শনিবার, নভেম্বর ২৩

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ১২

0

এমন কিছু মুহূর্ত আসে, অপাপবিদ্ধ জ্যোৎস্নার মতো, যা প্রায় লিপিবদ্ধ হয়ে ওঠে না। এমন কিছু মুহূর্তের পাণ্ডুলিপি অবর্ণনীয় বর্ণমালায় তৈরি হয়, যে পাণ্ডুলিপি অপ্রকাশিতই থেকে যায়। পাঠকের সামনে যায় না এমন কিছু কবিতা, সেই কবিতা কত অসহায়! এমন কিছু থাকে, যা ছবিতে তোলা যায় না—এ রকমই তো আমাদের একেকটি জীবনের গতিপ্রকৃতি, না? কখনো স্তব্ধতার আধিপত্যে পার হয় একেকটি দুপুর, একেকটি বিকাল-সন্ধ্যা! ও রকম অগুনতি দুপুর আমার গেছে, অগণন সন্ধ্যা কেটেছে। একেকটি রাতই তখন এক-একপ্রস্থ মহাকাল। ফরাসগঞ্জে ছিলাম যখন, বিকেলের পরে আরও কিছু মুহূর্ত পাড়ি দিয়ে আসত সন্ধ্যা, দেখতাম বুড়িগঙ্গায় বড়ো বড়ো যাত্রীবাহী জাহাজ ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু মগবাজারে এসে সেই স্তব্ধতা আমার ভেঙে গেছে। মগবাজারে এসে কি আমার নির্জনতার আস্বাদন পর্ব শেষ হয়ে গেল? অনেকানেক লোকজনে গিজগিজ করা আমার সময় তখন। মগবাজারে বাজার গেইট রেললাইনের পাশে কাঁটা ক্যাম্পে সকাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু হয়, সারা দিন যায়। আসে রাত; রাত ১১ টার দিকে কাঁটা ক্যাম্প থেকে যাই বাসায়। বাসাও তখন কাঁটার এক্সটেনশন ক্যাম্প। সুতরাং আমার ব্যক্তিজীবন উধাও। ইতিহাসের আলাদা আলাদা তিনটি সময়ের দলিল কাঁটা। আমার চেষ্টা ঠিকঠাক ইতিহাসের ভিজুয়ালাইজেশন করতে পারা।


প ১২.৩

প্রয়াত অভিনেতা এস এম মহসীন, কাঁটাই হয়তো তাঁর শেষ ছবি,কাঁটাতে তাঁর চরিত্র গুল্টু মিয়া


মগবাজার ক্যাম্পে চলছে পূর্ণমাত্রায় প্রি-প্রোডাকশন প্রস্তুতি। অর্থাৎ এরপরেই আমরা প্রোডাকশনে যাব। প্রোডাকশন স্টেশন নারিন্দায় হতে যাচ্ছে। প্রোডাকশন ক্যাম্প-স্টেশনই কিন্তু কাঁটার সেন্ট্রাল লোকেশন, যেটি ভূতের গলির আব্দুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি। সেই বাড়িতে কাঁটার ষাট-পঁয়ষট্টি ভাগ শুটিং সম্পন্ন করতে হবে। বাকি ৩০-৩৫ ভাগ লোকেশন হচ্ছে পুরান ঢাকারই অন্যান্য এলাকা, বিভিন্ন গলি-উপগলি। চৌরাস্তার মোড়ের ‘ইয়োর চয়েস সেলুন’, ডালপুরির দোকান—এসব আছে কাঁটায়। আর বাকি পাঁচ ভাগ শুটিং হবে নদী ও গ্রামে, ঢাকা শহর থেকে অনেক দূরে, পুরো বাংলাদেশ যেমন। তবে মগবাজারে থাকার সময়টুকু আমার ভাগ হয়ে গেল। সহকারীদের সঙ্গে সবসময় তখন শেয়ার করি কাজকর্ম। কোনো কোনো দিন সারা দিন চিত্রনাট্য পাঠ চলে। প্রপস-কস্টিউম চূড়ান্তকরণ চলছে। আজিজ ব্যাপারীর চরিত্র ফাইনাল হচ্ছে না, এই টেনশন সারাক্ষণ আমার মাথায়। কাঁটার অন্যান্য পাত্রপাত্রীর রিহার্সেল চলছে। আমি কাউকে কাউকে ভরসাযোগ্য মনে করে তখন দায়িত্ব চাপিয়ে যাচ্ছি। সেই চাপানো যে সবসময় ঠিক হয় বা আমার বেলায় হয়েছে, এমন নয় মোটেও। এতে আমার ক্ষতি মেনে নিতে হয়। গহন ক্ষত মেনে নিতে হয়। আমিও নিয়েছি। বেঁচে থাকবার অভিজ্ঞান এরকমই কি?


প। ১২। ৭

গতবছর ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে পরাজিত, স্মিত হাসিমুখের সাইফুল ইসলাম পান্না, কাঁটাতে ট্যাংরার বাপ চরিত্রের অভিনেতা


