ইতিহাস খালি চোখে পড়া যায় না। অণুবীক্ষণ-দূরবীক্ষণের প্রয়োজন না হলেও, ইতিহাস পড়তে চাইলে অন্ততপক্ষে চশমা লাগে। যত হালকা, যত স্বচ্ছই হোক না কেন—সেই চশমার কাচ একজোড়া অস্পষ্ট দেওয়াল তুলে দেয় চোখের সামনে। এই দুর্ভেদ্য আড়াল ভেঙে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা রীতিমতো দুঃসাহস। আর চশমা খুলে খালি চোখে ঐতিহাসিক শব্দ, ছবি, ঘটনাগুলোকে দেখতে চাওয়া অসম্ভব দিবাস্বপ্নের মতো।
ইতিহাস নিয়ে আমার নিভে যাওয়া আগ্রহের সলতে আরও একবার জ্বলতে শুরু করে মোটামুটি আকস্মিকভাবে, দিন পনেরো আগে। ‘ইয়েলোস্টোন’ (২০১৮-) নামের বেশ নামকরা একটা টিভি সিরিজ নিয়ে ঘাঁটতে গিয়ে। খুবই জনপ্রিয় এই মার্কিন ধারাবাহিকের এই বছর পঞ্চম মৌসুম চলে। ‘নিও-ওয়েস্টার্ন’ ঘরানার ‘ইয়েলোস্টোন’ আমি আসলে এখনও দেখি নাই। তবে এর দুইটা ‘প্রিকুয়েল’ সিরিজ কয়েক দিন একটানা দেখলাম। ‘১৮৮৩’ এবং ‘১৯২৩’ নামের এই পূর্ববর্তী গল্প দুইটা মূলত মার্কিন মুল্লুকের ‘ওয়াইল্ড ওয়েস্ট’ বলে পরিচিত অঞ্চলগুলোর দুর্গম, দুর্বিসহ জীবন অভিজ্ঞতার কথা বলে। দুই প্লটের পেছনেই ছায়ার মতো ছড়িয়ে আছে যথাক্রমে, উনিশ শতকে ঘটে যাওয়া মার্কিন গৃহযুদ্ধ এবং বিশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ইতিহাসের পাঠ এখানে সামষ্টিক এবং জাতিগত। আমিও সেইরকম প্রত্যাশা নিয়েই দেখতে বসেছিলাম। কিন্তু প্রথম পর্ব শেষ না করতেই ভুল ভাঙল। মনে হলো আমি ইতিহাস-নির্ভর এই কাহিনিগুলোকে আর মোটেও সমষ্টি বা সমাজের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারছি না। আমাকে দেখতে হচ্ছে এলসা ডাটন নামের অষ্টাদশী এক তরুণীর চোখ দিয়ে। অনেকগুলো অনিবার্য কারণে তার চোখে একান্ত ব্যক্তিগত চশমা। আমার মতো দর্শকদেরও সেই কাচের ভেতর দিয়েই বাকি চরিত্র আর সব ঘটনাকে দেখতে হচ্ছে।
এলসা ডাটনের দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য দুইটা জটিল প্রশ্নকে উসকে দেয়। সিরিজের শুরু হয় গৃহযুদ্ধের সতেরো-আঠারো বছর পর। জন্মস্থান ছেড়ে এলসার পিতা জেমস ডাটন পুরো পরিবার নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই বেরিয়ে পড়েন পশ্চিমের দিকে। পথে অজানা অচেনা আরও অনেকেই তার এই অনিশ্চিত যাত্রায় সঙ্গী হয়ে।
বিশেষ করে ‘১৮৮৩’র কাহিনিজুড়ে এলসা ডাটনের দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য দুইটা জটিল প্রশ্নকে উসকে দেয়। সিরিজের শুরু হয় গৃহযুদ্ধের সতেরো-আঠারো বছর পর। জন্মস্থান ছেড়ে এলসার পিতা জেমস ডাটন পুরো পরিবার নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই বেরিয়ে পড়েন পশ্চিমের দিকে। পথে অজানা অচেনা আরও অনেকেই তার এই অনিশ্চিত যাত্রায় সঙ্গী হয়ে। সকলের স্বপ্নই এক। নিজেদের জন্য স্থায়ী নিবাস, নির্ভরযোগ্য একটা নতুন ঠিকানা। খাদ্য, নিরাপত্তা, চিকিৎসা, বিশ্রাম বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুময় প্রায়-মরু এলাকাগুলো পার হয়ে যায় তারা।
