চাই বা না চাই— চলমান মুহূর্ত আমরা অতিক্রম করে যাই। চলমান দিনকে আমরা হারিয়ে ফেলি। এরপর ইচ্ছে করলেও আমরা কেউ আর আগের মুহূর্তে পৌঁছুতে পারব না। ধরাছোয়ার বাইরে চলে যাবে আজকের দিনটা, কারোরই সাধ্য নেই ফেরাবার, সময়। হয়তো মনে মনে ফেরার পিপাসা থাকতে পারে আমাদের, উল্লেখযোগ্য স্মৃতি-নিমজ্জনও থাকবে কিছু, কিন্তু কিছুতেই আর ফিরতে পারব না আমরা গতকালকের সকাল বা সন্ধেবেলায়। এই না-পারার অক্ষমতা নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় মানুষের। এমন কি সম্ভাব্য আগামীর কোনো ফোরকাস্ট আমরা করতে পারব না— জানা নেই, কী হবে আগামীকাল? কাল ভোরে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ পাব, নাকি পাব না দক্ষিণা হাওয়ায়? আগামীকাল তুমি কারো প্রিয় কেউই থাকবে, নাকি নিজে থেকেই ‘দূরের মানুষ, অপরিচিত’ হয়ে যাবে? নারিন্দায় যে জীবন আমরা পার করলাম, সে এখন অতীত, তাকে কোনো দিন ফিরিয়ে আনতে পারব না।
মগবাজার থেকে হাতিরঝিল মহানগর প্রজেক্টে থাকা দিন তখন বর্তমান, তাই জানি না, এরপর কোথায় যাচ্ছি? এরপর ঘটনার ভেতর দিয়ে কোন দিকে প্রবাহিত হবে আমার জীবন? কিংবা কাঁটা টিমের সঙ্গেই-বা আমার বোঝাপড়া কোথায় পৌঁছুবে আর মিলিয়ে যাবে কোন দিগন্তরেখায়? হাতিরঝিল মহানগর থেকে আমি চলে যাব হাতিরপুল ভূতের গলিতে, তবে কি ভূতের গলির সুড়ঙ্গেই আটকা পড়লাম আমি? কিছুই জানি না। হাতিরপুল ভূতের গলি থেকে নর্থ সার্কুলার রোডে ঢুকে পড়ব কবে, তাও জানি না। নর্থ সার্কুলার রোডে থাকতে থাকতেই পৃথিবী কোন দিকে টার্ন করবে, তাও কিছু জানি না। ২০১৯ এ কি আমরা জানতাম, বছরের শেষে পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে? জানতাম না, কোভিড ১৯ আবার কী জিনিস! দেখলাম, করোনা এলো, পাক্কা দেড়-দুই বছর স্থবির করে দিয়ে গেল। সবারই কাজ প্রায় বন্ধ থাকল। কাঁটার কাজ শুধু নয়, পুরো পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষের কাজই। কাজেই, কাঁটা শুট হয়ে থাকলেও সম্পাদনা ধরা যাচ্ছিল না। করোনা মারাত্মক ক্ষতি করে দিয়ে গেছে আমাদের। অবশ্য নর্থ সার্কুলার রোডে গিয়েই, কিছুদিন পর কাঁটার লাস্ট শুট করেছিলাম আমরা, আউটডোর, নরসিংদীতে, সুবোধের বিয়ের দৃশ্য; যে রাতে কৃতিরঞ্জনের বাবা জ্যোতি বাবু মারা যান, তার পরদিন এবং কৃতীর বাবার মরদেহ মনোয়ারা হসপিটাল থেকে বারডেমের মরচুয়ারিতে ২৪ ঘণ্টার জন্য ফ্রিজিং করে রেখে আমরা শুটিংয়ে যাই। আমি নর্থ সার্কুলার রোডে অতটা থাকতে চাইনি, যতটা