কাজেই সেই অলিপিবদ্ধ বাস্তবতার মুখোমুখি আমিও থেকেছি, থাকি, তবে মগবাজারে অন্তত আমাকে আর স্তব্ধতা আধিপত্য দেখাতে পারেনি, নিঃসঙ্গতা জাপটে ধরতে পারেনি। কিন্তু মগবাজারকে আমি পুরোটা অনুবাদ করতে পারছি তো জার্নি অব কাঁটায়? না, সব দুপুরকে অনুবাদ করা যায় না। সব রাতই পপুলার টেক্সট নয়। সব চাঁদ প্রাপ্য অডিয়েন্স পায় না। হয়তো মগবাজারও সম্পূর্ণরুপে লিপিবিদ্ধ হয় না। কখনো হবে না? তা তো বলা যায় না। কবে, কখন বৃষ্টি হবে অবিরাম—তা কি আমরা কেউ জানি? সেই বৃষ্টিতে উথলে ওঠে যদি ভেজা কোনো পুরনো পৃষ্ঠা, আমার কিছুই করার থাকবে না। আমিও বৃষ্টি হবো, সেইক্ষণে আমিও ঝরতে থাকব অক্ষরের পর অক্ষর হয়ে, শব্দ হয়ে, ধ্বনি হয়ে, বাক্যের পর বাক্য হয়ে। শ্লোকত জানি, আদিতে ওঁ-কার ধ্বনি ছিলেন, ধ্বনি শব্দ ছিলেন, শব্দ বাক্য ছিলেন, বাক্য ঈশ্বর ছিলেন। ঈশ্বর কি ছিলেন, সে তো লেখা হবে সেই বৃষ্টিতে কিংবা শীতকালে যে কুয়াশা বসে থাকবে পারস্পরিক দুজনের মায়া-ভালোবাসা ভরা রেললাইনের ওপর। সবই হয়তো লিখব, যেহেতু একটি জীবন বিরতিহীন লিখে গেলেও অভিজ্ঞান-মঞ্জরি সব উঠে আসবে না। এমন কিছু মগবাজার পর্বে আমার লেখার আছে। অবশ্য তা লেখার বাস্তবতা আর অবশিষ্ট কিছু আছে কি না, আমি এই মুহূর্তে জানি না। এখন, এত দিনে আমি বুঝি, কাঁটার জন্য তো আমাকে রক্তাক্ত হতেই হবে বা রক্তাক্ত হতেই হলো। কিন্তু সেটি কীভাবে, কোন কোন ঘাটে, কি কি ভাবে ঘটবে বা পরবর্তীতে ঘটল—তা আর আমি আগেভাগে বুঝি কীভাবে? আমি তো ভবিষ্যৎ দেখিনি।


প ১২। ঘ

কাঁটা লোকেশনে দুপুরের ভাত-খাবার ছবির অভিনেতা ডাক্তার আরিফ ও গুণী থিয়েটার কর্মী জেরিন


চলতি দিনের কোন মধু ভবিষ্যতের বিষ, তার কোনো ফোরকাস্ট পায় না মানুষ, আমিও পাইনি। মধুরেণ সমাপয়েৎ একটা অভিপ্রায় বটে, কিন্তু তা নাও মিলতে পারে! অনুভব মিশিয়ে একটি ছবি বানাতে গিয়ে কত কী শেখা হয়। কতজনের সঙ্গে চেনাপরিচয় হয়। কেউ হয়তো কাছে আসে, কেউ দূরে চলে যায়। নির্মাণ ও ভাঙন পরস্পর মুখোমুখি টেবিলে জুয়া খেলতে থাকে। আমি কাঁটা নির্মাণ করছি। আমার অর্জনে অনেক ভাঙন আছে। কিচ্ছু করার নেই। নিজের আপন অনুভূতির অংশ যখন ছিন্নতা ক্রিয়েট করে, ‘তমালে কনকলতা’র মতো বিচ্ছিন্ন হয়, তখন কিছু করার থাকে না বটে; হয়তো মাঝরাতে একা একা গান না শুনে নিজের পাঁজর ভাঙার শব্দ শুনতে হয়! পাঁজর ভাঙার শব্দ কি কোনো গান নয়? তাহলে কী? এই অন্তর্গত মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি কেমন লাগে আমার কিংবা আপন পাঁজর ভাঙার শব্দে অস্তিত্বের ভেতর হাহাকার করে যার—তার জন্য একটি কবিতা লিখতে চাই। কবিতা আসে না। কবিতা কি বৈবাহিক কিছু, যে দিন শেষে ঘরে আসবেই?

নিজের পাঁজর ভাঙার শব্দ শুনতে হয়! পাঁজর ভাঙার শব্দ কি কোনো গান নয়? তাহলে কী? এই অন্তর্গত মর্মান্তিক বাস্তবতার মুখোমুখি কেমন লাগে আমার কিংবা আপন পাঁজর ভাঙার শব্দে অস্তিত্বের ভেতর হাহাকার করে যার—তার জন্য একটি কবিতা লিখতে চাই। কবিতা আসে না। কবিতা কি বৈবাহিক কিছু, যে দিন শেষে ঘরে আসবেই?

কাঁটা করতে গিয়ে, প্রি-প্রোডাকশন ও প্রোডাকশন পর্বে আমার অন্তত এ রকম কিছু জানা ছিল না, যে, এর পোস্ট প্রডাকশন পর্ব কোথায় হবে, কেমন হবে? তখন কে কে কাঁটার সঙ্গে থাকবে বা থাকবে না, জড়াবে আরও, পোস্টের কাজ নিয়ে, তা তখনো ভবিষ্যৎ ছিল। বাহ। তা তখনো ভবিষ্যৎ ছিল তো একটা ভালো সাউন্ড! ভবিষ্যৎ তো দেখা যায় না। প্রি-প্রোডাকশন বা প্রোডাকশনের ভিড় সমাগম পোস্টে গিয়ে আমাকে আবার ক’বছর নিঃসঙ্গতায় অন্তরীণ করে দেবে, তা কিন্তু জানা ছিল না। সময় কত কিছু বদল করে দেয়। মানুষ বদলায়। মানুষের মনোভাব বদলায়। ‘পাল্টায় মন পাল্টায় চারপাশ, রাস্তায় আসে নতুন রুটের বাস। পাল্টায় চেনা মুখের দেখন হাসি, পাল্টাও তুমি তোমায় দেখতে আসি।’ বদলে যাওয়া মানুষ কেমন করে কথা বলে, কেমন করে তাকায়, সব ধরা যায়। অবাক লাগে। হতবাক লাগে। নির্বাক লাগে। সে-সব এপিক-মেটাফর-লাভ অ্যান্ড পেইন থেকে কিছু নির্বাচিত অংশ আমি জার্নি অব কাঁটায় বলতে চাই। আমি আমার অভিজ্ঞতাই তো পৃথিবীকে দান করে যাব, না? দম আটকে রাখার মতো ভালোবাসা, ভালোবাসা প্রকাশের যে ভারমুক্তির চাপহীনতা আসে, সেই মুক্তির স্বাদ আমি নেব না? কাঁটা মুক্তির স্বাদ যেমন পেতে চাই, সুবোধ-স্বপ্না ও মহল্লাবাসীরা যেমন মুক্ত হতে চায়। অনেকক্ষণ ধরে এই লেখাতে শুধু চাই চাই চাই চলছে, এত চাওয়া পূরণ করবে কীভাবে পৃথিবী? মগবাজার ক্যাম্পের অনুষঙ্গগুলো নিয়ে বলা উচিত, কী কী বলা যায়—এসব একটু ভাবতে হবে। ভবা তো কত আগেই দিয়ে গেছেন সেই ধ্রুপদ ডায়লগ—ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো। ওকে, ভাবব, ভাবনা প্রাকটিস করব। এখন, কাঁটা ছবির সিনিয়র সিটিজেন বা ভূতের গলির মহল্লবাসীদের কথা বলি। মহল্লা তো মহল্লাবাসীদের দখলে থাকবে, আছেও তাই। থাকুক তারা। তবে মহল্লাবাসীদের সঙ্গে একটু আলাপ করলে কেমন হয়? তাদের তো চিনে উঠতে হবে আমাদের, নাকি?