‘কালেক্টিভ সারভাইভাল স্টোরি’ অর্থাৎ টিকে থাকার সংগ্রাম হিসেবে ‘১৮৮৩’ কে পাঠ করাটাই বরং সহজ ছিল। কিন্তু এর লেখক, নির্মাতার উদ্দেশ্য অনেক বেশি ভিন্ন। টেলর শেরিডান বোধহয় ইতিহাসের বিকল্প সংজ্ঞাগুলোতে বিশ্বাসী। তিনি তাই লেখার সময় এলসার চোখের চশমাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গৃহযুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদের মতো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে দৃশ্যগুলোকে সাজিয়েও, সবকিছুকে তিনি অনায়াসে ব্যক্তির অভিজ্ঞতার আলোকে দেখিয়েছেন। এতো ‘ঐতিহাসিক’ ঘটনাপঞ্জিও তাঁর হাতে পরিণত হয় এক তরুণীর প্রেম, বন্ধুত্ব, যৌনতা আবিষ্কারের আখ্যানে। ব্যক্তির আবেগ, অনুভব, অভিজ্ঞতার আড়ালে ‘নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস’ আবছা হতে থাকে। প্রথম প্রশ্নের জন্ম এই পর্যবেক্ষণ থেকেই।
‘নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস’ বলতে আদৌ কিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা এই সন্দেহ এখন বহুল প্রচলিত। ইতিহাস কি তাহলে বহু ব্যক্তির আবেগ-পর্যবেক্ষণ, বিদ্বেষ-ভক্তি, প্রণয়-বিরহ, যোগাযোগ-একাকিত্ব ইত্যাদির সমষ্টি কেবল? ব্যক্তিগত বিরাগ বা অনুরাগের বাইরে ইতিহাস বলে কিছু নাই?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা ইতিহাসের সাথে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্ক নিয়ে। ইতিহাস জ্ঞান হিসেবে খুবই অনিবার্য বিষয় কিন্তু জীবন-যাপনে ইতিহাস-নির্ভরতা কি মোটামুটি ভয়ঙ্কর? অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া জরুরি হতে পারে, কিন্তু কেবল ঐতিহাসিক সত্যের উপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত নিলে, ফলাফল আত্মঘাতী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতখানি?
কেউ দুঃখ লয়ে কাঁদে
কেউ ভুলিতে গায় গীতি
নজরুলের এই জনপ্রিয় গান ‘অতীত দিনের স্মৃতি’র কাছে মানুষের অসহায় সমর্পণের কথা সকাতরে প্রকাশ করে। মানুষ তার জীবনে বহুবার, কারণে-অকারণে বিগত দিন-রাত দ্বারা তাড়িত হয়। লোনা মানুষের হাড়ে-মনে-মজ্জায় গিয়ে বেঁধে ফেলে আসা বছরগুলোর তিক্ত তির। আরিফ রহমানের বই ‘এটা আমার দর্শনের নোটখাতা নয়’ (২০২৩) পড়তে গিয়ে এ সংক্রান্ত একটা আলাপ পেলাম অতি সম্প্রতি। গৌতম বুদ্ধের বরাত দিয়ে লেখক দুঃখের সার্বজনীনতা বিষয়ে লিখেছেন। বুদ্ধের মতে সুখ আসলে ছদ্মবেশি দুঃখ।
এই সংসার যেহেতু অনিত্য এবং যা কিছু অনিত্য তাই দুঃখময়, ফলে সবকিছুই দুঃখময়।
এই দাবির কতখানি এখনকার দুনিয়ায় অনুভব করা যাবে জানি না, তবে সুখ-আনন্দ-উচ্ছ্বাস যে আসলে ক্ষণস্থায়ী সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। বরং অতীতের যেকোন সুখের স্মৃতিও অবশেষে শূন্যতা, হাহাকার তৈরি করে।
