১.
‘বাবা চয়ন, চা তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে রে। খেতে আয়!’
মা ডাকছেন। টেবিলে খাবার দেবার পর থেকেই মা একটানা একইভাবে কিছুক্ষণ পর পর ডেকে যান। শতবার ডাকতে হলেও মায়ের কন্ঠস্বরের কোনো ওঠানামা হয় না, বরং একইভাবে একরাশ মায়া ঢেলে মা ডেকেই যান।
‘খেতে বস চয়ন, দেরি করিস না।’
‘আয় না রে বাবা, খাবার জুড়িয়ে গেল।’
‘কতক্ষণ বসিয়ে রাখবি? খেতে চল বাবা।’
আমি না গেলে, মাও খেতে বসতে চায় না একদম। অথচ পাশের বাড়ির সুমনের মা দ্বিতীয়বার ডাক পাড়তে হলেই, এই সুমইন্না শয়তানের পুত, ভাত খাবি না জুতা খাবি—জানতে চায় গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়ে!
একদিন বারান্দায় বসে এই অদ্ভুত কথা শোনার পর থেকে মা ডাকলেও না শোনার ভান করে সাগ্রহে বসে থাকি, কোন দিন মায়ের মেজাজ যাবে চড়ে আর ডাইনিং থেকে মা হুংকার দিয়ে বলবে, ‘অ্যাই চয়ইন্না শয়তানের পুত, ভাত খাবি না জুতা খাবি?’
দস্তভয়স্কি, মার্কেজে ডুবে থাকা আমার মায়ের মুখে এই কথার আশা করা আর কাঁঠাল গাছে কলার আশা করা একই ব্যাপার। কারণ মা কখনো এভাবে বকেন না।
আমার মা সাক্ষাৎ সরস্বতী। অতি সাধারণ কায়ার এই রমণী হেন কোনো কাজ নেই যা জানেন না। চুলায় টগবগিয়ে ফুটতে থাকা গরম জলের মধ্যে এক হাতে চা-পাতা ছাড়তে গিয়ে, অন্য হাতে পরম মমতায় আঁকড়ে ধরে রাখেন ক্রেইগ এন্তনি রেইনের কবিতার বই। ঘর ঝাঁট দিতে দিতে সুললিত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন—
‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব তবু আমারে দেবো না ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ বেণী যাবে যবে খুলিতে…’
তাঁর নরম কণ্ঠস্বর ঘরের প্রতিটা চাদরে হাত বুলিয়ে যায় পরম আদরে, আনমনে ঢুকে পড়া বাতাসের সাথে এক পাক নেচে ওঠে, বারান্দার জবাফুলের পাঁপড়িতে গা এলিয়ে দেয় যেন।
বাবা পেপার গুটিয়ে বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করে, চোখ বন্ধ করে শুনতে থাকে। মা ততক্ষণে
চলে গেছে রবিবাবুর দুয়ারে—
‘নীরবে আছ কেন বাহিরদুয়ারে—
আঁধার লাগে চোখে, দেখি না তুহারে…’
আমার কেন জানি অবশ অবশ লাগে, যেন সমস্ত জগৎ-সংসার থেমে গেছে এক লহমায় শুধু ধীর লয়ে বয়ে যাচ্ছে বাড়ির পাশের পিয়ালী নদী আর মায়ের গান। বাবার মতো আমারও চোখ বুঁজে আসে। আমি বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে থাকি, ‘হে ঈশ্বর! মরে গেলে ওপারে এই আমার স্বর্গ হোক!’
২.
‘তোমার ছেলের নতুন খেলা কী জানো?’
চিত্রার প্রশ্নের জবাবে অনিকেত হেসে ওঠে।
‘হাসবে না একদম! প্রতিবেলা খাবার নিয়ে পুঁথি পড়ার মতো আমার তাকে ডেকে যেতেই হয়৷ সে শুনেও না শোনার ভান করে বসে থাকবে৷ তারপর জনাবের মর্জি যখন হবে তখন গুটি গুটি পায়ে এসে আঁচলের খুঁট ধরে আহ্লাদী গলায় বলবে, মা খাইয়ে দাও না! কিংবা রুমের দরজা সটান বন্ধ করে দিয়ে ভেতর থেকে বলে উঠবে, এখন খেতে পারব না মা!’
হাসি থামিয়ে অনিকেত বলে ওঠে, ‘তারপর?’
‘তারপর মানে? এই অনিকেত আমি কি গল্প শোনাচ্ছি তোমায়? আমার হাতে খেতে চায় তা বোঝা গেল কিন্তু এখন খেতে পারব নার মানে কি বলো তো? আজকাল তো কিছুই খেতে চায় না ও, যেন কড়া ডায়েটে আছে। অবনী দিদির মুরগীরাও তো তোমার ছেলের চেয়ে বেশি ভাত খায়! বয়স সতেরো হতে চলল, শরীরটায় হাড়-চামড়া ছাড়া মাংস নামের কোনো বস্তু আছে ওর?’
