কোথাও কোনো এক জীবন আমরা রেখে এলাম সম্ভবত। সেখানে কি কি ছিল আমার, কি কি তবে নেই হয়ে গেল? ‘এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর!’ সেই যে বুড়িগঙ্গার ধারে ছিলাম ফরাসগঞ্জে একদিন, তারপর ফিরেছিলাম মগবাজারে, চেয়ারম্যান গলির এই বাসাতেই। নারিন্দায় নয় মাস থেকে আবার ফিরেছি মগবাজার, আমার রেখে যাওয়া বাসায়। মধ্যে শুধু এই বাসা থেকে পাঁচ লাখ টাকা চুরি হয়ে গেছে এক রাতে, বাসার দরজা ভেঙে, নারিন্দা থেকে এসে হাতিরঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলাম। ফলাফল শূন্য। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ দেশের কোনো থানায় গিয়ে কেউ স্বচ্ছতার সঙ্গে কোনো প্রতিকার পেয়েছে কোনো দিন? রেকর্ড আছে? গত দুইশ বছরে কি সেই রেকর্ড আছে? রেকর্ড হ্যাজ? আবার প্রশ্ন করি, রেকর্ড আছে? সাধারণ মানুষ থানাকে এমনিতেই ভয় পায়। মানে হচ্ছে, থানা একটা ভয়ের জায়গা, সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকারের জায়গা হয়ে উঠল না। এরকম রাষ্ট্রই বাংলাদেশ, এরকম রাষ্ট্রেই আমি বা আমরা জন্মেছি! অথচ এই থানা পুলিশের বেতনের টাকাটা দিয়ে যাচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষই! ট্র্যাজেডি না প্রশ্ন এটা?
নারিন্দা থেকে ফেরার পরেও আমার মনে নারিন্দার জন্য জায়গা থেকে গেল। থেকে যে গেল, সেই মগবাজার থেকে অন্য কোথাও চলে গেছি বা আমি এখন কোথাও, কিন্তু নারিন্দা নারিন্দা বলে এক সারিন্দা তো ঠিকই বেজে চলেছে বুকের মধ্যে! নারিন্দায় থাকা খাওয়া জীবনযাপন ছিল কোনো জিপসি দলের হঠাৎ কোথাও কিছু দিনের জন্য সাময়িক অবস্থান করা আর কী! আবার একে জিপসি দলও কি বলা যাবে? না। বিচ্ছিন্ন কিছু মানুষ একসঙ্গে হয়েছিল মগবাজার শাহ নুরী হাইস্কুলের অপজিটে, সেটা ছিল কাঁটা ক্যাম্প। সেই ক্যাম্প থেকে একদিন আমরা চলে যাই নারিন্দায়, নয় মাস কাঁটার শুটিং হয়। শুটিং শেষ করে আমরা ফিরে এসেছি। শুটিং তখনো সামান্য কিছু বাকি ছিল, বিশেষ করে পুরান ঢাকার কয়েকটা সিকোয়েন্স, মুন্সিগঞ্জ আউটডোর, নরসিংদী আউটডোর। কিন্তু আমার মন তখন আর কিছুতেই মগবাজারে টিকছিল না। খুব সুন্দর একটি পরিপাটি ফ্ল্যাট ছিল মগবাজারে; কিন্তু নারিন্দার স্মৃতি থেকে কিছুতেই বেরোতে পারছিলাম না। তাছাড়া মগবাজার চেয়ারম্যান গলির বাসার ওখানকার পরিবেশ কিছুতেই আর আমার জন্য স্বস্তিকর মনে হচ্ছিল না।
নারিন্দা থেকে আমি ফিরলাম মগবাজারে, ফেরার দিন শুভ, গজেন’দা ছিল সঙ্গে। সেই অনেক আগে যখন ফরাসগঞ্জ থেকে এই মগবাজারে আসি, তখনো এড়া দুজন আমার সঙ্গে ছিল। তবে শুটিং শেষে ফেরার সময় হলো কী— মালামাল হয়ে গেছে ৪ পিকআপ। বাসায় কোনো খালি জায়গা নেই আর। শুটিংয়ে যাওয়ার আগে ছিল দুই পিক আপ মালামাল। সে তো খাট-ফ্রিজ, বই, লেপকাঁথা বালিশ, হাঁড়িপাতিল সব নিয়ে। এখন বাকি দুই পিক আপ মালামাল শুধু কাঁটার প্রপস আর কস্টিউম। মগবাজারের বাসাকে গোডাউন মনে হচ্ছিল। বাসার মধ্যে হাঁটাচলার জায়গা শেষ। এবং কাঁটা টিম মেম্বররা যে যার মতো চলে গেল নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে। হ্যাঁ, কাঁটা ক্যাম্প বা নারিন্দার সেই জিপসি দল আর দল থাকল না, হয়ে গেল একেকজন বিচ্ছিন্ন মানুষ। আমি একলা হলাম। এবং কদিনের মধ্যেই বাসায় আবার চুরি হলো। রাতে জানলা খোলা ছিল, আমার ল্যাপটপ চুরি হয়ে গেল। হারিয়ে গেল প্রচুর ডকুমেন্টস। প্রথম যখন এই বাসায় আসি, তখন এভাবেই জানলা দিয়ে আমার ফোন চুরি হয়েছিল। আর যখন নারিন্দায় ছিলাম, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একটা মহা চুরি হয়ে যায়, নগদ পাঁচ লাখ টাকা চলে যায় শুটিং চলাকালীন সময়ে। সিদ্ধান্ত নিলাম, মগবাজারে আর থাকব না। তাহলে কোথায় যাব? কাঁটার পোস্ট প্রোডাকশনের কথা মাথায় রেখেই একদিন চলে গেলাম হাতিরঝিল মহানগর প্রোজেক্টের একটা নতুন ফ্ল্যাটে; জাস্ট ব্রিজ পার হলেই নিকেতন। নিকেতনে প্রোডাকশনের বাজার। মগবাজারপর্ব আমার গুডবাই হয়ে গেল। ওই বাসাতে থাকাকালীন আমার ক্ষয়ক্ষতির পাল্লা ভারি। এমন কি মগবাজার আসতেই আসতেই এমন হলো যে, যেন বা ইউটার্ণ হয়ে গেছে রাস্তার। হয়তো তখন আর আমাদের টিম বন্ডিং আগের মতো থাকল না। পরে কেউ যে ‘দূরের মানুষ, অপরিচিত’ হয়ে উঠবে, তা কি তখন জানতাম?