মানুষের দৃষ্টিতে অতীত ঘটনাগুলো মোটামুটি দুই রকমের। নিজের জীবদ্দশায়, নিজের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে ঘটে যাওয়া মুহূর্তগুলো নিয়ে প্রথম ধরন। আর দ্বিতীয় অতীত সৃষ্টি হয় নিজের অস্তিত্বের বাইরে। জন্মের আগে ও জীবন শেষের পরে যেসব ঘটনা ঘটে, অথবা জীবিত অবস্থাতেও যেসব ঘটনার সাক্ষাৎ আমরা পাই না। নিজে জড়িত এমন মুহূর্ত, মাস, বছরের দায়, প্রভাব, অভিশাপ না হয় আমরা মেনে নেই যৌক্তিক কারণেই। কিন্তু বাকি সবকিছুর ছায়া আমরা মানবো কেন? যেসব ঘটনার সাথে আমার প্রাণিদেহ বা মানব-মগজের বিন্দুমাত্র সম্পর্কও নাই, সেইসবের রেশ আমার জীবনের উপর পড়বে কেন? ঠিকমতো নামধাম-চেহারাও জানি না কয়েক প্রজন্ম আগের এমন কোন পূর্বসুরীর ঋণের বোঝা টানতে বললে কি আমরা খুব সহজে রাজি হয়ে যাবো? আমার ধারণা আপনারা বেশিরভাগই না বলবেন। কিন্তু, আফসোসের বিষয় হলো আমরা চাই বা না চাই, উভয় প্রকারের অতীত আমাদের বিরক্ত করবেই। এর থেকে কোন নিস্তার নাই। আরও মুশকিল হলো, প্রথাগত-ইতিহাস-বিরোধী তাত্ত্বিকেরা, বিশেষ করে মিশেল ফুকো, অনেক আগেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন ইতিহাসের সত্য হয়ে ওঠার দাবি কতোটা ভঙ্গুর!
বিশেষ করে নিজের জীবনসীমা বা নাগালের বাইরে যেসব অতীত ঘটনার অবস্থান, সেগুলোর সবচেয়ে অসহায় দশা। সেইসব ব্যক্তিগত ইতিহাসের প্রভাব আমাদের জীবনে জানা-অজানায় ঘুরে ফিরে আসে। ইতিহাসবিদ ডেভিড লোয়েনথাল তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত একটা বইয়ে দেখিয়েছেন ফেলে আসা অতীত কীভাবে বর্তমান জীবনের শাসনকর্তা হয়ে ওঠে। বর্তমানের প্রচুর বাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে চলে পরাবস্তব অতীতেরা।
জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সামাজিক, পারিবারিক ইতিহাসের যেখানে অনেক অনেক সাক্ষী-প্রমাণ থাকে, ব্যক্তিগত ইতিহাস সেখানে একলা ঘরে বন্দীর মতো। প্রায় নিরুদ্দেশ। বিশেষ করে নিজের জীবনসীমা বা নাগালের বাইরে যেসব অতীত ঘটনার অবস্থান, সেগুলোর সবচেয়ে অসহায় দশা। সেইসব ব্যক্তিগত ইতিহাসের প্রভাব আমাদের জীবনে জানা-অজানায় ঘুরে ফিরে আসে। ইতিহাসবিদ ডেভিড লোয়েনথাল তাঁর ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত একটা বইয়ে দেখিয়েছেন ফেলে আসা অতীত কীভাবে বর্তমান জীবনের শাসনকর্তা হয়ে ওঠে। বর্তমানের প্রচুর বাস্তব সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে চলে পরাবস্তব অতীতেরা। যেমন এমন অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে, কয়েক দশক, এমনকি শতাব্দী ধরে, কেবল উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ লাভ-লোকশান ভুলে পরিবারে-পরিবারে শত্রুতা জিইয়ে রাখে। আবার যেমন এমন ঘটনাও ঘটে যে একজন ব্রিটিশ তরুণ তার পরিবারের কারো দেড়শ বছরের পুরোনো কোনো বর্ণবাদী হিংস্র আচরণের জন্য, অন্তত মনে মনে হলেও অনুতপ্ত হয়, অপরাধ বোধ করে।