অনিকেতের মুখের হাসি মুছে যায়, সে বোঝে চিত্রা নামের যে মানুষটাকে সে বিয়ে করেছে, তার জগৎ জুড়ে থাকত দর্শন আর সাহিত্য। সেই চিত্রার জগৎ জুড়ে এখন চয়ন ছাড়া বোধহয় আর কেউ নেই। মাঝেমাঝে অনিকেতের মনে হয় বোধহয় সেও নেই। চিত্রা আপাদমস্তক একজন মা।
বলতে গিয়ে চিত্রার গভীর চোখ দুটো জলে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। অনিকেতের মুখের হাসি মুছে যায়, সে বোঝে চিত্রা নামের যে মানুষটাকে সে বিয়ে করেছে, তার জগৎ জুড়ে থাকত দর্শন আর সাহিত্য। সেই চিত্রার জগৎ জুড়ে এখন চয়ন ছাড়া বোধহয় আর কেউ নেই। মাঝেমাঝে অনিকেতের মনে হয় বোধহয় সেও নেই। চিত্রা আপাদমস্তক একজন মা। চয়নের একটা কাঁটা ফুটলে মনে হয় চিত্রার বুক ফুটো হয়ে গেল। গেলবার স্কুলে বস্তাদৌড়ে মুখ থুবড়ে পড়ল চয়ন, ঠোঁট ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড। ছেলেকে সামলাতে গিয়ে অনিকেত দেখে চিত্রা তার আগেই ঢলে পড়ে গেছে। এমন মা অবনী’দির মুরগীর ভাত খাওয়া দেখে ছলছল চোখে আহাজারি করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
চিত্রার হাত নিজের হাতের মুঠোয় আলতো করে পুরে অনিকেত ধীরে ধীরে বলে ওঠে, ‘বয়ঃসন্ধির সময় বোঝো তো, কত কিছু হবে এ বেলা। চিন্তা কোরো না, আমি কথা বলব। কিন্তু….’ অনিকেত ঠোঁট কামড়ে ধরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। চিত্রা ধড়ফড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু কী অনিকেত?’
সব ঠিক আছে কিন্তু অবনী’দির নিষ্পাপ মুরগী গুলোর পাতের খাবারে নজর দেওয়া ঠিক হলো চিত্রা? মানুষ হয়ে এটা কি তোমাকে শোভা দেয় বলো?
চিত্রার ভেতরের দলা পাকিয়ে ওঠা রাগ নিমিষেই শরতের আকাশ হয়ে যায়, ঝরঝরে, সাদা-তুলো মেঘের মতোন। চোখভর্তি জল নিয়ে সে আঠারো বছরের তরুণীর মতো কলকলিয়ে হেসে ওঠে। দু’তলা ঘরটার প্রতিটা আনাচ-কানাচ ভরে ওঠে সেই হাসিতে।
৩.
মায়ের হাসি সুন্দর। যখন মা হাসে আমার মনে হয় জগৎ আলোকিত হয়ে উঠছে। সব আবছা অন্ধকার সরে যাচ্ছে মৃদু আলোতে, দূরে কোনো পাহাড়ের উপর মেঘ কেটে যাচ্ছে সে হাসিতে। তবে আমার বাবার হাসি তারচেয়েও বেশি সুন্দর। একজন পুরুষ মানুষের হাসিতে হৃদয় উষ্ণ হয়ে ওঠা রীতিমতো দুলর্ভ, কিন্তু যারাই আমার বাবাকে হাসতে দেখেছেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন আমি মিথ্যা বলছি না এক রত্তি। বরং সবাই বলেন, অনিকেত’দার হাসি দেখলে মন ভালো হয়ে ওঠে।
আমার বাবা বড্ড সহজ মানুষ। আমার সকাল-বিকেলগুলো এই বারান্দাবন্দি হবার আগে প্রায়ই বাবার সাথে হাঁটতে বেরুতাম এই সময়গুলোতে। সূর্য যখন উঠি উঠি করে, কিংবা এই ডুবলাম—ওই ডুবলাম করে পিয়ালি নদীর বুকে চট করে হারিয়ে যায়—আমরা তখন পাশাপাশি হাঁটতাম। বাবার কদম ধীর, নিয়মিত। হাত দুটো পিছনে একটার মুঠোয় অন্যটা। আমি হাঁটি দড়ি ছেঁড়া একটা দস্যি গরুর মতো। এইখানে এক কদম তো অন্যখানে আরেক কদম। কিছুক্ষণ পরপর হাত দুটো মেলে দিয়ে দেই একটা ছুট। বাবা আমায় ডেকে বলেন, ‘তোর নাম দেওয়া উচিত ছিল পবনকুমার।’
আমি তখন পায়ের কড়ে আঙুল কীসে লেগে নিচে পড়লাম তা খুঁজতে ব্যস্ত। দেখি এই এক হাত সমান ছোট্ট একটা তিল গাছের সাথে আঙুল জড়িয়ে আমি পড়ে গেছি৷ ছড়ে যাওয়া আঙুলটায় হাত বুলাতে গিয়ে মনে মনে তিলের চৌদ্দগুষ্ঠির শাপশাপান্ত করতে থাকি। সিদ্ধান্ত নিলাম এই তিলের ব্যাটাকে আমি এখান থেকে তুলে নিয়ে বারান্দার টবে লাগাব। গাছ বড়ো হয়ে তিল ধরলে তাকে নিংড়ে তেল বের করে তারপর আমি ক্ষান্ত দেবো! এই ভয়ংকর চিন্তাভাবনা যখন আমার মস্তিষ্কে গেঁথে নিচ্ছি, তখন দেখি আমার জলের মতোন বাবা নদীর দিকে তাকিয়ে হাত মেলে দিয়ে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ধীর পায়ে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই৷ শুনতে পাই, বাবা নীচুস্বরে বলছে, ঈশ্বর! জীবন এমনই থাকুক…এমন স্নিগ্ধ সকালের মতোন। আমার ছেলেটার সরলতার মতোন।
বাবা কি কখনো জানবে আমি তখন ছোট্ট একটা তিলগাছের উপর প্রতিশোধ নেবার চিন্তা করছিলাম?