অনেক কিছুই আমাদের জানা থাকে না। পরে যা ঘটবে, তা আগে টের পাওয়া যায় না কোনোভাবেই। মগবাজার তাই এক হন্তারক স্মৃতির মতো থেকে গেল। কাঁটার ফুটেজ নিয়ে, মালামাল নিয়ে একদিন আমি চলে গেলাম হাতিরঝিল মহানগর প্রোজেক্ট। একটি নতুন আবাসিক এলাকা। হাতিরঝিলের পাশেই। ব্রিজ পার হলেই নিকেতন। কিন্তু হাতিরঝিলে আমার মন টিকল না। কাঁটা সম্পাদনা নিকেতনেই হবে কি না, তখনো বুঝতে পারছি না। রামপুরার বাসা থেকে মাঝেমধ্যেই কৃতিরঞ্জন আসে, আমরা দুজনে শাহবাগ অঞ্চলে যাই। কিন্তু শান্তি পাই না কিছুতেই। কবে সম্পাদনা শুরু করতে পারব, এই ভাবনা তখন মাথায়।
কোথাও কিছু ভেঙে গেছে, টের পাই। কোথাও বাঁশির সুর থেমে গেছে, বুঝতে পারি। অর্থশূন্য দিন পার হয়। মন্ত্রণালয়ে ২৫ লাখ টাকা কাঁটার নামে আটকে আছে কিন্তু আমার হাত খালি—এরকম সময় পার করতে হচ্ছিল। ভালো লাগছিল না। সংগ্রহ করা কয়েকটা পেইন্টিং বিক্রি করতে চেষ্টা করছিলাম। হচ্ছিল না। তবে হাতিরঝিলে আসার আগে, মগবাজারে থাকাকালীন মুন্সিগঞ্জ আউটডোর করতে যে অর্থ লেগেছে, তা এসেছিল দুইটা পেইন্টিং বিক্রি করে। আমাদের শিক্ষক শিল্পী রফিকুন নবীর একটা কাজ বিক্রি করেছিলাম। সঙ্গে ছিল জামাল আহমেদ এর একটি কাজ। সেই দুটি কাজ আনতে আমি ও দীপন’দা একদিন যাই নবী স্যারের বাসায়, একদিন যাই জামাল স্যারের বাসায়। এবং আনোয়ারা সৈয়দ হক সে সময় একদিন বাসায় এলেন, একটা বাণ্ডিল দিলেন, বললেন, ‘তোমার হক ভাইকেও দেখছি শুটিংয়ের সময় চাপে থাকতে। এইটা রাখো। আমার এক বছরের চেম্বার করার টাকা। কাঁটা হয়ে উঠতে চারদিকে আমার ঋণ বেড়ে চলে। নবী স্যারের পেইটিং বিক্রি করছিলাম ৪ লাখ টাকা। স্যার কাজটা দেয়ার আগে বললেন, ‘নানান বিষয়ে পেইন্টিং দিছি, সিনেমার জন্য এই প্রথম দিলাম। তুমি আমার ছাত্র, ছবিটা ভালো হওয়া চাই।’
জার্নি অব কাঁটা প্রথম সিজন শেষ হতে যাচ্ছে। আগামী পর্বেই সিজন ওয়ান শেষ। অর্থাৎ ৩০ পর্বে সিজন ওয়ান দাঁড়াচ্ছে। কিছু দিন বিরতির পর সিজন টু শুরু হবে। সিজন টু ৬ পর্বে শেষ হবে। অর্থাৎ ৩৬ ভূতের গলির গল্প নিয়ে লেখা জার্নি অব কাঁটা লেখাটি শেষ হবে ৩৬ পর্বে।
কাজেই আগামী পর্বটা একটু বড়ো হবে, সে কারণেই এই পর্বটা একটু ছোটো হলো। ফেসবুকে কাঁটা পেইজে রাখা ছবিগুলো থেকেই জার্নি অব কাঁটাতে ছবি গেছে এত দিন, সিজন টু তে যে সব ছবি ছাপা হবে, তা আগে কোথাও প্রকাশিত নয়। ছবি রিলিজের আনুষ্ঠানিক প্রচারের সঙ্গে মিলিয়েই সিজন টু ছাপা হবে। কি বোর্ড থেকে এখন উঠছি, নিকেতন যেতে হবে আধাঘণ্টা পর…
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৮
কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।