করোনার কারণে থাকতে হলো। ওখান থেকে চলে আসি নিউ এলিফ্যান্ট রোডে, যেখানে একদা ছিলাম প্রায় বারো বছর। এই এলিফ্যান্ট রোড থেকেই প্রথমে আমি শংকর যাই এবং শংকর কয়েকমাস থেকে যাই ফরাসগঞ্জে। ফরাসগঞ্জ সাত মাস থেকে মগবাজার। মগবাজার থেকেই আমরা কাঁটা ক্যাম্পে আরও পাঁচমাস থেকে চলে যাই নারিন্দায়। নারিন্দায় নয় মাস। পুনরায় মগবাজার।
আরও দুই মাস থেকে হাতিরঝিল মহানগর প্রজেক্ট। ওখানে পাঁচ মাস থেকে হাতিরপুল ভূতের গলি। এই আরবান ভূতের গলিতে জাস্ট দুই মাস। তারপর নর্থ সার্কুলার রোড। এবং পুনরায় নিউ এলিফ্যান্ট রোড। পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে এত মালামাল নিয়ে বারবার বাসা বদল! নাগরিক শরণার্থী নাকি আমি? থিতু হতে না পারা পাখি! আমি কি সত্যি পাখি হতে পেরেছি? কী পাখি? বাবুই? একবার, একটি কবিতা লিখেছিলাম, কবিতার নাম, আমার বাসায় বসে লেখা বাবুই বাসার কবিতা। হতে পারে আমি মুখে মুখে ডিকটেশন দিয়েছি আর এক বাবুইনি তা লিখে দিয়েছিল। সত্যি? বাবুই পাখি কবিতা লিখে দিতে পারে? পারে। ছেলে বাবুইয়ের খড়কুটো দিয়ে বানানো ঘর মেয়ে বাবুইয়ের পছন্দ হতেও পারে, হলে সে থাকবে। না হলে চলে যাবে। বাবুই আবার ঘর বানাবে। সেই ঘরও কোনো বালিকা বাবুইয়ের যদি পছন্দ না হয়, সে বছর একলাই থেকে যেতে হবে ছেলেটিকে। সেই সময় এক বাবুই পাখি সত্যি আমার ঘরে ঢুকে পড়েছিল, ছেলে বাবুইটাকে হয়তো ভালোবেসেছিল। কবিতা লিখে দেওয়া সেই বাবুইটা কিশোরী বাবুই। এভাবে কখনো কবিতা লিখিনি আগে, পরেও। জীবনে ওই একবারই, একটি কবিতা আমার এক বাবুই পাখি লিখে দেয়। পরে সেটি মুদ্রিত হয় কাগজে। সত্যি, সেই সময় বাবুই পাখির সঙ্গে সংসার করতাম আমি। কনফেশন যদি করি, আমি বাবুইনিকে খুব ভালোবেসেছিলাম। প্রথমে সেভাবে বুঝতে পারিনি, কতটা ভালোবাসি? কাজের চাপে অস্থির জীবন ছিল। ভালোবাসা ধীরে ধীরে কমছিল পাঁজরে। কিন্তু যখন বাবুই পাখিটা একদিন সত্যি উড়ে গেল নীলিমায়, বুঝেছি, ভালোবাসা কতদূর পৌঁছেছিল! কবি তো লিখেছেন, ‘পাখি উড়ে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে।’ বাবুইটা উড়ে গেলে অনেক যন্ত্রণাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছি আমার ঘরে, বিছানায়। যন্ত্রণা কোলবালিশকে আঁকড়ে ধরে শুয়েছিল মৌসুমের পর মৌসুম। ভাবনার অতলান্তিকে ডুবে কখন যেন আমিও ঘুমিয়ে পড়ি। যন্ত্রণা আমাকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করিয়ে দেয়। আমি যন্ত্রণাকে এড়াতে পারছিলাম না। জীবন এমন, কিছু যন্ত্রণাকে এড়াতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে। কিছু যন্ত্রণাকে সম্পদের মতো মনে হয়, কিছুতেই তাকে ফেলে দেওয়া সম্ভব হয় না।
