রবিবার, নভেম্বর ২৪

রেইনবো ফিশ : মাহমুদ মাসুদ

0

 ১.০

এই গল্পটা ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম…’ দিয়ে শুরু করা যেত। কিন্তু আমি বুঝে উঠতে পারি না এই ঘটনা আমার জীবনে কখন ঘটেছিল। একবার মনে হয় এই তো সেদিনের ঘটনা। আবার মনে হয়, না, এই ঘটনা কয়েকশ বছর আগের। আবার মনে হয় এই ঘটনা কখনো ঘটেইনি, তবে ভবিষ্যতে ঘটবে, এই জন্মে না হলেও পরের কোনো জন্মে। আবার মনে হয়, এটা আমার জীবনের ঘটনা নয়, অন্য কারো। কোনো একদিন আউলা ঝাউলা এক বৃষ্টির মধ্যে আমরা আটকে পড়েছিলাম এক যাত্রী ছাউনিতে, আর তখন শেষ বাস মিস করা কেউ একজন শুনিয়েছিল এই অদ্ভুত মাছের গল্প। যা কিছুই হোক, আপনারা ধরে নিন এটা আমার গল্প যা শুরু হয়েছিল ছিপ দিয়ে মাছ ধরার সময়।

কসাইকে বলেছিল তার এক জেলে বন্ধুর বাবা। বন্ধুর বাবাকে কে বলেছিল তা জানা না যাওয়ায় বলাবলির ইতিহাস আর পেছনে যায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা সবাই রেইনবো ফিশ দেখেছে?

 

২.১

বড়ো হয়ে জেনেছিলাম এগুলোকে বলে হুইল ছিপ। কিন্তু আমরা বলতাম চাক্কা ছিপ। আমাদের এলাকায় এই ছিপ শুধু মাত্র বড়ো দাদুর কাছে ছিল। বড়ো দাদু বলতে আমার দাদার ভাই। উনি খুব ঢক করে চাকা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাছ টেনে তুলতেন। দেখতে খুবই ভালো লাগত আমার। একসময় জাহাজে চাকরি করতেন। উনি মাছ ধরতেন আর আপন মনে সাগর মহাসাগরের গল্প বলে যেতেন। আমাকে বললেও, আমার মনে হতো উনি আসলে নিজের সাথেই গল্প করছেন। এইসব গল্পের সাগর মহাসাগরে একদিন ভেসে উঠল এক রংধনু মাছ। আমি বললাম, ‘রংধনু মাছ?’ উনি বললেন, ‘হ্যাঁ, রেইনবো ফিশ।’ রেইনবোতে যেমন সাত রং থাকে এই মাছেরও সাত রং। ওনাকে নাকি এই মাছের কথা বলেছে সিলভার সেইল শিপের বাবুর্চি রামেশ্বর। তাকে বলেছিল আফ্রিকান এক নাবিক। ওই নাবিককে বলেছিল সাংহাইয়ের এক কসাই। কসাইকে বলেছিল তার এক জেলে বন্ধুর বাবা। বন্ধুর বাবাকে কে বলেছিল তা জানা না যাওয়ায় বলাবলির ইতিহাস আর পেছনে যায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা সবাই রেইনবো ফিশ দেখেছে? রামেশ্বর দেখেছিল, আর দেখেছে বড়ো দাদু নিজেই। বাকিদের কথা কেউ বলতে পারে না। দেখলেও দেখতে পারে, আবার নাও দেখতে পারে। রামেশ্বরের একদিন মনে হয়েছিল সে এই দুনিয়ায় আর থাকতে চায় না। নিজের পছন্দের আলুভর্তা বানিয়ে আয়েশ করে ডাল ভাত খেয়েছিল সেদিন। ডেকে গিয়ে সিগারেট ধরাল। ঠিক করল সিগারেট শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়বে সমুদ্রে আর সাঁতরে যাবে যত দূর যাওয়া যায়। একসময় ক্লান্ত হয়ে ডুবে যাবে। আহা! এই মৃত্যুই তো তার জন্য ঠিক হয়ে আছে। সিগারেটে শেষ টানের আগের টানের মাঝামাঝি সময়ে সে দেখল এক বিশাল তিমি লাফিয়ে উঠেছে অনেকটুকু। কিন্তু এ কী! এ আবার কেমন তিমি! যেন একটা রংধনু। সে কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইল তারপর ছুটে গেল ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই ভুলে গেল যে আজ তার মরে যাওয়ার কথা। এ পর্যন্ত বলে বড়ো দাদু ছিপে টান দিলেন। মনে হলো কোনো বড়ো মাছ গেঁথেছে। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা রংধনু ফুটে আছে।