প ১২। ক

কাঁটা ক্যাম্পে ছবির পাত্রপাত্রীদের একাংশ


প্রবীণ অভিনেতা এস এম মহসীনের কথা মনে পড়ছে। প্রায় ষাট বছর তাঁর অভিনয়ের জীবন। এই তো সেদিন, করোনাকালের একদম শেষ ভাগে এসে তিনি প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই বয়সে চলে গেলেন। কাঁটার অন্যতম প্রধান একজন অভিনেতা মহসীন ভাইয়ের কথা আমরা কখনো ভুলব না। হয়তো কাঁটাই তাঁর অভিনীত শেষ ছবি। ডাবিংটা হতে পারত মহসীন ভাইকে দিয়েই, হলো না। তিনি নেই হয়ে গেলেন। কাঁটা নিয়ে খুব আগ্রহ ও মনোযোগ ছিল তাঁর। শুটিংয়ের পরে আমার বাসা পাল্টেছে ৩-৪ বার। প্রতিটি বাসায় তিনি আসতেন, কাঁটার পোস্ট প্রোডাকশন নিয়ে তাঁর কথা জানাতেন। কাঁটাতে তাঁর যত কস্টিউম, সব একটি ব্যাগে রাখা আছে এখনো আমার বাসায়। মহসীন ভাই বলতেন, ‘থাকুক, তোমার কাছেই থাকুক।’ এডিটিংয়ের সময় যদি কোনো প্যাচওয়ার্ক লাগে, মহসীন ভাই তখন আমার বাসা থেকেই কস্টিউম মিলিয়ে নিয়ে শুটিংয়ে যাবেন। এমন ভাবনাই ছিল তাঁর। যদিও মহসীন ভাইয়ের কোনো প্যাচওয়ার্ক লাগবে না, কিন্তু মহসীন ভাই বলতেন, ‘তবু, থাকুক না পোশাকের ব্যাগটা।’ সত্যি, অভিনয়ের প্রতি তাঁর ক্ষুধা ছিল মারাত্মক। একদিন বললাম, ‘অনিমেষের “গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প”তে আপনি দুর্দান্ত কিছু এক্সপ্রেশন দিয়েছেন। মনে থেকে যাবে আমার।’ মহসীন ভাই খুশি হন। একদিন মহসীন ভাই বললেন, ‘শোনো, অভিনয়ের সুবাদে কোনো দিন দেশের বাইরে যেতে পারিনি। ভালো ছবিই তো হাতে পাইনি। সারা জীবন খালি টেলিভিশন নাটকই করেছি। কাঁটা যখন বাইরে-টাইরে যাবে, টিমে আমাকে রাখবা না?’ আমি বলি, ‘মহসীন ভাই, এখন শুটিং শুরু হবে। আপনি আপনার কাজটা নিয়ে ভাবতে থাকেন। দেশবিদেশ পরে, আগে নারিন্দা, আগে ভূতের গলি, আগে আজিজ ব্যাপারীর সঙ্গে আপনার কঠিন টক্কর, বুঝেছেন?’


প ১২.৪

কাঁটাতে ৭১ এর সুবোধ-স্বপ্নার ঘরের দেয়ালে টাঙানো ভুল বানানের শিল্পকর্মের শিল্পী আমার মা


‘তা বুঝছি কিন্তু কায়েসকে দিলে আমারে দিলে না? আমি কি পারতাম না?’

আমি মহসীন ভাইকে বলি, ‘পারতেন। কিন্তু আপনি যে পজিশনে আছেন, ঠিক আছেন। কাঁটাতে সবচেয়ে বেশি সংলাপ হয়তো আপনারই। স্ক্রিনেও বেশি সময় আপনি থাকবেন।’

মহসীন ভাই চাইতেন, আজিজ ব্যাপারীর চরিত্রে আমি যেন তাঁকে নিই। বললাম, ‘ব্যাপারীর মধ্যে কী পাইছেন আপনি মহসীন ভাই?’

‘না, কিছু না। ব্যাপারীর বাড়িতে তো তিন সময়ে তিনটা বউ আসে, ধরো বউদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হতো। বিভিন্নরকম তাকানো থাকত, শোনো, তোমার স্ক্রিপ্ট পুরোটাই পড়ছি আমি।’ বলেই, আকস্মিক আমার হাতের কব্জি ধরে ফেলেন তিনি, বলেন, ‘বাইরে গেলে আমারে কাঁটা টিমের সঙ্গে নিবা তো?’