হাতিরঝিল আবাসিক এলাকাটা নতুন, কিন্তু আমার খুব একলা লাগত ওখানে। ঝিল-লগ্ন ব্রিজ পার হলেই তো নিকেতন, নিকেতনে যেতাম। সামিরদের গাঁও প্রোডাকশনে যেতাম। ওখানেই কাঁটা সম্পাদনা করার ব্যাপারে একবার কথা হলো বন্ধু সামির আহমেদের সঙ্গে। হয়তো বসবাসের জন্য মহানগর একটা ভালো জায়গা হতে পারে, কিন্তু তখন আমার ওখানে খুব বেশি নিঃসঙ্গ লাগছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ফিরে ফিরে আসছে সেই যন্ত্রণা। যন্ত্রণা হলে আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কাঁটা সম্পাদনার কাজ করতে হবে, টাকা নেই। যদিও মিনিস্ট্রিতে তখন আমার প্রাপ্য ২৫ লাখ টাকা আটকে ছিল। কেন আটকে ছিল? আমার নামে মামলা ছিল সরকারের। সেই মামলা কাঁটা নিয়ে। কাঁটা নির্মাণে দেরি হওয়া নিয়ে মামলা। যদিও দেরি হওয়ার উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আমি মন্ত্রণালয়কে অবগত করেছি বারবার। কিন্তু ব্রিটিশ ল বঙ্গীয় কৃষকের ভাষা বুঝতে অসমর্থ এখনো। এই জন্য মিনিস্ট্রির অনুদানে নির্মিত বেশির ভাগ ছবির নির্মাণ জটিলতা একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখা হবে জার্নি অব কাঁটার সিজন টু তে। সিজন ওয়ানের শেষ পর্বে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করে রাখলাম। নিশ্চয়ই একটি নৈর্ব্যক্তিক বোঝাপড়া থেকেই আমি তা লিখব, কারণ, লেখক হিসেবে ত্রিশ বছরের বেশি সময় আমি অনুশীলন করছি, বাংলা ভাষা। এ দেশের প্রধান প্রধান কাগজেও তা দৃশ্যমান বটে। তাছাড়া ব্যবসায়িক অবস্থান থেকে নয়, শিল্পকলা প্রণয়নের দায়বদ্ধতা থেকেই তো আমি ছবি বানাচ্ছি। নইলে আর কাঁটা গল্পটি চিত্রনাট্য করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যাব কেন! অভিজ্ঞতাই আমাকে উৎসাহিত করে, বাংলাদেশ নামক একটি ছোট্ট লোকবহুল দেশ আমাকে ঋণী করে রেখেছে না? প্রসঙ্গক্রমে একটি সংলাপ মনে পড়ে গেল। নীলকণ্ঠ বাগচী, যে কিনা নিজেকে কলকাতার ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল বলে পরিহাস করছেন, টোটালি মদিরাচ্ছন্ন, তাঁর ঘরে বাঘের তাড়া খাওয়া হরিণীর মতো আকস্মিক ঢুকে পড়ে একটি মেয়ে, তখন নীলকণ্ঠ বাগচী বা নেশাতুর ঋত্বিক ঘটক ঘাড় বাঁকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘কে? কে ওখানে?’