এই ইতিহাস-যন্ত্রণা থেকে ব্যক্তির তাহলে বাঁচার উপায় কী? এই পরিণতি কি ‘নিয়তির মতো অনিবার্য’? সবচেয়ে সহজ উপায় হতে পারে, চুপচাপ মেনে নেয়া। দাঁতে দাঁত চেপে আঘাত সহ্য করে যাওয়া। কিন্তু এই সমাধানের পথে, আমার ধারণা, আমরা সচরাচর যেতে চাই না। উল্টো, আমরা চাই সবচেয়ে কঠিন পথে হাঁটতে। ইতিহাসে আমরা সফল পথের দিশা খুঁজি। একান্ত ব্যক্তিগত চোখ দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক সত্যের সন্ধান করি। অথচ যেকোন ঘটনা ইতিহাস হয়ে যাওয়া মাত্র, তার শব্দ ছবি গন্ধের উপর মূলত একের পর এক অলৌকিক আস্তরণ পড়তে শুরু করে। সময়ের সাথে এই আড়ালগুলো জটিল থেকে জটিলতর হয়। তাই ইতিহাসের সবচেয়ে মনোযোগী, সর্বোচ্চ উদারপন্থী পাঠও আসলে অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য।
অতীতকে অলৌকিক মনে করা, আমার মতে, প্রচণ্ড যুক্তিসঙ্গত। যে জিনিস দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের কোনটা দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করা যায় না, সেই জিনিস কী করে লৌকিক হতে পারে? বাস্তব বস্তুকে সংরক্ষণ করা যায়, অলৌকিককে যায় না। মনের ভেতর ধরে রাখা ছাড়া আর কোন উপায়ে ‘রেকর্ড’ করা যায় না।
গত শতকের অন্যতম মহান তাত্ত্বিক রেমন্ড উইলিয়ামস তাঁর সংস্কৃতি বিষয়ক যুগান্তকারী আলোচনার এক পর্যায়ে ‘স্ট্রাকচার অভ ফিলিং’ বলে এক বিমূর্ত সাংস্কৃতিক বন্ধনের কথা বলেছেন। তাঁর মতে, মানবসভ্যতার প্রত্যেকটা প্রজন্মই এমন কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে যা কোনমতেই অন্য প্রজন্মের বৈশিষ্ট্যের সাথে মেলে না। অনন্য, অদ্বিতীয় এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এতোই সূক্ষ যে আমরা আমাদের জীবদ্দশায় এই বিশেষ পরিচয়ের সবটুকু জানতে পারি না। স্বপ্ন দেখার মতো বিমূর্ত অভিজ্ঞতা আসলে অবাস্তব। এদের অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়া যায় না। সরল মনে বিশ্বাস করে নিতে হয়।
অথবা বিদ্রোহ করা যায়! অতীতকে অগ্রাহ্য করার দু:সাহস দেখানো যায়। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করে হয়তো অনেকাংশে সফলও হওয়া যাবে, কিন্তু ঝামেলা বাধবে অন্য কারণে। ডজনখানেক শিকড় কেটে যাওয়া গাছের মতো তীব্র যন্ত্রণা শুরু হতে পারে। আত্মপরিচয় নিয়ে সংকটও দেখা দিতে পারে। ‘ইতিহাস ভুলে যাওয়া’ প্রায় দু:সাধ্য একটা কাজ, মন ও মগজ রক্তাক্ত হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। সবচেয়ে বড় কথা ‘ইতিহাসের জটিলতা’ থেকে মুক্তির এই উপায়টাও আসলে কমবেশি ‘চরমপন্থী’। পৃথিবীর বিভিন্ন শহর-গ্রামের, প্রচুর সাহসী প্রজন্ম যুগের পর যুগ ইতিহাস-বাহিত-সংকট ভোগ করতে করতে এই অভিযোগ প্রমাণ করে গেছে।
