একজোড়া নারীপুরুষকে নদীর জলে ডোবানো হবে। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলো মুন্সিগঞ্জে, পদ্মার শাখা অংশে, সেটাও পদ্মা। পদ্মাংশ নদী? শাখা নদীগুলোর নতুন নামকরণ করলে কেমন হয়? জানুয়ারি মাস। প্রচণ্ড শীত। ভোর ৬টায় জোড়া নারীপুরুষকে নামানো হলো নদীতে। তারা নদীতে ডুবে যাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখা যাবে বটে, এখন প্রশ্ন, সেই দৃশ্য নেওয়া হবে কীভাবে? একবার মনে হলো, না, এই দৃশ্য নেওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিই। একজোড়া নারীপুরুষ নদীর জলের ওপর শুয়ে থাকা অবস্থায় ডুবে যাচ্ছে, এই পর্যন্ত নিতে পারলেই হবে। কাঁটার লাইট টিমের গ্যাফার হৃদয় একটা দরজা সাইজের লোহার শিকের গ্রিল নিয়ে গিয়েছিল বাসের ছাদে করে। এই দৃশ্য করাতে নাকি ওই গ্রিল কাজে আসবে, আমাকে বোঝাল। গ্রিলের ওপরে শুয়ে পড়বে নারী ও পুরুষ। গ্রিলের সঙ্গে তাদের কিছুটা বেঁধেও রাখা হবে। কবরের খাটিয়া ধরার মতো চার জন লোক সেই গ্রিল ধরে ডুব দেবে, আর গ্রিলে তো নারীপুরুষ বেঁধে রাখাই থাকবে। যখনই ডুব দেবে ওই চার জন, ডুববে তখন নারী পুরুষসহ ছয় জন। তখন একদম টপ থেকে, আকাশ থেকে নেমে আসবে ড্রোন, ড্রোন নামবে আর ড্রোন-ক্যামেরায় শুট হবে—একজোড়া নারীপুরুষ ডুবে যাচ্ছে জলের উপর চিত হয়ে শুয়ে। ক্ষণমুহূর্তের জন্য হলেও এইরকমই বানাতে হবে। তখন, যেই না গ্রিল বাহক চার জন ডুব দিলো, গ্রিলের উপরে শুয়ে থাকা নারীপুরুষসহ জলে ডুবে গেল ছয় জন। ড্রোন আকাশ বরাবর ওড়ানোই ছিল। এছাড়াও ডাঙায় ছিল সনি এফ এক্স ফাইভ। ড্রোন নদীর জলের কাছাকাছি বা ডুবন্ত ওই কর্মকাণ্ডের উপর নামছিল। এই অবস্থায় শট ভেস্তে গেল, জলের ভেতরে থেকে একটি হাত বেরিয়ে এলো জলের উপরে। সাহায্য চাচ্ছে সেই হাত। বাঁচতে চাচ্ছে। কাট।
হলো না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে অনিমেষের, সেই পুরুষের। তাই ও হাত তুলে ফেলেছিল জলের উপরে। সেই নারী, তৃপ্তির কিছু হয়নি। আরও ১০ সেকেন্ড ও পারত জলের অতলে থাকতে, বলল। কিন্তু ওই চার জন তো প্রোডাকশনের লোক, ওদের এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছে যে, সে তো আমাদের সঙ্গেই আছে। লাইট গ্যাফার হৃদয়। ওর বুদ্ধিতে কিছু হলো না। অনিমেষের সংক্ষুব্ধ হওয়া তখন স্বাভাবিক। বলল, ‘টোকন’দা, কাঁটা করতে গিয়ে আমি নদীতে ডুবে মরব? জীবন খোয়াব?’ আমি বললাম, ‘হৃদয়, ওভাবে হবে না। এভাবে করো।’ ন্যাচারালই নদীজলে লাশ ভেসে আছে একজোড়া। কিন্তু শীতকালের সেই সকাল সাতটায় জলে ভিজে ওরা, সুবোধ-স্বপ্নারা কাঁপছিল। এরপর নদীপাড়ে কিছু শুকনো খড়ের ব্যবস্থা করে তাতে আগুন দিয়ে একটুখানি নিজেদের সেঁকে নিচ্ছে দুজন। পরের দৃশ্যের প্রস্তুতি। নদীর ভেতরেই। হয়তো কাঁটা মূল গল্পে এরকম কোনো নদীর অস্তিত্ব নেই। নেই তো কী হয়েছে? বাংলাদেশে তো নদী আছে, চিত্রনাট্যে তো আছে। আমরা তো আর গল্পটা ধরে শুট করছি না, করছি চিত্রনাট্য ধরে। ফলত, নদী আমাদের ছাড়বে কেন? সুবোধ-স্বপ্নারা তো এসেছেই যমুনা নদীর পাড়, সিরাজগঞ্জ থেকে। সেখানে, সুহাসিনী গ্রামে সুবোধের মা আছে, ছোটো ভাই আছে। ওর ছোটো ভাইয়ের নাম পরাণ। ভূতের গলির মহল্লাবাসিরা তো জানেই, ‘ছুবোদের ছুডো বাইয়ের নাম ছবছম পরাণই হয়।’
মুন্সিগঞ্জের পদ্মাপাড়। আগের রাতের শেষ প্রহরে আমাদের একটি ছোট্ট টিম নিয়ে আমি নদীর ধারে চলে যাই। সেই যাওয়া রেকি করার জন্য যাওয়া। আমরা ডিটেইলে বুঝতে চাই, ঠিক কখন পুবাকাশ সাদা হতে শুরু করে! কখন মনে হয়, ওই দিক দিয়ে সূর্য উঠবে, আকশে তার আভা ছড়িয়ে পড়ছে। ভোর ৪টা তেতাল্লিশ মিনিটে আমরা নদীপাড়ে। কীভাবে রাতের শেষপ্রহরে মুহূর্ত অতিক্রম করে যায়, তাই সরেজমিন দেখা আর কী! ৪টা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে কী হচ্ছে? চারটা পঞ্চাশ, পঞ্চান্ন পেরুল। পাঁচটা বাজল। পাঁচটা এক, পাঁচটা দুই, পাঁচটা তিন মিনিট। ভোর পাঁচটা সাত মিনিটে কী দেখছি তখন আমরা? সময় মাপা হচ্ছে আর কী। কেন না, পরদিন ভোরের একই সময়ে আমাদের শুটিং শুরু হবে। তাই আগের দিন ভোরে রেকি করা হচ্ছে। একদিকে শীত, অন্যদিকে নদীর হিম দুহিতা হাওয়া আর কুয়াশা—চমেক্কার ব্যাপার। চমৎকার এখানে যায় না। চমেক্কার যথার্থ। তাই লিখলাম। কী লিখলাম? কী লিখলাম, তা তো আপনি পড়েই এলেন, এলেন না? কোথা থেকে এলেন আপনি? কোথা থেকে এলাম আমি? কোথা থেকে এলো সুবোধ-স্বপ্না? মহল্লাবাসির জ্বালা তো ওই সুবোধ-স্বপ্নাকে নিয়েই। একটা সংলাপ আছে ছবিতে, ‘কোত্থোন যে হালায় ঘুইরা ঘুইরা ভূতের গলিতে আহে আর আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনের কুয়ার মধ্যে হান্দাইয়া মরে!?’