ভয়ার্ত মেয়েটি বাঁচতে চাওয়া আকুতির সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘আমার নাম বঙ্গবালা। ওইপার থেকে আইছি। পুইড়া ধুইড়া সব শ্যাষ।’
‘যেই হও, ভেতরে আসো তো হে—’ ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়াল বলেন। মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়ে এবং বলে, ‘আশ্রয়।’ অর্থাৎ সে আশ্রয় চাইছে। আর কলকাতার পটভূমিকায় ‘ওইপার’ মানে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান কিংবা পূর্ব বাংলা। মুক্তিযুদ্ধ চলছে বাংলাদেশে। লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী, শরণার্থী কোটি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গন্তব্য ভারত। আগরতলা, ত্রিপুরা বা পশ্চিম বাংলা। তো যুবতী বঙ্গবালা মেয়েটিও শরণার্থীদের একজন। আশ্রয় চাইছে এই ব্রোকেন ইন্টেলেকচুয়ালের কাছে। নেশার তুরীয় প্রশ্বাস ছেড়ে নীলকণ্ঠ বাগচী তখন বলেন, ‘আশ্রয়! আশ্রয়ের সন্ধানে নীড়হাড়া আরেকটি পাখি, যে পাখির নাম, বাংলাদেশ!’ কী অসীম দায়বদ্ধতা নিয়ে মগ্ন থাকেন ঋত্বিক ঘটক। মনে থেকে গেছে সেই সংলাপ। মনে থেকে যায়। মনে থেকে গেলে হঠাৎ একদিন তা মন থেকে মুখে এসে ছলকে পড়ে। তখন বলতে ইচ্ছে করে, বললাম। লিখেও ফেললাম। যেভাবে একটি পাখিকে আমার মনে পড়ে। পাখির সঙ্গে সংসার মনে পড়ে। পাখির উড়ে যাওয়া শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকা মনে পড়ে।
কাঁটা ক্যাম্প মগবাজারে থাকতে ঋত্বিক ঘটক ও প্রতীতি দেবী— যমজ ভাইবোনের জন্মোৎসব করেছিলাম রমনার সেঞ্চুরি টাওয়ারে। ওটা সাংসদ আরমা দত্তের আবাসন। আরমা দি প্রতীতি দেবীর কন্যা, ঋত্বিক ঘটকের ভাগ্নি। আরমার ভাই রাহুল দত্ত। উপমহাদেশীয় রাজনীতির এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্রবধূ ছিলেন প্রতীতি দি। ভবা ও ভবি ডাকনাম, ঋত্বিক ও প্রতীতির। দিদি চলে গেলেন করোনাকালীন সময়ে। ৯৫ বছর আয়ু পেয়েছিলেন। একান্ন বছর বয়সে তাঁর যমজ ঋত্বিক ঘটক মারা যান কলকাতায়। যমজ, কিন্তু তাঁরা দুই দেশের নাগরিক। এটাই দেশভাগ। সে সব নিয়ে প্রতীতি দি’র সঙ্গে মাঝেমধ্যেই আমার গল্প হতো। অনেক গল্প। সে সব একদিন লিখব অন্যত্র। দিদি মারা যাওয়ার পর আর সেঞ্চুরি টাওয়ারে আমার যাওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যেই ফোন করেন রাহুল দত্ত। তাঁর সঙ্গে আমার অনেক কথা শেয়ার হয়। যেমন, হঠাৎ হয়তো ফোন করলেন রাহুল’দা, বললেন, ‘টোকন, আজকের ডেইলি স্টারে ছোটো মামার উপরে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে, পড়েছ?’ রাহুল’দার ছোটোমামার নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক। হয়তো হঠাৎ ফোন করে বললেন, ‘ঘটক পরিবারের ছোটো সন্তান প্রতীতি দেবীর আজ বার্থ ডে, জানো তো?’
বলি, ‘আমি তো ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছি রাহুল’দা।’
‘মা’র কথা তো তুমি লিখবেই, ছোটোমামার কথা লিখেছ তো?’