প ১২.১

১৯৭১ সালের স্বপ্নারানী দাস চরিত্রে চিন্ময়ী গুপ্ত | ছবি : টোকন ঠাকুর


আরও হাজার স্মৃতির ঝাঁপি উল্টে দিতে পারি অভিনেতা এস এম মহসীন ভাইকে নিয়ে। কিন্তু জার্নি অব কাঁটার অন্যদেরও তো পরিচয় করাতে হবে! হবে না? সবার পরিশ্রমেই তো গড়ে উঠছে বা উঠল ছবিটা। সিনিয়র অভিনেতা পরেশ আচার্য্যকে তাঁর জায়গা দিতে হবে। তিনি থাকেন পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে। শতভাগ পুরান ঢাকার একসেন্ট জানা লোক। মহল্লার সেলুন ঘর ও ডালপুরির দোকানে তাঁকে আমরা বারবার দেখি। তাঁকে দেখি আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতেও। টেলিভিশনে সারা জীবন দেখে এলাম পরেশ’দা কে, অত্যন্ত দক্ষ অভিনেতা তিনি। ভাবভঙ্গিতেই তিনি বুঝিয়ে দেন যে, ‘ছপ্নার হাতে বান্নাইন্না’ চা তাঁর ঠোঁটে বা জিব্বায় লেগে আছে। নিমকপারা তাঁর দাঁতে লেগে আছে। মহসীন ভাইয়ের পাশাপাশি কাঁটাতে সিনিয়র অভিনেতা যেমন পরেশ’দা আছেন, আছেন বসু বাজার পঞ্চায়েত প্রধান ন্যাপ নেতা শাহাবুদ্দিন ভাইও।


প ১২। ১৯

মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পের অনতিদূরেই হাতিরঝিল, অডিশন থেকে আসা কাঁটার পাত্রপাত্রীদের একাংশ


আছেন সূত্রাপুরের পলাশ ভাই, আছেন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার টঙ্গীর মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। যাত্রাশিল্প ফেডারেশনের সভাপতি প্রবীণ অভিনেতা মিলন কান্তি দে, অভিনেতা ইকবাল বাবু, রতন দেব, মামুর মাজার থেকে প্রাপ্ত কয়েকজন প্রবীণ চরিত্র, অভিনেতা সৈয়দ গোলাম সারোয়ার, শৈলেন পাল, শিখা কর্মকার, রেখারানী গুণ, অরণ্য রেজা—অশোক শীল, গজেন্দ্রগমন, তালিম কুমার, আতিকুর রহমান, ছ্যাদা ফারুক, সানজিদা, মৌমিতা, শ্রীমন্ত বসু, সোহেল তৌফিক, তুরা, তৃপ্তি, চিন্ময়ী, তিস্তা, শিবু কুমার শীল, পাপড়ি, নিজামের মা, ক্যাপ্টেন মুন্না, মাস্টার মিশু, রেজানুর ও তাঁর পরিবার, শাহরু, কাজী ফয়সল, রিফাত, সাদ্দাম, সোলেমান, মিনহাজুর রহমান, কামরুজ্জামান তাপু, ফাহিম মালেক ইভান, গাজী ফারুক, মাওলানা মোসলেম উদ্দিন, অনিমেষ আইচ, কায়েস চৌধুরী, আসিফ, কাজী রাসেল, আনন্দ খালেদ, অন্তু আজাদ, সন্দিপ বিশ্বাস, দেবাশীষ গুপ্ত, ফখরুল ইসলাম হারুণ, অ্যামেলিয়া, বর্ষা, তাথৈ, শক্তি, তন্ময়, রুনা, গুপু ত্রিবেদী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মিলটন মোল্লা, ফরাসগঞ্জের বাবু ভাই, তৈমুর খান, জুনায়েদ হালিম, জেরিন, শ্যামলী, বাঁশিওয়ালা লাবু ভাই, জাহাঙ্গীর হোসেন, প্রয়াত সাইফুল ইসলাম পান্না, শুভ, হৃদয় রায়, সৌরভ, দোলা, ঝিনুক, পলক রহমান, নাজমুল ইসলাম বাবু, বিপ্লব সরকার, বিস্ময় মুগ্ধ, ছোটো সুমন, রোমান্টিক ডাক্তার আরিফ, আনোয়ারা সৈয়দ হক—কাঁটা একটা মহল্লার সবাইকে চরিত্র মনে করে। এছাড়া পাকিস্তানি সেনা দল, মন্দিরের কীর্তন গায়কেরা, বিবাহ বাড়ির লোকেরা, সিনেমা হলসহ নানান জমায়েত আছে কাঁটায়। পাবলিক মব আছে। তাই পাঁচশো পাঁচশো যে বলি, আদতে কাঁটাতে পাঁচশোর অধিক চরিত্র স্ক্রিনে আছে।


প ১২। ১৩

অন্যতম সিনিয়র অভিনেতা পরেশ আচার্য্য কাঁটাতে হয়েছেন আবদুস সাত্তার চরিত্রের মহল্লাবাসী


শিখা কর্মকার যেমন খুব গুণী একজন অভিনেত্রী, কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক লেখেন এবং তাঁর সবচেয়ে দায়িত্বশীল পরিচয় তিনি উদীচীর একজন দক্ষ সংগঠক। বরিশাল থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে সারা দেশ বা কোলকাতা-ত্রিপুরাতেও তাঁর বিস্তৃতি রয়েছে। শিখা কর্মকার কাঁটাকে সমৃদ্ধ করেছেন যেমন দুর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে, আবার তাঁর কাছ থেকে অনেক প্রপস ও কস্টিউম সাপোর্ট পেয়েছে কাঁটা। এখনো ফেরত যায়নি সেগুলো, চাপ অনুভব করি সবসময়। খুব শিগগিরই ফেরত যেতে হবে। কাঁটার অভিনেত্রী নাহার আহমেদের শাড়ির সাপোর্ট আছে কিছু। দেশাল তো ছিলই। স্থপতি শামিম ভাই সাপোর্ট দিয়েছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রপস। ঝিনেদা আমাদের বাড়ি থেকেও কিছু প্রপস এসেছে। বিশেষ করে আমার মায়ের হাতে সেলাই করা কিছু নকশা কাপড়। নারিন্দার শুটিংয়ের ফাঁকে কোনো কোনো দিন আমরা গেছি পোস্তাগোলার কাছে আর্সিন গেইটে, শিখা কর্মকারের বাসায়। শিখা কর্মকারের ছেলে সৌরভ কাঁটার একজন এডি হিসেবে কাজ করেছে। সেই সব স্মৃতি এখনো অমলিন আমার চোখে। শিখা’দির কাছে কাঁটা কৃতজ্ঞ থাকবে সবসময়। মনে আছে, মুন্সিগঞ্জে শুটিংয়ের সময় তাঁর পায়ে একটি পেরেক ঢুকে গেলেও তিনি শটে ছিলেন, আমাকে বা কাঁটা টিমকে বুঝতেই দেননি যে পায়ে তাঁর তখনো পেরেক ফুটে আছে। রক্ত বেরুচ্ছে। তবে শুটিংয়ে একটি মোরগ দরকার ছিল। সকাল ৬ টায় যখন সেই মোরগ আমাকে শট নেওয়ার আগে দেখাল, আমি বললাম, ‘এ তো মুরগি, মোরগ কই? মোরগের লাল ফুল কই?’ সকাল ছয়টায় দুষ্টুরা আমাকে বোঝাল যে, ‘না, এটা মোরগই। ফুলওয়ালা মোরগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ এটা কোনো কথা হলো! রাগ হলো আমার। রাগে গালি সিস্টেমই ব্রেইন সচল রাখার তাৎক্ষণিক টোটকা। গালি মুখ দিয়ে বেরুল মানেই মাথাটা হালকা হয়ে গেল। পরবর্তী শট বা কাজের জন্য মাথা হালকা করা অত্যন্ত জরুরি। মোরগ-শুটিং শেষ হলো। দুই দিন পর সেই মোরগ ডিম পাড়ল। বললাম, ‘মোরগ ডিম পাড়ে?’