সুবোধ-স্বপ্নারা গ্রাম থেকে ঢাকায় আসে। ভূতের গলিতে ভাড়াটিয়া হয়। ওরা আসে যমুনা নদীর পাড় থেকে, ওরা আসে সাতক্ষীরা থেকে, আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে বা সুবোধ-স্বপ্নারা আসে চুমোডাঙা থেকে। চুমোডাঙা আবার কী? চুমো দিতে দিতে ডাঙা, নাকি যে ডাঙায় গেলে শুধু চুমু খেতে হয় তিন বেলা, সেটাই কি চুমোডাঙা? কেউ কেউ তো কয়, চুঙোডাঙা, আর খাতাপত্রে লেখা হয় চুয়াডাঙা। কলোকালি কেউ কেউ কয়, চুয়োডাঙা। জার্নি অব কাঁটা কি চুমোডাঙায় নিয়ে যাবে পাঠককে? না। সাতক্ষীরা নিয়ে যাবে? না। নারায়ণগঞ্জ বা সিরাজগঞ্জে নিয়ে যাবে? আদতে কাঁটা গল্পটি আবর্তিত পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে। তাই চাইলেই আমরা কক্সবাজার বা পাহাড়ের দিকে যেতে পারছি না। কারণ, ভূতের গলি একটি প্রাচীন মহল্লা। আর সিনেমা হচ্ছে বলেই সমুদ্রে ঝাঁপাবে ছবির নায়িকা, বা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে শরীর বাঁকিয়ে নাচবে, তা তো কাঁটা না। কাঁটা আপনার নিজের গল্প। নিজের মহল্লার গল্প। মহল্লার মানুষের মনোজগতের গল্প। কাঁটা মহল্লার মোড়ের সেলুন ঘরের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে থাকা একদল সিনিয়র সিটিজেনের জাবর কাটা গসিপিংয়ের গল্প।
তাই ঘুরে ফিরে আমরা যাব ভূতের গলির চৌরাস্তার মোড়ে, ইয়োর চয়েস সেলুনে। সেলুন ঘরই কাঁটার স্টোরি স্টেশন। ১৯৮৯-৯০ সালের প্রেক্ষাপটে দেখা যাবে এই সেলুন ঘর। সেলুনের সামনে পেতে রাখা দুটি কাঠের বেঞ্চে বসে গল্প গুজব করে ভূতের গলির মহল্লাবাসির একাংশ। তারা যা বলাবলি করে, তা হচ্ছে, ‘আজিজ ব্যাপারীর বাইত্তে নয়া ভাড়াইট্টা আইছে।’ মহল্লাবাসিরা মনে করতে থাকে, ব্যাপারীর বাইত্তে এরকম আরেক দম্পতি এসেছিল আঠারো বছর আগে, ১৯৭১ সালে। এবং তারও আগে ১৯৬৪ সালে এসেছিল আরও এক দম্পতি। সব দম্পতিরই পরিণতি করুণ, মহল্লাবাসিরা জানে। দেখেছে। সাক্ষী আছে। নাকি সেই ঘটনা মহল্লবাসিরাও ঘটিয়েছে? কী ভয়াবহ কথা! প্রয়াত অভিনেতা এস এম মহসীন, পরেশ আচার্য, বসু বাজার পঞ্চায়েত প্রধান ও ন্যাপ নেতা শাহাবুদ্দিন ভাই, মিলন কান্তি দে, মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান, অশোক শীল, অনিমেষ আইচ, তৃপ্তি রানী, ইকবাল বাবু, রতন দেব, তালিম কুমার, আতিকুল ইসলাম, ছ্যাদা ফারুক, রাফাত আলম মিশু, শিল্পী শেখ সাহেদ এবং মামুর মাজারের কিছু বয়স্ক