অফিস থেকে ফিরে বাকিদের বাবার মতো আমার বাবা বিছানায় এলিয়ে পড়ে না। বরং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে কিংবা স্কুলের মাঠে দৌড় দেবে। কদিন আগে এসএসসি শেষ হলো আমার। বাবাকে আর পায় কে! ‘পড়ালেখা বন্ধ, বাপ-পুতে খানিকক্ষণ দৌড়ে আসি চল!’ এই হলো রোজকার ঘটনা। দুজন স্বার্থহীন, কাদামাটির মতো মানুষের সন্তান আমার মতো হলো কীভাবে তা ভেবে পাই না। আমি কতকিছুর হিসেব-নিকেশ করি তার ইয়ত্তা নেই। আর আমার মা-বাবাকে দেখে মনে হয় তাদের হিসেবের খাতা বলতে কিছু নেই, তাদের জগৎ জুড়ে আছি শুধু আমি। আমার কি এটা নিয়ে খুব আনন্দিত হওয়া উচিত? ক্লাসের বাকিরা অবশ্য খুব বলত, চয়ন চৌধুরী এক্কেবারে আদতেই চৌধুরী! তোর মা-বাবা তোকে তো স্নেহে ডুবিয়ে রাখে রে! পাশ থেকে শৈবাল ফোড়ন কাটে, ‘প্রাণিজ স্নেহ নাকি উদ্ভিজ স্নেহ?’ মীনু খাতা গোছাতে গোছাতে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘তরল নাকি কঠিন স্নেহ? তেল নাকি চর্বি?’
সবাই হাসিতে এর-ওর উপর গড়াগড়ি খায়। এর মধ্যে সুমনার লম্বা বেণি কীভাবে যেন বসার বেঞ্চির এক ফাঁকে আটকে যায়। তরল-কঠিন স্নেহ থেকে সরে গিয়ে সবাই মিলে কঠিন আলোচনা জুড়ে দিই কীভাবে চুল অক্ষত রেখে সেই বেণি উদ্ধার করা যাবে। তা অবশ্য আর হয় না। স্কুলের ঘন্টা বাজানো করিম চাচা কাঁচি দিয়ে কুচ করে চুল কেটে অবশেষে আমাদের উত্তেজনার পরিসমাপ্তি ঘটালেন। সুমনার সে কী কান্না!
অবশ্য তারচেয়ে বেশি কেঁদেছিলাম আমরা সবাই, বিদায়ের দিন। রং ছুড়ে, মেখে একেকজন ভূতের বড়ো ভাই হয়ে স্কুল মাঠ থেকে ফিরে যাবার সময় কি হলো কে জানে। আমি হঠাৎ মাঠে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমাকে কেউ আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। একটা দুটো করে অনেকগুলো পরিচিত হাতে আবৃত্ত হয়ে তাদের চোখের জলে কতক্ষণ সিক্ত হলাম জানি না। সেদিন ঘরে ফেরার পর মনে হয়েছিল, এক চয়নকে আমি আসলে আমি ওই স্কুল মাঠে ফেলে এসেছি। যে চয়ন ঘরে ফিরে এসেছে সে কখনো সেই পুরোনো চয়নের কাছে ফিরে যেতে পারবে না, কখনো না। ভাবনাটা এমন বিশ্রিভাবে সত্য হবে সেটা তখনো জানতাম না। আচ্ছা, খারাপ চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মাথা থেকে দশ টাকার কালো ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে পারি না কেন? ঈশ্বর বেছে বেছে ওসবকেই কেন জীয়ন্ত করে বাস্তবে ছেড়ে দেন! এই কারণে মানুষ হয়ে ঈশ্বরের উপর অভিমান করার অধিকার কি আমার আছে?
৪.
শ্যাওলা রঙের একটা শাড়ি পরে চিত্রা এলোমেলোভাবে ডাইনিং এ পায়চারি করতে থাকে। ছেলেটার আজকাল কী হয়, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে সে। এত চমৎকার ছবি আঁকত চয়ন! মনে হতো ক্যানভাস থেকে জীয়ন্ত হয়ে ঘাসফুলগুলো মাথা দোলাবে, পাখিগুলো এই বুঝি গেয়ে উঠল, ক্যানভাসের উপর চয়নের প্রতিটি রং-তুলির আঁচড় যেন শ্বাস ফেলছে। আর সেই চয়ন বারান্দা থেকে একটা একটা করে সবকটা রঙের কৌটো, তুলি নিচে ফেলে দিলো! শব্দ শুনে দৌড়ে গিয়ে চিত্রা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল, পরক্ষণে সামলে নিয়ে জানতে চায় ব্যাপার কী। চয়ন গম্ভীর স্বরে উত্তর দেয়, কিছু না মা। আর ছবি আঁকব না। বলতে গিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চিত্রার বুক কেঁপে ওঠে তাতে।
সেই থেকে অপেক্ষা করছে কবে অনিকেত আসবে। বিষণ্ণ এক পাখির সুরে বেল বেজে উঠলে চিত্রা ছুটে যায় দরজার কাছে। অনিকেত ঘরে ঢুকেই চিত্রার দিকে তাকিয়ে পরাজিত একজন মানুষের মতোন ক্লান্তভাবে হাসে, তার এক হাতে অফিসের ব্যাগ অন্য হাতে বড়ো একটা খাম। তাতে চিত্রার চেহারাজুড়ে ভর করে থাকা কালো মেঘ আষাঢ়-শ্রাবণের সন্ধ্যার আকাশের মতো হয়ে যায়।
ত্রস্ত হাতে সেটা পরিষ্কার করে অনিকেত চিত্রার দিকে কোমলভাবে তাকিয়ে থাকে। মেঝের উপর বসে কোলের মধ্যে একটা কুশন টেনে নেয় চিত্রা, তারপর সেটাতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। শব্দহীন, একটানা কান্না। অনিকেত চিত্রার মাথা বুকে তুলে নেয়, তার পরনের ফতুয়া চোখের জল, কাজল আর সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে যায়। মনে হতে থাকে সে বিশাল একটি বনের মাঝে দাঁড়িয়েছিল, চারদিকে সারি সারি ঝাউ আর মেহগনি। দূর থেকে ভেসে আসছিল নোনা বাতাস। হুট করে সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল।
অনিকেতের সামনে চায়ের কাপ রাখতে গিয়ে চিত্রার হাত থেকে কাপ পড়ে যায়। ত্রস্ত হাতে সেটা পরিষ্কার করে অনিকেত চিত্রার দিকে কোমলভাবে তাকিয়ে থাকে। মেঝের উপর বসে কোলের মধ্যে একটা কুশন টেনে নেয় চিত্রা, তারপর সেটাতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে। শব্দহীন, একটানা কান্না। অনিকেত চিত্রার মাথা বুকে তুলে নেয়, তার পরনের ফতুয়া চোখের জল, কাজল আর সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে যায়। মনে হতে থাকে সে বিশাল একটি বনের মাঝে দাঁড়িয়েছিল, চারদিকে সারি সারি ঝাউ আর মেহগনি। দূর থেকে ভেসে আসছিল নোনা বাতাস। হুট করে সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। সে এখন দাঁড়িয়ে আছে বিরান একটা মরুদ্যানে৷ তপ্ত আকাশ, গনগনে বালি, নিশ্বাস নিতে পারছে না। চিত্রার হাত তার মুখ স্পর্শ করতেই যেন সে শ্বাস নিতে পারল ফের৷ দেখে, দুহাতে তার মুখখানা ধরে চিত্রা চেয়ে আছে। বড়ো খামটির দিকে তাকিয়ে বলল, ভুলও তো হতে পারে।
পারে।
আরেকবার দেখা যায় না চেষ্টা করে?