‘লিখেছি।’
‘ঠিক আছে, আমার দাদুকে নিয়ে কিছু লিখো তো।’
‘লিখব। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নিয়ে আগে পড়ালেখা করতে হবে আমাকে। তারপর লিখব।’
রাহুল দত্ত বলেন, ‘ঠিক আছে। আমি যে তোমার বন্ধু, এ কথাও লিখো কিন্তু ফেসবুকে। আমার ফেসবুক নেই। নইলে তোমার কথাও আমি লিখতাম।’ এভাবেই আমাদের ভাব-ভালোবাসা বিনিময় হয় ফোনে ফোনে। কথার মধ্যে ঢুকে পরে কাঁটা। রাহুল’দা বলেন, ‘আমাকে কিন্তু ছবি দেখাতে নিয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
‘মামণি তো কাঁটা দেখতে চেয়েছিল। মামণি তো চলেই গেল।’ এরকম শিশুতোষ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে রাহুল’দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সত্যি, কাঁটা নির্মাণের এই সমাপনীতে এসে আমার প্রতীতি দি’কে মনে পড়ে। দিদি একদিন কথায় কথায় বললেন, ‘বাংলা কোথায় পাওয়া যাবে বলো তো।’
বললাম, ‘বাংলা দিয়ে তুমি কি করবা?’
‘মরার আগে একবার পান করব। ভবা পছন্দ করত। ও আমার সাত মিনিট আগে জন্মেছিল। সাঈদ জানে, বাংলা কোথায় পাওয়া যায়, সাইদ আগে আমাদের বাড়িতে আসত।’ দিদি বলতে চাইলেন নাট্যকার সাঈদ আহমেদের কথা। আমি বললাম না, তিনি কয়েক বছর আগেই মারা গেছেন। দিদি বলেন, ‘বাংলা ব্যাপারটার মধ্যে ভবা মিশে গেছে। আমাকে একলা রেখে চলে গেল। জন্মেছিলাম একসঙ্গে, ও কত আগে চলে গেল। তোমরা তো আসো ভবার জন্যই, আমি তো কিছু করতে পারলাম না। ওই ধীরেন বাবুর পুত্রবধু আর ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন—এটুকুই।’
মগবাজার কাঁটা ক্যাম্পে এসেছিলেন লেখক ও নির্মাতা আমজাদ হোসেন, তিতাস একটি নদীর নামের কিশোর মালো চরিত্রের অভিনেতা প্রবীর মিত্র। কবরী আপার আসার কথা ছিল। শিডিউল অ্যাডজাস্ট হয়নি। লেখক বুলবুল চৌধুরী, সাংবাদিক ফখরুল ইসলাম হারুন, নির্মাতা-অভিনেতা তৌকীর আহমেদ, নির্মাতা জাহিদুর রহিম অঞ্জন, এসেছিল এডিটর বন্ধু ইকবাল কবির জুয়েল, বন্ধু-নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, লেখক ও সাংবাদিক জাহিদ রেজা নূর, কবি ও নির্মাতা-বন্ধু আকরাম খান, অভিনেত্রী অপি করিম, অভিনেতা-নির্দেশক আমিনুর রহমান মুকুল, অভিনেতা শাহীর হুদা র্যমী, অভিনেতা আরমান পারভেজ মুরাদ, কবি ও অভিনেতা তারেক মাহমুদ, নির্মাতা অনিমেষ আইচ, গায়ক ও নির্মাতা শিবু কুমার শীল বা আরও অনেক গুণী মানুষ। এসেছে আমার ছোটোবেলার বন্ধু হিমাদ্রিশেখর রায় বা বিপু। অনেক বছর পরে বিপুর সঙ্গে দেখা হলো। বিপু সিলেটে থাকে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এখন হিমাদ্রিশেখর রায়, ওর ডাকনাম বিপু। কাঁটা টিমের নতুন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে ওদের আড্ডা হয়েছে। পরে অবশ্য কাকতালীয়ভাবে অনিমেষ ও শিবু কাঁটার অভিনেতা হয়েছে। সবই মজার ব্যাপার, আনন্দের ব্যাপার। মহাকালের পৃথিবীতে কিছুদিন আমরা কাজের ভেতর দিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারলাম!। দারুণ স্মৃতি সে সব।