লোক ছিলেন সেলুন ঘরের দৃশ্যাবলিতে। ১৯৮৯-৯০ সালের অনেক সিনেমার পোস্টার আছে এই সব সিনে। মোটরসাইকেল, রিকশা, বেবিট্যাক্সি দেখা যাবে এখানে। ভিউকার্ড, খুর-কাঁচিসহ প্রচুর প্রপস লেগেছে সেলুন ঘরের দৃশ্যে। সেলুন ঘরের অপজিটের বাড়ির সাদা দেওয়ালে ছাত্র ইউনিয়নের স্লোগান বড়ো করে লেখা— ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক।’
পুরান ঢাকার বিভিন্ন গলি ও রাস্তায় শুটিং হয়েছে কাঁটার। শুটিং মানেই লোকজন জমে যায়। কাজে তখন সমস্যা বাড়েই বৈকি! কিন্তু মানুষ সরানো যায় না। অন্তত যেটুকু ফ্রেম ধরা হয়েছে, সেইটুকুতে মানুষ সরানোর কাজ থাকে তখন। পাবলিক লোকেশনের শুটিংয়ে কিছুটা অসুবিধা থাকেই। সেটা মেনে নিয়েই কাজটা করতে হয়েছে আমাদের। কিছু রাস্তা আটকে রেখেই কাজ করতে হয়েছে। রাস্তা আটকালে তখন চলাচলকারী লোকেরা তা মেনে নিতে চায় না। শুটিংয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কাজের সমস্যা করলেও, মানুষ সরতে চায় না। না সরিয়ে কাজও করা সম্ভব নয়। এভাবেই চলে। মাঝেমধ্যে ঝুট ঝামেলা লেগে যায়। এসব নিয়েই শুটিং, অন্তত আউটডোর পাবলিক লোকেশনে কাজ করলে। তাছাড়া বাংলাদেশে কী পরিমাণ লোক, সে তো আমরা সবাই জানি। বাচ্চা জন্ম দেওয়া ছাড়া এদেশের অভিভাবকদের নাগরিক হিসেবে আর মৌলিক কাজ আছে? এমনি এমনি তো আর বিশ কোটি দাঁড়ায়নি? আমরা স্বীকার না করলে, অন্যান্য দেশের লোক তো ঠিকই দেখছে, এ দেশের লোকেরা কী করে একটা জীবন পেয়ে!
প্রায় পঁচিশজন মাদ্রাসা ছাত্র অভিনয় করেছে কাঁটার পাবলিক মব-এ। প্রথমে ওরা ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চায়নি, কিন্তু এমন এক ধর্মীয় জোশ এনে দিলাম কথা বলে, ওরা স্বতস্ফূর্তভাবেই কাজটা করল। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই মাদ্রাসা ছাত্রদের। কাঁটাতে জোন হিসেবে প্রাচীন বাড়ি দেখা যাবে প্রায় ষাট-সত্তুরটা। অর্থাৎ গত শতকের ষাটের দশকের ভূতের গলিতে প্রবেশ করলে কী দেখা যেত? এরকম সব বাড়িই তো তখন ছিল, তাই না? বাংলাদেশে পুরান ঢাকার চরিত্র শুধু পুরান ঢাকাতেই পাওয়া যায়। পুরান ঢাকাই বাংলাদেশের পুরোনো শহরের নমুনা হিসেবে দৃশ্যমান। পুরান ঢাকায় বানর দেখা মেলে। কাঁটাতেও দেখা যাবে।
খাটের উপর সিঁদুরের কৌটা উলটে পড়ে আছে। সিঁদুরের গুড়ো ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে। আছে ভাঙা শাঁখা। এগুলো কার?