 

২.২

আকাশে রংধনু দেখলেই আমার মনে প্রশ্ন জাগত বড়ো দাদু রেইনবো ফিশ কোথায় দেখেছিলেন। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি কেমন একটা রহস্যের হাসি হাসতেন। একদিন বড়ো দাদু আমায় ডাকলেন। খুব অসুস্থ ছিলেন। পারতপক্ষে বের হতেন না। আমি সামনে যেতেই টেনে পাশে বসালেন। তারপর বললেন, ‘তুই না জানতে চেয়েছিলি আমি রেইনবো ফিশ কোথায় দেখেছি?’ আমি চুপ করে থাকলাম। বড়ো দাদু আমার কাঁধে হাত রাখলেন। বলে গেলেন ওনার সেইসব হাহাকার দিনের কথা। একবার রেঙ্গুন থেকে ফিরে এসে দেখলেন দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ওনার বাবা বিয়ে করিয়ে দিলেন। বিয়ের দিন সাতেক পরে নতুন বউ ঘরে রেখে বন্ধুদের সাথে মিলে যুদ্ধে চলে গেলেন। ট্রেনিং, যুদ্ধ, পালিয়ে থাকা, যুদ্ধ, অ্যামবুশ, কত কত কিছু! যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে মোটামুটি সবাইকে পেলেন। পেলেন না শুধু ফেলে যাওয়া নতুন বউকে। কোনো এক রাতে মিলিটারিরা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক খুঁজেও পেলেন না। প্রচণ্ড হতাশ মনে এলোমেলো ঘুরতেন। তার কাছে এই দেশ, এই মাটি, এইসব স্বাধীনতা সবকিছুই বিষাদ হয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছিল। এভাবেই একদিন ঘুরতে ঘুরতে পেছনের দেওয়ালের ফাঁক গলে ঢুকলেন জমিদার বাড়ি। বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে বসে থাকলেন অনেকক্ষণ। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা দাড়কিনামাছের ঝাঁক। আর সেই ঝাঁক থেকে পেছনে পড়ে যাওয়া একটা অদ্ভুত মাছ। মাছের দেহে যেন একটা রংধনু আঁকা। মুহূর্তেই আবার মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে যেন নিয়ে গেল তার সমস্ত বিষাদ। নিয়তিকে তিনি মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

 

৩.১

পৃথিবীর আরেক নিয়তি হলো মৃত্যু। এই মৃত্যুর চক্করে পড়ে বড়ো দাদু একদিন নেই হয়ে গেলেন। তার সাথে নেই হয়ে গেল একটা গোটা পৃথিবী। নেই হয়ে যাওয়া সেই পৃথিবীর একটা ছোট্ট কণা আমার মাঝে থেকে গেল। তা হলো রেইনবো ফিশ। আমি প্রায়ই ভাবতাম এই রেইনবো ফিশ কেমন হবে তা নিয়ে। একদিন সাহস করে জমিদার বাড়ির পেছনে যাই। কিন্তু পেছনের দেওয়ালে কোনো ফাঁক খুঁজে পেলাম না। দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসলাম। ভয় হচ্ছিল কেউ দেখে ফেললে কী হবে। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকেও রংধনু মাছ তো দূরের কথা একটা দাড়কিনামাছও দেখতে পেলাম না। ফিরে আসব এই সময় কে যেন পেছন থেকে ডাকল, ‘এই বাবু এদিকে এসো।’ ভয়ে আমার পা জমে এলো। ঘুরে দেখলাম সামান্য দূরত্বে ছোটো একটা ঘর, আর জানালায় দাঁড়িয়ে আছে অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা। ‘কই, এদিকে এসো।’, আবার বলল। ভয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। মনে দ্বিধা নিয়ে একটু কাছে গেলাম। ‘তোমার পেছনে যে কাঁঠালচাঁপা ফুলগুলো পড়ে আছে আমাকে কয়েকটা তুলে দাও।’ আমি কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে প্রায় ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে এলাম।