বছরের পর বছর তাই-ই করে যাচ্ছি চিত্রা।
চিত্রা এবার হু হু করে কেঁদে ওঠে। অনিকেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ঈশ্বর খুব বেশি চেয়েছিলাম কি তোমার কাছে?
৫.
প্রতিটা দিনের নিজস্ব গতি আছে বলে আমার বিশ্বাস। আমার ফিজিক্সের প্রফেসর বাবা এটা শুনলে মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলবেন, ‘কী সব অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা বলিস তুই! মাথাভর্তি গোবর দেখি তোর!’ অথচ মানুষের মাথাভর্তি কখনো গোবর হতে পারে না, এত বড়ো অবৈজ্ঞানিক কথা আমার বাবা নিমিষেই বলে ফেলবেন আমি নিশ্চিত। তাতে আমার কথার কোনো হেরফের হবে না। ওই যে বললাম দিনের নিজস্ব গতি আছে৷ কিছু দিন হলো একদম শফিউলের হাত থেকে ছুটে যাওয়া লাটিমের মতো। তীব্র গতিতে বনবন করে ঘোরে ওটা, চোখে ভ্রম হয়, মনে হয় লাটিমটা বোধহয় এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। শফিউলের সাথে লাটিম ঘুরানোয় কেউ পেরে ওঠে না। ঠিক তেমনি আমিও এমনতরো দিনের সাথে একেবারে পেরে উঠি না বাপু। হাতের মুঠো থেকে বালি সরে যাবার মতো কিছু দিনও এভাবে চলে যায়, ঠিক যেন হাওয়াই মিঠাই। আবার কিছু দিন আমাদের নীতুর বেড়ালের মতো হয়, অলস, ঘুমকাতুরে। সোফা ছেড়ে কতক্ষণ কাকিমার বিছানার উপর, বিছানা ছেড়ে কিছুক্ষণ জলচৌকির উপর—এভাবে টুনি নামের বেড়ালটার দিন কেটে যায় রোজ। আমি অবশ্যি চোখে দেখিনি এসব, নীতুর কাছে শুনেছি। ঠাকুরদার সেই বেতের রকিং চেয়ার, বিশাল বারান্দা, ঠাকুমার পানের বাটা, কাকিমার হাতের আমসত্ত্ব রাখার পোর্সেলিনের বয়াম কিংবা উঠোনের ওই ল্যাংড়া আমের গাছটা….কখনো কি দেখা হবে আমার? ভেতর বাড়ির পাতকুয়োটা, লেপেপুছে রাখা পুরোনো দিনের মাটির উনুন, ছোটোকাকার বারান্দায় থাকা কুন্দফুলের গাছটা…ছুঁয়ে দেখতে পারব কোনো দিন? সময় যে শফিউলের লাটিমের মতো তীব্র গতিতে ছুটছে…
কিন্তু নীতু বলে—পারব। জাম্বুরা গাছে সে নতুন দোলনা বেঁধেছে, তার ভাষ্যমতে আমাকেই এই দোলনায় চড়ে উদ্বোধন করতে হবে। আমি হাসি। মেয়েটা আমার চেয়ে দুই বছরের ছোটো কিন্তু কথা বলে এমন করে যেন সে আমার দশ বছরের বড়ো৷ বাবার বাড়ির সাথে নীতু আমাকে রেশমি সুতার মতো নিয়ত জুড়ে রাখে। সপ্তাহে দুই-এক দিন আমাদের দেখা হয়, গেল সপ্তাহে তাও হলো না। শুক্রবার আসলে পিয়ালী নদীর সাঁকো বেয়ে আমরা দুজন ওই পাড়ে চলে যাই। নদীর ওপারে বিষ্ণুপুর গ্রাম। একপাশে তার সারি সারি তালগাছ। তালগাছে নাকি ভূত-পেতনীরা আরাম আয়েশে থাকেন তাই সবাই পারতপক্ষে এই জায়গাটা এড়িয়েই চলে। কিন্তু নীতু আর আমার আস্তানা হয়ে উঠল এই জায়গাটা। খালি হাতে সে কখনো আসে না৷ বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার জন্য এটা সেটা নিয়ে আসবেই। কোঁচড় থেকে ডাসা পেয়ারা, তিলের নাড়ু এটা-সেটা বের করে রাজ্যের গল্পের ঝুড়ি খুলে দেবে সে। ‘জানিস চয়নদা, আমার মনে হয় ঠাকুমা তোর জন্য সহ হিসেব করে নাড়ু বানায়।’ কথা শুনে শুকনো নাড়ু আমার গলায় আটকে যায়। খুকখুক কাশির ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করি কেন এমন মনে হলো তার? নীতু এক ঝটকায় তার দুই ঝুঁটি পিছনে সরিয়ে বলে, ‘আরে ঠাকুমার যে হিসেব রে ব্যাটা, সে হিসেব করে সবার জন্য দুটো করে নাড়ু গড়ে। আমি গুণে দেখি সবসময় দুটো নাড়ু থাকে বাড়তি।’
একেবারে বুদ্ধির ঘটি দেখি তুমি! হতে পারে ওই নাড়ু ঠাকুমা নিজের জন্য বাড়তি বানায় আর সেগুলো তুই চুরি করে আনিস
আরে ঠাকুমার দাঁত আছে নাকি রে ওই শক্ত নাড়ু খাবে? খুব সাধু সাজা হচ্ছে, না? চুরি করে তো আনি তোর জন্য, তুই-ই তো খাস রাক্ষসের মতো। গিলিসও আবার আনন্দে কাঁদিসও। মুখ ঝামটা মেরে নীতু বলে।
এই রে! নীতু খেয়াল করেছে আমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে যতবারই বাড়ি থেকে আনা খাবার মুখে পুরি! আমি তো ভাবতাম চশমায় চোখ ঢাকা থাকে বলে অশ্রু বোঝা যায় না, অবশ্য এমনিতেই আমার বড়ো বড়ো চোখ তার উপর মোটা চশমার কাচ। চাইলেই তো সব লুকানো যায় না। আচ্ছা, আগে কখনো সে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি কেন?