স্বপ্নারানী ছিল সুবোধের বউ। ওরা মরে গেছে। কীভাবে মরেছে? এটা দেখতে ও জানতেই তো কাঁটা ছবির মুখোমুখি হতে হবে আপনাকে। কাঁটা দেখতে হবে। কাঁটার ইতিহাস কি আপনার আমার চেনা ইতিহাস নয়, বাংলাদেশে? তাই বললাম, ছবিটা দেখতে হবে। দেখে, আপনার না ভালো লাগা বলে দিতে হবে। দর্শক হিসেবে আপনি স্বাধীন। ভালো লাগলে, আপনার বন্ধুকেও জানিয়ে দেবেন, সে যেন ছবিটি দেখতে উৎসাহী হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে তো পিরিয়ড চর্চার ছবি প্রায় হয়ই না। কাঁটা একটি পিরিওডিক্যাল ছবি। এক ছবির ভেতরে তিন ছবি।
স্বপ্নারানী দাস ঘরের মধ্যে পুজো করে, সিনেমা হলে চাকরি করা স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে। উঠোনের তুলসীতলায় মাটি দিয়ে লেপে দেয়। কুয়া থেকে বালতিতে করে জল ওঠায়, কলসিতে ঢালে। কবুতর বাকবাকুম করে। মিসেস ডায়না, মানে বাড়ির মহিলা বিড়াল ডাকে। ঘুঘু ডাকে। মহল্লাবাসিরা চা নিমকপারা খেতে আসে।
কাঁটাতে নয়নতারা ফুল ধরা পড়েছে একাধিক ফ্রেমে। ‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ সে অন্য গল্প, কিন্তু নারিন্দার ভূতের গলিতে ফুটেছে নয়নতারা। কাঁটার অন্যতম দুজন প্রবীণ অভিনেতা কায়েস চৌধুরী ও এস এম মহসীন হুট করেই চলে গেলেন। কাঁটা দেখেও যেতে পারলেন না। কত কষ্ট করেছে শুটিংয়ের সময়। পোস্ট প্রোডাকশনের এই শেষ সময়ে তাঁদের কথা আমাদের ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রক্সি ভোকালেই ডাবিং শেষ করতে হলো তাদের। ক্যারেক্টর মারা গেলে কীইবা আর করার থাকে! হয়তো নারিন্দার দিন আমাদের শেষ হয়ে আসছে। এখানে এসেছিলাম সেই এপ্রিলের শুরুতে, এখন শীত নেমে গেছে। ডিসেম্বর চলছে। আমরা এই ডিসেম্বরেই ছেড়ে যাব ভূতের গলি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে চলে যাবে বা লোকালয়ে হারিয়ে যাবে ভূতের গলি। কাঁটাতে ক্যাপচার হয়ে গেছে ভূতের গলি। এখন আমরা কাঁটা টিমের যারা, তারা যেখানেই যাক ভূতের গলি তাদের সঙ্গেই যাবে। এড়াতে পারবে না কেউ। এড়ানোর ভান করতে পারবে কেউ, কিন্তু ভেতর থেকে সে এড়াতে পারবে না। অথবা পারবে। মানুষ এমন কিছু করতে পারে, যা আগে কোনো মানুষ করেনি। মানুষ সব পারে। বিশ্বাসকে অবিশ্বাস্য করে তুলতে পারে। যদিও, মানুষ বলতে কয়জন মানুষ, তার কোনো হিসেব নেই। তাহলে এ নিয়ে কথার কী আছে? না, কিছু নেই। তাই বাদ। মানুষকে অপবাদ দেওয়া বাদ।
সারা রাত মাতাল হাওয়ার রাত ছিল। ভূতের গলি সারা রাত ঝড়বাদলে ভিজেছে। সকালে দেখা গেল কোথাও ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে পড়ে আছে। নেট লাইন ছিঁড়ে গেছে কোথাও। পুরো নারিন্দাতেই এই অবস্থা। আমরা কাঁটা টিম থাকি আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে। এই বাড়িতেও কিছু ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়ে গেছে ঝড় বৃষ্টি, মাতাল হাওয়া। মনে হলো, ঝড় বৃষ্টি ভেঙে দিয়ে গেছে