আমি জানতে চাইতাম তার ঘরে বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে কেন, সে কোথায় চলে যায়, আরও কত কিছু। আমার এই সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মলিন হাসি হাসত। মাঝে মাঝে এই হাসি আমার কাছে বড়ো অচেনা মনে হতো। মনে হতো একটা অচেনা শূন্য নির্জন দ্বীপে আমি আর মণি আটকে পড়ে আছি। সেই নির্জনতার বুক চিরে মণি আমায় বলত তাকে একটু বিষ নিয়ে দিতে পারব কি না।

 

৩.২

ফুল নিয়ে আমার আলাদা কোনো ভাবনা ছিল না কখনো। কিন্তু সেদিনের পর যেকোনো রকমের ফুল দেখলেই আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখতাম। ফুলের রং, গন্ধ, গঠন সবকিছু। তত দিনে আমি জেনে গিয়েছি ওই ঘরের ওই মহিলাকে। সবাই যে বলে জমিদার বাড়িতে এক পাগলি থাকে এ হলো সে। কিন্তু সে আসলে পাগলি না। কখনো পাগলি ছিলই না। পাগলি কখনো কাঁঠালচাঁপা ফুল চাইবে বলেন? আমি প্রায়ই জমিদার বাড়ি যেতাম। সবার এই পাগলি আমার কাছে মণি হয়ে গিয়েছিল। আর মণি ছিল আমার বন্ধু। আমি পৃথিবীর যত রকম ফুল আছে সব খুঁজে মণিকে নিয়ে দিতাম। অনেক গল্প করতাম আমরা। আমাকে অনেক করে জিজ্ঞেস করত পুকুরপাড়ে গিয়ে আমি কী করি। আমি কিছুই বলতাম না। বড়ো দাদুর মতো করে রহস্যময় হাসি দিতাম। মাঝে মধ্যে মণি নেই হয়ে যেত। আমার তখন অস্থির লাগত। তারপর যখন ফিরে আসত, চুপ করে বসে থাকত। আমি জানতে চাইতাম তার ঘরে বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে কেন, সে কোথায় চলে যায়, আরও কত কিছু। আমার এই সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মলিন হাসি হাসত। মাঝে মাঝে এই হাসি আমার কাছে বড়ো অচেনা মনে হতো। মনে হতো একটা অচেনা শূন্য নির্জন দ্বীপে আমি আর মণি আটকে পড়ে আছি। সেই নির্জনতার বুক চিরে মণি আমায় বলত তাকে একটু বিষ নিয়ে দিতে পারব কি না। এর উত্তর কী হতে পারে আমার জানা ছিল না। সেই না জানা মন নিয়ে পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম আর রেইনবো ফিশ খুঁজতাম।

 