সকাল ছয়টায় দুষ্টুরা আমাকে বোঝাল যে, ‘না, এটা মোরগই। ফুলওয়ালা মোরগ খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ এটা কোনো কথা হলো! রাগ হলো আমার। রাগে গালি সিস্টেমই ব্রেইন সচল রাখার তাৎক্ষণিক টোটকা। গালি মুখ দিয়ে বেরুল মানেই মাথাটা হালকা হয়ে গেল। পরবর্তী শট বা কাজের জন্য মাথা হালকা করা অত্যন্ত জরুরি। মোরগ-শুটিং শেষ হলো। দুই দিন পর সেই মোরগ ডিম পাড়ল। বললাম, ‘মোরগ ডিম পাড়ে?’

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তখন সে বা তারা, যারা মুরগিকে মোরগ বলে চালানো নিয়ে শুটিংয়ের ইমার্জেন্সি মুহূর্তে আমাকে বোঝাতে চেয়েছিল। সহকারিদের কেউ খুব সার্প যেমন পেয়েছি আমার পাশে, তাকে আরও শান দিয়ে নিয়ে কাজে আরও ভালো করে যেতে চেষ্টা করেছি। আবার যেকোনো পরিবেশে দু-একজন বিশিষ্ট ছন্দ বুঝতে না পারা মাল থাকে, থাকবে, ছিল বা থাকে সর্বত্রই। ছিল নারিন্দাতেও। একটু একটু করে নির্মাতার অনুভূতি যেমন ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়, আবার কোথাও একটু একটু প্লাসও হয়। যেমন, স্ক্রিপ্টে নেই কিন্তু দেড়শো বছর আগের একটা দেওয়াল ঘড়ি আমরা শুটিংয়ের সময় পেয়ে যাই নাসিরিউদ্দিনের বাড়ির একটি ঘরে। সেই ঘড়িকে প্রপস বানিয়ে একটা প্রয়োজনীয় ইম্প্রোভাইস শট নেওয়া আছে কাঁটায়, সেটি প্লাস। কোথাও নেমে গেছে চিত্রনাট্য অনুযায়ী। ব্যথা পেয়েছি, এখনো পাই। প্লাস-মাইনাসই চলে, চলতে থাকে। কেউ এলে প্লাস হয়, কেউ গেলে মাইনাস হয়। দুনিয়া আমাদের প্লাস-মাইনাসই শিখিয়ে গেল! আহারে দুনিয়া রে! দন্যে রে! দন রে! দ রে! আরে, এত রে রে করছি কেন এতক্ষণ ধরে! মহল্লাবাসীদের একটা অংশ মানুষের মতো আমারও কি ‘কাজ কাম নেইক্কা?