আমার পাঁজর। কিন্তু ঝড়কে আমি কী বলতে পারি? বৃষ্টি, হাওয়াকে আমি কী বলব? সেটের যে অংশ বানানো, ক্ষতি সেখানেই বেশি হয়েছে। রিপিয়ারিং শুরু হলো। কিন্তু পাঁজরে যে ক্ষত হয়, তা কি প্রকৃত প্রস্তাবে রিপিয়ারিং হয়? আমার হয়েছে? দেখেছি যে, এত এত ক্ষত আমার পাঁজরে প্রবাহিত, এতে করে লক্ষণীয়, আমি যদি রোম্যান্টিক মুডও ক্রিয়েট করতে চাই, ওই ক্ষতশিল্পই আত্মপ্রকাশ করে। আমি হয়তো ভাবলাম, প্রেম; অমনি বানভাসি হয়ে গেল বুক। শান্তি নেই। ভাবলাম বসন্ত; অমনি আগুন জ্বলে উঠল আমার ঘরে, আমার বিছানায়। যেন বা দ্বৈরথে দ্বৈরথে কাটিয়ে দিচ্ছি জীবন। জীবন আবার কী? জীবন তখন, এখন পর্যন্ত ব্যাপ্ত শুধু একটি ছবি নির্মাণে। ছবির নাম, কাঁটা। মনোজগতের কাঁটা। উলের কাঁটা দেখা যায়, ফুলের কাঁটা দেখা যায়। কিন্তু মনোজগতের কাঁটা দেখা বা দেখানো যায় কীভাবে? এই প্রশ্ন গভীরতর প্রশ্ন বটে। আপনি ভাবুন তো, সেই কাঁটা কেমন, যা মনোজগৎ বাহিত?
অবৈধভাবে বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে কাজ করেছি আমরা। কারণ, যে বাড়িতে শুটিং হচ্ছিল, সে বাড়ির নামে বিদ্যুৎ বিভাগ আগেই মামলা করে রেখেছিল। অন্ধকার ছিল বাড়িটিতে, যখন আমরা উঠি সেখানে। একদিন গোপীবাগ বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে দুই জন কর্মচারি এলো, তারা বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিয়ে আমাদের নামে মামলা করার কথা বলছিল। আমরা নেগোসিয়েট করার জন্য আলোচনা করি, সেই নেগোসিয়েটসে আলোচনা চালায় কাঁটার সহকারী পরিচালক সৌরভ কর্মকার। কিন্তু কর্মচারি দুজন এত টাকা চেয়ে ফেলল, আমরা সেটা দিতে না চাওয়ায় তারা লাইন কেটে দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ‘লোক’ সম্পাদক শামীমুল হক শামীমকে ফোন করি। কাজ হয়। খুব ভালো কাজ হয়। কর্মচারি দুজন ফিরে যায়।
আমার মেজমামা মারা গেলেন ঝিনাইদহে। আমি নারিন্দা থেকে যাব কী করে তখন? এই টিম ফেলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেজমামার জন্য খুব কান্না পাচ্ছিল। ওই বাড়ির পেছনে, নির্জনে গিয়ে একা কাঁদলাম অনেকক্ষণ। টিমের কেউ যাতে কিছু দেখতে না পায়, সেই জন্যই ওই নির্জনে যাওয়া। বারডেমে অসুস্থ অবস্থায় এক ধরনের তন্দ্রার ভেতর থেকে মেজমামার সেই কথাটা মনে পড়ল, ‘সিনেমা হচ্ছে? ঝিনেদায় আসবে?’ মেজমামাকে হারিয়ে ফেললাম চিরকালের মতো।
চাঁদ ওঠে বসুবাজারের কোনাকুণি দিয়ে। সন্ধ্যা নামে নারিন্দায়। ভূতের গলিতে মানুষের চলাচলের শব্দ ক্ষীণ হয়ে আসে। কবুতর ঘরে ওঠে। মসজিদের মাইক থেকে আজান ভেসে আসে। গলি দিয়ে রিকশা যায়। নারিন্দা আমাদের নিয়ে যায় সেই প্রাচীন শহরে, যেখানে একদা আমরা বাস করতাম। সে বাড়ির প্রাচীন দেওয়ালে ফুটেছিল নয়নতারা, নয়নতারা ফুল দিনরাত তাকিয়ে দেখেছে, কাঁটা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে!
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।