চয়নদা তুই আমার সাথে একবার চল বাড়িতে। আমি নিশ্চিত তোকে দেখলে ঠাকুমা জড়িয়ে ধরবে।
আমি মাথা নীচু করে পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খোঁচাতে থাকি। প্রথম এবং বোধহয় শেষবারের মতো বাড়িতে গিয়েছিলাম যখন বড়ো কাকা মারা গেলেন। দাঁড়িয়ে ছিলাম সদর দরজার বাইরে, কেউ একটিবার ঢুকতে বলল না। অস্পৃশ্য, অচ্ছুতের মতো কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। পিঠের উপর হাত পড়তে বুঝলাম বাবা এসেছে। তাহলে বাবাও এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল? ওখান থেকেই বাবা-ছেলে ফিরে আসলাম। এরপর কখনো ও বাড়িমুখো হইনি, সাহস হয়নি। রাগ সরে অভিমান চেপে বসেছে বুক জুড়ে। ও বাড়ির কেউ আমার দিকে চোখ তুলে চায়ও না। কাছের মানুষরাই বুঝি এমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে! কত বড়ো বড়ো পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়, বাবা-মা-আমি, আমরা তো তেমন পাপ করিনি, তবে কিসের প্রায়শ্চিত্ত করছি আমরা? বেশিক্ষণ ভাবতে পারি না আর, মাথার ভেতর দপদপ করছে।
৬.
‘আমি জানতাম, আমি জানতাম এমন কিছু হবে!’, চিত্রা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে,’ এভাবে শাপ না দিলেও তো পারতেন তারা, পারতেন না বলো অনি? আমরা কী এত বড়ো পাপ করে ফেললাম!’
অনিকেত কোনো জবাব দিলো না, কিই-বা বলার আছে। বিয়ের ঊনিশ বছর হতে চলল তাদের। ছোটো-বড়ো যে কোনো বিপদে চিত্রা এভাবে বিহ্বল হয়ে পড়ে, ঘুরেফিরে তার মনে হতে থাকে এটা তাদের কর্মফল। আচ্ছা কী এমন পাপ করেছে তারা? ভালোই তো বেসেছে! চৌধুরী বাড়ির দুই ভাই সম্পদ নিয়ে একে অন্যের চেহারা দেখত না, রোজ করত ঝগড়া। সেখানে তাদের ছেলে-মেয়ে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলবে—এটা কে ভেবেছে! চিত্রা-অনিকেতের বিয়ের পর পাশাপাশি দুবাড়ির মাঝখানের দেওয়ালটা যেন রাতারাতি আকাশসম হয়ে গেল। এমন এক অদৃশ্য দেওয়াল উঠল, যেটা টপকানো হয়তো এ জীবনে আর সম্ভব নয়। একে তো শত্রু তার উপরে কাকাতো ভাই-বোনে বিয়ে, ছিছি পড়ে গেল চারদিক। দু-বাড়ির দরজাই তাদের জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ি ছেড়ে আসার আগে চিত্রার মা কঠিনভাবে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘আমাদের আশীর্বাদ নয় অভিশাপ নিয়ে তোর জীবন কাটবে!’
একই এলাকায় থাকে অথচ দেখা হলে তারা এমন ভাব করে যেন চোখেই দেখে না। দুজনে তাতে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করলেও চয়নের বেশ বুকে লাগে ব্যাপারগুলো। দিদা-দিদু, ঠাকুমা-ঠাকুরদাদা থাকা স্বত্তেও সে তাদের আদর-স্নেহ বঞ্চিত, এটা সে ঠিক মেনে নিতে পারে না।
চিত্রা বোধহয় এ কারণেই চয়নের সমস্ত অপ্রাপ্তিকে তার অসীম মাতৃস্নেহ দিয়ে পূরণ করে দিতে চায়। কিন্তু সব স্নেহের, ভালোবাসার উৎস এক হলে চলে না। জীবনে মা-বাবার স্নেহ যেমন দরকার, বন্ধু-বান্ধবের মায়াও তেমন দরকার, দাদা-দিদার আদরমাখা আশীর্বাদও তেমনি প্রয়োজন। চয়নের ছোটোকাকার মেয়ে নীতু অবশ্য এসব কিছুর ধার ধারে না। একটু বুদ্ধি শুদ্ধি হবার পর থেকেই সে ফাঁক পেলেই চয়নের কাছে ছুটে আসে, বাড়ির ভেতরে কখনো ঢোকে না ঠিক। তবে নীতুই চয়নের দাদাবাড়ির সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র বন্ধন। অন্যদিকে মামার বাড়ির কেউই যোগাযোগ রাখেনি। একমাত্র চিত্রার মাসতুতো বোন অবনী ছাড়া।
অনিকেতের চিন্তায় ছেদ পড়ে যখন সে দেখে কাঁদতে কাঁদতে চিত্রার শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম। দৌড়ে শোবার ঘর থেকে ইনহেলার এনে দেয় সে৷ ধাতস্থ হয়ে চিত্রা ফের কান্না শুরু করে, ‘অনি চলো বাড়িতে যাই, ওদের পায়ে ধরে ক্ষমা চাই। যতক্ষণ ক্ষমা করবেন না ততক্ষণ পায়ের কাছে পড়ে থাকব। তাতে যদি তারা ক্ষমা করে দেন, তাদের অভিশাপ তুলে নেন….’ তার কথা শেষ হয় না, জড়িয়ে যায়। অনিকেতের ভারী চশমা ঝাপসা হয়ে আসে। তার কট্টর বিজ্ঞানমনস্ক মনও ভাবতে বসে এমন করলে যদি সত্যি একটা মিরাকল হয়ে যায়!