মগবাজার ক্যাম্প থেকে আমরা হাতিরঝিলে যাই একদিন ফটোশুট করতে। হোসাইন আতাহার আমাদের স্টিল ফটোগ্রাফার, রোমান সিনেমাটোগ্রাফার। দীপন’দা আর্ট ডিরেক্টর। শুভ লাইন প্রোডিসার। মগবাজার ক্যাম্পে একটি অনভিপ্রেত ঘটনার কথা বলি। কুলসুম চরিত্রের রিহার্সেল চলছিল। বেসরকারি মেডিকেল থেকে সদ্য পাস করা এক সুন্দরি যুবতী ডাক্তার, তিনি কুলসুম হতে অডিশনে এলেন, হতে চাইলেন। অভিনয়ে তাঁর খুবই মনোযোগ। একদিন তাকে বলি, ‘আপনার পূর্ব পুরুষরা কি কাশ্মীর থেকে আগত?’ তিনি বললেন, ‘না তো।’ তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অফিসারের স্ত্রী। আমি দেখছিলাম, তাঁর মুখে কোথাও একটা পার্সিয়ান লুক আছে। অবশ্য একদিন তিনি স্বীকার করলেন, ‘আমার বাবা বাংলাদেশরই কিন্তু আমার মা বেলুচি, বেলুচিস্তানের মানুষ।’ কিন্তু আমাদের কুলসুমকে দরকার পুরান ঢাকার ভাষা জানা একজন সাদামাটা যুবতী মেয়ে। কিন্তু সেই ডাক্তার একেবারে কাজের বুয়ার মেকাপ-গেটাপ করে কাঁটা ক্যাম্পে আসেন নিয়মিত। একদিন তাকে বলি, ‘আপনার লুক বেশি সুন্দর লুক। চেহারায় পার্সিয়ান লুক। পুরান ঢাকার ভাষাও আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ তিনি যেই বুঝলেন, কুলসুম চরিত্রটি তাঁকে দিতে পারছি না, অমনি রেগে মেগে একদম অস্বাভাবিক হয়ে পড়লেন! সিন-ক্রিয়েট করে ফেললেন। রাগের মধ্যেই খুব করে কাঁদলেনও। জানি, অভিনয়ের পিপাসা থেকেই তাঁর এই রাগ, ক্রুদ্ধ হওয়া। কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না তখন। শেষ পর্যন্ত দেশি লুকের মৌমিতা হয়ে গেল কুলসুম। আর ডাক্তার আরিফ তো অভিনয়ের পাগল। বারডেমের এই তরুণ ডাক্তার বর্তমানে আমেরিকায় আছেন। কিন্তু কাঁটাতে তাঁর উপস্থিতিটুকু খুবই সপ্রতিভ, ১৯৭১ সালের একজন মহল্লাবসী আরিফ। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনার গুলিতে মরে পড়ে থাকে আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে। যেমন মরেছে কাজী রাসেল। রাসেল একজন ইঞ্জিনিয়ার। সে কাঁটার ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ করেছে। অভিনয়ও করেছে আলামিন নামের একটা চরিত্রে। পাকিস্তানি সেনারা ধরে ফেললে রাসেল ভয়ে প্রস্রাব করে দেয়। সেই নির্দিষ্ট শুটিংয়ের দিনের আগের রাত বারোটা থেকেই রাসেল প্রস্রাব করা বন্ধ করে দিল। পরদিন সকালেই শুটিং শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু ওইদিন ৩৭ জন অভিনেতাকে একসঙ্গে পেতে পেতেই বেলা ১টা বেজে গেল। রাসেল আগের রাত থেকে প্রস্রাব আটকে ক্যারেক্টারে ছিল। বেলা একটায় শুটিং শুরু হওয়ার পরে সেই দৃশ্য, পাক সেনার ভয়ে সকলের সামনেই আলামিন প্রস্রাব করে দেবে। শুরু হলো সেই শট। রাসেলকে যখন সেনারা জিজ্ঞাসা করে, ‘নাম বোলো, কলমা বোলো/’ রাসেল প্রস্রাব করে দেয়। তলপেটে এতই জমে যাওয়া প্রস্রাব যে, প্রস্রাব আর শেষই হচ্ছে না। শটলেন্থ বেড়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মিশু; মিশুও অভিনয় করেছে ১৯৯০ সালের একটি চরিত্রে। মিশু লেখালেখির মানুষ। সমাজের নানারকম পেশার লোকেরাই কাঁটার অভিনেতা-অভিনেত্রী। যেমন, ফাহিম মালেক ইভান পড়ান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, নাটক ও নাট্যতত্ব বিভাগে। বারডেমের আরেকজন ডাক্তার কাঁটাতে অভিনয় করেছেন, তিনি লেখক আনোয়ারা সৈয়দ হক। ভাবি শুধু বললেন, ‘এসবে তো আগ্রহ ছিল হক সাহেবের, তুমি যখন বলছ করব, কিন্তু আমার চুল পাকানো যাবে না।’ বললাম, ‘আপনি যে রকম আছেন সে রকমই। শুধু একজন বাড়িওয়ালা মহিলা হবেন।’ ভাবি তাই হয়েছেন। যেমন, কাঁটাতে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশ সরকারের একজন সদ্য অবসর নেওয়া অতিরিক্ত সচিব জাহাঙ্গীর হোসেন। ফিল্ম আর্কাইভ, ডি এফ পি, বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এবং সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে তিনি কাজ করেছেন। জাহাঙ্গীর ভাই ছবি নির্মাণ ভালোবাসেন এবং অবসরের পর এখন পুরোদস্তুর সিনেমার লোক হয়ে গেছেন। এইভাবে বললে বলতে হবে যে, বিভিন্ন থিয়েটার দল, নানান পেশার মানুষ বা আমাদের বৃহত্তর সাধারণ মানুষের ভেতর থেকেই আমি কাঁটার চরিত্রগুলো তুলে আনতে চেয়েছি। প্রায় পাঁচশো জন সবাই ভূতের গলির মহল্লবাসী হয়েছেন এই ছবিতে।


প ১২। ৬

শিখা কর্মকার, কাঁটার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেত্রী। শিখা লেখক ও উদীচীর একজন হার্ডকোর সংগঠক