৩.৩

পুকুরপাড়ে এভাবে বসে থাকা যে ঠিক হচ্ছে না মণি আমাকে সেটা প্রায়ই বলত। কেউ দেখে ফেললে খুব সমস্যা হয়ে যাবে। সমস্যা একদিন ঠিকই হলো। তবে আমার না, মণির। একদিন আমি একটা কালো জবা ফুল পেয়ে মণিকে দিতে গেলাম। দূর থেকে ঘরে কয়েকজনের কথা শুনতে পেলাম। একটু আড়াল হয়ে শুনতে চাইলাম কী হচ্ছে। মণিকে কোথাও নিয়ে যেতে চাচ্ছে আর সে যেতে চাচ্ছে না। অনেক টেনে হিঁচড়েও কাজ না হওয়ায় তাকে মারধর শুরু করল। মণির চিৎকারে আমার চোখ ফেটে জল এলো। আমার খুব ইচ্ছে হলো একটা অতিকায় চিল হয়ে মণিকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাই অনেক অনেক দূরে। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে না। ঈশ্বর আমায় যে কতটা ক্ষুদ্র আর অসহায় করে বানিয়েছে আমি সেদিন বুঝলাম। বুঝলাম, অক্ষমতা আসলে কী, মানুষ কখন অপারগতার জন্য নিজেকেই অভিশাপ দেয়। এইসব অভিশাপ মাথায় নিয়ে আমি বাড়ি ফিরি আর অনেক অনেক দিন আমার কোথাও যাওয়া হয় না। এই অনেক অনেক দিনে মণির জন্য আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগে।

 

৩.৪

খারাপ লাগা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন গেলাম জমিদার বাড়ির পেছনে। আমি অবশ্য ধরে নিয়েছিলাম মণিকে আর দেখতে পাব না। উঁকি দিয়ে দেখলাম আমার ধারণা ভুল। আমি মণিকে ফিসফিস করে ডাকলাম। জানালার পাশে এসে জানতে চাইল আমি কেন গিয়েছি। কি বলবো বুঝতে পারি না। কিন্তু মণির ভেতরে আমি কিছু একটা পরিবর্তন বুঝতে পারি। ভালো করে খেয়াল করে দেখি মণির পেট একটু বড়ো হয়ে আছে। এই বড়ো হয়ে যাওয়ার অর্থ আমি জানতাম। আমি আর সামলাতে না পেরে জানতে চাইলাম। হেসে বলল, ‘তুই তো আর সারা জীবন এই ভাবে আমায় দেখতে আসবি না, তাই তোর মতো একজনকে নিয়ে আসব।’ আমি ফিক করে হেসে দিলাম। বললাম যে আমি সব সময়ই তাকে দেখতে আসব। এরপর আমি সুযোগ পেলেই মণিকে দেখতে যেতাম। এটা ওটা নিয়ে যেতাম। খুব খুশি হতো। খুশি দেখে আমারও অনেক ভালো লাগতো। এসব ভালো লাগার মাঝে একদিন আমি ধরা পড়ে গেলাম। জমিদার বাড়ির কাজের লোক আমায় টানতে টানতে নিয়ে গেল। বাবাকে খবর দিয়ে ইচ্ছে মতো ঝাড়ল। বলে দিলো আর কোনো দিন দেখলে আমার হাত পা ভেঙে দিবে। বাবা বাড়িতে এনে প্রচণ্ড মারল। অবশ্য এসব মার টারে তেমন একটা ব্যথা লাগল না। কিন্তু এই ভেবে মনে ব্যথা লাগছিল যে মণি আমার জন্য মন খারাপ করে কাঁদছে।

 

৪.১

মন খারাপ করে কাঁদতাম আমিও। ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতাম। একদিন বাবা একটা সাইকেল এনে দিলো। সাইকেলের নাম হারকিউলিস এমটিবি। সাইকেল পেয়ে দেদারসে ঘুরে বেড়াতাম। ইশকুলে যেতাম, বিকেলে খেলতাম। মোটামুটি দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল। একদিন ইশকুল থেকে ফেরার পথে দেখলাম রাস্তার পাশে এক গাভির বাছুর হয়েছে। ছোট্ট বাছুর এলোমেলো পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তখন আমার মনে হলো কী জানি আমার মনে নেই। মনে পড়ল যে মণির কথা মনে নেই। মণির এরকম বাচ্চা হওয়ার কথা। কিছু দিন এই সেই ভাবলাম। সাহস হচ্ছিল না যে আবার জমিদার বাড়ির দিকে যাব। তবুও একদিন ইশকুল থেকে ফেরার সময় গেলাম। সাইকেল রাস্তার নিচে জমিতে নামিয়ে রেখে দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলাম। মণি ঘরের ভেতরেই আছে। কিন্তু আগের মণি আর নেই।

মনে হলো যেন একটু বয়স হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে গিয়েছে। ফোলা পেটও নেই। আমি এদিক-সেদিক দেখলাম। না, কোনো বাচ্চাও দেখলাম না। মণি আমার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘তুই এসেছিস। আমি ভেবেছিলাম আর আসবি না।’ আমি বলতে পারলাম না যে আমার না এসে আর কোনো উপায় ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাচ্চা কোথায় মণি?’