কিন্তু তা হয় না। চিত্রার কান্না, অনিকেতের বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকা কোনো কিছুতেই ও বাড়ির লোকজনের মুখে একটা কথা ফোটানো গেল না, সদর দরজাও খুলল না। অনিকেত জোর করে চিত্রাকে টেনে নিজ ঘরে ফিরিয়ে আনল। বাসায় ফিরে বড়ো খামটা নিয়ে আবার বসল। বড়ো খামটা থেকে সব ফাইলপত্তর ফের বের করে আবার সে ইমেইল পাঠানো শুরু করল দেশের গন্ডি পেরিয়ে। কেউ যদি কোনো সমাধান দেয়! কিন্তু জীবনের সূত্র বড়ো জটিল, এই মিলে গেল ভেবে খুশি হতে গিয়ে দেখা যায় পুরো সমাধানই ভুল হয়ে বসে আছে।
৭.
ছোটোবেলা থেকেই চশমা পরি। সত্যি বলতে চশমাকে আমার নিজের শরীরের একটা অংশ মনে হয়। ইদানীং চশমাতেও কাজ হয়না দেখি। সব কেমন জানি আবছা, ঘোলাটে হয়ে আসে কিছুক্ষণ পর। নীতু বলে, চয়নদা তোর চশমাটা খোল কিছুক্ষণ কানামাছি খেলি৷ সে তো প্রায়ই আমাকে কানামাছি বলে খেপায়। কিন্তু চোখের সাথে সাথে কানও খোয়াতে শুরু করেছি আজকাল। সেদিন সুমনা এত ডাকল পিছন থেকে, শুনলামই না তেমন৷ মনে হচ্ছিল দূর থেকে কিছু শব্দ ভেসে আসছে। পরে পিঠের উপর গাট্টা পড়তেই ফিরে দেখি শৈবাল, তার পিছনে সুমনা দাঁড়িয়ে— চোখ দুটো জলে টলটল করছে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সুমনা ভেবেছে আমি ইচ্ছে করেই তার ডাক না শোনার ভান করেছি। এর মধ্যে বেশ কবার অনেকের সাথে এরকম ভুল বোঝাবুঝি হবার পর বুঝতে পারলাম শ্রবণশক্তি ক্ষয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা আমি কি তবে নীতুর হড়বড় করে বলতে থাকা গল্প শুনতে পারব না আর? মায়ের কণ্ঠে গান, বাবার গলার স্বর…
মাঠ পেরোলেই যে অড়হরের খেত, তার পাশে বিরাট একটা নিম গাছ৷ ওটা আঁকড়ে ধরে আমি মেলায় হারিয়ে যাওয়া চার বছরের বাচ্চার মতো কাঁদলাম। শান্তি লাগলে। নিজের গালে নিজে চড় মেরে বললাম, এই আধুনিক যুগে বসে তুমি শুনতে পারবে না, দেখতে পারবে না— এমন কেন ভাবলে? কত উন্নত প্রযুক্তি আছে, কত চমৎকার চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে! বছর কয়েক আগেই পাসপোর্ট করা হয়ে গেছে আমার, মা-বাবা বাইরে যাবার পরিকল্পনা করছেন অনেক আগে থেকেই। হঠাৎ কেন জানি মন খারাপটুকু ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। সবমসময় অবশ্য মন খারাপের ভূতের সাথে যুদ্ধে কুলিয়ে উঠতে পারি না। আজকাল প্রায় সে বেতাল পঞ্চবিংশতির বেতালের মতো ঘাড়ে চেপে বসে থাকে। তারপরও অসীম আশা নিয়ে আমি বাড়ির দিকে রওনা দেই।
৮.
‘কতবার খেতে ডাকি ওকে জবাবই দেয় না! না খেয়ে খেয়ে শরীরটা হয়েছে এতটুকু! অনি, এ্যাই অনিকেত তোমার ছেলে ঘরে ফিরলে বকবে আজ। দরকার পড়লে দুটো মার দেবে৷ খাবার নাকি স্বাদ হয় না তাই খায় না! এত বড়ো কথা৷ বলি আমার হাতের ডাল-ভাত খেয়ে মানুষ ধন্যি ধন্যি করে আর তোমার ছেলে মাছ-মাংস দেখলে নাক সিঁটকায়! আজ আমি পোলাও কোরমা করব, ডালও চড়াব। দেখি সে কীভাবে না খায়!’
অনিকেত চুপচাপ চিত্রার হুংকার শোনে। দেখে, রান্নাঘরে ত্রস্তপায়ে এদিক সেদিক ছুটছে, পাঁচফোঁড়নের বয়াম, পাটায় লেগে থাকা জিরে বাটা, কুঁচো করে রাখা ধনেপাতা— সব কিছুর মেলবন্ধনে হরেক পদের রান্না জুড়ছে সে।
অনিকেত ধীরপায়ে চিত্রার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
চয়ন জানে।
চয়ন জানে মানে?