‘চরাচর’ যে মেথড বা ভাবনার ভেতর দিয়ে বানানো, একই নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘আনোয়ার কা আজিব কিচ্ছা’ বা ‘স্বপ্নের দিন’ বা ‘গৃহযুদ্ধ’ কি একই ভাবনা-প্রক্রিয়ায় নির্মিত? ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ বা ‘বোম্বে ভেলবেট’ এর নির্মাতা অনুরাগ কাশ্যপ। কিন্তু ছবি আলাদা, ছবির নির্মাণ ভঙ্গিও আলাদা। তাই হয়। ‘কান্দাহার’ ও ‘সাইক্লিস্ট’ মাখমালবাফের দুই রকমের কাজ। কুরোসাওয়ার ‘রাশোমন’ বা ‘ড্রিমস’ও আলাদা। কোথাও একটা সিগনেচারের মিল থাকতে পারে বড়ো জোর। এর বেশি নয়। কারণ, প্রতিটি স্টোরি আলাদা, জার্নিও আলদা। পাত্রপাত্রী আলাদা। টেকনিশিয়ানও আলাদা হয়ে যেতে পারে, স্বাভাবিক। যেমন, ‘ঝরাপালক’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’ আলাদা, কী নির্মাণ-গাঁথুনিতে, কী বক্তব্যে! আমার প্রথম কাজ ‘ব্ল্যাকআউট’ বা ‘কাঁটা’ তাই আলাদা হবে, স্বাভাবিক। ‘ব্ল্যাকআউট’-এর ব্যাকগ্রাউন্ডে সামির আহমেদ ছিল ক্যামেরায়, পরে সম্পাদনা, শব্দ ও কালার কারেকশনেও ছিল সামিরই। কবি-গীতিকার রাজীব আশারাফ ছিল আমার চিফ এডি। আব্দুল হালিম চঞ্চল ছিল আর্ট ডিরেকশনে। চঞ্চল ও চিন্ময় দেবর্ষি ছিল অ্যানিমেশনের কাজে। স্টিল করেছে রিচার্ড রোজারিও। ২০০৬ এ নির্মিত ‘ব্ল্যাকআউট’ যেমন আমার প্রথম কাজ, ছবি হিসেবে ‘ব্ল্যাকআউট’ই অর্ণবের প্রথম মিউজিক ডিরেকশন। অর্ণব কিছু শব্দও সংযোজন করেছে ‘ব্ল্যাকআউট’-এ। দুটো গানও ছিল অর্ণবের, ‘ব্ল্যাকআউট’ বা ‘মনে নেই’ ছবিতে। আর অভিনয়ে কারা ছিল? তানভীর হাসান সুমন, জাহাঙ্গীরনগর নাটক ও নাট্যতত্বের ছাত্র ছিল তানভীর। পরে একদিন আত্মহত্যা করল। ছিল রাহুল আনন্দ। তখনো ‘জলের গান’ তৈরি হয়নি। আর কারা? গায়ক কফিল আহমেদ, শিল্পী ধ্রুব এষ, বর্ষা বিভাবরী, বেলায়েত হোসেন, চারুকলার দাদু, মিতুল, বিমল বাউল… এই তো! তিন মাস প্রি-প্রোডাকশন ছিল, শুটিং ছিল ১৫ দিনের, পোস্ট প্রডাকশন ছিল চার মাসের, আট মাসেই কাজ শেষ। রাশান কালচারাল সেন্টারে প্রিমিয়ার শো হয় ‘ব্ল্যাকআউট’ এর। ব্ল্যাকআউট, এ টেল অফ টু পালস, অফ এ মিস্টিফাইং নাইট। একরাত বা অনেক রাতের গল্প। আমার লেখা চিত্রনাট্য ‘মনে নেই’। কাঁটা অন্য ধরনের গল্প, জনাব শহীদুল জহির লিখেছেন আমাদের জন্য। সমাজ-রাস্ট্র-সময় ও একটি মহল্লার প্রায় পাঁচশো মানুষ এতে অভিনয় করেছে, যাদের ৯৫ ভাগই অডিশন করে আনা নতুন দিনের পাখপাখলি পায়রা। পায়রাগুলো আকশে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি। কাঁটার শুটিংয়েও ঘরভর্তি একঝাঁক পায়রা ছিল সেটে। কাঁটাতে সময়, অর্থ, লোকজন সবকিছুই অনেক বেশি। ব্যাকগ্রাউন্ড টিম, পাত্রপাত্রী প্রায় সব্বাই নতুন। ওই যে বললাম, একঝাঁক নতুন কইতর। কাঁটার প্রি-প্রডাকশনে সময় নিয়েছি দেড়বছর। অডিশন ও পাঁচশো পাত্রপাত্রীর রিহার্সেল বা চরিত্র বিন্যাস করতে সময় লেগেছে ৪ মাস। অবশ্য পাঁচশো জনের জন্য পিরিয়ড অনুযায়ী কস্টিউম, ব্যাবহারিক প্রপস, সামগ্রিক সেটের প্রপস, দুইশো বছরের প্রায় ৭০টা পুরানো ঢাকার পুরোনো বাড়ি—একটা এলাহি কারবার। যা কাঁটাতে দর্শক দেখতে পাবে। শুটিংয়ে আমরা তিনটা ঋতু ধরেছি একই লোকেশনে, বর্ষা-শীত ও গ্রীষ্ম—অর্থাৎ ২০১৮ সালে নয় মাস ছিলাম আমরা লোকেশনে, নারিন্দায়। এরপর পোস্ট প্রোডাকশনে যাব যাব করছি এমন বাস্তবতায় এলো মহামতি করোনা। করোনায় খেয়ে গেছে দুইবছর। করোনার শেষে আমি মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী। সরকারবাদী মামলা। সেই মামলা নিষ্পত্তি হতেই লাগল ২ বছর ৪ মাস। ২০২৩ এর রোজার ঈদের আগে মামলা নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তির পর সরকারের কাছ থেকে কাঁটার দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পাই আমি। প্রথম পর্বের যে সাড়ে দশ লাখ টাকা পেয়েছিলাম, তার সঙ্গে আরও নব্বই লাখ টাকা যুক্ত করে পুরো ছবির শুটিং ফুটেজ একসঙ্গে জমা দিই মিনিস্ট্রিতে। কিন্তু তার আগেই মামলা হয়ে ছিল। সেই ফুটেজ জমা দেওয়ার পর একদিন ইনফো মিনিস্ট্রির সভাকক্ষে নির্ধারিত কমিটি কর্তৃক কাঁটা সম্পাদিত খসড়া ভার্সন দেখানোও হয়। এরপর আমাকে চিঠি দেয় মন্ত্রণালয়। জানায়, রাশ ফুটেজ সন্তোষজনক। কিন্তু সরকারি মামলা সহজে প্রত্যাহার হয় না। আরও প্রায় ১১ মাস পর একদিন সন্ধ্যার পর আমার বাসায় পুলিশ আসে, বলে, ওয়ারেন্ট আছে। থানায় চলেন। একদম সিনেমার মতো। আমার যদিও কিছুই বিশ্বাস হচ্ছিল না। হাজত লকাপে ঢোকার পরেই মনে হচ্ছিল, না, এগুলো যা হচ্ছে, তা সত্যি না। ড্রিমি ড্রিমি। জিমিজিমি। কিমি কিমি। আমাকে গ্রেফতারের পর নিউমার্কেট থানা হাজতে থাকি প্রথম রাত। পরদিন কোর্টে চালান করা হয় আমাকে। ঢাকার টিভি, সংবাদপত্র, অনলাইন মিডিয়া বা ফেসবুক-টুইটারে আমার গ্রেফতারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আমি সরকারের টাকা আত্মসাৎ করেছি, সিনেমা বানাইনি, মুহুর্মুহু প্রচার করা হয়। হাজার হাজার মানুষ আমার পক্ষে ফেসবুক তথা সোশ্যাল মিডিয়া গরম করে তোলে। তাদের প্রতি আমার মাথা নত করে রাখা শ্রদ্ধা জানাই। জানাচ্ছি, জানাব চিরকাল। তাঁরাই কাঁটার দর্শক, তাঁরাই কাঁটার পরিবেশক হবেন, কাঁটার মালিকানাও তাঁদের, যাঁরা আমার প্রতি আস্থা রেখে ফেসবুক-টুইটার গরম করে ফেলেন। এবং যা আমার আদালত থেকে মুক্তির ব্যাপাতে দারুণ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। অথচ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া মাত্র সাড়ে দশ লাখ টাকার বিপরীতে আমি ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচ সাপেক্ষে সমস্ত ফুটেজ মিনিস্ট্রিতে জমা দেওয়ার এক বছর পর, সরকারের ঘরে মাত্র ৪০ মিনিটের ফুটেজ দেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও, আমি জমা দিয়েছিলাম ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিটের রাশপ্রিন্ট। সেই জমা দেওয়ার এক বছর পর আমার হাতে হাত কড়া দিয়ে কোর্টে চালান করা হলো। সমস্ত গণমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজ হলো, ‘সরকারি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে টোকন ঠাকুরকে গ্রেফতার।’ পরদিন বিচারকের একটি প্রশ্নের উত্তরে, যখন একবছর আগেই সব জমা দেওয়ার কথা বলি, বলি যে, ‘আপনার টেবিলে আমার যে ফাইল, ওর মধ্যে একদম উপরের কাগজটাই হচ্ছে মিনিস্ট্রিতে কাঁটা সম্পূর্ণ রাশপ্রিন্ট জমা দেওয়ার। আপনিও ওটা পড়ে দেখতে পারেন।’