শুধু দরকার এই দুই বিপরীতের সমন্বয় এবং সহাবস্থান। বর্তমান বিশ্বের শান্ত, উদার দেশের অধিকাংশ মানুষেরা আজকাল এই চর্চাই করে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জীবনে অতীতের দমকা বাতাস আসলে আসুক, ঠাণ্ডা মাথায় সটান দাঁড়িয়ে থাকে তারা।
তাই বরং একটা বিকল্প পথের সন্ধান করা যেতে পারে। ব্যক্তিগত ইতিহাসের বিপদ, আর্তনাদ, অনুতাপগুলো মেনে নিতেও নতুন এই সমাধানে কোন সমস্যা নাই। আবার পুরোনো, আবছা স্মৃতি ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও এখানে ঠিক আছে। শুধু দরকার এই দুই বিপরীতের সমন্বয় এবং সহাবস্থান। বর্তমান বিশ্বের শান্ত, উদার দেশের অধিকাংশ মানুষেরা আজকাল এই চর্চাই করে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। জীবনে অতীতের দমকা বাতাস আসলে আসুক, ঠাণ্ডা মাথায় সটান দাঁড়িয়ে থাকে তারা। বিগত সময়ের বিশ্রী স্মৃতি বিস্তারিত মনে রেখেও, এখন তারা হাসিমুখে ক্ষোভ-অভিযোগ উপেক্ষা করতে পারে।
তখন বয়স ছয়। কেবল মনে রাখতে শিখছি। প্রথম স্কুলে যাওয়ার বছর একটা গান বাংলাদেশ বেতারে প্রায়ই শুনতাম। রুনা লায়লার কণ্ঠে ঢাকা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সকাল নয়টার দিকে বাজতো। মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান লিখেছিলেন অম্লান কথাগুলো, সুর ছিল খন্দকার নূরুল আলমের।
আমাকে একটি নদী বলেছে
এই তীর ছেড়ে গেলে প্রেম ভুলে যাবো।
এমন ছবি আর কোথায় পাবো?
দেশাত্মবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা এই গানের একটা পর্যায়ে সুমধুর সুপরিচিত কণ্ঠটি নিজেই নিজেকে ‘নদী’ বলে পরিচয় দেয়। দাবি করে বসে তার নিজের জীবনও নদীর মতো বহমান এবং বিচিত্র।
আমিও এক নদীর মতোন,
হাজার প্রাণের প্রেম নিয়ে তো
এই হৃদয়ের সুরের স্বপন।
এইরকম আপোষেই মোকাবেলা করতে হয় অতীত স্মৃতির ভার। ব্যক্তিজীবনে রহস্যময় ইতিহাসের ঘন ছায়া কাটানোর জন্য প্রয়োজন চাঁদের মতো স্নিগ্ধ আলো। বিজ্ঞান যাই বলুক, নি:সীম অন্ধকার অথবা অতি পরিস্কার আলো কোনোটাই বেশিক্ষণ সহ্য করা কঠিন। চাঁদের আলো তাই রোদের চেয়ে সুন্দরতর সমাধান। এই অস্পষ্ট আলো আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোন আর্থ-সামাজিক কাজে হয়তো লাগে না। তবে আমাদের চলমান ব্যক্তিজীবনে এই বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে।
একটা প্রস্তাব দিয়ে শেষ করলে বোধহয় আমার রেখে যাওয়া অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর, ঠিক উত্তর না হলেও, একটা সান্ত্বনা মিলবে। চলুন, ধরে নেই, আমাদের জীবনের সমস্ত ইতিহাস একইসাথে জরুরি এবং অদরকারি।
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে । এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই দুইটা, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান (২০১৬) ও যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন (২০২০)। প্রথম গল্প সংকলন বছরের দীর্ঘতম রাত প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।