ওকে আমি অনেক আগেই ডায়েট চার্টটা দিয়ে দিয়েছি চিত্রা। ওরও জানতে হবে কী খাওয়া নিরাপদ। বন্ধুদের সাথে যদি এটা-সেটা খেয়ে বসে…অত বড়ো ঝুঁকি আমি নিতে পারেনি৷ ও এত মসলাদার খাবার খেতে পারবে না চিত্রা, তুমি তো জানো। তাও কেন এমন করো বলো তো?
এক উনুনে তখন টগবগ করছে কাঁচা রোদের মতো হলুদ ডাল, আরেক পাশে কড়াইয়ে সর্ষের তেলের মধ্যে শুকনো লঙ্কা, কখানা রসুনের কোয়া, জিরে আর কাঁচা মরিচের ফোঁড়ন। চিত্রা সেটা তুলে ডালে ঢালতে গিয়ে থমকে যায়। অনিকেত আলগোছে কড়াইটা সরিয়ে নেয়। সময় ওই ছোট্ট রান্নাঘরে স্তব্ধ হয়ে যায়, কত প্রহর কেটে গেল তার হিসেব কেউ রাখে না। যে নিষ্ঠুর সময় সব কেড়ে নেয় আগ্রাসী ছোবলে তার হিসেব রাখা কি খুব জরুরি?
আমি জানি আমার আর কোনো ভাইবোন এই পৃথিবীতে আসবে না, আসা উচিতও না৷ যে অপরিসীম শারীরিক কষ্টের ভেতর আমার নিয়ত বসবাস সেটা আর কারো না হোক৷ বাবা-মার মতো শিক্ষিত মানুষ কীভাবে না ভেবেচিন্তে আমায় পৃথিবীতে আনল সেটা প্রায়ই আমাকে ভাবায়।
৯.
নীতু জানে। আমি নিশ্চিত বাবাই তাকে বলেছে। এ জন্যই সে বিড়ালের মতো আমার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। চয়নদা, চয়নদা বলে রাজ্যের সব কথা শোনায়। বেচারি! সে বোধহয় ভাবে চয়নদা তো কিছু দিন পর আর হয়তো শুনতে পাবে না, দেখতে পাবে না, তাই হয়তো সব কথা এখনই শুনিয়ে ফেলতে চায়। নীতুটা এত মায়াবী! আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে চালতা গাছের ফুলের মাঝে পুরে বুক পকেটে নিয়ে ঘুরি। তার মতো যদি আমার একটা বোন থাকত তাহলে সেও বোধহয় দাদা দাদা করে আমার চারপাশে ঘুরঘুর করত, এটা-সেটার বায়না ধরত, শফিউলদের উঠোন লাগোয়া মিষ্টি কুল, মিতুদের গাছের তেঁতুল সবকিছুই চাইত। ঠিক নীতুর মতোন। কিন্তু আমি জানি আমার আর কোনো ভাইবোন এই পৃথিবীতে আসবে না, আসা উচিতও না৷ যে অপরিসীম শারীরিক কষ্টের ভেতর আমার নিয়ত বসবাস সেটা আর কারো না হোক৷ বাবা-মার মতো শিক্ষিত মানুষ কীভাবে না ভেবেচিন্তে আমায় পৃথিবীতে আনল সেটা প্রায়ই আমাকে ভাবায়।
কিন্তু তারা দুজন যখন পাশাপাশি বসে, হাত ধরে হাটে কিংবা বিকেলে চায়ের কাপ হাতে দাবা খেলে আমার তখন মনে হয় এমন ভালোবাসা জগতে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন আরেকজনের দিকে একরাশ মায়া নিয়ে তারা তাকায়, কী সুন্দর সেই দৃশ্য! আমার কি এই জগতে আসা খুব দরকার ছিল? ভালোই তো কেটে যাচ্ছিল তাদের জীবন। কত কাজিনদের মধ্যেই তো বিয়ে হয়, কই তাদের সন্তানদের তো আমার মতো জন্মগত রোগশোক নিয়ে পৃথিবীতে আসা হয় না। অথচ আমার মা-বাবার মতো ভালো মানুষের জন্য আপদ হলাম আমি। কান পেতে শুনেছি ডাক্তার কাকু চুকচুক শব্দ করে বললেন, অনিকেত সাহেব আপনারা স্বামী স্ত্রী দুজনই উচ্চ শিক্ষিত। আপনাদের তো জানার কথা ফার্স্ট কাজিনের মধ্যে বিয়ে হলে সন্তানের স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে। চয়নের ব্যাপারে আমি আশা জাগানিয়া কিছু বলে আপনাদের আকাঙ্ক্ষা বাড়াতে পারব না। মা তো সেদিন থেকেই ধরে নিয়েছেন, এটা নির্ঘাত দিদা-দিদু, ঠাকুমা-ঠাকুরদার সেই অভিশাপ। আমার মাঝেমাঝে খুব হাসি পায়। নিজেকে কেন জানি সার্কাসের সঙ এর মতো লাগে। রং মেখে বিধাতা পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েছেন, আজব খেল দেখাচ্ছি রোজ। ছবি আঁকা ছেড়ে দিলাম, চোখে দেখতে পাচ্ছি না বলে; মা গান করলে দরজা বন্ধ করে দেই, শুনতে পাই না ঠিক মতো। মা যখন বলে, চয়ন বাবা পরের লাইনটা ধর তো আমার সাথে— আমি খেই হারিয়ে ফেলি তখন। অথচ মুখের হাসি আমার হারায় না৷ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ হাসির অভ্যেস করতে করতে একেবারে মাস্টার হয়ে গেছি আমি। আমার তো মনে হয় মরে গেলেও আমার মুখে জোকারের মতো এই হাসি লেগে থাকবে। গ্রীষ্মের এই কড়া রোদ সামনে কমে আসবে, কিন্তু আমার কষ্টটুকু কমবে কখন? আমি আজকাল দুঃখ-কষ্টের সাথে লড়াই করা ছেড়ে দিয়েছি। ডাক্তার কাকুর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী যে যুদ্ধে জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেই যুদ্ধে বোকার মতে লড়ে লাভ নেই।
১০.
