দেয় সে মাটির ওপর। দূর থেকে নাম না জানা কোনো এক পাখির সুর ভেসে আসে। কী বিষণ্ণ সেই সুর! হুরমতির চোখ বেয়ে শ্রাবণ ধারার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বৃষ্টি থেমে গেছে কিংবা আদৌ কি বৃষ্টি হচ্ছিল? হুরমতির পুরো শরীর ভিজে জবজবে। শরীরজুড়ে অসম্ভব ব্যথা। হুরমতির চোখের পানিতে মুখ ছাপিয়ে বুক ভিজে ওঠে। সে হাত দিয়ে মোছার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারে, হাত নাড়ানোর শক্তিটুকুও আর নেই। তার ঠোঁটে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে ওঠে, অস্পষ্ট স্বরে সে বলে উঠে, ‘একটা জীবন দিলা, কিন্তু তারে জীবন কইতে পারলাম না। তাইলে কী এতদিন আসলে মইরা ছিলাম, আইজ বাঁচলাম?’
ভাদ্র মাসের উনিশ তারিখ। রয়না বেগমের ঘর থেকে ভেসে আসা কটু গন্ধে রাস্তায় হাঁটা পর্যন্ত যায় না। সৈয়দ বাড়ির বড়ো ছেলে বর্তমানে মেম্বার। লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে মুখে গামছা বেঁধে রওনা দেয় রয়না বেগমের ঘরের দিকে, মুখে তাদের গালির তু্বড়ি ছুটছে, ‘শালী কী ঘরের মধ্যে কুত্তা মারসে? এত গন্ধ ক্যা?’
কিন্তু রাস্তা লাগোয়া গেইটখানা খুলতেই দেখে ঘরের দরজা হাট করে খোলা। আর উঠোনের উত্তরে ভুঁইচাঁপার ঝাড়ের পাশে পড়ে আছে আধখাওয়া, পচে-গলে যাওয়া হুরমতির লাশ। শরীরের যতটুকু বেঁচেবর্তে আছে তাতে স্পষ্ট দেখা যায় ধারালো-সুক্ষ্ণ কোনো কিছুর এলোপাতাড়ি আঘাত। তার ডান হাতে মুষ্টিবদ্ধ একটা রুপোর খোঁপার কাঁটা। বাম হাতের পাশে খটখটে শুকনো উঠোনে লাফাচ্ছে প্রায় সাত কেজি ওজনের একটা রুই মাছ। তার শরীরে চমৎকার লালচে রঙের আভা।
পড়ালেখা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। বর্তমানে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। লিখতে ভালোবাসেন, তবে তারচেয়েও বেশি ভালোবাসেন পড়তে।