যে কোনো বড়ো ঘটনারই ‘ফিরে দেখা’ বলে একটা ব্যাপার থাকে। কাঁটা শুট হয়ে গেল, সেটা অবশ্যই একটা ঘটনা। ঘটনা বড়ো না মাঝারি না ছোটো, এটা কাঁটা দেখে বিচার করবেন দর্শক। আমার কাছে, কাঁটা টিমের কাছে এটা বড়ো ঘটনা। জার্নি অব কাঁটার ৩০ পর্ব অর্থাৎ সিজন ওয়ান শেষ হচ্ছে এই পর্বের মধ্য দিয়েই। তাই ফিরে দেখার অবকাশ আসে। এরপর পোস্ট প্রোডাকশন পর্ব শুরু হবে জার্নিতে, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটনা এসে যাবে। তবে আর আসবে না নারিন্দার দিন। জানি, আর আসবে না সেই সন্ধ্যা, দয়াগঞ্জ মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খাওয়া, আর আসবে না সেই ফরাসগঞ্জ-উল্টিনগঞ্জ বসন্ত কুমার দাস রোডের অপুদের বাড়িতে থাকার স্মৃতিগ্রাহী যাপন-উৎসব। সেই গজেন’দাই তো নেই। মরে গেছেন। সেলিম নেই, মধ্যপ্রাচ্যে আছে। শুভ এখন রংপুরে। রংপুরে থাকলেও শুভর সঙ্গে যোগাযোগ আছে অনলাইনে। রাসেল আহমেদ মরে গেছে। ওর বউ ইথেল অন্যত্র বিয়ে করেছে। ড্যানী ব্যস্ত আছে ওর কাজ নিয়ে। লীনাও ব্যস্ত। মাসুক হেলাল প্রথম আলোতে তার জব নিয়ে আছেন। রুবেল কুদ্দুস এখন কুমিল্লায় থাকেন। দীপন’দা আছেন, দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে। মিথুন আছে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এডিটর হয়ে। নাফিস আহমেদ বিন্দু ব্যস্ত আছে অভিনয়ে। ওর বউ-বাচ্চা নিশ্চয়ই ভালো আছে! কাঁটার প্রি-প্রোডাকশনের সময় ওদের সন্তান জন্মায়, বিন্দুর বউ খুব চেয়েছিল আমি সে সন্তানের নাম রাখি। কিন্তু আমি তখন এতই কাঁটা-কাঁটা আছি যে, আমি রাখতে পারিনি। কাঁটার বাইরে কিছু ভাবতেই পারিনি।
সৌরভ কাজ করছে প্রোডাকশন তরঙ্গেই। নিজের কাজে ব্যস্ত আছে জ্যানেট অভী, তানভীর গাজী। কবি বলেছেন, মন রে কৃষিকাজ জানো না! কৃতী ফিরে গেছে মাগুরায়, কৃষি কাজে মনোযোগ দিয়েছে। তন্ময়-শক্তি ব্যস্ত আছে ওদের শিল্পকর্ম সৃষ্টি নিয়ে। সিনেমাটোগ্রাফার রোমান পুত্র সন্তানের পিতা হয়েছে। কাঁটা টিমের বাকিরা কে কোথায়— এই ফিরিস্তি এখনো পুরোটা লেখা সম্ভব নয়, কারণ, টিম এখনো বর্ধিত হচ্ছে। একজন পেশাদার সম্পাদকের কাছে কাঁটা সম্পাদনায় দিয়ে, টাকা দিয়েও শেষপর্যন্ত প্রজেক্ট সেখান থেকে উইথড্রো করেছি আমি, কারণ, ভালো