প ১২। ১৪

পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন সরফরাজ এর চরিত্রে ইমরুল কায়েস মুন্না। পাশে ভূতের গলির শান্তি কমিটির নেতা মওলানা আবুবকর
প্রোডাকশন | আলোকচিত্র : হোসেইন আতাহার


না, না না না। এ পর্বে নয়। আমার বিরুদ্ধে মামলা, এবং গ্রেফতার সংক্রান্ত ডিটেইল আরেক পর্বে বলব। চলতি পর্ব শেষ করতে চাই এই বলে যে, কাঁটা নির্মিত হচ্ছে পৃথিবীর অন্য কোনো সিনেমার তরিকায় না। দর্শক কী খাবে সেই অনুযায়ী খাদ্য পরিবেশন করার দায় আমি নেইনি, খসরু ভাইয়ের ভাষায় ‘পুনেটিক’ ফর্মুলায়ও নয়, বানাচ্ছি অনেকটা ধুনেটিক ফর্মুলায়। সেটা আবার কী? কী তা বলতে হবে কেন? কাঁটা দেখার পর বুঝে যাবেন, আমাকে ডেকে কথা শোনাবেন। অপমান করবেন। কিচ্ছু বলব না। মাথা নত করে রাখব। কিন্তু কাঁটা আপনাকে দেখতেই হবে। সেই ক্ষমতা নিয়েই কাঁটা আপনার মুখোমুখি হবে, এ বছরেই। বাজারের নটনটী এ ছবিতে অনুপস্থিত। আমি অডিশন করে সমাজের ফ্রেশারদের নিয়েছি। ব্যাকগ্রাউণ্ডেও তাই করেছি। অর্গানিক টোন অটুট রাখতে চেয়েছি। তাই বাজারের কোনো নির্মাতা এই ছবির নির্মাণভঙ্গি প্রথমত নাও পছন্দ করতে পারেন। তাছাড়া বাজারি মালের আড়ৎদারি করি না আমি। আশা করি, আমার ছবিতে আমার ভাবনাই প্রণীত হবে। হ্যাঁ, চ্যালেঞ্জ নিয়েছি, চ্যালেঞ্জকে পছন্দ করেছি আমি। বাজারের প্রডিওসারের সঙ্গে আমার মেলেনি, আমি নিজেই প্রযোজনা করছি কাঁটার। আমার কি অত পয়সাকড়ি আছে? আমার প্রতি কিছু মানুষের কোটি টাকার মতো আস্থা অবিচল আছে। সেই অর্জন আমাকে আত্মবিশ্বাসী থাকতে সাপোর্ট দেয়। সহযোগিতা করেছেন কিছু মানুষ, সেই জন্যই তো ১ কোটি ত্রিশ লাখ টাকা খরচ করতে পেরেছি এখন পর্যন্ত। আরও বিশ যাবে চূড়ান্তটুকু নামিয়ে আনতে। এর মধ্যে আমার কয়েক জায়গায় বড়ো তিনটা লোন নেওয়া আছে। সেই লোন পরিশোধ করতে হবে। লোন রেখে ভালো করে ঘুম আসে না। আমারও হয় না। ছবির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। সেই উপলক্ষ্যেই ‘শ্রী’তে এই ধারাবাহিক ‘জার্নি অব কাঁটা’ প্রকাশ হচ্ছে। ডাবিং শেষ। প্রায় ১১০ জনের সিঙ্গেল সংলাপ। বাংলাদেশের যেকোনো ছবির স্ক্রিপ্টে ২০-৩০ জনের বেশি সংলাপ-আর্টিস্ট থাকেই না সাধারণত। কাঁটা তো মহল্লাবাসীদের গল্প। তাই বেশি। এতই বেশি যে, আমি নিজেও এত আর্টিস্টের সংলাপ থাকা ছবি দেখিনি বাংলাদেশে। নানাভাবেই কাঁটা প্রচলিত সিনে-নন্দন ঘরানা এড়িয়ে গিয়ে আমার ভাবনা থেকে যা কিছু বুদবুদ, সেটুকুই একটি নবীন টিম নিয়ে আমি সব কিছু সম্পন্ন করেছি। এবার একটু রেস্টে যাই? কথা পরের পর্বে বলি?

ঝিনেদা থেকে কুরিয়ারে আম পাঠিয়েছে মা, এখন আম খেতে শুরু করব। ইউ নো, আমি যথেষ্ট আমকোহলিক!


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১


শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।