মনে হলো যেন একটু বয়স হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে গিয়েছে। ফোলা পেটও নেই। আমি এদিক-সেদিক দেখলাম। না, কোনো বাচ্চাও দেখলাম না। মণি আমার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘তুই এসেছিস। আমি ভেবেছিলাম আর আসবি না।’ আমি বলতে পারলাম না যে আমার না এসে আর কোনো উপায় ছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাচ্চা কোথায় মণি?’ কোনো উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আবার বললাম, ‘কী হলো। কিছু বলছ না যে?’ এবার বলল, ‘তুই কি আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পারিস না?’ এই প্রশ্নের উত্তর সেদিনও দিতে পারলাম না। প্রথমবারের মতো দেখলাম মণির চোখে জল। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর পুকুরপাড়ের দিকে গেলাম। দেখলাম পুকুরে অনেকগুলো তেলাপিয়া মাছ ভাসছে। এরই মধ্যে পাড়ে থাকা আমগাছের শেকড়ের নিচ থেকে একটা মাছ বেরিয়ে এলো। মনে হলো মাছের শরীরে রংধনু বাসা বেঁধেছে। আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। বড়ো দাদুর কাছ থেকে শোনা রেইনবো ফিশ! আমি তো এর কথা ভুলেই বসেছিলাম। চোখের পলকে আবার শেকড়ের নিচে ঢুকে গেল। ধাতস্থ হয়েই আমি এক রকম ছুটে বেরিয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে ধানগাছের পোকা মারার জন্য যে বিষ আনা হয়েছে তা থেকে কিছুটা একটা শিশিতে ভরে নিলাম।

 

৪.২

শিশিটা পকেটে পুরে কিছুক্ষণের মধ্যেই জমিদার বাড়ির কাছে চলে এলাম। মণির ঘরের জানালার কাছে গিয়ে আস্তে করে ডাকলাম। মণি কাছে এলো। বলল, ‘তুই আবার কেন এসেছিস। সন্ধ্যা হলো বলে। ওদের লোকজন এখনই আসবে।’ আমি মণির দিকে বিষের শিশিটা বাড়িয়ে দিলাম। বললাম, ‘এই নাও।’ মণি শিশিটা হাতে নিতেই কে যেন ডাক দিলো, ‘এই কে রে ওইখানে?’ একটা ছায়া আমার দিকে এগিয়ে এলো। পা থেকে স্যান্ডেল খুলে সজোরে ছায়ার দিকে ছুড়ে দিলাম। এরপর একরকম দৌড়ে গিয়ে দেওয়াল টপকালাম। ডান পায়ে কেমন একটা ব্যথা পেলাম যেন। উঠে সাইকেল না নিয়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড় শুরু করলাম। আমি যতই দৌড়ে সামনে যাই ততই মনে হয় আশেপাশের সবকিছু হারিয়ে যাচ্ছে। ধানখেত, সবুজ মাঠ, এই রাস্তা-ঘাট, উড়তে থাকা পাখিরা, সবই হারিয়ে যাচ্ছে। লাল সূর্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে হারিয়ে যাচ্ছে দিন। তাদের সাথে আমিও সেদিন হারিয়ে গেলাম। এরপর থেকে আমাকে কেউ আর কখনো খুঁজে পায়নি। আমি নিজেও খুঁজে পাইনি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে হলেও ফেনীতে বেড়ে উঠা। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে। পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমানে একটি সরকারি দপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।