লাগেনি আর সেখানে কাজ করাতে। অনেকটা সময় আমার সেখানে নষ্ট হয়েছে, যেমন নষ্ট হয়েছে অর্থও। মেনে নিয়েছি। কত কিছুই মেনে নিতে হয়। অনেক আপন মনে করা অস্তিত্বও একদিন ‘দূরের মানুষ, অপরিচিত’ হয়ে যায়। গেলে আর কী করার থাকে? এরকম একটি বড়ো প্রোজেক্টে কতজন এসেছে, চলে গেছে, কেউ কেউ এখনো সঙ্গেই আছে। এটাই বাস্তবতা। এই চলে যাওয়া মেনে নিতে নিতে পাঁজরে আরও কিছু শূন্যতা সংযুক্ত হতে পারে বৈকি! কিছু তো করার নেই। অভিজ্ঞতা হচ্ছে, মানুষ চিনতে গিয়েই তো আমরা বুঝতে পারি, মানুষ চেনা যায় না! একজন মানুষ এমন অন্য মানুষ হয়ে থাকতে পারে, চেনা যায় না। একজন মানুষের ভেতরে অনেক রকম মানুষ থাকে। সেই মানুষ মুখস্ত নৈতিক কথাও বলতে পারে, আবার সেই মানুষই হয়তো তার সেই কথার একেবারে বিপরীত অবস্থানে চলে যেতে পারে। সেই যাওয়া তার স্বাধীনতা হয়তোবা। সেই যাওয়াতে কার কি ক্ষতি হলো, তার ধার ধারে কে? নির্মাণাধীন অবস্থায় কাঁটাও যে ক্ষতিগ্রস্থ হলো কতটা, কে হিসেব রাখে? ফলত, মানুষের আসা আর চলে যাওয়া দেখি। মানুষের বদলে যাওয়া দেখি। সত্যি, ‘দূরের মানুষ’ এবং ‘অপরিচতি’ লাগে, যখন একজন কেউ তার ভঙ্গিটা পালটায়, যখন ইউটার্ন করে, বদলে যায়। অমোচনীয় বিস্ময় এসে উপস্থিত হয়। শিমুলপুরের বিনয় বলেছিলেন, ‘বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কি করতে পারি?’
আমি কবিতা লিখি, কবিতা পড়ি। যখন পড়ি নির্গুণ, ‘আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম।’ যখন পড়ি দাশ, ‘হয়তো মানুষ নয়, শালিখ বা শঙ্খচিল’ হতে চাওয়া অভিপ্রায়। প্রকৃতপ্রস্তাবে, মানুষ বড়ো জটিল! নির্মম, নিষ্ঠুর। এবং তারপরও শেষ কথা, এক কণা ভালোবাসা এখনো অনেক বড়ো কিছু। এই বিশ্বাসই শেষ কথা। আমি ভালোবাসাকে বিশ্বাস করি। প্রতারিতের সংক্ষোভ থাকে বটে, ভালোবাসার জন্যই তা থাকে। ভালোবাসা বসে থাকে রেল লাইনের ওপর, ভালোবাসা মুড়িয়ে থাকে কুয়াশা। সিনেমা নির্মাণও এক ভালোবাসা। ভালোবাসা ঘুরতে যায় রিকশায়। কাঁটা নির্মাণও ভালোবাসা। ভালোবাসা বলেই না যন্ত্রণা এসে আমার বালিশে ঘুমিয়ে থাকে, আমি তাকে পাশ কাটিয়ে শুতে চাই একটু। ভালোবাসাকে ছুঁতে চাই বলেই না মুহূর্তরা অপেক্ষা হয়ে বসে থাকে।