নীলকমল নামের দোতলা বাড়িটার সদর দরজার দুই পাল্লা হাট করে খোলা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে অনিকেত ক্ষীণ কণ্ঠে বলে চলে ‘চিত্রা অল্প হলেও খাও প্লিজ, এভাবে না খেলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।’ কিন্তু শিউলি ফুলের মতো এক থালা ভাত অস্পৃশ্য হয়ে ডাইনিংয়ে পড়ে থাকে, কেউ সেটা ছুঁয়েও দেখে না। চিত্রা চয়নের রুমের দরজা আগলে বসে পড়ে, উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘কোথায় নিয়ে গেল আমার ছেলেকে! আমার চয়ন কোথায়? আমার চয়ন!’ এর জবাব অনিকেত দিতে পারে না। সে শুধু চিত্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে যায়, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আমার ছেলে ভাবত আমি খুব সাদাসিধে মানুষ। কিন্তু আমি খুবই স্বার্থপর চিত্রা। আমি স্বার্থপরের মতো চাই তুমি আমার জন্য বেঁচে থাকো। তুমিও না থাকলে আমি কীভাবে বাঁচব বলো?’ বুকের ভেতর দুমড়েমুচড়ে বেরিয়ে আসা এই আহাজারি চিত্রার কানে পৌঁছায় কি না তা আমরা জানি না। কারণ পার্থিব জগতের সীমারেখা ছেদ করে ও জগতে এসব রোনাজারি কোনো ইথারে ভেসে যায় কি না, কেউ জানে না৷ শুধু নীতু তার বাবা সুনিকেতের হাত আঁকড়ে ধরে থাকে তার সামনে চিত্রিত হওয়া দৃশ্য। পাহাড়সম অদৃশ্য কষ্ট তার বুকে চেপে বসে দৃঢ়ভাবে। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো তার, যদিও জানে কাকা খাবে না তারপরও মিষ্টি নিয়ে বাবার সাথে আসে সে। খোলা দরজা পেরিয়ে দেখে গত দু-বছরে ঘরটার আদলই বদলে গেছে। চারদিকে বিষণ্ন বাতাস, পুরো ঘর যেন মেঘমেদুর আকাশ। অনিকেত কোন অদৃশ্য কায়াকে আঁকড়ে ধরে স্বার্থপরের মতো বাঁচার কথা বলছে, দেওয়ালে ঝুলছে ফুলের হার পরানো পাশাপাশি দুটো ছবি। নীতুর নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বিরান ভিটের মতো টেবিলে পড়ে থাকা উন্মুক্ত নোটবুকটা হাতে তুলে নিয়ে সেই পুরোনো বারান্দায় ছুটে যায় নিতু। প্রতিটি পাতাজুড়ে অশ্রুজলের গ্রাফিতি।
চেনা হাতে শেষ পাতায় এলোমেলো অক্ষরে লেখা—
‘আমার রুমের পাশের আমগাছটায় কাকের বাসায় ডিম থেকে ছানা ফুটেছে। আবছা দেখি তো, তাই বুঝতে পারছি না কাকের ছানা নাকি কোকিলের। অবশ্য দেখলেও চিনতে পারতাম না। আচ্ছা, যদি ওখানে কোকিল হয় তবে এই বসন্তে তারা কি গান গাইবে? তারও আগে পায়ে-পায়ে আসবে শীত। মা গাঁদা ফুল লাগাবে, বাড়ির পেছনের এক টুকরো জায়গা সয়লাব হবে নানান সবজিতে। বারান্দার গ্রীল জড়িয়ে থাকবে শিমের ফুল। পিয়ালী নদীর পাশে শিশির মেখে বসে থাকবে কিছু লাজুক বাঁধাকপি। চারদিকে থাকবে হরেক রং, বাতাসে কুচো করে ছড়িয়ে দেওয়া মিহিন কুয়াশা।
তারপরই কোকিলরা চারদিকে ছটফট করে উড়ে কুহু রবে ভরিয়ে তুলবে। জীবন হবে কোলাহলে সরব, কিন্তু আমি হয়তো সেটা দেখতে পারব না। আমার না থাকার শূন্যতা এক অদ্ভুত নীরবতা নিয়ে আসবে আমার মা-বাবার জীবনে। নিজের জন্য কষ্ট হয় না আর। বরং খারাপ লাগে এই ভেবে— আমার মা-বাবা তো এই চলে যাওয়া সইতেই পারবে না…
আগামী শীতের কথা চিন্তা করে এই ভরপুর গ্রীষ্মের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে মায়ের আবৃত্তি করা প্রস্থান কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। মা প্রায়ই ভীষণ দরদ দিয়ে কবিতাটা পড়ে। আজকাল এটা শুনে আমার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড ঘাসফড়িং এর মতো লাফায়, মনে হয় মা আমার জন্যই এটা পড়ছে—
‘চলে গেলে বইলা যাওয়া ভালো
ঘুঘুর ডাকের মতো এই একলা দুপুরে
তাহলে আর ধূসর ধূসর লাগবে না—
খাবারের প্লেট হাতে
অপেক্ষায় থাকবে না কেউ—
কেউ কেউ এমন করে হঠাৎ চইলা যায়
বুকে খিল লাইগা আসে—’
চলে গেলে বলে যেতে হয়, কিন্তু আমি তো যাব সেই সুদূর। যেখানে যাবার সময় কেউ বলে যেতে পারে না। কিন্তু আমার চলে যাওয়ায় মা-বাবার বুকে যে কঠিন খিল লেগে যাবে সেটা কে খুলবে ঈশ্বর!
নোট: গল্পে ব্যবহৃত ‘প্রস্থান’ কবিতাটি কবি হাসান রোবায়েতের লেখা।
পড়ালেখা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। বর্তমানে চিটাগং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। লিখতে ভালোবাসেন, তবে তারচেয়েও বেশি ভালোবাসেন পড়তে।