এরপর জার্নি অব কাঁটা সিজন টু শুরু হবে। সিজন ওয়ান শেষ হলো ৩০ পর্বে, সিজন টু হবে মাত্র ৬ পর্বে। সব মিলিয়ে ৩৬ পর্ব জার্নি। ৩৬ ভূতের গলির গল্প কাঁটা। এই জার্নিতে সব কি ধরা গেল? না। কত কিছুই না বাদ পড়ে গেছে! আবার অনেক কিছুই ইঙ্গিতে উঁকি দিয়ে গেছে। এরপর জার্নি অব কাঁটা ক্রাউন সাইজ গ্রন্থে প্রকাশিত হচ্ছে। জাগতিক পাবলিকেশন্স থেকে বইটা বের হবে আসন্ন বইমেলায়। লিখিতব্য ৬ পর্ব যুক্ত হবে ৩০ পর্বের সঙ্গে। বই হিসেবে প্রকাশের সময় সমস্ত লেখা একসঙ্গে সম্পাদনা করা হবে। রিপিটেশন কাটাছেড়া করা হবে। অন লাইন ওয়েবম্যাগ ‘শ্রী’তে যা অপ্রকাশ্য থাকল, যেখান থেকে কিছু না হয় প্রকাশ্যই হলো সেই গ্রন্থে, কী বলেন? জার্নি অব কাঁটা তো একটা অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ডকুমেনটেনশনও বটে। কাজেই, সত্য পুষ্প ফোটাবার দরকার আছে। অভিযোগ-অনুযোগ অন্য কাউকে করি আর না করি, নিজেকে তো করতে পারব! নিজেকে যাবতজীবন প্রেমিক হিসেবে দণ্ড দিতে চাই। ‘যদ্দিন বাঁচবি তুই তোকে ভালোবেসে যেতে হবে’ এই বলে নিজেকে একটা সাধুবাবার আদেশ দিতে চাই। পর্যাপ্ত রঙিন ছবি যাবে জার্নি অব কাঁটা গ্রন্থে। নতুন অনেক তথ্য সংযুক্ত হবে। একটি সুদৃশ্য-শোভন গ্রন্থের মাধ্যমে এই জার্নিটা পাঠকের কাছে পৌঁছাক, সেই চিন্তা মাথায় ঢুকেছে। মাথায় ঢুকেছে কাঁটা। দর্শকের মাথায়ও কাঁটাটা ঢুকিয়ে দিতে চাই। স্টারকাস্টলেস ছবি কাঁটা। নতুনদের ছবি কাঁটা। যেমন, ব্যাকগ্রাউন্ড কর্মী নতুন, পাত্রপাত্রী ৯৯.৯৯ ভাগ নতুন। সম্পাদনা, শব্দ যোজনা বা কাঁটার গানের দলও সম্পূর্ণ নতুন মানুষদের নিয়ে গড়া। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত কলা বিভাগ ও ছায়ানট থেকে আগত একদল প্রতিভাবান শিল্পীই কাঁটার গান করছেন। গান বলতে লিপ সিং একটা, বাকিগুলো ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। ধামালি, বিদ্যাপতি, সংস্কৃত ভজন, আমার নিজের লেখা একটা লিরিক বা লোকগীতি আছে কাঁটাতে।
তাহলে, কী দাঁড়াচ্ছে? আপাতত ‘শ্রী’ ওয়েবম্যাগ থেকে বিরতি নিচ্ছি। খুব শিগগিরিই জার্নি অব কাঁটার সিজন টু নিয়ে ফিরে আসব। সিজন টু-তে মূলত কাঁটার পোস্ট প্রোডাকশনকালীন সময়টা উঠে আসবে। মাত্র ছয় পর্বে সেটি বিন্যাস করা হবে। ধন্যবাদ, যারা এত দিন পাঠক হিসেবে জার্নি অব কাঁটার সঙ্গে আছেন, ধন্যবাদ সম্পাদক ও কবি বিধান সাহাকে। ‘শ্রী’ ও কাঁটা যৌথভাবে কিছু কাজ করবে, সেরকম কিছু আলাপ হয়েছে বিধানের সঙ্গে। কাঁটা মুক্তি-সংলগ্ন সময়টা মিলিয়েই সে সব করার ভাবনা এসেছে। ভাবনারা আড়ি দেয় মাঝেমধ্যে, ভাবনারা বাড়ি দেয় সবসময়।
সিজন ওয়ানের শেষ বাক্য বলি? আমি তো বাসিই ভালো, আমার ভাবনারাও তোমাকে ভালোবাসতে চায়।
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৯
কাঁটার এই পর্বের প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : শাশ্বত মিত্র
জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস: ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।